আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সফল সামরিক প্রধান। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবা দ্বিতীয় ফিলিপের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি অপরাজেয় সমরবিদ, ইতিহাসের অন্যতম সেরা নায়ক হিসেবে পরিগণিত হন। আলেকজান্ডার সর্বাঙ্গীনভাবে গ্রেট ছিলেন কিনা তা নিয়ে আজকে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বিজেতা ছিলেন, কিন্তু তাঁর ছিল অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক পদ্ধতি- এমন দুর্নাম তার আছে। তিনি পারস্যের সুবৃহৎ লাইব্রেরীটি পুড়িয়ে কিভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিলেন, সে কাহিনী আমরা আরেকদিন জানব।
আজ তাঁর ছোটবেলার একটি ঘটনার কথা বলা হবে। একটি ঘোড়া কে নিয়ে এই ঘটনা, যেটা পরবর্তীতে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট’ এর জীবনে বহু যুদ্ধের সাথী ছিল। আলেকজান্ডারের বাবা, দ্বিতীয় ফিলিপ তার শাসনকালে গ্রিসের নগর রাষ্ট্র গুলোকে নিজের শাসনাধীনে আনেন। তিনি ছিলেন ম্যাসিডোনিয়ার রাজা। তিনি তাঁর মৃত্যুর পূর্বে গ্রিসের বেশিরভাগ অংশই জয় করেছিলেন। বীর সাহসী যোদ্ধা ফিলিপ গড়ে তুলেছিলেন সুদক্ষ সেনাবাহিনী।
সুদক্ষ সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজন হয় অনেক চৌকস ঘোড়ার। এই প্রয়োজন পূরণের জন্য একবার ঘোড়া বাছাইয়ের কাজ চলছিল। ম্যাসিডোনিয়ায় ঘোড়া বিক্রির জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে সেরা ঘোড়াগুলো নিয়ে হাজির হতো ঘোড়া ব্যবসায়ীরা। এক ব্যবসায়ী তার সাথে এনেছিল এক প্রকাণ্ড কালো চকচকে ঘোড়া। কেউ ঘোড়াটির কাছে ঘেঁষার সাহস পাচ্ছিল না ; কারণ এটি পাগলের মত লাথি মারছিলো।
ঘোড়াটিকে মাঠে নেবার চেষ্টা করেও কেউ সফল হয়নি। কারণ এর পিঠে চড়তে গেলেই সে লাফিয়ে সবাইকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। পেছনের দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে ঝাপাঝাপি করছিল। অত্যন্ত হিংস্র মেজাজের ছিল এই ঘোড়াটি। তার মনোভাব ছিল এমন- “আসো তো কাছে, ছুঁয়ে দেখো আমাকে, দেখাবো মজা!” জন্তুটির এইসব কান্ড দেখে রাজা ফিলিপ ভীষণ বিরক্ত হয়ে যান এবং এটিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বলেন। এটিকে দিয়ে কাজ হবে না, পাগলা ঘোড়া, তাই একে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য নির্দেশ দেন। রাজার নির্দেশ পেয়ে বদমেজাজি ঘোড়াটিকে যখন সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন রাজা ফিলিপের ছোট ছেলে আলেকজান্ডার হঠাৎ দৌঁড়ে এসে দাঁড়ান। ঘোড়াটি তার খুব পছন্দ হয়েছিল, আর আসলেই এটি ছিল খুবই চমৎকার। দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি তেজী। নাম তার বুসিফেলাস। এ যেন প্রথম দেখাতেই ভালোবাসা।
ঘোড়াটির পাগলামি করার কারণ কিন্তু আলেকজান্ডার বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি খুব খেয়াল করে দেখেন যে, ঘোড়াটি তার নিজের ছায়া দেখে ভয় পাচ্ছে। তিনি ঘোড়াটির পাশে যেয়ে এর মুখটি সূর্যের দিকে ঘুরিয়ে দেন আর তার গলায় কয়েকবার ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে খুব নরম স্বরে কথা বলেন। এরপর এক ঝটকায় কিশোর আলেকজান্ডার ঘোড়ার পিঠে উঠে বসেন এবং তীব্র গতিতে মাঠ থেকে বের হয়ে যান। রাজা ফিলিপ এই দৃশ্য দেখে আনন্দিত হয়ে ঘোড়াটি কিনে ছেলেকে উপহার দেন। ঘোড়ার পিঠে আলেকজান্ডার কে দেখে মনে হচ্ছিল যেন এটি তার জন্যই তৈরি হয়েছে। এরপর থেকে বুসিফেলাস হয়ে যায় আলেকজান্ডারের সঙ্গী।
বাবার মৃত্যুর পরে আলেকজান্ডারই ম্যাসিডোনিয়ার রাজা হন। সামরিক কৌশল ও পদ্ধতির জন্য আলেকজান্ডার ছিলেন বিশ্ব বিখ্যাত। তিনি তার বাবার মতোই গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলোকে নিজের শাসনাধীনে আনেন। তার শাসনামলে তিনি অধিকাংশ সময় উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়া জুড়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি মিশর থেকে উত্তর পশ্চিম ভারত পর্যন্ত প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম রাজ্য গুলির মধ্যে অন্যতম একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। আলেকজান্ডার তাঁর প্রিয় ঘোড়ায় চড়ে সেনাবাহিনী নিয়ে মিশর ও ভারত পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যবশত বুসিফেলাস ভারতে মারা যায়। প্রিয় ঘোরার প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বুসিফেলাস এর নামে একটি নগরীর নামকরণ করেন আলেকজান্ডার। ঘোড়াটির প্রতি তার যে কত গভীর ভালোবাসা ছিল, তা এ থেকে বোঝা যায়।