আকাশে বিমানে উড়ে চলা অনেকের কাছে যেমন একটি মজার ব্যাপার, তেমনি অনেকের কাছে এটি আবার এক আশ্চর্যের বিষয়ও বটে। এখনও বিমান নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। অনেকে হয়তো মনে মনে ভাবে, এতো বড়ো একটি যান এতো যাত্রী নিয়ে উড়ে কিভাবে? আর বিমান চালকদের প্রতি তো সাধারণ মানুষের রয়েছে জন্মগত কৌতূহল ও শ্রদ্ধা। “বড়ো হয়ে কি হতে চাও?”, স্কুলের বাচ্চাদের এমন প্রশ্নের বেশীরভাগ উত্তর আসবে, “পাইলট”! বলা হয়, বৈমানিকদের হৃদয় নাকি অনেক বড়, সাহসও অগাদ। আর যারা অতীতে, শত শত বছর আগে, বিমান ছাড়াই আকাশে উড়তে চেয়েছিলেন, তারা তাহলে কত সাহসী ছিলেন? আজ দেখবো এমনই এক অকুতোভয় ব্যক্তির আকাশে উড়ার অদম্য স্পৃহা, এবং তাঁর ইতিহাস সৃষ্টির সেই মহাকাব্য।
নবম শতকে উমাইয়া খিলাফতের সময়ে (মুরসদের আমলে), স্পেনের আন্দুলিসিয়ার অধিবাসী আব্বাস ইবনে ফিরনাসও ছিলেন এমনি এক অকুতোভয় মানব। তিঁনি ছিলেন একাধারে একজন প্রকৌশলী, উড্ডয়ন বিশারদ, চিকিৎসক, আবিষ্কারক, সংগীতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, কবি -এক কথায়, সর্ববিদ্যায় পারদর্শী। তাঁর জন্ম হয় ৮১০ সালে, শৈশব কাটে স্পেনের কর্ডোবাতে। জ্ঞান অর্জনের জন্য একসময় চলে যান বাগদাদে। বাগদাদ ছিল তখন বিশ্বের জ্ঞান অর্জনের প্রধান কেন্দ্রস্থল। ফিরনাস ফিরে আসেন কোর্ডোবাতে শিক্ষা শেষ করে। তিঁনি বিশ্ব ভ্রম্মান্ডে গ্রহ-উপগ্রহের গতিবিধি লক্ষ্য করার যন্ত্র আবিষ্কার করেন। শুধু কি তাই, পানি-ঘড়ি (Water-Clock), ম্যাগনিফাইং গ্লাস, পাথর কেটে ক্রিস্টাল বানানোর কৌশল, এ সব তাঁরই আবিষ্কার। এগুলো ছাড়াও, তিঁনি চিরাচরিত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে ভাবতে লাগলেন এক ‘Out of the Box’ কিছু আবিষ্কারের। কি সেই “বাক্সের বাহিরে”এর চিন্তা? দেখতে আমাদের আপত্তি কি একটু চোখ মেলে!
তিঁনি গভীরভাবে লক্ষ্য করতেন পাখীর আকাশে উড়ার কৌশল, আর ভাবতেন, তিঁনিও কিভাবে একদিন এমনি ভাবে আকাশে উড়তে পারবেন। এই ভাবনা থেকেই ইবনে ফিরনাস অনেক গবেষণা করে আকাশে উড়ার জন্য বিশ্বের প্রথম দুই ডানা বিশিষ্ট একটি গ্লাইডার তৈরী করে ফেলেন। উড়ার জন্য সব কিছুই যখন প্রস্তুত, আর দেরী কেন? ছুটে চললেন কর্ডোবার সব চেয়ে উঁচু স্থানে। ৮৫২ খ্রিস্টাব্দের কোনো একদিন গ্লাইডারটি নিয়ে উঠে গেলেন কর্ডোবার মসজিদের সুউচ্চ মিনারের মাথায়। তাকিয়ে দেখলেন তাঁর সামনের উম্মুক্ত রংবিহীন হাওয়ার বিস্তীর্ণ এক ময়দান। নিজের দেহে গ্লাইডারটি আটকিয়ে ফিরনাস একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন। নেই কোনো ভয়, রয়েছে শুধু মহাসাগরের অজানা অতল গম্বরে হারিয়ে যাবার রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি। পেছনে তাকাবার কোনো ইচ্ছেই তাঁর হলো না। ফিরনাস কর্ডোবার মসজিদের সুউচ্চ মিনার থেকে লাফিয়ে পড়েন শূন্যে। দুর্ভাগ্য, প্রচেষ্টাটি যায় বিফলে। তিঁনি উড়তে পারেন নি, পরে গেলেন মিনার থেকে। ভাগ্যগুনে তাঁর গ্ল্যাইডারের বদৌলতে বেঁচে যান এবারের মতো। আহত হন তিঁনি। কিন্তু এই ব্যর্থতা তাঁকে দমাতে পারে নি। সুস্থ হয়ে আবারো নেমে পড়লেন গ্লাইডারটির ডিজাইন নিয়ে।
একজন জাত-প্রকৌশলী এবং উদ্ভাবক, ফিরনাস পরবর্তী ২৩টি বছর নিলেন তার উড্ডয়নের প্রস্তুতি। এখন থেকে প্রায় ১,১৪৫ বৎসর পূর্বে, ৮৭৫ শতাব্দীতে এসে হাজির হলো দিনটি। দীর্ঘ তেইশ বছর পর তিনি আবারো আকাশে উড়ার জন্য হলেন উম্মুখ। তাঁর বয়স তখন পঁয়ষট্টি বছর। এই বয়সে এই দুঃসাহসিকতা? ভাবা যায়?
গ্লাইডারটি নিয়ে চলে গেলেন স্পেনের কর্ডোবার কাছে রুসাফা এলাকার আরুস পর্বতে। উপরে উঠে প্রাণ ভরে দেখলেন চারিদিকের শূণ্যতা। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস মনে। তাঁরই উদ্ভাবিত গ্লাইডারটি পরে দ্বিতীয় বারের মতো শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন ভয়হীনভাবে। প্রায় দশ মিনিট উড়ে চললেন ভেলার মতো বাতাসে। আহ, কি আনন্দ! তিঁনি পাখীর মতো উড়ে গিয়েছিলেন যথেষ্ট দূরে। সফলভাবে উড়তে পারলেও নিরাপদে অবতরণ করতে ব্যর্থ হন ফিরনাস। মাটিতে নামার সময় গুরুতর আহত হন তিঁনি। পরে বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাখীরা অবতরণের সময় তাদের পাখা এবং লেজের সমন্বয়ে গতি নিয়ন্ত্রণ করে। তাঁর গ্লাইডারে এই গতি নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ব্যবস্থাই রাখেন নি তিঁনি। তাই এমন দুর্ঘটনা। ভাবলেন তাঁর মূর্খতা! ফিরনাসের এই আকাশে উড়ার সফলতাকে তখনকার কর্ডোবার রাজকীয় কবি মু’মিন বিন সাঈদ বর্ণনা করেছেন এভাবে, “ফিরনাস অস্ট্রিচ পাখীর গতিকে হার মানিয়েছেন উড়ার সময়, কিন্তু তাঁর দেহকে শকুনের দক্ষতায় রূপান্তরিত করতে ভুলে গেছেন অবতরণের সময়”।
ফিরনাস ছিলেন মানুষের আকাশে উড়ার এক সফল স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর গ্ল্যাইডারের সাহায্যে উড়ার প্রচেষ্টাকে বলা যায় আধুনিক বিমান আবিষ্কারের প্রথম সোপান। মানুষকে বিমানের মাধ্যমে ডানা মেলে উড়ার স্বপ্ন দেখানো ফিরনাস মারা যান এই সফলতার আরো বারো বছর পর। ইবনে ফিরনাসের আগেও বিভিন্ন সভ্যতার অনেকে আকাশে উড়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফলতা পাই নি কেউই। গ্রীক কাব্য-উপন্যাস-পুরাকাহিনীতে আকাশে উড়ার স্বপ্নের দেখা মেলে। এমন কি চীন দেশেও পঞ্চম শতাব্দীতে ঘুড়ি আবিষ্কারের পর ষষ্ঠ শতাব্দীতে আকাশে উড়ার চেষ্টা করা হয়েছিল ঘুড়ির সাহায্যে, কিন্তু সফলতা আসে নি। এই স্বপ্নদ্রষ্টার অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে বিখ্যাত গাড়ী নির্মাণ প্রতিষ্ঠান রোলস রয়েস (Rolls Royce) ২০১৩ সালে ফিরনাসের নামে তাদের একটি গাড়ির নামকরণ করে, “ইবনে ফিরনাস মোটিফ”। স্পেনের কর্ডোবায় ইবনে ফিরনাস সেতু এখনো বিদ্যমান, বাগদাদ বিমানবন্দরের সামনে ইবনে ফিরনাসের ভাস্কর্য, দুবাইয়ের ইবনে বতুতা শপিং-মলে ফিরনাসের ভাস্কর্য, চাঁদের একটি জ্বালামুখের নাম ইবনে ফিরনাস তাঁর অবদানেরই সাক্ষী বহন করছে আজো। বিশ্ব দিয়েছে স্বীকতি। অভিবাদন এভিয়েশন জগতের এই সাহসী অগ্রদূতকে!
তথ্য সূত্র:
* J. Vernet: Abbas Ibn Firnas. Dictionary of Scientific Biography (C.C. Gilespie, ed.) Vol. I, New York: 970–1980