১৯৫০ সালের কাছাকাছি কোনো এক সময়। ঢাকার বাবুপুরার ‘আল-কাউসার’ দালানে একটি ঘরে মুখোমুখি বসে আছেন দুজন ব্যক্তি। এদের একজন হলেন ঢাকার অন্যতম বনেদী পরিবারের সন্তান। এটা তারই বাসা। বনেদী পরিবারের বলে তার সংগ্রহশালা ছিলো অ্যান্টিক কালেকশানে সমৃদ্ধ। সবটাই ছিলো তার শখ। নিজের বিশাল সংগ্রহ নিয়ে ভীষণ গর্ববোধও করতেন তিনি। আরেকজন হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ও ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর। ভীষণ ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারা দুজন। ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাতও এই ঢাকা এবং তার ঐতিহ্য। কথায় আছে না, মনের মিল না হলে বন্ধু হওয়া যায় না। দুজনেরই ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি অদ্ভূত এক টান রয়েছে। এ কারণেই সামান্য পরিচয় রূপ নিয়েছে বন্ধুত্বে। তবে বন্ধুত্ব গাঢ় হলেও ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর আজ এ বাসায় এসেছেন বিশেষ এক উদ্দেশ্য নিয়ে। মনে মনে তিনি ভীষণ চিন্তিত। তিনি জানেন না, বন্ধুকে তিনি তার কথায় রাজি করাতে পারবেন কি না। গল্প করতে করতে অবশেষে বলেই ফেললেন, বন্ধুর সমস্ত অমূল্য সংগ্রহ দিয়ে জাদুঘরকে পরিপূর্ণ করতে চান তিনি। শুনে চোখ বড় বড় করে বসে রইলেন বন্ধু। না না, এ হতেই পারে না। সাফ জানিয়ে দিলেন, এতো দিনের সংগ্রহ কিছুতেই হারাতে পারবেন না তিনি। কিন্তু তিনি জানতেন না, তার কিউরেটর বন্ধু এতো সহজে হাল ছাড়বার পাত্র নন, একদিন তিনি ঠিকই প্রিয় বন্ধুকে রাজি করিয়ে ছাড়বেন। সেই অমূল্য সংগ্রহশালার মালিক আর কেউ নন, ঢাকার ইতিহাসের অন্যতম লেখক ও পুরাতত্ত্ব সংগ্রাহক সৈয়দ মুহম্মদ তৈফুর। আর তার সেই একগুঁয়ে বন্ধুটি হলেন পাকিস্তানি প্রত্নতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রফেসর আহমেদ হাসান দানী।
আহমেদ হাসান দানীর আদি নিবাস কাশ্মীর। ১৮৫০ সালের দিকে ছত্রিশগড়ে পাড়ি জমায় তার পূর্বপুরুষ। ভীষণ মেধাবী এই তরুণ পর্যায়ক্রমে গ্রাম্য পাঠশালা, মার্কিন মিশনারি কলেজ, নাগপুর কলেজ, বেনারস হিন্দু কলেজ ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। শিক্ষা জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই তিনি ছিলেন সর্বেসর্বা। ইতিহাসে মাস্টার্স করেছেন বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে গড়েছিলেন রেকর্ড মার্কস, যেই রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারে নি।
জীবনের শুরুর দিকে মার্টিমার হুইলারের সঙ্গে দানী কাজ করেছেন হরপ্পা, তক্ষশীলা ও অখন্ড ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায়। রীতিমতো চষে বেড়িয়েছেন সমগ্র ভারতবর্ষ। ১৯৪৫ সালে হুইলারের সহকর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে। এরপর এলো ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ সাল। হঠাৎ-ই বেজে উঠলো ভারত বিভাগের দামামা। র্যাডক্লিফের আঁকা রেখার ভিত্তিতে খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেলো পুরো ভারতবর্ষ। ২৬-২৭ বছর বয়সী টগবগে এক যুবক তখন দানী। সে সময় দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন তিনি। বিভক্ত ভারতের পাকিস্তান অংশে স্বেচ্ছায়ই যেতে চাইলেন তিনি। তাকে বদলি করা হলো পূর্ব বাংলায়। প্রায় ১৪ বছর যাবৎ পূর্ব বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছেন দানী। বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়াটিক সোসাইটি ও জাদুঘরে তার অবদান ভুলবার মতো নয়। আর ঢাকাকে জানতে হলে তো তার বই না পড়লেই নয়।
ভারতবর্ষ ভাগের পর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সুপারিনটেনডেন্ট শামসুদ্দীন আহমদ এবং সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট আহমেদ হাসান দানীকে দায়িত্ব দেয়া হলো রাজশাহী প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের। ট্রেনে চড়ে বসলেন দুজন রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। ঝিকঝিক শব্দ করে চলছে ট্রেন, গাছপালা ও পরিচিত রাস্তাগুলো সব যেনো দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, আর ট্রেনের জানালার পাশে বসা শামসুদ্দীন আহমদ ও দানীর মনে উঁকি দিচ্ছে নানান শঙ্কা। এমনিতেই সরকারেরে সবচেয়ে অবহেলিত দপ্তর হলো প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, তার উপর দেশভাগের কারণে সবখানেই এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। এক অজানার উদ্দেশ্যেই তো তাদের এই যাত্রা। চিরচেনা পথ-ঘাট সমস্তই তো ফেলে এসেছেন পেছনে। কিছুটা বিদেশ ভ্রমণের স্বাদ পাচ্ছেন দানী। তবে এই বিদেশ যাত্রা কতোটা সুখকর হবে, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন।
অবশেষে দানীরা পৌঁছে গেলেন রাজশাহী। পৌঁছেই বুঝতে পারলেন, তাদের মনের শঙ্কা অমূলক ছিলো না। কোনো অফিসের নাম-গন্ধ তো নেই-ই, এমনকি নেই কোনো থাকার জায়গাও। দানীদের জীবনে একটি স্মরণীয় রাত হয়ে থাকলো পূর্ব বাংলায় নিয়োগ পাওয়ার প্রথম রাতটি। নিরুপায় হয়ে বরেন্দ্র জাদুঘরের বারান্দায় মশা ও পোকামাকড়ের কামড়ে জর্জরিত হয়ে কোনোমতে সেই রাতটি পার করলেন তারা। বহু কষ্টের সেই রাতের পর থেকে পনেরো দিনের জন্য ঠাঁই মিললো রাজশাহীতে বাস করা শামসুদ্দীন আহমদের এক আত্মীয়ের বাসায়। আর কাজ করার একমাত্র উপাদান হিসেবে রাজশাহীর কমিশনারের কাছ থেকে দানী পেলেন একটি টাইপরাইটার। পনেরো দিন পর অবশ্য অফিসের জন্য এবং থাকবার জন্য একটি বাসা পেয়েছিলেন তিনি। সে যা-ই হোক, বাসা পাবার এক মাস পর প্রথম বার ঢাকায় আসেন দানী। সঙ্গে ছিলেন শামসুদ্দীন আহমদ। দানী তখনও জানতেন না, তার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সঙ্গে এই ঢাকা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকবে।
ঢাকায় আসার পর শামসুদ্দীন আহমদ উঠলেন একটি মেসে এবং দানী আশ্রয় নিলেন গুলিস্তানের মোড়ে রমনা রেস্ট হাউজে। মুনতাসীর মামুনের কাছে দানী জানিয়েছেন তখনকার ঢাকার চেহারা কেমন ছিলো। ঢাকা ছিলো একটি ছোট্ট শহর। আসলে সে সময়ের ঢাকার চেহারা অনেকটা গ্রামের মতোই ছিলো। মানুষ এবং যানবাহন দুটোই ছিলো সংখ্যায় কম। শুধু কিছুটা গমগমে ছিলো পুরনো ঢাকার নওয়াবপুর এলাকা। তোপখানা ও পুরনো পল্টনে সবেমাত্র গুটিকয়েক নতুন ঘর-বাড়ি গড়ে উঠতে শুরু করেছে। মতিঝিল তো ছিলো ফাঁকা মাঠ। বঙ্গভবনের জায়গায় ছিলো ছোট্ট একটি দালান। সেখানে তখন গভর্নর ফ্রেডারিক বোর্ন থাকতেন।
ঢাকার ধানমন্ডির এক চমৎকার বর্ণনা পাওয়া গেছে আহমেদ হাসান দানীর ভাষ্যে। ধানমন্ডি তখন একটি জংলা এলাকা ছাড়া কিছুই ছিলো না। সাইকেলে করে কিছুদূর যাবার পর পায়ে হাঁটা রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলের মতো একটি জায়গায় ছিলো সাতমসজিদ। জায়গাটি এতো নির্জন ছিলো যে, নামাজ পড়তেও সেখানে কেউ আসলে যেতো কিনা সেই বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। শুধু একজন ফকির থাকতেন সেখানে। মুঘল আমলের একটি পুরনো সাঁকো ছিলো ধানমন্ডির ঈদগাহের কাছে।
ঢাকায় আসার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডারশীপের অফার পেলেন দানী। আবার এরই মধ্যে পরিবারের সবাই অমৃতসর ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন। এ কারণে পূর্ব বাংলায় কিছুতেই মন টিকছিলো না দানীর। রিডারশীপের প্রস্তাবও তিনি ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত। বার বার পদত্যাগপত্র দিতে থাকলেন এবং বার বারই বাতিল হতে থাকলো সেটি। হুইলারের নির্দেশে আবারো কিছুদিন তিনি কাজ করলেন তার সঙ্গে এবং হুইলারের ‘ফাইভ থাউজ্যান্ড ইয়ারস অফ পাকিস্তান’ বইয়ের জন্য দিনরাত ফিল্ডওয়ার্ক করে রিপোর্ট পাঠাতেন তাকে। এরই মাঝে বিয়ে করলেন দানী। কিন্তু সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীকে চলে যেতে হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। এক বান্ধবীর সঙ্গে থাকতে হচ্ছিলো তাকে। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি পদত্যাগপত্র গৃহীত হবার অপেক্ষা না করেই পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। কিন্তু ঢাকার সাথে এক বন্ধন তো তার ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়কার ভিসি ড. মোয়াজ্জেম হোসেন সরাসরি দেখা করলেন দানীর সঙ্গে এবং দেশভাগের বিশৃঙ্খল সময়ে পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে কিছুটা মরিয়া হয়েই আটশো টাকা বেতনে তাকে নিয়োগ দিলেন ইতিহাস বিভাগের রিডার হিসেবে। সেই সাথে মিললো এক মাসের ছুটি এবং ঢাকায় স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে থাকবার সুযোগ। হতভম্ব আহমেদ হাসান দানী ছুটির সময়টা পশ্চিম পাকিস্তানে পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে আসলেন ঢাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডারশীপের পাশাপাশি ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটরের দায়িত্বও দেয়া হলো দানীকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মুসলমান যুগের ইতিহাস পড়াতে পড়াতেই দানী লিখে ফেললেন ‘আর্লি মুসলিম কন্ট্যাক্ট উইথ বেঙ্গল’। হঠাৎ করেই প্রবল আগ্রহ বোধ করলেন তিনি বাংলার ইতিহাসকে ঘিরে। তার কাছে মনে হতে লাগলো, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় নি। ভেবে ফেললেন দানী, বাংলার ইতিহাসের ওপর কাজ করবেন তিনি। কাজের সুবিধার্থে আগে থেকেই অনেকগুলো ভাষায় পারদর্শিতা ছিলো তার। ইংরেজি, সংস্কৃতি, হিন্দি, মারাঠি, কানাড়ি, অহম, তামিল, গুজরাটি –প্রতিটি ভাষাই শিখেছিলেন দানী। এবার আয়ত্ত করে নিলেন বাংলা, আরবি এবং ফারসি ভাষাও। দানী রাতারাতি এতো দ্রুততার সাথে সব ভাষা আয়ত্ত করতেন যে, তার ফারসি ভাষার শিক্ষক রীতিমতো তার কাছ থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন। সংস্কৃত ভাষায় তার দক্ষতার জন্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাকে ভীষণ পছন্দ করতেন।
ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর হবার পর দানী ভিসি মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছে জাদুঘরের সংগ্রহ সম্পর্কে জানতে চাইলে ভিসি তাকে জানালেন, জাদুঘরে অল্প কিছু মূর্তি এবং সোনা ও রূপার গুটিকয়েক মুদ্রা ছাড়া আর কিছুই নেই। ভিসির কথা বলার ধরনেও ছিলো বেশ অবজ্ঞার সুর। বোঝাই যাচ্ছিলো, এলিট শ্রেণির মানুষদেরই জাদুঘর বিষয়ে তেমন আগ্রহ নেই। সুতরাং সাধারণ মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি হবেই বা কি করে?
পুরনো ঢাকার নিমতলীতে নায়েব-নাজিমদের প্রাসাদের পুরনো ফটকে ছিলো তখন জাদুঘরের অফিস। আর একটি পুরনো দালানে রাখা ছিলো তার গুটিকয়েক সংগ্রহ। সেই সংগ্রহশালার সামনে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নলিনীকান্ত ভট্টশালী নারকেল গাছ দিয়ে তৈরী করেছিলেন একটি বৃত্ত, আর প্রতিটি গাছের নিচে রাখা ছিলো একটি করে মূর্তি। এই ব্যাপারটিই সবচেয়ে বেশি পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ালো ঢাকার মুসলমান সমাজের কাছে। জাদুঘরের ঠিক বিপরীত দিকেই ছিলো উদ্বাস্তু মুসলমানদের বস্তি। দেশভাগের সেই সময়টাতে ভূমিহারা সেসব মানুষদের মানসিক পরিস্থিতি এমনই ছিলো যে, তাদের মধ্যে হিন্দুবিদ্বেষের রেশ ক্রমাগত বেড়ে চলা ছিলো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এমনকি জাদুঘরের সংগ্রহশালার সামনের মূর্তিসমেত সেই বৃত্তটি ভেঙ্গে ফেলারও পরিকল্পনা চলছিলো তাদের মাঝে। বিষয়টি জানার পর প্রথমবারের মতো দানী উপলব্ধি করলেন, জাদুঘরের ব্যবস্থাপনায় যতো দ্রুত সম্ভব পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে, জাদুঘরের প্রতি সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করবার একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ। তিনি জাদুঘরকে মুসলিম নিদর্শন দিয়ে সমৃদ্ধ করার ইচ্ছার কথা জানালেন ভিসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে। ভিসিকে অবাক করে দিয়ে বললেন, “আই ওয়ান্ট টু ইসলামাইজ দ্য মিউজিয়াম”।
বেশ গভীরভাবে ভাবলেন দানী বিষয়টিকে নিয়ে এবং প্রথমেই সংগ্রহশালার সামনের সেই বৃত্তটিকে ভেঙ্গে ফেললেন তিনি। মূর্তিগুলোকেও জাদুঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। এতে কিছুটা স্বস্তি পেলো উদ্বাস্তু মুসলমানেরা। তাদের রাগও খানিকটা কমলো। এবার জাদুঘরকে ইসলামিক ঐতিহ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করবার পালা। কিন্তু ইসলামী নিদর্শন চাইলেই তো পাওয়া যায় না। তার জন্য চাই টাকা। কিন্তু এমন দুর্দিনে যেখানে মানুষেরই বাঁচা-মরার প্রশ্ন চলে আসে, সেখানে সবার অনাগ্রহের পাত্র জাদুঘরের আর্থিক সঙ্গতি ভালো হবে কি করে? সুতরাং আবারো দানী পড়লেন ভীষণ দুশ্চিন্তায়।
এরই মধ্যে সংবাদপত্রগুলোতে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেছিলেন দানী। সেই সূত্রেই এক দিন তার পরিচয় হলো সৈয়দ মুহম্মদ তৈফুরের সঙ্গে। শুধুমাত্র পরিচয়ে সীমাবদ্ধ থাকে নি সেই সম্পর্ক, পরিণত হয়েছিলো সখ্যতায়। তৈফুরের বিশাল সংগ্রহশালার কথা তো আগেই বলেছি। ইসলামী নিদর্শন সংগ্রহের প্রচেষ্টা থেকেই দানী তৈফুরকে অনুরোধ করেছিলেন তার সংগ্রহগুলো জাদুঘরকে দান করে দিতে। এতে প্রথমে তৈফুরের প্রবল আপত্তি থাকলেও পরবর্তীতে তিনি ঠিকই রাজি হয়েছিলেন দানীর অনুরোধে। তৈফুরের সে সিদ্ধান্ত দানীকে ভীষণভাবে সহায়তা করেছিলো। সেই সময়ের হিসেবে প্রায় দুই লক্ষ টাকার সংগ্রহ তৈফুর দান করেছিলেন জাদুঘরে।
তৈফুরের সংগ্রহ পেয়েই কাজে নেমে পড়লেন দানী। জাদুঘরের দরজার ওপর লেখা হলো, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’। আর জাদুঘরেই ঢুকতেই প্রথম যে গ্যালারি, তাকে পরিণত করা হলো ইসলামিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ প্রধান গ্যালারিতে। এরপরে রাখা হলো বৌদ্ধ ও হিন্দু নিদর্শনগুলোকে। শুধু তা-ই নয়, বিশেষ বিশেষ সময়ের হিসেবে সাজানো হলো জাদুঘরকে। শিক্ষণীয় এক আবেশ তৈরী হলো প্রতিটি গ্যালারির সজ্জার মাঝে।
নতুন রূপে গড়ে ওঠা জাদুঘর দেখে ভীষণ খুশি হলো সাধারণ মুসলমানেরা। অবহেলিত জাদুঘর পরিণত হলো ঢাকাবাসীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। তৈফুরের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্র ধরে এবং ঢাকা নিয়ে দানীর লেখালেখি প্রবল জনপ্রিয়তা পাওয়ায় ঢাকার আরো অনেক বনেদী পরিবারের সাথে উঠা-বসা শুরু হলো দানীর এবং জাদুঘরের প্রতি দানী মানুষকে এতোটাই আগ্রহী করতে পেরেছিলেন যে তাদের অনেকেই নিজস্ব সংগ্রহগুলো জাদুঘরে দান করে দিয়েছিলো। এদের মধ্যে একজন ছিলেন বেচারাম দেউড়ির আবুল হাসনাত। তৈফুরের মাধ্যমেই তার সাথে পরিচয় হয় দানীর। তার সংগ্রহে থাকা অমূল্য কিছু চিত্র দেখতে দানী গিয়েছিলেন তার বাসায়। দানীকে অবাক করে দিয়ে আবুল হাসনাত তার সেই অমূল্য চিত্রশিল্পগুলো তাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই রাতে এতো এতো ঢাকাই খাবারের আয়োজন আবুল হাসনাত করেছিলেন যে, দানীর মনে হয়েছিলো তিনি কোনো নবাবের বাড়িতে খেতে এসেছেন।
একই ভাবে নওয়াব আব্দুল লতিফের আচকান, চিঠিপত্র, অস্ত্রশস্ত্র, মোহামেডান লিটারেরী সোসাইটির সমস্ত প্রসিডিংস জাদুঘরকে দান করে দিলেন আব্দুল লতিফের নাতি কাজী সাহেব। তারপর দান করলেন হাকিম হাবিবুর রহমান। মানুষের মধ্যে হঠাৎ করেই ব্যক্তিগত সংগ্রহ জাদুঘরকে দান করে দেবার এক অদ্ভূত আগ্রহ তৈরী হলো। আসলে দানীর মুসলিম ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রচেষ্টা তখনকার মানুষকে ভীষণ আবেগপ্রবণ করে তুলেছিলো। খবরের কাগজ ও সংবাদপত্রে দানীর নিয়মিত লেখাগুলো তাকে ‘ভিন্নভাষী ঢাকাপ্রেমী’ হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। আর এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ কোনো মিটিং-এ আর কারো ডাক পড়ুক বা না পড়ুক, দানীকে উপস্থিত থাকতেই হতো। দানী তখন ঢাকাবাসীর কাছে এক আবেগানুভূতির নাম। মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খান দানীর লেখাগুলো অনুবাদ করে করে তার ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় প্রকাশের ব্যাপারে ভীষণভাবে সচেষ্ট থাকতেন। ‘পাকিস্তান অবজারভার’ –এও বহু লেখা ছাপা হয়েছে দানীর।
কোলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে কাজ করেছিলেন দানী। ঢাকায় থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে তিনি অনুভব করলেন, এ শহর বড্ড সাদামাটা! জ্ঞানচর্চার জন্য উপযুক্ত কোনো ক্ষেত্র এখন অবধি তৈরী হয় নি এখানে। আর ভারতে এশিয়াটিক সোসাইটি থাকলে পাকিস্তানে কেনো হবে না? এসবই ভাবতে ভাবতে মরিয়া হয়ে উঠলেন দানী। এশিয়াটিক সোসাইটি গড়ার জন্য প্রস্তাব দিলেন তিনি ভিসির কাছে। ভিসি সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামিদের সঙ্গে মিটিং-এ বসলেন এই বিষয়ে কথা বলার জন্য। মন্ত্রীও সাগ্রহে রাজি হলেন। এভাবেই দানীর উদ্যোগে শুরু হলো ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অফ পাকিস্তান’ এর কাজ। বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও সম্পাদক হিসেবে দানীর নামই প্রস্তাব করা হলো। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে নতুন এক যাত্রা শুরু হলো আহমেদ হাসান দানীর জীবনে।
এশিয়াটিক সোসাইটির যাত্রা শুরু হবার পর দানীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠলো বোর্ড অফ রেভেনিউ এর সদস্য এস. এম. ইকরামের সঙ্গে। সেই সূত্র ধরেই এশিয়াটিক সোসাইটির অফিস দেখতে আসলেন অর্থসচিব মমতাজ হাসান। দানী খোঁজ নিয়ে জানলেন মমতাজ হাসানের আগ্রহের মূল বিষয়বস্তু ‘সাহিত্য’। তখন এশিয়াটিক সোসাইটির কোনো আলাদা অফিস ছিলো না। দানীর জাদুঘরের অফিসেই হতো এর কাজ। দানী নিজের অফিসের একটি আলমারি খালি করে জাদুঘরের কিছু পান্ডুলিপি দিয়ে ভরে ফেললেন সেটিকে। আর তাতে নাম লিখে দিলেন ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’। অর্থসচিব সেই পান্ডুলিপিগুলো দেখে মুগ্ধ হলেন এবং প্রথমে পাঁচ হাজার ও পরে আবারো দশ হাজার টাকা অনুদান দিলেন তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির জন্য। সেই টাকা ব্যবহার করে দানীর উদ্যোগে ‘সওগাত’ প্রেসে প্রকাশিত হলো এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নাল। এভাবেই আস্তে আস্তে ডালপালা মেলতে শুরু করলো বর্তমান বাংলাদেশের এক অন্যতম জ্ঞান বিনিময়ের ক্ষেত্র ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’।
সেই সময়ের গভর্নর ফিরোজ খান নুনের স্ত্রী লেডি নুন জাদুঘরের নিদর্শনগুলো দেখতে গেলেন এবং দানীকে অনুরোধ করলেন, ঢাকার ওপর একটি বই লেখা হোক। তৈফুর এবং দানীর মিলিত প্রচেষ্টায় শুরু হলো ঢাকার ওপর বই লেখার কাজ। জাদুঘর, বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয়াটিক সোসাইটির কাজের পাশাপাশি দানী শুরু করলেন ঢাকার ইতিহাস উন্মোচন ও ঢাকার তথ্য সংগ্রহের কাজ। প্রচুর পরিশ্রম করলেন দানী এবং অল্প দিনেই শেষ করলেন বইয়ের কাজ। ১৯৫২ সালের ইতিহাস সম্মেলনে বের করতে চেয়েছিলেন তিনি বইটি। কিন্তু বই বের করার জন্য ভালো প্রেস এবং টাকা-দুটোরই খুব অভাব ছিলো। অবশেষে ১৯৫৭ সালের ইতিহাস সম্মেলনে মোঃ নাসিরউদ্দীনের উদ্যোগে ‘সওগাত’ প্রেসে বই ছাপা হলো। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কামরুল হাসান। বইটির নাম ‘ঢাকাঃ আ রেকর্ড অফ ইটস চেঞ্জিং ফরচুনস’।
এরই মধ্যে ইংল্যান্ড থেকে পিএইচ.ডি. করে ১৯৫৫ সালে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন দানী। এরপর আবারো শুরু করলেন বাংলার ঐতিহ্য রক্ষার কাজ। ঘুরতে শুরু করলেন সমগ্র বাংলাদেশ। আর এই যাত্রায় তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন তার ছাত্র ড. এনামুল হককে। এনামুল হক তখন মাত্র পাস করে বেরিয়েছেন, তখনও কোনো চাকরি করেন না তিনি। পরবর্তীতে জাদুঘরের মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন ড. হক।
১৯৬১ সাল থেকে ঢাকায় শুরু হলো এক অস্থির অবস্থা। কারফিউ লেগেই থাকতো। এমন অবস্থায় দুঃশ্চিন্তায় দিনযাপন করতে লাগলেন দানী। এদিকে পরিস্থিতির কারণে কোনো কাজও করতে পারছিলেন না। কিন্তু শুয়ে-বসে সময় কাটানোর লোক ছিলেন না দানী। একদিন নিজের বাসার বারান্দায় বসে বসে কি করবেন এসবই ভাবছিলেন দানী। হঠাৎ একটি চিঠি এলো। পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছ থেকে এসেছে সেই চিঠি। পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খোলা হয়েছে এবং স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকার প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ আহমেদ হাসান দানীকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন।
অবশেষে ১৯৬২ সালে বহু স্মৃতি বিজড়িত ঢাকা ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলেন দানী। বাংলা এবং বিশেষ করে ঢাকার প্রতি আহমেদ হাসান দানীর অবদান বলে শেষ করা সম্ভব নয়। বাংলা ভাষাকে তিনি একদম নিজের করে নিয়েছিলেন। এতোটাই দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছিলেন যে, বাংলায় অনর্গল কথা চালিয়ে যেতে তার কখনো সমস্যা হয় নি। আর এভাবেই সাধারণের সাথে তার যোগাযোগ তো সহজ হয়েছিলোই, বাঙালিদের অতি আপনজনেও পরিণত হতে পেরেছিলেন দানী। হয়েছিলেন সবার স্নেহের পাত্র। তবে মুনতাসীর মামুনের কাছে তিনি ভীষণ দুঃখ নিয়ে বলেছিলেন যে, তার ওপর এবং তার কাজের ওপর করা এতো এতো ডকুমেন্টারীতেও কোনো দিন ঢাকায় অতিবাহিত করা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি কখনোই উঠে আসে নি। কখনো আলোচিত হয় নি ঢাকায় করা তার অমূল্য কাজগুলো। এ কেমন বিচার! হয়তো পূর্ব বাংলার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যই দানীর এই নিদারুণ কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এবার দায়িত্ব আমাদের হাতে। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে যারা প্রাণ দিয়ে গেছেন, তাদের এবং তাদের অবদানকে আমরাই তুলে আনবো বিশ্ববাসীর সামনে।