বিশ্বসাম্রাজ্য ইতিহাসে অন্যতম বর্ণময় শাসক মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন আকবর, তার সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের মোড় একাহাতে ঘুরিয়ে দিতে পেরেছেন। ৪৫০ বছর আগে আবির্ভূত হয়ে তিনি টলমলে মুঘল সাম্রাজ্যকে স্থিতি দিয়েছেন; মুঘল সম্রাজ্যকে গড়ে তুলেছেন এক্কেবারে মাটিছেনে। প্রতিভাশালী সমরবিদ শের শাহের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া এবং অকাল মৃত পিতা মহম্মদ হুমায়ুনের সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার স্বীকার করেছেন বুক চিতিয়ে মাত্র ১৪ বছর বয়সে। কাঁটার মুকুট মাথায় নিয়ে বাংলার পূব অঞ্চল এবং মুঘল হিন্দুস্তানের দক্ষিণ অঞ্চল বাদ দিয়ে বাকি অঞ্চলে সাম্রাজ্য বাড়িয়েছেন, নতুন শহর তৈরি করেছেন, নতুন ধরণের শাসনের পরিকল্পনা করেছেন, শুলইকুল নামে সবার জন্যে শান্তি নীতি প্রণয়ন করেছেন, অসামান্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় তিনি দক্ষিণ এশিয়াকে তুলে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ২০০ বছরের কাছাকাছি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রথম ছজন মুঘল সম্রাটের মধ্যে আমি খুব বেশি গুরুত্ব দিই ৫০ বছর করে রাজত্বসময় ভাগ করে নেওয়া দুজন ব্যতিক্রমী সম্রাট জালালুদ্দিন আকবর এবং আলমগির আওরঙ্গজেবকে। আওরঙ্গজেব তার শাসনের বিরুদ্ধাচরণ করা ভাইদের হত্যা করেন, জীবিত সম্রাটকে অন্তরীণ করে রাখায় তাঁর শাসনকে স্বীকৃতি না দেওয়া কাজিকে বাধ্যতামূলকভাবে হজ করতে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে নিন্দিত হলেও ঠিক উল্টোদিকে আকবরও ৫০ বছরের রাজত্ব নিষ্কন্টক করতে একে একে বৈরাম খান, মহাম আঙ্গা এবং আরও বেশ কিছু প্রভাবশালী মানুষকে ধরাধাম থেকে সরিয়ে, অথবা তাদের নিষ্ক্রিয় করে দিয়েও মহান সম্রাট হিসেবে স্বীকৃত হলেন। আকবরের জীবনক্রমের নানান ঘটনা আলোচনায় ঢোকার আগে চুম্বকে আমরা বিশ্বশ্রুত আকবর সম্রাটের জীবনীর সারাংশ আলোচনা করব।
—
তৈমুরলঙ্গ এবং চেঙ্গিসখানের যৌথ পারিবারিক উত্তরাধিকার বহন করা আকবরের ঠাকুর্দা, বাবর মধ্য এশিয়ার স্তেপভূমিতে তুতোভাই শাইবানি খানের বিরুদ্ধে সিংহাসনের লড়াইতে ইস্তফা দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় পালিয়ে এসে হিন্দুস্তানে নতুন ধরণের সামরিক পরিকল্পনায় মুঘল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। ১৫৩০এ বাবরের মৃত্যুর দশ বছর পর পুত্র মহম্মদ হুমায়ুন শের শাহের প্রতাপে ক্ষমতা হারিয়ে আত্মীয় স্বজন নিয়ে পারস্য প্রবাসে যাওয়ার সময়, শিক্ষক কন্যা হামিদা বানুর সঙ্গে প্রেম এবং চল্লিশ দিন পরে রাজত্বহীন সম্রাটের সঙ্গে মাথা উঁচু এক সাধারণ কন্যার বিবাহ(১৫৪১) হয়। পরের বছর আকবরের জন্ম। আকবরকে আত্মীয়দের হাতে ছেড়ে সম্রাট-রাজ্ঞী পারস্যে আশ্রয় নিলেন। আকবরের প্রথম তিন বছর কান্দাহার এবং ১৫৪৫ থেকে কাবুলে কাকার অধীনে বড় হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা তার আগামীদিনে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠমো সংস্কারে প্রভাবিত করবে। ভাইদের সঙ্গে হুমায়ুনের তিক্ততার পরিবেশ আমরা আন্দাজ করতে পারি আকবরের বেড়ে ওঠার ঘটনায়। কাকাদের আশ্রয়ে প্রায় অযত্ন অবহেলায় বন্দী জীবন কাটাতে থাকা আকবরকে হুমায়ুন ১৫৪৫এ কাবুল দখল করে উদ্ধার করলেও ১৫৪৫-৪৬এ ভাই কামরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে বিজীতভূমি ভাইকে তুলে দিতে বাধ্য হন। এবার থেকে আকবর তার পিতা-মাতার সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। হুমায়ুন তার পুত্রকে শিক্ষিত করেছেন। আকবর যেহেতু কোনও কিছুই নিজের হাতে লিখে যান নি, তাই তাঁকে পশ্চিমি ইতিহাসে ‘অশিক্ষিত’ বলা হয়েছে, কিন্তু আমরা ভৃত্যদের স্মৃতিকথায় দেখব আকবরের অক্ষর না চেনার যে গল্প রটেছে, তা স্রেফ অতিকথাই। আকবর কর্মচারী রেখে বই পড়াতেন ঠিকই, কিন্তু হস্তাক্ষরের নানান আঙ্গিক তিনি চিনতে পারতেন, চিত্রকলা তার মত, তার সময়ে খুব কম মানুষ বুঝতেন। দুর্ঘটনায় শের শাহের মৃত্যুর পরে মহম্মদ হুমায়ুন রাজত্ব দখলে নিলেন। সিংহাসনে বসতে না বসতেই দুর্ঘটনায় ১৫৫৬য় প্রাণ হারান। মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার দিনই পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলায় কালানৌরে চৌদ্দ বছরের বালক জালালুদ্দিন আকবরকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করা হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি এখন দিল্লি থেকে কাবুল। যে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা আকবরের পিতা হুমায়ুন ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেই নিরাপত্তা রক্ষার দায় এখন এক অনভিজ্ঞ কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ১৪ বছরের বালকের হাতে ন্যস্ত করা হল। সেই মুহূর্তে আফগানেরা হিমুর নেতৃত্বে মুঘল সাম্রাজ্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার জন্যে সংঘবদ্ধ হচ্ছে।
নবীন সম্রাটকে নিরাপত্তা আর সাম্রাজ্য সুরক্ষার দায় পড়ল আকবরের অভিভাবক ‘ইয়ার-ই-ওয়াফাদর’ বৈরাম খানের (হুমায়ুনের বদনাধারকের জৌহর আফতাবাচির বয়ানে বৈরাম বেগ, মুঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট তাঁকে সম্মানসূচক খান উপাধি দেন) ওপর। প্রথম চার বছর ১৫৫৬ থেকে ১৬৬০ পর্যন্ত বৈরাম খান এবমগ দাই/সৎ মা মাহাম আঙ্গা সমান্তরালভাবে আকবরের ব’কলমে রাজত্ব নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। বৈরাম খানের নির্দেশ মান্য করতে করতে বিরক্ত আকবর বিশ বছরে পড়া মাত্রই রাজত্বে অভ্যুত্থান আয়োজন করে, আকবরের এক দাই জিনজি আঙ্গার পুত্র শামশুদ্দিন আতগা খানের মাধ্যমে ক্ষমতাশালী অভিভাবকের খবরদারি কাঁধ থেকে নামিয়ে দিয়ে বৈরাম-বিধবা সালিমা সুলতান বেগমকে বিবাহ করেন এবং পুত্র আবদুর রহিমকে আশ্রিত, পালিত পুত্রের স্বীকৃতি দিয়ে ভবিষ্যতে তাঁকে তাঁর সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ উপাধি খানইখানান অর্পণ করে প্রধান সেনায়কের পদে বসাবেন। দরবারে সম্রাটের উকিল শামশুদ্দিন আতগা খানকে ১৫৬৩তে খুন করান আকবরের আরেক প্রধান দাই এবং ক্ষমতাকেন্দ্র মাহাম আঙ্গার পুত্র আধম খান। হত্যাকাণ্ডের সংবাদে স্বয়ং আকবর দাঁড়িয়ে থেকে আধম খানকে কেল্লার উচ্চ প্রাচীর থেকে তলায় ফেলে হত্যা করান। পুত্রের মৃত্যুর প্রায় এক মাসের মধ্যেই আরেক ক্ষমতাশালী মাহাম আঙ্গার মৃত্যু ঘটল। মুঘল রাজ্যের পক্ষে মালওয়া অঞ্চলে বাজবাহাদুরের রাজ্য দখল করা উজবেগ প্রধান আবদুল্লা খান উজবেগের বিদ্রোহ ১৫৬৪-৬৫ এবং তার পরের বছর ১৫৬৬-৬৭তে মির্জা বিদ্রোহ দমন করেন। যদিও ঐতিহাসিকেরা বলছেন দিল্লির রাজত্বে রাজপুতদের অংশগ্রহন আকবরের কৃতিত্ব, কিন্তু সুলতানি আমলেও রাজপুতেরা দিল্লিতে ক্ষমতার অংশদারি করেছেন। আকবরের জন্মই হয়েছে রাজপুতানায় আশ্রিত এক রাজার আশ্রয়ে। সেই ধারাবাহিকতাতেই আকবর রাজপুতদের মুঘল রাজনীতির অংশ করে নেন। ১৫৬১তে মালওয়া, ১৫৬৪তে গণ্ডোয়ানা, ১৫৬৮তে চিতোর দখলের পরে রাজপুতানাজুড়ে খুব দ্রুত মুঘল নিয়ন্ত্রণ ছড়াতে থাকবে। ১৫৭৪এ তিনি বিহার এবং বাংলার পশ্চিমপ্রান্ত দখল করবেন।
তিনি অসামান্য সামরিক দক্ষতায় শুধু সাম্রাজ্যই বিস্তার ঘটালেন না, ক্ষণজন্মা স্থপতিদের পৃষ্ঠপোষণা করে রাজধানী আগরায় সুবিশাল কেল্লা তৈরি করালেন, দিল্লিতে হুমায়ুনের বিশাল সমাধিক্ষেত্রে তৈরি করালেন এবং এক্কেবারে মাটি ছেনে নতুন নানন্দনিকতা, নতুন স্থাপত্য ঘরানা তৈরি করে গড়ে তুললেন ফতেহপুর সিক্রি নামক এক নতুন রাজধানী। একই সঙ্গে ১৫৬০এ দস্তানআমীরহামজা বইতে অঙ্কনলিপি এবং ছবি আঁকার মাধ্যমে নতুন ধরণের এক অঙ্কণ শৈলীরও বিকাশ ঘটাবেন। ক্রমশ আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় বাস্তবধর্মী এই ছবি এবং বই চিত্রণ নতুন এক ধারার বিকাশ ঘটাল। আজকে যাকে আমরা মুঘল অঙ্কন শৈলী হিসেবে চিনি, সেটা আকবরের সময়েই বিকশিত হয়।
সাম্রাজ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাম্রাজ্যের খাজনা ব্যবস্থাপনা সংস্কারে মন দিলেন। ১৫৬০ থেকেই মুজফফর খান তুরবাতি এবং টোডরমল্লকে সাম্রাজ্যের খাজনা ব্যবস্থাপনা সংস্কারে যে কাজ শুরু করেছিলেন তার ফল ফলল ১৫৭৪-৭৫এর দিকে, বছরে নির্দিষ্ট খাজনার বিনিময়য়ে অস্থায়ী নির্দিষ্ট আকারের ভূখণ্ড জায়গির ব্যবস্থা প্রবর্তনে। জায়গির দেওয়া হল মুঘল অভিজাতদের। এদের বলা হল জায়গিরদার। প্রত্যেক অভিজাত জায়গিরদারের পদ, মনসব নির্দিষ্ট করে তাকে ঘোড়সওয়ার এবং পদাতিক বাহিনীর মিলিত দায়িত্ব দেওয়া হল সাম্রাজ্যকে যুদ্ধের সময় সাহায্য করা এবং সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় শান্তি বজায় রাখার শর্তে। সেনার ওপর নজরদারি করতে জায়গিরদারদের সেনাবাহিনীর পশুকে নির্দিষ্ট দাগ বা ছাপ মার্ফত চিহ্নিত করা হল। ১৫৮০ থেকে প্রশাসনিক সুবিধের জন্যে সাম্রাজ্যকে ১২টা সর্বোচ্চ প্রশাসনিক একক, সুবায় ভাগ করা হল। প্রত্যেক অঞ্চলে সামরিক দিক নিয়ন্ত্রণ করত সুবাদারের নিয়াবত বিভাগ এবং খাজনা তোলার দায়িত্ব ছিল দেওয়ানের নেতৃত্বে রাজস্ব বিভাগের। হুমায়ুনের সময়ের দুঃখপ্রদ অভিজ্ঞতায় তিনি সুবা প্রশাসনে পাঠনো শাহজাদা বা খানজাদাদের স্বাধীনতা হরণ করে তাদের সব কাজের জন্যে কৈফিয়ত চাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। ফলে সুবায় শাহজাদা বা খানজাদাদের বাদী হওয়া, প্রয়োজনে সুবার প্রশাসকদের প্রশাসনিক জরুরি অবস্থায় কাজে না লাগার সমস্যা কিছুটা সমাধান হল। সম্রাট আকবরের তৈরি করা প্রশাসনিক কাঠামো আগামী দেড়শ বছল মুঘল আমলে এবং তারপরেও ঘোমটা দিয়ে ব্রিটিশ আমলেও অনুসৃত হবে। তিনি সোনা রূপো তামা এবং কড়ি নির্ভর মুদ্রা ব্যবস্থাও সংস্কার করেলেন।
আকবরের সুফিদের প্রতি আকর্ষণ তাকে নতুন দার্শনিক অবস্থান গ্রহনে উৎসাহিত করে। ইবনুলআরাবির তত্ত্ব অবলম্বনে অনুসৃত সবার জন্যে শান্তি শুলইকুল দর্শন অনুসরণ করতে থাকেন আকবর। ১৫৭০ থেকে ইসলাম ছাড়াও তিনি নানান ধর্মত বোঝার চেষ্টা করছিলেন। শুরুতে ইসলাম, পরে প্রায় সব ধরণের পন্থর প্রচারকদের সঙ্গে নিয়ে উপাসনার জন্যে ইবাদতখানা আয়োজন করতেন। মাথায় রাখতে হবে দিনইইলাহি নামক শব্দবন্ধ মুঘল সরকারি নথিতে বিশেষ করে আবুলফজলের লেখা আইনিআকবরিতে উল্লিখিত হয় নি।
তাছাড়া ধর্মতাত্ত্বিক এবং রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে অতীতের দ্বন্দ্বকে আকবরের অন্তত মুঘল আমলে চিরকালের জন্যে খতম করে দিলেন। রাজত্বকালে ১৫৭৯এ শেখ মুবারক একটি নথি খসড়া করেন এবং উলেমা স্বাক্ষর করেন। এই নথিতে বলা হল আকবর স্বয়ং পাদিশাইইসলাম এবং তার সময়ের মুজতাহিদ(যিনি ইসলামের ধার্মিক আইন ব্যাখ্যা করেন)। তাঁকে শারিয়ার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেওয়া হল। সেই বছরেই তিনি নিজে খুতবা পড়লেন এবং উসমানীয় সুলতানকে ইসলামি জগতের এবং উপমহাদেশের মুসলমানেদের নেতা হিসেবে মানতে অস্বীকৃত হলেন। ‘আল্লাহু আকবর’ শব্দবন্ধটি উলেমা দ্বর্থকভাবে ব্যবহার করল। যদিও এর মানে ‘ঈশ্বর মহান/সর্বশক্তিমান’, কিন্তু এখানে ব্যাখ্যা হল, সম্রাট ‘আকবরই সর্বশক্তিমান’। এই বিষয়টা আরও ভালভাবে প্রতিভাত হবে মুদ্রাচিত্রণে। সম্রাট আকবরের রাজত্বে প্রায় ৩৫ বছরের কিছু কম সময়ের ব্যবধানে জারিকরা দুটি মুদ্রা আকবরের রাষ্ট্রীয় ধারণার বিকবর্তনের রূপরেখা উপস্থাপন করে। প্রথম মুদ্রাটি ১৫৬৮-৬৯এর; এতে উতকীর্ণ আছে ‘লা ইলাহা ইল্লা আল্লা/মহম্মদ রসুল আল্লা’; অর্থাত “no god but God, Muhammad is the messenger of God” তারপরে খলিফার নাম। দ্বিতীয় মুদ্রা সম্রাট আকবরের রাজত্বের শেষ সময়ের ১৬০২এর। প্রয়াণের ৩ বছর পূর্বের। এতে লেখা ‘আল্লাহু আকবর/ জাল্লা জালালুহু’ অর্থাৎ “God is most great, glorified be his glory”’। শব্দগুলির মানে দুভাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্য পরিষ্কার।
আকবর সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন। কথিত তিনি স্বয়ং সতীদাহ নিজের হাতে বিফল করতেন। এক সময় আকবর জয়মল কাছওয়াকে বাংলা প্রশাসনে পাঠিয়েছিলেন। অতিরিক্ত গরমে জয়মল পথেই মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর স্ত্রী, মারওয়াড়ের মোটা রাজা উদয় সিংএর বিধবা কন্যার পুড়ে মরার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আত্মীয়রা তাকে বলপ্রয়োগে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয়। ভোর হওয়ার মুহূর্তে সংবাদটা মহামহিমের কানে পৌঁছল। তিনি ভেবে নিলেন অন্য কাউকে এই কাজ রুখতে পাঠালে অকুস্থলে পৌঁছতে নিশ্চই দেরি হবে। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসে একটি তুরগে চড়ে এতই তড়িতগতিতে রওনা হলেন যে, তার রক্ষীরাও গতির সঙ্গে তাল রাখতে পারল না। সতী আয়োজন রুখতে স্বয়ং শাহেনশাহকে উদয় হতে দেখে, সমবেত দলটি তাদের কর্মকাণ্ড ত্যাগ করে। স্বয়ং আকবর এগিয়ে অজ্ঞ পালের গোদাকে গ্রেফতার করেন। তিনি তাদের জীবনদান করলেও বহুকাল কারাগারের অন্তরালে রেখেছিলেন। আরেকটি ঘটনায় তিনি এক চণ্ডালকে খিদমত রাই উপাধি দিয়ে তাকে অভিজাত প্রাসাদ সুরক্ষা দলের প্রধান নির্বাচন করেন।
১৫৮৬তে ভাই মির্জা হাকিমের মৃত্যুর খবরে রাজধানী ফতেপুর সিক্রি থেকে লাহোরে তুলে নিয়ে যান। উদ্দেশ্য কাবুলে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ। ১৫৮৬তে রেশম পথের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল কাশ্মীর ১৫৮৯তে সিন্ধ, ১৫৯২তে কান্দাহার বিজয় সম্পন্ন হয়। ১৫৯২তে ওডিসা দখল হল। মানসিংহকে বাংলা প্রশাসনে পাঠানো হল।
মুঘল আমলের শুরুর সময়ের ইতিহাসচর্চা এবং ইতিহাস লেখায় আকবরের ভূমিকা আধুনিক ইতিহাসে প্রায় অচর্চিত এবং অস্বীকৃত একটা বিষয়। ১৫৭৩এ যে মহাভারতেরমত প্রাচীন গ্রন্থগুলো ফারসিতে যে অনুবাদের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সে কাজ লাহোরে আরও গতি পেল। তাঁরই আমলে ফাতাউল্লাহ সিরাজি বেশ কিছু প্রযুক্তি উন্নয়নে কাজ করেছেন। লাহোরেই ১৫৮৬তে তিনি আবুলফজলকে আইনিআকবরের শেষ অংশ আকবরনামা লেখার নির্দেশ দেবেন। ১৫৯৮ নাগাদ আইনিআকবরি লেখা শেষ হয় এবং সংকলনের কাজ চলতে থাকে আবুলফজলের হত্যাকাণ্ডের বছর ১৬০১ অবদি। আইনিআকবরি লেখার জন্যে, সাম্রাজ্যজুড়ে তথ্য, নথি জোগাড়ের জন্যে চলতি নথিকরণের দপ্তর তৈরি করা হয়।
হুমায়ুনের বোন, আকবরের পিসি, ২০০ মহিলা দল নিয়ে হজ্বে যাওয়া গুলবদন বেগম তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন, তার ভাস্তা/ভাইপো, সম্রাট আকবর, হুমায়ুনের প্রত্যেক জীবিত সঙ্গীকে স্মৃতিকথা লেখার জন্যে নির্দেশ জারি করেন। বাবরনামার অনুবাদক বেভারিজ বলছেন, আকবরের ইতিহাসচর্চার উৎসাহকে কোনও জীবনীকারই খুব একটা গুরুত্ব দেন নি। আকবরই আবুলফজলকে আকবরনামা লিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। নিহত বৈরাম খানের পুত্র এবং আকবরের প্রধান সেনাপতি আবদুর রহিম খানইখানানকে সম্রাট যেমন বাবরের অতুলনীয় স্মৃতিকথাটি তুর্কি থেকে পারসিকে অনুবাদের নির্দেশ দিয়েছেন, তেমনি তিনি আবুলফজলকে তার পূর্বজদের বিষয়ে আরও তথ্য জোগাড় করার জন্যেও উতসাহিত করেন। আকবর শুধু যে পিসি গুলবদন বেগমকে স্মৃতিকথা লিখতে অনুরোধ করেন তাই নয়, একই সঙ্গে তিনি প্রয়াত পিতা হুমায়ুনের বদনাধারক জওহর আফতাবাচি এবং মুঘল রান্নাঘর কারখানার দারোগা তুর্কমান বায়াজিদকে স্মৃতিকথা লেখারও নির্দেশ দেন। ‘অক্ষরজ্ঞানহীন’ আকবরের রাজত্বেই কিন্তু মুঘল আমলের প্রথম যুগের প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য সমৃদ্ধ দরবারি ইতিহাসচর্চা শুরু হল। তার পথভাঙ্গা ভাবনা, ইতিহাসকে বোঝার নতুন উদ্যম, নতুন ইতিহাসচর্চার আঙ্গিকের জন্মদেওয়া এবং তথ্যকে যাচাই করে নেওয়ার রাস্তায় তৈরি হল নতুন যুগের ইতিহাস চর্চা। আকবরের সময়ের রচিত ইতিহাস এবং তার পূর্ব সময়ের ইতিহাসের মধ্যে তুলনার পার্থক্যটি যে কোনও ইতিহাস উতসাহীর কাছে স্পষ্ট হবে। তার রাজত্বের প্রথম সময়ে রচিত বাদাউনির ইতিহাসে ব্যক্তিগত ভাললাগা না লাগার বিষয়টা তীব্রভাবে উপস্থিত ছিল। আকবর মনে করতেন বাদাউনি লিখেছেন ইতিহাসের গল্প। তারিখইআলফিতে বাদাউনির লিখিত নির্দিষ্ট একটি অংশ পড়ে অসন্তুষ্ট আকবর তাঁকে নতুন করে তথ্য যাচাই করে লিখতে নির্দেশ দিলেন। সম্রাট আকবর চাইছিলেন তথ্য সমৃদ্ধ ইতিহাস। ১৫৭৪ থেকে তিনি ফতেহপুর সিক্রিতে আরেকটি কারখানা(আদতে দপ্তর), মহাফেজখানা তৈরি করলেন। উদ্দেশ্য এই কারখানায় দৈনন্দিনের রাজকীয় এবং দরবারি সমস্ত তথ্য জড়ো করা। কাকতালীয় হলেও সেই বছরেই আবুলফজলের দরবারে অন্তর্ভূক্তি ঘটল। সম্রাটের নবম রাজত্ব বছরে মহাফেজখানা ব্যবস্থাপনার জন্যে দৈনিক দুজন করে দপ্তর সামলানোর জন্যে মোট ১৪ করণিক বরাদ্দ হল। আগামী দিনের নতুন সময়ের মুঘল ইতিহাস লিখতে এই তথ্যগুলি আকর হিসেবে ব্যবহৃত হবে। মাথায় রাখতে হবে সম্রাট আকবর সুচিন্তিতভাবেই তথ্য রাখার কারখানা, মহাফেজখানার নতুন গুরুত্ব তৈরি করলেন। যারা ইতিহাস লিখতে উদ্দিষ্ট হলেন তাদের পমর্যাদাকে গুরুত্ব দিয়ে সম্মান দেওয়া হল। অতীতে এই ধরণের কাজে পরম্পরা অনুসারে সাধারণত মুন্সি বা করণিক হিসেবে চিহ্নিত হতেন। আকবর প্রথম তাঁদের প্রত্যেককে দরবারের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিলেন। এদের দুই হাজারি মনসবদারি নিশ্চিত করা হল। নির্দেশ জারি হল, একমাত্র দুই হাজারি মনসবদারেরই অধিকার হবে মহাফেজখানা থেকে ব্যক্তিগত বা দরবারি কাজের জন্যে তথ্য সংগ্রহ করার। ওয়াকিয়াবাবুরির অনুবাদক দুজাহারি মনসবদার আবদুর রহিম খানইখানান প্রখ্যাত দরবারি, জ্ঞানী, প্রখ্যাত কবি এবং অনুবাদক। সম্রাটের ব্যক্তিগত বন্ধু আবুলফজলকেও দুই হাজারি মনসবদারিতে উত্তরণ ঘটানো হল। তবাকতইআকবরির লেখক প্রসাশক নিজামুদ্দিন আহমেদকে সাম্রাজ্যের বক্সী পদে বসানো হল
১৫৯৬তে বেরার সাম্রাজ্যে জুড়েগেছে। ১৫৯৮তে তিনি দক্ষিণ বিজয় পরিকল্পনা করলেন। আহমদনগর আর খণ্ডেশ জুড়ল ১৬০০ নাগাদ। আরও দক্ষিণে বিজয় অভিযানে যাওয়ার আগে শাহজাদা সেলিমের বিদ্রোহ ১৬০১এ তাকে আগরায় ফিরিয়ে আনে। শাহজাদা সেলিম পিতার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সেলিমের পরিকল্পনায় আবুলফজলের হত্যাকাণ্ড সম্রাটের জীবনীশক্তি কেড়ে নেয়। আকবর ১৬০৫এ মারা যান। সেলিম জাহাঙ্গির নামে সিংহাসনে আরোহন করলেন।
১৫৪১ হামিদা বানুর সঙ্গে হুমায়ুনের বিবাহ
[আগেই বলেছি আকবরের নির্দেশে হুমায়ুনের সৎবোন গুলবদন বানু বেগম ভাই সম্রাট মহম্মদ হুমায়ুনের স্মৃতিকথা হুমায়ুননামা লেখেন বাবা বাবরের অসামান্য চাঘতাইতে লিখিত স্মৃতিকথা আঙ্গিক অনুসরণে যাতে ইতিহাসলেখক সাম্রাজ্য তাত্ত্বিক আবুলফজল মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস আকবরনামা লেখার মালমশলা আহরণ করতে পারেন। গুলবদন বানু বেগম শাহজাদা হিন্দালের মায়ের পেটের বোন। মায়ের নাম দিলদার বেগম। ১৯৪১এর গ্রীষ্মের শেষ সময় থেকে হুমায়ুন-হামিদা প্রেমপর্ব চলে। তাদের বিবাহ হয় বসন্তে সিন্ধে, শের শাহের কাছে রাজত্ব হারিয়ে পারস্যের দিকে পালিয়ে যাওয়ার সময়। গুলবদন বানু বেগমের বেভারিজের স্মৃতিকথার অনুবাদ বিষয়ে হিস্টোরিসাইজিং হারেমএ রুবি লাল এবং এপিসোডস ইন দ্য লাইফ অব বাবরে শিরিন মুসভি স্পষ্টভাবে অনুবাদের ইনএকিউরেসি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই অংশটি আমি নিয়েছি শিরিন মুসভির অনুবাদ থেকে]
ইতিমধ্যে হুমায়ুনের ছোট সৎ ভাই মির্জা হিন্দাল[অর্থাৎ ভারতজয়ী], সিন্ধু পার হলেন, যাতে সাধারণ মানুষ মনে করে তিনি কান্দাহারের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। সংবাদ শোনার পরে মহামহিম দূত পাঠিয়ে ভাইকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, তিনি শুনছেন যে হিন্দাল কান্দাহারের দিকে যাচ্ছেন, সে তথ্য সত্য কী না। হিন্দাল বার্তাবহকে বলল মহামহিমের কাছে ভুল তথ্য গেছে। পাঠানো সংবাদ শুনে মহামহিম মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। মির্জার বাড়ির সমস্ত মানুষ এবং উপস্থিত অন্যান্যরা মহামহিমের সঙ্গ নিলেন। হামিদা বানু বেগমের বিষয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘মেয়েটির কে?’ মা উত্তর দিলেন ‘এটি মীর বাবা দোস্তের কন্যে’। [হামিদা বানুর ভাই] খোয়াজা মুয়াজ্জম মহামহিমের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর মা বললেন ‘এই বালকটি আমাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত’ এবং হামিদা বানু বেগমের বিষয়েও একই কথা বললেন, ‘সেও আমাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত’।
সে সব দিনে হামিদা বানু বেগম মির্জার শিবিরেই থাকতেন। পরের দিন আবারও মহামহিম আমার মা দিলদার বেগমের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনি মা’কে বললেন ‘মির্জা বাবা দোস্ত আমাদের গোত্রের মানুষ; আপনি যদি তার মেয়ের সঙ্গে আমার বিবাহের ব্যবস্থা করেন, তাহলে উপকার হয়’। মির্জা হিন্দাল অজুহাত দেওয়ার সুরে বললেন, ‘আমি কন্যাটিকে বোন বা মেয়ের মতই দেখি। মহামহিম আপনি সর্বেসর্বা; ধরুণ তিনি যদি যথোপযুক্ত রসদ বা দেনমোহরের ব্যবস্থা না করতে পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে আপনি কিছুটা বিরক্ত হতেই পারেন’। [বাতচিত তার বিপক্ষে যাওয়ায়] মহামহিম ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে গেলেন।
কিছু পরে আমাদের মা মহামহিমকে একটি চিঠি লিখে জানালেন যে মেয়েটির বিবাহ বিষয়ে আলোচনা চলছে; তার মা জানিয়েছে মেয়ের সোজাসাপটা কথা বলা অভ্যাস। অবাক হয়ে দেখলাম, ব্যতিক্রমীভাবে এই কটি মাত্র কথা শুনে মহামহিম উঠে চলেগেলেন। চিঠির উত্তরে মহামহিম লিখলেন, ‘ব্যাখ্যাটা আমি আনন্দিত চিত্তে গ্রহণ করলাম – যে ধরণেরই সোজাসাপটা কথা বলুক না কেন আমি সেটা মাথা আর মন দিয়ে শুনব। আর কন্যার দেনমোহর ইত্যাদি যে সব কথা আপনি লিখেছেন – সর্বশক্তিমান চাইলে সে সব জোগাড় হয়ে যাবে। আমি আপনার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম’। আমার মা মহামহিমের সমক্ষে গিয়ে তাকে [মেয়েটির বাড়িতে] নিয়ে এলে সে দিন একটি আমন্ত্রণী ভোজসভা আয়োজন করা হল। এর পরে মহামহিম তার প্রাসাদে ফিরে যান। পরের দিন মহামহিম আমার মায়ের সামনে এসে বললেন তিনি যেন কাউকে পাঠিয়ে হামিদা বানুকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। মা তাঁকে ডেকে আনতে পাঠালে মেয়েটি না এসে বলেপাঠায় ‘তিনি আমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে জানানোয় আমি আগের দিনই তাঁর সঙ্গে দেখা করার সম্মান অর্জন করেছি। কিন্তু আমার আজকে [তার সকাশে] আসার যৌক্তিকতা কী’? মহামহিম সুভান কুলিকে মির্জা হিন্দালের কাছে পাঠালেন বেগমকে নিয়ে আসার জন্যে। মির্জা জানালেন, ‘আমি মেয়েটিকে যা বলার বলেছি, কিন্তু মেয়েটি আসতে ইচ্ছুক নয়। তুমি মেয়েটির কাছে গিয়ে বোঝাও’। সুভান কুলি মেয়েটির কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলে মেয়েটি বললে, ‘সম্রাট কোনও মেয়েকে একবার দেখতে চাওয়া আইনি খোয়াইশ, দ্বিতীয়বার তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার করতে চাওয়া অচেনা মানুষের সঙ্গে দেখা করার তুল্য, তার সঙ্গে দেখা করা বেআইনি। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করব না’। বেগমের বার্তা সুভান কুলি মহামহিমকে জানালেন, ‘সে যদি অচেনাই হয়ে থাকে (নামহরম), [তাহলে] আমি তাকে বিয়ে করে চিনব(মহরম)’।
চল্লিশ দিন ধরে নানাভাবে তাকে বোঝানো শোনানো এবং হামিদা বানুর পক্ষ থেকে খোশামদের চেষ্টা চলল, কিন্তু তার দিক থেকে সম্মতি মিলল না। শেষ পর্যন্ত আমার মা, দিলদার বানু বেগম তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, ‘তোমায় তো কাউকে না কাউকে পছন্দ করতে হবে, সব থেকে ভাল হয় রাজার পছন্দে যদি তুমি সম্মতি দাও’। বেগম সপাটে উত্তর দিলেন, ‘কিন্তু আমি তাকেই বিয়ে করব, যার জামার গলার কলার পর্যন্ত আমার হাত পৌঁছতে পারে, আমি এমন কাউকে বিয়ে করতে চাই না, আমরা সকলেই জানি যার জামার তলার ঘেরে আমার হাত পৌঁছবে না’। শেষ দিন পর্যন্ত আমার মা তাঁকে সতর্ক করে গিয়েছেন। চল্লিশ দিন পরে প্রথম জুমাদা ৯৪৮, ২৩ আগস্ট ২১ সেপ্টেম্বর ১৫৪১, পাতার নামক প্রাসাদে, দুপুরবেলায় মহামহিম এস্ট্রালোবটি এক হাতে ধরে শুভক্ষণ বেছে নিয়ে মীর আবদুল বাকাকে বিবাহের আচার আরম্ভ করতে বললেন। তিনি মীর আবদুল বাকাকে দুই লক্ষ টঙ্কা দিলেন দেনমোহর হিসেবে। বিবাহের পর তিনি তিনদিন সেখানে কাটিয়ে নৌকো করে, নববিবাহিতরা ভাক্ষারের দিকে চলে গেলেন।
১৫৪২ আকবরের জন্ম
[জৌহর আফতাবাচি[বদনাবাহক], হুমায়ুনের ভৃত্য, আকবরের নির্দেশে ১৫৮৬-৮৭তে তাজকিরাতুলওয়াকিতা বইতে তাঁর জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকা হুমায়ুনের স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করেছেন। জৌহর লিখছেন হুমায়ুন যখন রাজত্ব হারিয়ে মারোয়াড় হয়ে পারস্যের দিকে পালিয়ে যাচ্ছেন, সে সময় রানা প্রসাদের বিশ্বস্ততায় ছেড়ে আসা স্ত্রী হামিদা বানু বেগমের প্রথম সন্তান আকবরের জন্ম সংবাদ পান। আকবরকে জন্মবার্তা হুমায়ুনের সঙ্গে থাকা তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে একমাত্র জৌহরই প্রথম জেনেছেন। যদিও তিনি আকবরের জন্মতারিখ ১৪ অক্টোবর লিখছেন আর গুলবদন বানু বেগমের লেখা আকবরের জন্মতারিখটি হল ১৫ অক্টোবর। ইতিহাস অন্যান্য পারিপার্শ্বিক প্রমান অনুসরণ করে গুলবদন বানু বেগমের উল্লিখিত তারিখটিকেই সম্রাট আকবরের জন্মদিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। শিরিন মুসভি স্পষ্টভাবে কর্ণেল স্টুয়ার্টকৃত ইংরেজি অনুবাদের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই অংশটি আমি নিয়েছি শিরিন মুসভির অনুবাদ থেকে।]
মহামহিম তখন একটি হ্রদের তীরে তাঁবু খাটিয়ে বিশ্রামে আছেন। ভোরের নমাজের সময় অমরকোট থেকে দূত এসে রাজার পক্ষ থেকে সম্রাটকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন সর্বশক্তিমানের দয়ায় এ বিশ্বের অতিথি, মহামহিম, একটি পুত্র সন্তান লাভ করেছেন। সংবাদ পেয়ে মহামহিম যারপরনাই খুশি হলেন। শাহজাদা ১৪ তারিখে শনিবার রাতে ২৩ নভেম্বর ১৫৪২এ জন্মালেন।
চৌদ্দতম [রাতের] চাঁদকে বলা হয় বদর। এইভাবেই শাহজাদা মহম্মদ আকবর, গাজি, বিশ্বের বিশ্বাসীদের পূর্ণচন্দ্র, দুই বিশ্বকে উজ্জ্বলতা দেওয়া বিশ্বে অবতরণ করলেন, বদরুদ্দিনের [পূর্ণিমার চাঁদ] সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর নাম রাখা হল জালালুদ্দিন, এবং সেই রাতে পূর্ণমার চাঁদের আলো ছাড়া অন্য কোনও আলো নেই; ফলে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় দুটি বিশ্বই উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
মহামহিমের উপাসনা শেষ হলে অভিজাতরা [এই সংবাদ শোনার পর] একে একে এসে তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে গেলেন। [সবাই চলে যাওয়ার পরে] মহামহিম আমায় বললেন, জৌহর আফতাবাচি, ‘আমি কী তোমার বকলমার সুরক্ষায় কিছু রেখেছিলাম?’ আমি উত্তর করলাম, ‘অবশ্যই মহামহিম’। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কী সম্পদ তোমার জিম্মায় আমি রেখেছি?’। আমি উত্তর করলাম, ‘মহামহিম, দুশ শাহরুখি, একটা রূপোর দস্তানা আর এক দলা কস্তুরি। কিন্তু মহামহিম, আপনার নির্দেশে আমি সেই শাহরুখি আর রূপোর দস্তানাটি খাজাঞ্চিখানায় জমা করেছি’। মহামহিম উত্তর বললেন, ‘শাহরুখি আর হাত-দস্তানাটি আমি তোমায় উপহার হিসেবে দিয়েছি; তুমি কেন সেগুলি ফেরত দিলে?’ তখন মহামহিম উত্তর করলেন ‘কস্তুরির দলাটি আমার সামনে নিয়ে এসো’। আমি সেই বস্তুটি তার সামনে নিয়ে এলাম। মহামহিম একটি চৈনিক পেয়ালা আনার নির্দেশ দিয়ে কস্তুরির দলাটি খুললেন, অভিজাত আমীরদের ডাকিয়ে সেটি তাদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। তিনি উপস্থিত অভিজাত আমীরদের বললেন, ‘সর্বক্ষমতাধর আমাদের জন্যে একটি সন্তান জন্ম দিয়ে উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছেন’। উপস্থিত সকলে তাঁকে শুভেচ্ছা এবং আশিস জানাল।
১৫৪২
উমরকোটে শিশু আকবর পৌঁছলে নানান গোষ্ঠীর আদিবাসী মহিলা দাইরা তাঁকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। মাথায় রাখতে হবে মধ্য এশিয়ার আদিবাসী সমাজে দাইএর গুরুত্ব অপরিসীম – তিনি শুধু শিশুকে পালন করে বড় করে তোলেন না, শিশুটির সতমা হিসেবেও তিনি গণ্য হন – কখনও কখনও তিনি মায়ের থেকেও বেশি গুরুত্ব পান। উমরকোটে ভবিষ্যতের সম্রাটকে বুকের দুধ খাইয়ে বড় করার সম্মান অর্জন করলেন একদা হুমায়ুনকে কনৌজে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচানো গজনীর শামসুদ্দিন মহম্মদের স্ত্রী জিজি আঙ্গা। কিন্তু জিজি যেহেতু তখন গর্ভবতী ছিলেন[ভবিষ্যতের মির্জা আজিজ কোকা], তিনি আকবরকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারলেন না। সেই সময় জিজি ছাড়াও আকবরকে স্তন্য পান করানো যে দশ জন মহিলার নাম পাওয়া যাচ্ছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন অমুসলমান বিবি রূপা। দাই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন দশ বছরের সন্তান আধম খানের মা মাহাম আঙ্গা। এই মহিলা এবং তাদের শিশুরা আকবরকে সারাক্ষণ ঘরে থাকতেন। জিজি আঙ্গাকে আকবর এতই সম্মান করত্যেন যে তার মৃত্যুর পর আকবর স্বয়ং তার কফিন কাঁধে জানেজায় অংশ নিয়েছেন।
১৫৪৩
পালিয়ে যেতে থাকা মুঘল দরবার কান্দাহারের দিকে যাওয়ার পথে মাঝেমধ্যে থমকে দাঁড়িয়ে হতাশ বাদশা বিড় বিড় করছিলেন ‘হিন্দুস্তানের জনগণের আনুগত্য প্রকাশ করার কী অস্বাভাবিক তরিকা’। কয়েকমাস চলার পরে সংবাদ পাওয়া গেল সম্রাটের ভাই আসকরি ২০০০ সেনা নিয়ে তাদের তাড়া করেছেন। হুমায়ুন বুঝলেন হিন্দুস্তান তাঁর খোয়াবেই থেকে যাবে। সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত হল বাহিনী কান্দাহারের দিকে না এগিয়ে পারস্যের সাওম্রাট শাহ তামস্পের দরবার পানে যাওয়া হবে। কিন্তু আকবরকে সঙ্গে নিয়ে না যাওয়া নিয়ে বেশ কয়েকটা বয়ান রয়েছে। হুমায়ুননামায় সম্রাটের বোন গুলবদন হসামিদা বানুর সূত্রে বলছেন, আসকরির হুড়মুড় করে ঘাড়ের ওপর এসেপড়ার সংবাদে আতঙ্কিত হলেও খাজা মুয়াজ্জম এবং বৈরাম খান হুমায়ুনের পিছনে একটিউ ঘোড়ায় হামিদা বানুকে রওনা করয়ে দিলেন, ‘মায়ের হাতে শিশু আকবরকে তুলে দেওয়ারমত সময় বার করারও সুযোগ ছিল না। তবে, যিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত জৌহর আফতাবাচির বক্তব্য, বাধ্য হয়ে আকবরকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন স্বয়ং হুমায়ুন। দরবারি ঐতিহাসিক নিজামুদ্দিন আহমেদের বক্তব্য এই গরম আবহাওয়ার দরুন আকবরকে নিয়ে যাওয়ার সম্ভব ছিল না। আবুলফজলের বয়ান সম্রাটের মাস্থায় সর্বভশক্তমানের হাত ছিল। তবে হুমায়ুন যে পারস্যের দিকে মাত্র ৩০-৪০জনের দল নিয়ে রওনা হয়েছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। এই বাহিনীতে মাত্র দুজন মহিলা ছিলেন, তাদের একজন হামিদা বানু। শোনাযায় স্বয়ং হুমায়ুন ১৬ বছরের হামিদা বানুকে তার সঙ্গে একলা আসার প্রস্তাব দেন, যেটা তখন তার পরিস্থিতির চাপে মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। শিশু আকবর বাকি দলের সঙ্গে থেকে গেলেন। হুমায়ুনের খোঁজে আসকরি পৌঁছলে তাকে বলা হল, ‘তিনি বহুক্ষণ শিকারে বেরিয়েছেন’। আসকরির নির্দেশে আকবরকে কান্দাহারে নিয়ে গিয়ে তাঁর স্ত্রী সুলতানম বেগমের জিম্মায় সঁপে দেওয়া হল।
১৫৪৫ কাবুলে বাল্যকাল
[দক্ষিণ কোয়েটার মুস্তাঙ্গ থেকে শিবির তুলে হামিদা বানু বেগমকে নিয়ে ১৫৪৩এ সিস্তানের দিকে পালিয়ে যাচ্ছেন। আকবর কাকা আসকরির জিম্মায় কান্দাহারে আছেন। ১৫৪৫এ তিনি যখন পারস্য থেকে ফিরে এসে কান্দাহার দখল নিতে সেনাবাহিনীকে রণসাজে সজ্জিত করছেন, আসকরি শিশু আকবরকে কান্দাহার থেকে কাবুলে তার আরেক কাকা কামরানের জিম্মায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সে সময় কাবুলে হুমায়ুনের সৎবোন আজকবরের পিসি গুলবদন বেগম উপস্থিত ছিলেন। তিনি ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী। এই বয়ানটা আমি নিয়েছি শিরিন মুসভির অনুবাদ থেকে।]
সম্রাটের ইরাণছেড়ে কান্দাহারের অভিযানের সংবাদ পেয়ে মির্জা আসকারি শাহজাদা জালালুদ্দিন মহম্মদ আকবরকে কাবুলে মির্জা কামরানের অধিকারে পাঠিয়ে দেয়। মির্জা কামরান শাহজাদাকে আমার আকা জান, খানজাদা বেগমের কাছে হস্তান্তরিত করেন। সে সময়ে জালালুদ্দিন মহম্মদ আকবর মাত্র আড়াই বছরের। শাহজাদাকে কাছে পেয়ে আকা জান তাঁকে দেখভাল করতে লাগলেন, তাঁকে স্নেহে ভরিয়ে দিলেন, তাঁর হাত পা চুম্বন করে বললেন, ‘আকবরের হাত পা আমার ভাই সম্রাটের বাবরের মত দেখতে হয়েছে’।
১৫৪৫ জোর করে খেলনা কেড়ে নিলেন
[ঘটনাটি ঘটেছিল, আকবর যখন কাবুলে ১৫৪৫এ তাঁর কাকা কামরানের দখলে ছিলেন। ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন বন্দিত ঐতিহাসিক আবুলফজল তাঁর কর্তৃত্বব্যাঞ্জক লেখার আঙ্গিকে, কামরানের বিপক্ষে। আবুলফজল যেহেতু মুঘল সাম্রাজ্যে স্বয়ং সম্রাট আকবরের ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি বহু প্রত্যক্ষ্যদর্শীর স্মৃতিকথার অনুলেখক, শ্রোতা ছিলেন, আমরা ধরেই নিচ্ছি, তাঁর বয়ানটা সত্য। সে সময় শবেবারাত পড়েছিল ১ নভেম্বর, তাই ঘটনাটির তারিখ নির্দিষ্ট করা যায়। ঘটনার ১৫ দিন পরে সম্রাট আকবরের সঙ্গে তাঁর পিতার মিলন হবে। আকবর খেলনা চাওয়া নিয়ে কামরানের প্রতিক্রিয়ায় মাথায় রাখা দরকার আকবর তখন তিন বছরের। হেনরি বেভারিজের অনুবাদে আকবরনামা আহমদ আলির সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। অনুবাদের এই অংশটিকে শিরিন মুসভি যথেষ্ট সংস্কার করেছেন]
মির্জা কামরান তখন ফরচুনের রোজারিয়ামের সত্যকারের সাইপ্রাসকে[আকবর] শহর-আরা বাগানে আটকে রেখেছিল। সে সময় তিনি মহামহিমের[আকবরের] উজ্জ্বল কপালে চিরকালীন আধিপত্য এবং সাফল্য অর্জনের মহত্ব দেখে মাঝেমধ্যে নিজের অভাগাভাগ্যের জন্যে বিহ্বল এবং অবাক হয়ে যেতেন। সর্বশক্তিমান বিশ্ব-মোহন ঈশ্বর সাফল্যের বিজয়ের সমস্ত মহত্ব মহামহিমের ভাগ্যে অর্পণ করে মির্জার আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক পরাজয় নিশ্চিত করেছিলেন এবং মির্জা যতই জীবন থেকে পরিতুষ্টি সংগ্রহ করার চেষ্টা করুক না কেন সে সব শুধুই তার জীবনে বিরক্তি উৎপাদন করছিল। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, নিজের সম্মানে মির্জা[কামরান] ভোজ আয়োজনের দিন, তিনি মহামহিম সম্রাটকে[আকবরের] তলব করলেন এবং শবে-বরাতের দিন আচারের অঙ্গ হিসেবে তিনি পুত্র ইব্রাহিম মির্জাকে একটি সাজানোগোজানো নাকাড়া উপহার দেন। মহামহিম সম্রাট আকবর জানতেন এই নাকাড়া একদিন সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে তাঁর নামে বাজবে, তিনি ভাবলেন সেটি তার কব্জাতেই রাখা যাক। বিশ্বাসঘাতক মির্জা, মহামহিমের হাতে সেই নাকাড়াটি দিতে অস্বীকার করে একটি পরিকল্পনা ভাঁজলেন। মির্জা ইব্রাহিম যেহেতু দুই শিশুর মধ্যে বড় এবং দেখতে শক্তপোক্ত, তাই তিনি হয়ত ভেবেছিলেন নাকাড়া নিয়ে দ্বন্দ্ব হলে তাঁর পুত্রই জিতবে; ফলে মহামহিমের কাকা দুই শিশুকে কুস্তি লড়িয়ে দেখতে চাইলেন কে জেতে – যে জিতবে, নাকাড়াটা তাঁর হবে।
স্বর্গের দুয়ায় এবং মহাকালের পৃষ্ঠপোষকতায় মির্জা কামরানের সম্পদ দেখনদারিতে অথবা ইব্রাহিম মির্জার বয়স এবং বড়সড় চেহারায় মহামহিম বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হন নি; মির্জা নিজের আনন্দের জন্যে মহামহিমের ওপর খেলার শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিল, মহামহিম সে সব শর্ত শুনে উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন। তিনি ক্রমশঃই মির্জার দুঃখের কারন হয়ে উঠছিলেন। বাল্যাবস্থাতেই মহামহিমের আচার ব্যবহার মির্জার জীবনে অপার বিস্ময় জাগাচ্ছিল। তিনি ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণা এবং নির্দেশনায় জামার হাতা গুটিয়ে কোমর বেঁধে শক্ত বাহু তুলে অসীম ক্ষমতায় ঘটনার মুখোমুখি হতে এগিয়ে গেলেন। যেন প্রশিক্ষিত কুস্তিগিরদের তত্ত্ব অনুসরণ করে এবং একই দক্ষতায় তিনি হাতটি প্রতিপক্ষের কোমরে বেড় দিয়ে ধরে তাকে তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিলেন। উপস্থিতদের মুখ থেকে হর্ষচিৎকার বেরিয়ে এল, আর পিছনে, দূরে দাঁড়িয়েথাকা মানুষদের মুখ থেকে ‘দুঃসাহসী’ ‘বীর’ ইত্যাদি শব্দ শোনা যেতে লাগল। সম্রাট, বিজয়ী, সর্বশক্তিমানের ছায়া মহামহিমের জন্যে এটাই ছিল মাটির ওপরে আর আকাশের তলায় প্রথম জয়ের নাকাড়া বাদন।
মির্জা কামরান দুই শিশুর কুস্তিকে তাঁর এবং মহামহিম জাহানবানির(হুমায়ুন) মধ্যে লড়াইয়ের পরীক্ষা হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। কুস্তি যুদ্ধের ফলে তিনি অশুভ অমঙ্গলের ছায়া দেখে আতঙ্কিত হয়ে নিরন্তর হতাশা প্রকাশ করতে থাকলেন, আর যারা মহামহিম সম্রাটের[আকবর] পক্ষে ছিলেন, তারা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলেন এবং এই বিজয়কে শুভ লক্ষ্মণ গণ্য করলেন। বাহুবলে মহামহিম যে নাকাড়া অর্জন করেছেন, বাজাতে শুরু করতেই রাজকীয় ভৃত্য, অনুগামীদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ উঠল। ঘটনাক্রম তাঁর পরিকল্পনামাফিক না চলায় কামরান আশংকার লক্ষ্মণে হতাশ হলেন এবং [আকবরের] ভাগ্য পরিবর্তনে, তাকে তখনও স্তন্যপান ছাড়াবার সময় না এলেও, মির্জা আকবরকে স্তন্য পান ছাড়াবার নির্দেশ জারি করলেন। তিনি জানতেন, যে ব্যক্তি ঐশ্বরিক পৃষ্ঠপোষণায় স্বর্গের দুগ্ধ পান করেন, এবং দৈবী দাইদের থেকে পুষ্টি আহরণ করেন, এই ধরণের চক্রান্ত করে তাঁর কোনও ক্ষতি করা যায় না এবং যে মানুষটার রক্ষাকর্তা হন স্বয়ং সর্বশক্তিমান তাকে এই ধরণের হীন চক্রান্তে কাবু করা যায় না।
১৫৪৮ আকবর আর তাঁর সতমা
[এই গল্পে স্বয়ং সম্রাট আকবর বক্তা। এই ঘটনাটি ঘটছে ১৫৪৮এর ২৭ এপ্রিল হুমায়ুনের কাবুল দখলের পর তাঁর পিতা-মাতার সঙ্গে দ্বিতীয় মিলন হয়। আবুলফজল সম্রাট আকবরের বয়ানে এটিকে আকবরনামায় নথিবদ্ধ করেন,]
আনন্দের এবং গর্বের বছরটিতে[১৫৭৩-৭৪] মহানুভব মহিলা হাজি বেগম[আকবরের সৎ মা, বেগা বেগম, হজ করে ফিরে আসার জন্যে তিনি হাজি বেগম] হজ করে মক্কা এবং মদিনার মত পূণ্য শহর ভ্রমণ করে ফেরত এসার পরেও তাঁর এবং তাঁর পুত্রের মধ্যে অটুট সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তিনি [রাজধানী আগরায় বাস না করে] দিল্লিতে, তাঁর হাতে তৈরি স্বামী হুমায়ুনের স্মৃতিস্তম্ভের পাশের অঞ্চলেই বাড়ি নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এই সময় মহামহিম গুজরাট বিজয় সম্পন্ন হওয়ায় চারিদিকে নিয়মিত প্রচুর ভোজসভার আয়োজন করা হচ্ছিল। এমনই এক ভোজসভায় ২৯ দাই ইলাহি বা ২০ জানুয়ারিতে মহান এই নারী মহামহিমকে শুভেচ্ছা জানাতে এলেন। আকবর এগিয়ে গিয়ে তাঁকে সম্মান দেখিয়ে অনুষ্ঠান এলাকায় নিয়ে এলেন। তাঁর আরেকটা পরিচয় হল প্রয়াত সম্রাট হুমায়ুনের মায়ের মামীর মেয়ে। তাদের পুত্রের নাম আলামন মির্জা। প্রয়াত সম্রাট হুমায়ুন তাঁর প্রতি অসমান্য শ্রদ্ধা দেখাতেন। আমি সম্রাট[আকবর]কে বলতে শুনেছি, ‘যে ভালবাসা, মহানুভবতা তিনি আমায় দেখয়েছেন, তাতে তাঁর প্রতি আমার ভালবাসা হয়েছে অবর্ণনীয়। অনেকেই জানেন না তিনি আমার গইর্ভধারিনী নন। আমার যখন ৬ বছর, আমার তীব্র দাঁতের ব্যথা হয়। তিনি বলেন তার কাছে কাজের ওষুধ আছে এবং তিনি সেটা আনতে গেলেন। মা [হামিদা বানু] আমার জন্যে অতিরিক্ত সতর্কতা আর সুরক্ষার জন্যে চাইলেন আমি মহান মহিলার দেওয়া সেই ওষুধটা যেন ব্যবহার না করি[বিষ সন্দেহে]। কিন্তু আমার মা জানতেন, তিনি প্রয়াত সম্রাটের স্ত্রীকে তাঁর আশংকা কথা বলতে পারবেন না। তাই তিনি তড়িঘড়ি উনি আসার আগেই আমায় নিয়ে নিজের প্রাসাদে চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমি হাজি বেগমের প্রাসাদ থেকে যেতে রাজি নই। সেই মুহূর্তেই তিনি অষুধটা নিয়ে বেরিয়ে এসে, গুমোট পরিবেশ আন্দাজ করে, কোনও কথা না বলে, ওষুধটার একাংশ নিজের মুখে নিলেন এবং আরেক অংশ আমার দাঁতে ঘরে দিলেন। প্রত্যেকের মন খুশিতে ভরে উঠল, আর আমার ব্যথাও কমে যেতে শুরু করল’।
১৫৫১ পড়াশোনায় ফাঁকি
[বায়াজিদ বয়াত হুমায়ুন এবং আকবর উভয় সময়ের মুঘল আমলা। ১৫৯১-৯২তে তিনি শাহী রান্নাঘরের দায়িত্বে থাকার সময় আবুলফজলের মুন্সিকে তাঁর স্মৃতিকথা বয়ান করেছেন। আবুলফজল জানাচ্ছেন শেষের দিকে তিনি ১৫৭১-৭২এ উল্লিখিত ঘটনাটা আকবরের লব্জে বয়ান করেছেন। ১৫৫১তে ১০ বছর বয়সী আকবর কাবুলে ছিলেন। পড়াশোনায় তাঁর খুব একটা মনযোগ ছিল না। তাঁর আতলিক ছিলেন হুমায়ুনের আমলাতন্ত্রের উচ্চপদস্থ আধিকারিক মুনিম খান, আকবরের সময় তিনি সর্বোচ্চ উকিল পদে উঠবেন। এই অংশটা বাজায়িদ বয়াতএর তাজকিরাইহুমায়ুনওআকবর থেকে নেওয়া]
সে সময় [১৫৫১] শাহজাদা জালালুদ্দিন মহম্মদ আকবর মির্জা হুসামুদ্দিনের পুত্র, মুল্লাজাদার ছাত্র ছিলেন। সমরখন্দে মির্জা হুসামুদ্দিনের তুলনীয় পণ্ডিত ছিল না। মহম্মদ আকবর মহামহিমা হামিদা বানু বেগমের তাঁবুতেই পাঠ নিতেন। মহামহিমকে [আকবর] সম্মান জানানো উদ্দেশ্যে মুনিম বেগ [হুমায়ুনকে] প্রণাম জানিয়ে, বিদায় নিলেন। শাহজাদা সত[কোকা]ভাই আধমকে বললেন, ‘মুনিমকে জানিয়ে দাও, সে আজকের মত আমাদের [পড়াশোনা থেকে] মুক্তি দিক’। আধম, মুনিম খানকে শাহাজাদার ইচ্ছে জানিয়ে দিলেন। শাহাজাদার ইচ্ছেকে সম্মান দিয়ে মুনিম বেগ মুল্লাজাদাকে বার্তা পাঠিয়ে দিলেন। মুনিম বেগ যেহেতু বরাবরই হুমায়ুনের উকিল ছিলেন এবং তাঁর বক্তব্যকে সম্মান করতেন সামরিক, অসামরিক প্রজা উভয় পক্ষই, মুল্লাজাদা তাঁর প্রস্তাব মান্য করে, শাহজাদাকে সেদিনের পড়াশোনার চাপ থেকে মুক্তি দিয়ে খেলার অনুমতি দিলেন। সংবাদটা সম্রাটের কানে পৌঁছল। অভ্যেসবশত পরের দিন মুনিম বেগ সম্রাটের দরবারে হাজির। শামসুদ্দিন আতকা শাহজাদাকে সম্রাটের সামনে নিয়ে এসেছেন প্রণাম করার জন্যে। সম্রাট শাহজাদাকে সতর্ক করে বললেন, ‘গতকাল তুমি তোমার আতলিক হাজি মহম্মদ সুলতানের থেকে পড়াশোনায় ছুটি নিয়েছ। এরকম আর কোনও দিন কোরো না’।
শাহজাদা মক্তবে পড়তে গেলে মহামহিম বললেন, ‘মুনিম, আমি শুনতে পেলাম তুমি তাকে পড়াশোনা থেকে ছুটি দিয়েছিলে। আমি উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে হাজি মহম্মদের নাম নিলাম কারন মির্জা[আকবর] এখনও বালক। সে যেন না ভাবে মুনিম বেগ তাকে পড়াশোনা থেকে মুক্তি দেওয়ার পর সেই ঘটনাটা চক্রান্ত করার জন্যে সম্রাটের কানে তুলেছে; আমি যখন ধরাধামে থাকব না, এ ধরণের কাজ করা থেকে বিরত থেকো; তার যদি এই ধারণা তৈরি হয়, তাহলে সে ভবিষ্যতে তোমার ক্ষতি করার সুযোগ খুঁজবে। হাজি মহম্মদ শিষ্টাচারহীন এক বদনসিব; তাঁর শাস্তি পাওয়াই উচিৎ’।
মহামহিম সম্রাট আকবর গপ্পটা জৌনপুরে ১৫৭১-৭২এ কাসিম আলি খানকে তাঁর জুবানে মুনিম খান খানইখানানের সামনেই বলেছিলেন। মুনিম খানকে সম্রাট তখনও আদর-সম্মান জানিয়ে খান বাবা সম্বোধন করতেন। এখানেই বাংলা আক্রমণের পরামর্শদানের লক্ষে বাজাইদকে সরকার বেনারসের প্রধান করা হয়। (চলবে)