প্রথম পর্বঃ আকবরের গপ্প প্রথম পর্ব

১৫৫১ আঁকা শেখা

[আকবরের শিক্ষায়, আঁকা শেখা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। পুত্র জাহাঙ্গিরের স্মৃতিকথা তুজুকইজাহাঙ্গিরিতে সম্রাট আকবরের আঁকা শেখার উল্লেখ পাচ্ছি। এই অংশটা ১৬০৫এ সম্রাট আকবরের প্রয়াণের একদুবছর পর লেখা হয়েছিল। বাজায়িদ আমাদের জানাচ্ছেন আবদুস সামাদ কাবুলে হুমায়ুনের দরররে পৌঁছন সেপ্টেম্বর অক্টোবর ১৫৫২য় শাওয়াল মাসে। পরের দিকে সম্রাট আকবর চিত্রবিদ্যা নিয়ে যতসব কথা বলেছেন, তাঁর শুরুয়াত হয়েছিল আবদুসসামাদের চিত্রবিদ্যা হাতেখড়িতে ১৫৫২-৫৪র মধ্যে। তখন তিনি ১০-১২ বছর। হিমু ছিলেন শুর সেনাপতি, ১৫৫৬য় পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত হন।]

মহামহিম স্মৃতিকণ্ডুয়ন করে বলতেন, ‘কাবুলে এক দিন আমি শিরিন কলম খাজা আবদুসসামাদের অধীনে আঁকা শিখছি, আমার তুলি দিয়ে একটা চরিত্র কাঠামো আঁকার সময় সেটা ছড়িয়ে থেঁতলে যায়। আমার পাশের একজন প্রশ্ন করল, এটা কার ছবি আঁকলে? আমি উত্তর দিলাম হিমুর।

১৫৫২ আকবর তখন ১০

[মাত্র দশ বছর বয়সে ১৫৫২র নভেম্বর-ডিসেম্বরের ঘক্ষরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হুমায়ুন আকবরকে সঙ্গে নিলেন। জৌহর আফতাবাচি ফারহালার লবন পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা উল্লেখ করেছেন। রফিক ছিলেন সম্রাট আকবরের ব্যক্তিগত সহকারী, আতখা খানের হত্যার পরে আধম খানের সঙ্গে যখন সম্রাটের আবার মুখোমুখি দেখা হবে, তখনও রফিক আবার উল্লিখিত হবেন। এই ঘটনাটা নেওয়া হয়েছে জৌহর আফতাবাচির তাজকিরাতুলওয়াকিয়াত থেকে]

আকবর

অকুস্থলে [ফারহালা] দাঁড়িয়ে মহামহিম শাহজাদাকে[আকবর] স্নান করিয়ে এবং জামাকাপড় পরিয়ে নিয়ে আসতে আমায় জৌহরকে নির্দেশ দিলেন। তাঁর নির্দেশে আমি আমি, জৌহর, শাহজাদার সামনে গিয়ে বললাম, ‘মহামহিম আপনাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আমায় নির্দেশ দিয়েছেন। আপনি দয়া করে স্নান করে নিয়ে, সেজেগুজে আমার সঙ্গে মহামহিমের সঙ্গে দেখা করতে চলুন’। শাহজাদা বললেন, ‘আমি তোমার সামনে ন্যাংটো হতে পারব না। আমরা নগ্নতা অন্য কাউকে দেখাতে লজ্জা লাগে’। আমি, জৌহর তখন বললাম, ‘তোমার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি রফিককে এত্তেলা দিই’। শাহজাদা উত্তর দিলেন, ‘তাই কর’। রফিক এলে মহামহিম স্নান এবং সাজসজ্জা করলেন। আমি, জৌহর তাকে এবারে সম্রাটের সমক্ষে নিয়ে গেলাম। মহামহিম মক্কার দিকে মুখ করে বসেছিলেন। তিনি তাঁকে তাঁর সামনে বসতে বললেন। যখনই তিনি কোনও কিছু আবৃত্তি করছেন, তিনি[শাহজাদা] তাঁর মুখে বাতাস বইয়ে দিচ্ছিলেন। মহামহিমকে[হুমায়ুন] দেখে খুবই পরিতৃপ্ত মনে হচ্ছিল।

১৫৫৬

[কেন ইতিহাস পাঠ বহুমাত্রিক, বিভিন্ন ঘটনার ভাষ্য মিলিয়ে বোঝা দরকার। এই লেখাটা ইংরেজিতে লিখেছেন আমার যুবা বন্ধু-ভাই মোঘল ছবি এবং স্থাপত্য গবেষক Suvadip Sanyall। লেখাটির অনুবাদ দিলাম।]

ছবি শুধুই ছবি নয় যার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে নানান ভাষ্য, এবং সেটি যদি ইতিহাস ঘটনা বিবৃত করা ছবি হয়, তাহলে আমাদের অনেকটা সচেতন থাকতে হয়। দর্শক যদি ছবিটির সঙ্গে জুড়ে থাকা ঘটনা ভাষ্য বিষয়ে সচেতন না থাকেন, তাহলে তাকে বদ্ধ জলায় ঘুরে মরতে হয়। এইরকম একটা ছবি এবং ভাষ্য ফেবু বিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ। সেই ভাষ্য লেখার শেষে উল্লিখিত হয়েছে। আমরা এই ছবি আর ঘটনাটার কাটাছেঁড়া করব।

আমরা দেখে নিই ১৫৫৬এর পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে কী ঘটেছিল। যুদ্ধটি হয় ৫ নভেম্বর সদ্য সম্রাট আকবরের বাহিনী এবং হিমুর মধ্যে। ইরা মুখুটি ‘আকবর দ্য গ্রেট মুঘল’ বইতে লিখছেন ‘আকবর নয়, এই যুদ্ধে আকবরকে বাহিনীর পিছনে সুরক্ষিত রেখে ৩০০০ ঘোড়সওয়ার নিয়ে অংশ নেন বৈরাম খান …হিমু হাওয়াই নামক হাতির ওপর সওয়ার হয়ে উচ্চৈস্বরে বন্দওবাস্তাঁ নির্ঘোষে মুঘল বাহিনী আক্রমন করেন’।

হিমু যুদ্ধ অনেকটা নিজের কব্জায় নিয়ে আসছিলেন, আচমকা একটি তীর হিমুর চোখে বিঁধে যাওয়ায় যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। রক্তে ভেসে যাওয়া হিমুকে শিবিরে নিয়ে যাওয়া হলে বৈরাম খাঁ, আকবরকে হিমুকে হত্যার নির্দেশ দেন। আবুলফজল বলছেন আকবর আহত শত্রুকে হত্যা করতে অস্বীকার করেন। হিমুর মাথাটি কেটে প্রদর্শন করানোর জন্যে দিল্লি পাঠানো হয় এবং দেহটা লাহোরের মুঘল হারেমে। তবে হিমুর মাথা সে যুদ্ধে কে কাটল সেই তথ্য আজও রহস্যাবৃত। আমরা ধরেই নিতে পারি হিমুর মাথা কাটার প্রতিবাদ করা নতুন সম্রাট আকবর নিশ্চই সেই কাজ করতে নির্দেশ দেন নি।

লেখার সঙ্গে প্রথম ছবিটি উত্তর ভারতের কিশনগড়ের, ক্রিস্টির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া শীর্ষক ‘AKBAR’S VICTORY OVER HEMU AT THE BATTLE OF PANIPAT MUGHAL STYLE AT KISHANGARH, NORTH INDIA, EARLY 18TH CENTURY.’। আমরা যেন মাথায় রাখি, ছবিটা যদি ১৮ শতকের শুরুর সময়ে আঁকা হয়, তাহলে সেটি পানিপথের থেকে ১৫০-২০০ বছরের মধ্যে কোনও এক সময়ে রচিত হচ্ছে। কিন্তু ভাষ্যটি বিপরীত; কারন রাজা পাল্টে যাচ্ছে।

কিশনগড়ের ছবির বলছে যে হাতিতে আকবর চড়েছেন, তার পায়ের নিচে হিমুকে ফেলে মারা হচ্ছে। ছবি ভাষ্যে স্পষ্ট বৈরাম খান নয়, আকবরই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন যা আবুলফজল লেখা ইতিহাসের বয়ানের বিপরীত। হিমুর স্ত্রী স্বামীর মৃত্যুতে লুটিয়ে কাঁদছেন। অথচ আকবরনামা সূত্রে আমরা জানি হিমু তার মহিলামহলকে যুদ্ধে আনেন নি।

পানিপথের যুদ্ধে হেমুর বিরুদ্ধে আকবরের বিজয়

এর সঙ্গে আমরা জুড়লাম আকবরনামার সংশ্লিষ্ট চিত্রটি।

১৮ শতকের শুরুতে শেষ আওরঙ্গজেব আলমগিরের মৃত্যু ঘটছে, ছবিটা তার পরে আঁকা হচ্ছে এবং এই ছবিতে মূল তথ্যের সঙ্গে জোড়া হচ্ছে আরও কিছু অতিরিক্ত মনের মাধুরী, যা দুশ বছর আগের ঘটে যাওয়া তথ্যের বিপরীত।

১৫৬০ বৈরাম খানের সঙ্গে বিচ্ছেদ

[আকবর মুঘল সাম্রাজ্যের চরম সন্ধিক্ষণে ১৫৫৬তে কালানৌরে সিংহাসনে আরোহন করেন। প্রথম চার বছর রাজত্ব চালানোর মূল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন তাঁর আতলিক(পরামর্শদাতা, শিক্ষক) বৈরাম খান। আকবর বৈরাম খানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন ১৫৬০এ। ১৫৬১র ৩১ জানুয়ারিতে বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ডের সময় পর্যন্ত, তাঁর প্রধান সাহায্যকারী মহম্মদ আরিফ কান্দাহারি বৈরাম খানের সঙ্গে ছিলেন। এখন যে বাখানটা উল্লেখ করব, সেটি তাঁর জবানিতেই পাওয়া। তিনি ১৫৬০এর মার্চে আকবরের একটি চিঠির বয়ান উল্লেখ করে, তাঁকে পাঠানো একটি চিঠিতে বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ড বর্ণনা করেন। আবুলফজল এই চিঠিকে অন্য বয়ানে, অন্য কাঠামোয় উল্লেখ করেছেন। আরিফ কান্দাহারি ১৫৭৯তে তারিখইআকবরি, আকবরের সময়ের ইতিহাস নামক বইএর লেখক।]

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে, মহামহিম এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে, কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুগামী নিয়ে দ্বিতীয় জুমাদা ২৮-ফেব্রুয়ারি ২৭ মার্চ ১৫৬০তে রাজধানী আগরা ছেড়ে যেন যুদ্ধাভিযানের মত, পিছু নেওয়ার মত করে দিল্লির দিকে অগ্রসর হলেন। পরের দিনে মহামহিম সম্রাটের রাজধানী ছাড়ার সংবাদ পেয়ে বৈরাম খান আতঙ্কিত হয়ে সম্রাটের সকাশে নতুনভাবে আনুগত্য প্রদর্শন করতে, তাঁর পুরোনো ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার আবেদন করে একটি প্রতিনিধি দল পাঠান। সম্রাটের উদ্দেশ্যে পাঠানো এই দলে তিনি রেখেছিলেন খাজা জাহান, তাঁর উকিল [প্রতিনিধি] হাজি মহম্মদ খান, এবং তাঁর সিলমোহর বাহক তারসুন মহম্মদ খানকে। তাঁর আবেদন সম্পূর্ণ বা অংশত, কোনও মতেই গ্রাহ্য হল না। যে দল এই কাজ সম্পন্ন করতে এসেছিল, তারাও আর ফিরে গেল না।

দিনে রাতে, সেনাপতি আর সেনার দল রাজধানী আগরা থেকে দলে দলে বেরিয়ে সাম্রাজ্যের তাঁবুর দিকে অভিযান করতে থাকে, যাতে তারা সকলে সাম্রাজ্যের পতাকা তলে একত্রিত হতে পারে। এই সময় সম্রাট আকবর এই লিখিত বয়ানটি বৈরাম খানকে পাঠান,

আকবর তার অভিভাবক বৈরাম খানের সাথে মুঘল সর্দার এবং অভিজাতদের সাথে বাজপাখি

‘আমার প্রিয় খান বাবা! আশাকরি আপনি আমাদের ভালবাসার, আদরের সঙ্গে লেখা চিঠিটি পড়বেন, এবং নিশ্চই জানবেন যে কোনও এক কারনে এবং প্রেক্ষিতে আমাদের দিল্লিতে শিবির বসাতে হয়েছিল। কিন্তু যখন শুনলাম, আপনি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন, আমরা তারসুম বেগকে দিয়ে[বলে] পাঠালাম যে, যেহেতু আমরা আপনার পক্ষ থেকে বহু অভিযোগ এবং আহত হওয়ার সংবাদ পাচ্ছিলাম, তাই আমাদের জন্যে সে সময় আপনার অপেক্ষা করার প্রয়োজন ছিল না, আপনি যেরকম মনে করেন, সেইভাবেই ঘটনার মুখোমুখি হতে পারেন। যদি প্রয়োজন দেখা দেয় আমরাই আগরা ফিরে আসব। আপনি যততাড়াতাড়ি সম্ভব গোয়ালিয়র এবং তাঁর আশেপাশের অঞ্চলে পৌঁছন, কারন যখনই আপনাকে আমাদের প্রয়োজন হবে, আপনি আমাদের জন্যে প্রতীক্ষা করতে পারেন। আমি আপনাকে আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই, বাবা ছেলের মধ্যে ঝগড়া হয়, কিন্তু কেউ কারোর প্রতি সম্পূর্ণ নিস্পৃহ থাকে না। আপনি যেহেতু আমার খান বাবা, আপনার আমার মধ্যে একই সম্পর্ক বিদ্যমান। আপনার দুঃখ, আহত হওয়া এবং অনুচিত, অযোগ্যতা[আপনার দিক থেকে] সত্ত্বেও, আমার দিলে আপনার প্রতি অনুরাগ, অনুগ্রহ এবং ভালবাসা জমা হয়ে আছে। অতীতের মতই আমি আপনাকে ‘খান বাবা’ নামেই অভিহিত করি এবং স্বীকার করব। আমার মনে হয়, আপনার আমার মধ্যে একটি বৈঠক মুলতুবি আছে, আপনার চিঠির প্রস্তাব অনুযায়ী আপনি যদি পূণ্য শহরে হজ্বের জন্যে তীর্থযাত্রা করেন, তাহলে সেটাই যথাযথ হয়। লাহোর বা সিরহিন্দের খাজাঞ্চিতে আপনার পথ খরচার অর্থের জন্যে কাউকে পাঠালে অর্থ পেয়ে যাবেন, সেটি নিয়ে আপনি অবিলম্বে রওনা হয়ে যান। তারিখ…

চিঠিটি পড়ার পরে বৈরাম খান আরও আশঙ্কিত এবং উত্তেজিত হয়ে ৯ রজবে[১৭ এপ্রিল ১৫৬০] [সৈয়দ নাজুবুদ্দিন হাবিবুল্লাহর সঙ্গে দেখা করার আগেই, তাঁর সমস্ত বুদ্ধিসুদ্ধি হারিয়ে রাজধানী আগরা ত্যাগ করে বায়ানার দিকে রওনা হয়ে যাবেন…

১৫৬০-৬১ যৌবনের খামখেয়ালিপনা

[এই ঘটনাটা নিয়েছি বায়াজিদ বায়াতের লেখা থেকে। তিনি তখন সম্রাটের কাছে আগরাতেই ছিলেন। ১৫৬১ অবদি শামসুদ্দিন মহম্মদ আতকা খান পাঞ্জাবের ফৌজদার ছিলেন। আমাদের যেন মাথায় থাকে আতকা খান আকবরের দাই জিজি আঙ্গার স্বামী ছিলেন, এক দিক থেকে আকবরের সৎ পিতাও। এই অংশটা তাজকিরাতইহুমায়ুনওআকবর থেকে নেওয়া]

সে সময়[১৫৬০-৬১] মহামহিম লড়ুয়ে মোরগ এবং মোরগ লড়াই ইত্যাদি নিয়ে খুব উৎসাহী হয়েপড়েছিলেন। তাঁর নির্দেশ ছিল যে মানুষই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসুন না কেন, সম্রাটকে সম্মান জানাতে গেলে হাতে একটা করে অন্তত লড়াই মোরগ প্রণামী হিসেবে নিয়ে আসতে হবে। এক দিন পাঞ্জাব সরকারের ফৌজদার শামসুদ্দিন মহম্মদ আতকা লাহোর থেকে আসছিলেন। রাস্তায় তিনি মাথা ন্যাড়া করার সম্রাটের নির্দেশ হাতে পান। যদিও এই জন্যে তাঁর মাথায় খুব বেশি চুল গজায় নি। মহামহিম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আমি তোমায় নির্দেশ পাঠালাম, তুমি এখনও ন্যাড়া হলে না?’ সঙ্গে সঙ্গে শামসুদ্দিন উত্তর দিলেন ‘আমার মাথায় খুব কম চুল গজিয়েছে[অর্থাত নতুন করে ন্যাড়া হওয়ার দরকার আছে কী?]। আমি রাস্তায় মথুরা পৌঁছলে হিন্দুরা যেভাবে ন্যাড়া হয়, আমি সেভাবেই ন্যাড়া হব’। উত্তর শুনে সম্রাট মোহিত হলেন।

১৫৬০-৬১ জনপ্রিয় উৎসব

[এই ঘটনা আবুলফজল লিখেছেন রাজত্বের ৬তম বছরে। এই ঘটনার সঙ্গে স্বয়ং সম্রাট জড়িয়ে আছেন। এটি আকবরনামা থেকে নেওয়া হয়েছে]

বাহারাইচে প্রখ্যাত সালার মাসুদ গাজির মাজার আছে। তিনি গজনীর বাহিনীর সঙ্গে এসে শহীদ হয়েছিলেন। এখানে এসে প্রত্যেকেই তাঁর অঞ্চলের নানা রঙের পতাকা এনে চড়ায় এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আনা নানা রকম উপহার দেয়। এই মাজারে যাওয়ার জন্যে মাঝেমধ্যেই আগরা থেকে বড় রংবেরঙের দল বেরোত এবং তারা [আগরার] পাশের গঞ্জে পরের রাতটি কাটা্ত। সেই গঞ্জে বিপুল সংখ্যার মানুষ জমায়েত হত – অধিকাংশ ভাল আর কিছু খারাপ। এই গল্পটি লিখেছেন আবুলফজল। তাঁকে একদিন সম্রাট পুণ্য মধুর স্বরে বললেন, একবার এধরণের বিপুল মানুষের জমায়েতে তিনি গোপনে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ছদ্মবেশে হারুন রশিদের মত জমায়েতে উপস্থিত হয়ে নানান মানুষের চরিত্র দেখতেন, মানুষের বিবিধ চরিত্র বিষয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতেন। এক সময় ‘কিছু দুষ্কৃতি আমায় চিনেফেলে। সচেতন থাকায় আমি বিষয়টা খুব তাড়াতাড়ি বুঝে যাই এবং মুহূর্তের মধ্যে আমি আমার চোখের চেহারার এমন কিছু করে পাল্টে নিই যাতে সহজে আমায় সম্রাট হিসেবে চেনা না যায়, এবং মানুষ বুঝতে না পারে রাজত্বের সম্রাট একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে এই জমায়েতে আদৌ আসতে পারে। তারা দ্বিতীয়বার আমার দিকে তাকালেও আমায় চিনতে না পেরে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে থাকে, এই চোখ তো আগে দেখি নি, এই দৃষ্টি সম্রাটের হতে পারে না’। ‘আমি অবিলম্বে নিঃশব্দে সেখান থেকে সরে প্রাসাদে চলে আসি’। গল্পটা আমায় বলতে বলতে মহামহিম কীভাবে চোখের আকৃতির বদল এনেছিলেন সেটি আমায় নতুন করে দেখালেন; আমাদের বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। বাস্তবিক, এরকম অবাক অভিনয় বিষ্ময়কর।

বাহারাইচে প্রখ্যাত সালার মাসুদ গাজির মাজার

১৫৬১-৬২ হাতির লড়াই

[সম্রাট আকবর বন্য হাতি ঘোড়াকে বশ করে তাতে চড়তে ভালবাসতেন। এটাও ছিল তাঁর প্রিয় বিনোদনকর্ম। আবুলফজল আকবরনামায় ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। আকবরের নাম নিয়ে এই ঘটনাটি তুজুকইজাহাঙ্গিরিতে জাহাঙ্গির প্রত্যায়িত করেছেন। আকবর বলছেন তিনি মাতালের অভিনয় করছিলেন, কিন্তু একবার মাতালের ছদ্মবেশ ধারণ করার পর, বিপদ এলেও সে সময় তার পক্ষে সেই মাতলামির ছদ্মবেশ ঝেড়েফেলার উপায় ছিল না।]

ঘটনাটি ঘটে যখন মহামহিম হাওয়াই[ইন্টারেস্টিং হল পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ হিমুর যে হাতিটি চড়ে যুদ্ধ করছেন, তার নামও হাওয়াই। এই হাওয়াই সেই হাওয়াই কী না জানা যায় নি] নামে একটি হাতির ওপরে উঠে তাকে অন্য হাতির সঙ্গে লড়িয়ে দিয়েছিলেন। হাওয়াই বড়সড় আকারের সাম্রাজ্যের ফিলখানার হাতি। সাধারণভাবে চলাফেরা করতে করতে হঠাত হঠাত সে খেপে উঠে ভয়ঙ্কর আর আতঙ্কজনক অবস্থা তৈরি করত। এইধরণের বদরাগি হাতিকে সামলানো মাহুতেরাও হাওয়াইকে সামলাতে সমস্যায় পড়তেন। কিন্তু যুদ্ধেগেলে একে সামলানো যায় কী প্রকারে? আমাদের নায়কী এবং সাহসী সম্রাট বিন্দুমাত্র দ্বিধা না রেখেই আগরা কেল্লার বাইরে তাঁর বিনোদনের জন্যে তৈরি পোলো খেলার মাঠে, পতাকার আকারের লম্বা হাতি হাওয়াইএর পিঠে চড়েবসলেন। হাওয়াইকে তিনি, তাঁর দিকে তেড়ে আসা হাতি রান বাঘার দিকে তাক করলেন। উপস্থিত অনুগামী আর অভিজ্ঞ মানুষেরা এই অবস্থায় হতবাক, তারা কোনও দিনই চাইবেন না, আকস্মিকভাবে এই ধরণের ঘটনা ঘটুক।

মুঘল সম্রাট আকবর একটি হাতিকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন

দাঁড়িয়ে থাকা দরবারিরা ঘটনাক্রম সামলাতে না পেরে সম্রাটের বিপদের আশংকায় অধীর হয়ে উঠল। বেপরোয়া হয়ে তারা সে সময়ের দরবারের বড় আমলা আতকা খানকে ডেকে নিয়ে এল; তাদের আশা, আতকা খান হয়ত সম্রাটকে এই মৃত্যুমুখী লড়াই থেকে নিরস্ত করতে পারবেন। এই সময়ের প্রত্যেকেরই রক্ত শুকিয়ে জল হয়েযাচ্ছিল। আতকা খান বিশাল গোলযোগের মধ্যে উপস্থিত হয়ে, হাতির নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা দেখে হতাশ হয়ে মাথা থেকে টুপিটা খুলে ফেলে মাথা ন্যাংটো হয়ে বিচার না পাওয়া প্রার্থীর মত কান্নাকাটি শুরু করে সব কিছু মাথায় তুললেন। ছোট বড় তুচ্ছ সকলেই সর্বশক্তিমানের দিকে হাত তুলে জগতসংসারের উদ্ধারকর্তা, শান্তি আর স্থিতিশীলতার পাঠানো মানুষটার সুরক্ষার জন্যে ঐশ্বরিক সাহায্য প্রার্থনা শুরু করল। মহামহিমের আকুল আতকা খানের দিকে চোখ পড়লে ধমকে বলে উঠলেন, ‘তুমি হাহাকার কোরবেনা। তুমি যদি কান্না না থামাও এক্ষুণি আমি হাতির তলায় লাফিয়ে পড়ব’। আতকা খান বুঝলেন তাঁর প্রভু মিথ্যে হুমকি দিচ্ছেন না। তাঁর চিৎকার এবং বাইরে তাঁর উদ্বেগী সমস্ত প্রকাশভঙ্গীই অদৃশ্য হল।

যতক্ষণনা উত্তেজিত হাওয়াইএর শক্তি, সামর্থ্য এবং ঐশ্বরিক সহায়তায় বিপক্ষের হাতিটিকে বশ না করতে পারলেন, ততক্ষণ সিংহহৃদয় সম্রাট ভীতিপ্রদ এই খেলা চালিয়ে গেলেন। রান বাঘা বাঁধা কাছির সমস্ত নিরাপত্তা বেড়া ছিঁড়ে ফেলে পালিয়ে গেল। পিঠে সম্রাটকে নিয়ে বিপুল বিশাল হাওয়াই পলাতক হাতিটির পিছনে মাতাল বাতাসের মত ওলটপালট খেয়ে ধাওয়া করতে থাকে। মহামহিম, যেন জানতেন ভবিষ্যতে কী ঘটনা ঘটতে চলেছে, তিনি পাথরের মত শক্ত হয়ে তার পিঠে বসে রইলেন। শেষ পর্যন্ত হাতিটি দুটি, দীর্ঘ পথ দৌড়ে পৌঁছল যমুনার তীরে, নৌকো দিয়ে তৈরি পনটুন সেতুর মুখে। রান বাঘা ভ্যাবাচেকা খেয়ে নৌকো সেতুর ওপর উঠে পড়ে, আর সাম্রাজ্যের নায়ক হাতি হাওয়াইও তার পিছন নিয়ে সেতুতে ওঠে। দুই মত্ত হাতির চাপে পনটুন সেতুর প্রায় সব কটা নৌকো ডুবে যায়। শাহী ভৃত্যেরা সেতুর দুপাশের জলে লাফিয়ে পড়ে হাতিগুলোর পিছনে সাঁতার কেটে হাতিগুলোর সঙ্গে অন্যতীরে ওঠেন। জড়ো হওয়া দর্শকেরা বিষ্মিতচিত্তে ঘটনাবলী দেখতে থাকেন কীভাবে আগুণের গোলা হাওয়াই নামক হাতিকে ক্রমশ নিজের বশে এনে সম্রাট তাকে পালতু হাতিতে রূপান্তরিত করেন। প্রাণ হাতে নিয়ে রণ বাঘা পালিয়ে যায়।

সকলের ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল। কয়েকজন দূরদৃষ্টিহীন মানুষ মনে করেছিলেন সম্রাট মাতাল ছিলেন এবং যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটি তার মাতলামির বহিঃপ্রকাশ। তারা এখন বুঝতে পারল তাদের অজ্ঞতা কখনো মহামহিমের জ্ঞানার্জিত চিন্তাধারার কাছাকাছি পৌঁছতে পারে না।