দেবদাস উপন্যাসটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন মাত্র ১৭ বছর বয়সে। তিনি বইটি লেখা শেষ করেন ১৯০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কিন্তু প্রকাশনা করেন ১৯১৭ সালে। প্রকাশনা করতে কেন এই লম্বা সময়? কারন দেবদাস উপন্যাসটা নিয়ে লেখক দ্বিধার মধ্যে ছিলেন তাই প্রকাশ করতে ১৭ বছরের লম্বা সময় নিয়েছিলেন।
আসলে তিনি উপন্যাসটি লিখেছিলেন মাতাল অবস্থায়। ১৯১৩-তে লেখা বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে এক চিঠিতে শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন ‘’একেবারে মাতাল হইয়া বোতল খাইয়া দেবদাস উপন্যাসটি লেখা’’।

দেবদাস উপন্যাস – বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ; Image source: Wikimedia

পার্বতীর জন্য দেবদাসের যে বিরহ সেটাকেই উপজীব্য করে লেখা এই উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯টি চলচ্চিত্র তৈরী হয়েছে হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষায় উপন্যাসটি অনূবাদ করা হয়েছে। দেবদাস উপন্যাসে ভালোবাসার যে করুণ আবেগের আর্তি সেটা লেখকের অন্য কোনো লেখায় পাওয়া যায়নি তাই যুগে যুগে রূপালি পর্দায় দর্শক-হৃদয়কে জয় করেছে বাঙালির প্রেমের প্রতীক দেবদাস ও পার্বতী।

কলকাতায় ১৯২৭ সালে দেবদাস নিয়ে প্রথম ছবি তৈরি হয়। এই ছবিটি ছিলো নির্বাক, পরিচালনা করেন নরেশ মিত্র। ছবিতে দেবদাস, পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর ভূমিকায় ছিলেন ফণী শর্মা, তারকবালা ও নিহার বালা।

এরপর শুরু হয় সবাক চলচ্চিত্র বা ‘টকি’র যুগ। ১৯৩৫ সালে কলকাতাতে আবার তৈরি হয় সবাক ‘দেবদাস’। এর পরিচালক ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত অভিনেতা ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব প্রমথেশ বড়ুয়া। তিনি নিজেই দেবদাসের ভূমিকায় অভিনয় করেন। পার্বতী ও চন্দ্রমুখী ছিলেন যমুনা ও চন্দ্রাবতী দেবী। বড়ুয়া-যমুনার জুটি দর্শকদের মুগ্ধ করে।  এই দেবদাস ছবিটি দুর্দান্ত বাণিজ্যিক সাফল্য পায়।  বাংলাদেশের ফিল্ম আর্কাইভে এখনও এই দেবদাসের কিছুটা অংশ সংরক্ষিত রয়েছে।
শেষ দৃশ্যে প্রমথেশ বড়ুয়া দেবদাসের মৃত্যুর অভিনয়টি অনবদ্য করেন। জমিদার বাড়ির বন্ধ সিংহ দরজায় পার্বতীর আছড়ে পড়ার দৃশ্যে যমুনাও ছিলেন অসামান্যা। এই ছবির বাণিজ্যিক সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৩৬ সালে হিন্দিতে ‘দেবদাস’ নির্মাণ করেন বড়ুয়া। এতে দেবদাস , পারু ও চন্দ্রমুখী ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত অভিনেতা কুন্দলাল সায়গল, যমুনা ও রাজকুমারী। এটিও সফল হয়।  এরপর প্রমথেশ বড়ুয়া অহমিয়া ভাষায় ‘দেবদাস’ বানান ১৯৩৭ সালে তার পরিচালনায় অহমিয়া ভাষায় তৈরি ছবিটির তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেন ফণী শর্মা, জুবাইদা ও মোহিনি। এই ছবিটির সাফল্য ভারতের অন্যান্য ভাষাভাষীরা ‘দেবদাস’ তৈরিতে উৎসাহিত হয়।

প্রথম সবাক দেবদাস ছবিতে প্রমথেশ বড়ুয়া ও যমুনা দেবী

পরিচালক বেদান্তম রাঘোবৈঁয়া ১৯৫৩ সালে তেলেগু ও তামিল ভাষায় এই ছবিটি বানান। তিন চরিত্রে ছিলেন আক্কিনেনি নাগেশ্বর রাও, সাবিত্রী ও ললিতা। ছবিটির নাম ছিল ‘দেবদাসু’। ১৯৫৫ সালে বলিউডের বাঙালি পরিচালক বিমল রায় আবার হিন্দিতে দেবদাস বানানোর চিন্তা করেন। দেবদাস চরিত্রে অভিনয় করেন দিলিপ কুমার। তিনি চেয়েছিলেন পারুর ভূমিকায় মীনা কুমারী এবং চন্দ্রমুখীর চরিত্রে নার্গিস অভিনয় করুক, মীনা কুমারী ছবিটি করতে রাজিও ছিলেন। কিন্তু তার স্বামী কামাল আমরোহি এমন কিছু শর্ত দেন যা বিমল রায় মেনে নিতে পারেননি।

দেবদাসু মুভির পোষ্টার

নার্গিস চন্দ্রমুখীর ভূমিকা নিতে রাজি হননি। কারণ তার কাছে মনে হয়েছিল এটি দ্বিতীয় নায়িকার ভূমিকা। সুরাইয়াও সে কারণে চরিত্রটি প্রত্যাখ্যান করেন। তাই বিমল রায় উঠতি নায়িকা নৃত্যপটিয়সী বৈজয়ন্তি মালাকে প্রস্তাব দেন। তিনি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে চন্দ্রমুখীর চরিত্রে অভিনয় করেন। তখন বিমল রায়ের মনে হয় বাঙালি নারী পারুর ভূমিকায় একজন বাঙালিকেই নিতে হবে। সেসময় সুচিত্রা সেনের চেয়ে এত দক্ষ ও সুন্দরী নায়িকা আর কেউ ছিলোনা তাই তাকে পারুর ভূমিকায় নেন।
দিলিপ কুমার দেবদাসের ভূমিকায় অভিনয় করেন। হিন্দিভাষায় নির্মিত সেরা কাহিনিচিত্র হিসেবে দেবদাস ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। ফিল্ম ফেয়ার আসরে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান দিলিপ কুমার। চুণীলালের ভূমিকায় মোতিলাল পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান বৈজয়ন্তিমালা। কিন্তু তিনি পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তার মনে হয়েছিল চন্দ্রমুখী মোটেই পার্শ্ব-চরিত্র নয় বরং সুচিত্রা সেনের মতোই এ ছবির আরেক প্রধান নায়িকা ছিলেন তিনি।

১৯৭৪ সালে তেলেগু ভাষায় ‘দেবদাসু’ নির্মিত হয় বিজয়া নির্মলার পরিচালনায়। অভিনয় করেন ঘাট্টামানেনি কৃষ্ণা, বিজয়া নির্মলা (পারু) এবং জয়ন্তি। ১৯৭৯ সালে কলকাতায় দিলিপ রায়ের পরিচালনায় তৈরি করা হয় দেবদাস। অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় এবং সুপ্রিয়া দেবী। এ ছবিতে চুণীলাল হয়েছিলেন উত্তম কুমার।

ক্রসবেল্ট মানি ১৯৮৯ সালে মালায়াম ভাষায় দেবদাস পরিচালনা করেন। অভিনয় করেন বেনু নাগাবল্লী , পার্বতী এবং রামাইয়া কৃষ্ণা। বলিউডের পরিচালক সঞ্জয়লীলা বনসালী ২০০২ সালে দেবদাস ছবিটি বানান।এই ছবিতে দেবদাস ছিলেন শাহরুখ খান, পার্বতী ঐশ্বরিয়া রাই , চন্দ্রমুখী মাধুরী দিক্ষিত এবং চুণীলাল হন জ্যাকি শ্রফ। এই ছবিটির পেছনে প্রচুর পয়সা খরচ করা হয়। সেট, পোশাক, গানের চিত্রায়ন এবং গ্লামারের কারণে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার আগেই মানুষের মন কাডতে সক্ষম হয়। ছবি হয় সুপার-ডুপার হিট। ছবিটি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পাঁচটি পুরস্কার পায়, এবং ফিল্মফেয়ারে দশটি পুরস্কার জিতে নেয়।
এর মধ্যে সেরা ছবি, সেরা পরিচালনা, সেরা অভিনেতা ও সেরা অভিনেত্রী রয়েছে। পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান মাধুরী দীক্ষিত। ছবিটি কানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসা পায় এবং প্রথম ভারতীয় ছবি হিসেবে অস্কারে অংশ নেয়।

একই বছর হিন্দি ছবিটির আগে মুক্তি পায় কলকাতায় নির্মিত বাংলা ছবি ‘দেবদাস’। শক্তি সামন্ত পরিচালিত ছবিটিতে অভিনয় করেন প্রসেনজিৎ, অর্পিতা পাল এবং ইন্দ্রাণী হালদার। এখানে চুণীলালের ভূমিকায় ছিলেন তাপস পাল। অনুরাগ কাশ্যপের পরিচালনায় ২০০৯ সালে বলিউডে ‘দেভ ডি’ মুক্তি পায়। সেখানে দেবদাসের কাহিনীকে আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করা হয়। এতে অভিনয় করেন অভয় দেওল, মাহি গিল ও কালকি কোয়েচলিন। ব্ল্যাক কমেডি ড্রামা ঘরানার এ ছবিটিও ব্যবসাসফল হয়।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তানে উর্দু ভাষায় বানানো হয় ‘দেবদাস’।পরিচালক ছিলেন খাজা সারফারাজ। তিনটি প্রধান ভূমিকায় ছিলেন হাবিব তালিশ, শামীম আরা ও নায়ার সুলতানা। তখন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ চলছিলো কিন্তু ভারতীয় উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে ছবি বানাতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি।
২০১০ সালে আবার পাকিস্তানে ‘দেবদাস’ বানানো হয়। ইকবাল কাশ্মিরি পরিচালিত ছবিটিতে অভিনয় করেন নাদিম শাহ, জারা শেখ এবং মীরা।
২০১৩ সালে বাংলাদেশে চাষী নজরুল ইসলাম নতুনভাবে ‘দেবদাস’ ছবিটি বানান। দেবদাসের ভূমিকায় শাকিব খান, পার্বতী হন অপু বিশ্বাস এবং চন্দ্রমুখীর ভূমিকায় মৌসুমী।শহীদুজ্জামান সেলিম হন চুণীলাল। এই ছবিটি বক্স-অফিসে সফল হয়।

দেবদাস উপন্যাসে শরৎচন্দ্রের এই কথাগুলি হৃদয়বিদারক-

শুধু দেবদাসের জন্য বড় কষ্ট হয়৷ তোমরা যে-কেহ এ কাহিনী পড়িবে, হয়ত আমাদেরই মত দুঃখ পাইবে৷ তবু যদি কখনও দেবদাসের মত এমন হতভাগ্য, অসংযমী পাপিষ্ঠের সহিত পরিচয় ঘটে, তাহার জন্য একটু প্রার্থনা করিও৷ প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হউক, যেন তাহার মত এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে৷ মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহকরস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে- যেন একটিও করুনার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়৷ মরিবার সময় যেন কাহারও একফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে৷’ এ ভাবেই শরত্‍বাবু শেষ করেছেন তাঁর উপন্যাস, দেবদাসের কাহিনি৷ নায়কের জন্য লেখকের করুণার অন্ত নেই৷
মৃত্যুর আগে দেবদাস পারুর দরজা পর্যন্ত আসলেও পৌঁছাতে পারেনি তার পার্বতীর কাছে, তার শেষ স্পর্শটুকুও পায়নি । এই করুন ট্র্যাজেডি দেবদাসকে অমর করে রেখেছে। আর তাই রুপালী পর্দায় বারে বারে ফিরে এসেছে দেবদাস- পার্বতীর প্রেম।