প্রত্যেক যুগেই কোনো না কোনো বিপ্লবী নেতাকে সবসময়ই হতে হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার বলি। বিশ্বাসঘাতকতা যেনো রক্তে মিশে আছে এই উপমহাদেশে। ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া গুটিকয়েক নাম ছাড়া অসংখ্য সাহসী বীরের নামই কালের অতলে হারিয়ে গেছে, বিশেষ করে সেই নাম যদি কোনো উপজাতির হয়ে থাকে, তবে তার কথা তুলে ধরার তো কোনো প্রয়োজনই আমরা মনে করি না। কিন্তু সময় এসেছে সে সব নামকে আবারো প্রতিষ্ঠা করে তাদের যথাযথ সম্মান ফিরিয়ে দেবার, তাদেরকে যোগ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করবার।
১৮৩৫ সালের ১৭ জুলাই। ঢাকা কারাগারের ভেতর এক ধরনের নীরব অস্থিরতা বিরাজ করছে। শেষ প্রহর গুণছেন একজন বন্দী। না, ইনি যেনোতেনো কোনো বন্দী নন, ইনি একজন বীর, একজন বিদ্রোহী। তার চারিত্রিক দৃঢ়তা কারাগারের আঁধারেও এনে দিয়েছিলো আলোকছটা। তাই তো সুদূর মেঘালয় থেকে আসা এই বিদ্রোহী বীরকে এখানেও সবাই ভীষণ শ্রদ্ধা করতো ও ভালোবাসতো। সারাজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও স্বজাতির স্বার্থে লড়ে যাওয়া বিদ্রোহী এই বীর নেতা হঠাৎ পেটের ব্যথায় প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে নিজের জন্মভূমি থেকে অনেক দূরে ঢাকা কারাগারের ভেতর ত্যাগ করেছিলেন তার শেষ নিঃশ্বাস।
১৮০২ সাল। সিলেট থেকে শুরু করে গুয়াহাটি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের ঠিক মাঝামাঝিতে শিলং এর কাছাকাছি একটি অঞ্চল হলো নংখলৌ। খাসি পাহাড়ের অধীনে এই নংখলৌ অঞ্চলেরই একটি ঘরে প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছেন কাকসান সিয়েম (খাসিয়া বা খাসি উপজাতিদের অঞ্চলভিত্তিক প্রধানদেরকে ‘সিয়েম’ বলা হয়)। একটু পরই কাকসানের আর্তনাদকে ছাপিয়ে ভেসে এলো শিশুর কান্নার আওয়াজ। পৃথিবীর বুকে আগমন হলো সংগ্রামী এক বিশেষ ব্যক্তিত্বের, যিনি হতে যাচ্ছেন ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা ও বীরত্বের মূর্ত প্রতীক। অপ্রধান খাসিয়া জনগোষ্ঠীর মাঝে আবির্ভূত হওয়া বিশেষ এই শিশুর নাম রাখা হয়েছিলো ‘ইউ তিরোত সিং’।
১৮২৬ সাল। বর্তমান ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মানুষেরা মাত্রই একটি কঠিন সময় কাটিয়ে উঠেছে। পুরো অঞ্চল জুড়ে বিরাজ করছে হঠাৎ পেয়ে বসা এক ধরনের স্থিরতা। করবেই বা না কেনো? দীর্ঘ চার বছর পর ইয়ান্ডাবো চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার মাধ্যমে শেষ হয়েছে অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধ। তবে এটি কি আসলেই একটি শান্তিপূর্ণ জীবনের সূচনালগ্ন, নাকি আরো বিশাল কোনো দুর্যোগের আভাস? সেখানকার মানুষের কাছে তখনও এই বিষয়টি পরিষ্কার ছিলো না।
অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধের সমাপ্তি আসাম এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চলগুলোতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রবেশকে সহজ করে দিয়েছিলো। সে সময় শিলচর থেকে দক্ষিণে সিলেট ও উত্তরে সিকিম পর্যন্ত পুরো পূর্ব সীমান্তের গভর্নর জেনারেলের এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ডেভিড স্কট। সেই সাথে তিনি উত্তর-পূর্ব রংপুরের বিশেষ সিভিল কমিশনার এবং সিলেট জেলার সার্কিট ও আপিলের বিচারক হিসেবেও দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। এ কারণে সিলেট থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত (প্রায় ২৩০ কিলোমিটার) সবচেয়ে কম সময়সাপেক্ষ একটি রাস্তা তৈরীর দায়িত্ব ডেভিড স্কটকেই নিতে হয়েছিলো। জনসাধারণকে জানানো হলো, ম্যালেরিয়া আক্রান্ত অঞ্চলের ভ্রমণের সময় কমানোর জন্যই এই রাস্তা তৈরীর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এতো গুরুত্বারোপ করা এই রাস্তা নির্মাণের পেছনে ব্রিটিশদের এতো সাবলীল উদ্দেশ্য থাকা কি করে সম্ভব? নাকি এর পেছনে আছে স্বার্থান্বেষী কোনো ষড়যন্ত্র?
সিলেট এবং গুয়াহাটিকে সংযোগকারী রাস্তাটি যাবে মেঘালয়ের মধ্য দিয়ে। আর তাই রাস্তা নির্মাণের আগে সেখানে বসবাসরত সম্প্রদায়কে রাজি করানোটা খুবই জরুরি। কিন্তু প্রায় পচিশ-ছাব্বিশ জন সিয়েমের রাজত্ব চলছে পুরো এলাকা জুড়ে। এই অবস্থায় পাহাড়-জঙ্গলঘেরা এই দুর্গম এলাকায় প্রতিটি সিয়েমের কাছে পৌঁছানো এবং তাদেরকে আলাদা আলাদাভাবে রাজি করানো ভীষণ ঝামেলাপূর্ণ মনে হয় চল্লিশ বছর বয়সী ডেভিড স্কটের। তাই তিনি এমন একজন সিয়েমকে খুঁজে বের করলেন, যাকে অন্য সবাই মান্য করে, যার কথা সবাই শোনে। এই সিয়েমই হলেন খাসি পাহাড়ের খাদস্বফরা এলাকার নংখলৌ এর ইউ তিরোত সিং।
শান্ত, সাহসী, সরল ও হাসিখুশি বিশ বচর বয়সী ইউ তিরোত সিং ছিলেন সবার প্রিয় মানুষ। তার মা কাকসান সিয়েমকেও সব সিয়েমরাই শ্রদ্ধা করতেন। ইউ তিরোত সিং ছিলেন মায়ের ভক্ত। মায়ের কাছে সময় কাটাতেই তার ভালো লাগতো। কিন্তু তার মা আবার পাহাড়ের চেয়ে সমভূমিতে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। কিন্তু সিয়েমের দায়িত্ব ফেলে সমভূমিতে বাস করা তো সম্ভব না। তাই কাকসান সিয়েম সমভূমিতে বাস করলেও তিরোত সিং মাঝেমধ্যেই নংখলৌ থেকে মায়ের কাছে গুয়াহাটিতে চলে আসতেন। আর মায়ের সুবাদে হোক অথবা তার ব্যক্তিগত গুণের কারণে হোক, ইউ তিরোত সিংকে অন্যান্য সিয়েমরাও বেশ সমীহ করতেন। তাই বুঝে শুনে এই সুযোগটা কাজে লাগান ডেভিড স্কট। তিনি গুয়াহাটিতে তিরোত সিং আর কাকসান সিয়েমের সঙ্গে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ শুরু করেন। তিনি ধারাবাহিকভাবে ইউ তিরোত সিং আর তার মাকে বোঝাতে থাকলেন যে, গুয়াহাটি থেকে সিলেট হয়ে ঢাকা পর্যন্ত একটা সড়ক তৈরী করলে পাহাড়ের জনজীবনে কি কি সুবিধা হবে এবং শেষ পর্যন্ত তিনি সফলও হলেন। এরপর বুঝে হোক কিংবা না বুঝে হোক, ডেভিড স্কটকে একদিন ইউ তিরোত সিং জানিয়ে দিলেন যে তার পক্ষে একা এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়, এই ব্যাপারে আন্য সব সিয়েমের মতামত নেয়া জরুরি। ডেভিড স্কটও রাজি হয়ে গেলেন। ইউ তিরোত সিং-এর উদ্যোগে নংখলৌতে খাসি, জয়ন্তিয়া ও গারো পাহাড়ের সব সিয়েমদের একটি সাধারণ অধিবেশনের আয়োজন করা হলো। এই নংখলৌ বর্তমানে মেঘালয়ের পশ্চিম খাসি পাহাড়ের নংস্টিন উপজেলার একটি গ্রাম; শিলং থেকে বড়জোর ৬৩ কিলোমিটার এবং গুয়াহাটি থেকে ১০১ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। ব্রিটিশরা এই পথটাকেই বেছে নিয়েছিলো, কারণ এটাই ছিলো সিলেট পথে অর্থাৎ বাংলার শেষ সীমানা পর্যন্ত সবচেয়ে দ্রুততম সড়ক। ডেভিড স্কট এই অধিবেশনের দর্শক হিসেবে নিজে উপস্থিত থাকার প্রস্তাব দিলেন। তিরোত সিং-ও আপত্তি করলেন না।
দিনটি ছিলো ১৮২৬ সালের ৩ নভেম্বর। দরবারে উপস্থিত হয়ে ডেভিড স্কট রীতিমতো অবাক হয়ে যান। স্কটল্যান্ডে জন্ম নেয়া ডেভিড স্কট ধারণা করা তো দূরের কথা, কল্পনাই করতে পারেন নি যে, সিয়েমের দরবার কতো শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন সিয়েমের প্রায় ৫০০-৬০০ জন প্রতিনিধি দরবারে সমবেত হয়েছেন। প্রত্যেকেই সশস্ত্র, কাঁধে তীর-ধনুক, হাতে খোলা তলোয়ার। আসলে যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে সিয়েমদের এসব অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে উপস্থিত হওয়াই ছিলো এখানকার সংস্কৃতি। দরবারের বিদেশী দর্শক সন্ত্রস্ত হয়ে সবকিছু প্রত্যক্ষ করছিলেন এবং তিনি লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, এতো সুশৃঙ্খল সভায় তিনি আগে কখনও উপস্থিত থাকেন নি।
কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়াকে এতোটুকু গুরুত্ব না দিয়ে টানা দুই দিন ধরে চললো আলোচনা এবং অনেক বিতর্ক শেষে রাস্তা তৈরীর অনুমতি দিতে সম্মত হয় সব সিয়েমরা। অনুমতি পেয়েই ডেভিড স্কট আর সময় নষ্ট না করে লোকলস্কর, যন্ত্রপাতি, সাজ-সরঞ্জাম, গাধা-ঘোড়া নিয়ে কাজে নেমে পড়েন। ততোদিনে নংখলৌতে প্রকল্প রূপায়ণের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্থানীয় দপ্তরও স্থাপন করা হয়ে গেছে। পাশেই গড়ে উঠেছে শ্রমিক-আধিকারীদের অস্থায়ী আস্তানা এবং আস্তাবল। রাস্তার রূপরেখা নিয়ে ডেভিড স্কটের খসড়া অনুসারে শুরু হয়ে গেলো জমি জরীপ ও আনুষঙ্গিক কাজকর্ম। সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছিলো। তবে এক পর্যায়ে ব্রিটিশদের আসল উদ্দেশ্যটা জানতে পারে খাসিয়া জনগোষ্ঠী। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ স্যার অ্যাডওয়ার্ড গাইট ১৯০৬ সালে তার লেখা বই ‘দ্য হিস্টোরি অফ আসাম’-এ উল্লেখ করেন যে, ১৮২৯ সালের এপ্রিল মাসের দিকে খাসি পাহাড়ের সিয়েমদের মধ্যে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তারা একজন বাঙালি পিয়নের মাধ্যমে ব্রিটিশদের এই রাস্তা তৈরীর আসল উদ্দেশ্যটা জানতে পারে। ভারতবর্ষ শাসনে ব্রিটিশদের অন্যতম প্রধান কৌশল ছিলো একটি সুদৃঢ় যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেনো তারা সহজেই প্রদেশগুলোতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে। তাদের পরিকল্পনা ছিলো, যতো দ্রুত সম্ভব এই রাস্তা নির্মাণ শেষ করে তারা স্থানীয় মানুষের উপর কর ধার্য করবে এবং ধীরে ধীরে তদেরকে বশীভূত করবে অর্থাৎ দাসে পরিণত করবে। তিরোত সিং এ-ও খবর পান যে, গুয়াহাটিতে ব্রিটিশ সৈন্যের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাই দেরি না করে ১৮২৯ সালে আবারও আয়োজিত হয় সিয়েমের দরবার এবং সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে, অনেক হয়েছে, আর নয়, এবার চলে যেতে হবে বিদেশীদের, ভালো কথায় না গেলে মেরে তাড়াতে হবে।
এদিকে ব্রহ্মপুত্র বরাক উপত্যকা হয়ে সুরমা নদীর অববাহিকা পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা ডেভিড স্কটের স্বপ্ন। আর তা সফল না করে চলে যেতে তিনিও রাজি নন। সুতরাং তিনিও তৈরী থাকলেন। ১৮২৯ সালের ৪ এপ্রিল ইউ তিরোত সিং সৈন্য নিয়ে ব্রিটিশদের অফিসার ক্যাম্পগুলোতে অতর্কিত হামলা চালান। হামলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুই লেফটেন্যান্ট বেডিংফিল্ড ও বার্লটন নিহত হন। ডেভিড স্কট কোনোরকমে নিজের প্রাণ রক্ষা করে চেরাপুঞ্জিতে পালিয়ে গেলেন এবং সেখান থেকে সরাসরি চলে গেলেন সিলেট। কিছুদিনের মধ্যে সিলেট এবং কামরূপ থেকে ব্রিটিশ সৈন্য প্রবেশ করে তিরোত সিং -দের এলাকায়, উদ্দেশ্য বিদ্রোহ দমন করা। ব্রিটিশ সৈন্যরা সবাই আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, আর অন্য দিকে তিরোত সৈন্যদের সবার হাতে স্থানীয় হাতিয়ার। তিরোত সিং বুঝলেন, এই অবস্থায় ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধ অনেকটা দুঃস্বপ্নের মতো। তাই গেরিলা আক্রমণের পথ বেছে নিলেন তিরোত সিং। ব্রিটিশ সৈন্যদের হত্যা করার পর তাদের কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্র তারা কেড়ে নিতে শুরু করলেন তারা এবং এভাবে তাদের হাতেও চলে আসলো আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র।
শত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও হাল ছাড়েন নি তিরোত সিং। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফ থেকে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়ার চেষ্টাও করা হয়েছিলো। ইউ তিরথ সিংয়ের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় সব মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে সেই প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। দীর্ঘ চার বছর এই দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। কোম্পানির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে তিরোত সিং এর বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অহোম রাজ্যের শেষ রাজা চন্দ্রকান্ত সিংহ, ভুটিয়া রাজা সিংফৌ প্রমুখ। যুদ্ধের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ডেভিড স্কট হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৮৩১ সালের ২০ আগস্ট পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে ডেভিড স্কট মারা যান।
প্রতিবেশীদের নিয়ে স্থানীয় খাসিয়াদের এই মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভের সম্ভাবনা যখন প্রায় নিশ্চিত, ঠিক সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নবনিযুক্ত কর্তাব্যক্তিরা বেছে নিলেন ব্রিটিশ রাজশক্তির চিরায়ত রণকৌশল, কূটনীতি। তারা ইউ তিরোত সিং-কে জনবিচ্ছিন্ন করে তোলার উদ্দেশ্যে স্থানীয় জনজাতির বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রধানদের সঙ্গে গোপনে শলাপরামর্শ করা শুরু করলো। উৎকোচ, ক্ষমতার প্রলোভন ইত্যাদির মাধ্যমে অনেক গোষ্ঠীপতিকে নিষ্ক্রিয় করার উদ্যোগ নেয়া হলো। পরিস্থিতি বিবেচনা করে কয়েকজনকে গোপনে হত্যাও করা হলো। ইউ তিরোত সিং ক্রমশ একাকীত্বের শেকলে বাঁধা পড়তে থাকলেন। এক পর্যায়ে যুদ্ধে তিনি আহত হন এবং জনবিচ্ছিন্ন এক গুহায় আশ্রয় নেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, তার কাছের কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে ব্রিটিশ বাহিনীর দেয়া উৎকোচের লোভ সামলাতে না পেরে। ব্রিটিশদের কাছে তিরোত সিং এর অবস্থান বলে দেয় সেই বিশ্বাসঘাতক। এরপর যা হবার সেটাই হয়, ১৯৩৩ সালের ৯ জানুয়ারি তিরোত সিং ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে ধরাশায়ী হয় এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
মাইরং সেনাশিবির হয়ে গুয়াহাটি আদালতে হাজির করা হয় ইউ তিরোত সিং-কে। সেখান থেকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। প্রফেসর ডেভিড আর. সিমলিহ এর গবেষণা থেকে জানা যায় যে, তিরোত সিং ঢাকার কারাগারে রাজবন্দী হিসেবে থাকলেও তার সাথে একজন স্থানীয় শাসকের মতোই আচরণ করা হতো। তার সেবাযত্ন করার জন্য একজন সহযোগী নিয়োগ করা হয়েছিলো। সামান্য ভাতাও বরাদ্দ করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এছাড়া বন্দী থাকলেও পালকি করে ঢাকার ভেতর বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার অনুমতি ছিলো তার। কে জানে, হয়তো এই নাজিমুদ্দীন রোডেরই কোথাও ঘুরে বেড়িয়েছেন ইউ তিরোত সিং।
প্রফেসর ডেভিডের গবেষণা থেকে এ-ও জানা যায় যে, পাহাড়ী জনগণের আক্রোশ সামাল দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের জন্য স্থানীয় এক যুবককে নিয়োগ করেছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কিন্তু মানুষ তাকে মানতে রাজি হয় নি। পরিস্থিতির ভয়াবহতা টের পেয়ে বাধ্য হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইউ তিরোত সিংকে আবারো ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছিলো। ইউ তিরোত সিং স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন যে, ঢাকার কারাগারে বন্দী থেকে রাজার সম্মান নিয়ে মৃত্যুকে বরণ করতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাস হয়ে নংখলৌ এর সিংহাসনে তিনি বসতে পারবেন না।
ঢাকা কারাগারে থাকা অবস্থায় মেঘালয়ের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউ তিরোত সিং ১৮৩৫ সালের ১৭ জুলাই মারা যান। প্রতি বছর তার মৃত্যুবার্ষিকীতে মাইরাং শহরের ‘ইউ তিরোত সিং স্মৃতিসৌধ’ -তে ফুল দেয়া হয়। এখনও মেঘালয়ের মানুষ তাদের এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ভুলে যায় নি। মেঘালয় সরকার ১৭ জুলাইকে ‘তিরোত সিং দিবস’ এবং রাষ্ট্রীয় ছুটি হিসেবে ঘোষণা করেন। শিল্প-সাহিত্যে সেরা অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘ইউ তিরোত সিং পুরস্কার’ খুবই মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার হিসেবে স্বীকৃত। তিরোত সিং শুধুমাত্র সর্বাধিক প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় সিয়েমই ছিলেন না, তার দেশপ্রেম এবং সাহসিকতা তাকে মেঘালয়ে একটি পারিবারিক নামও দিয়েছে। তিনি একজন সত্যিকারের মাটির মানুষ যিনি অন্তর থেকে তার লোকদের কল্যাণ চেয়েছেন। জীবননাশের আশঙ্কা থাকার পরও তিনি একটুও দ্বিধাগ্রস্থ হন নি কিংবা পিছু হটে যান নি। আর যখনই তিনি ব্রিটিশদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছেন, তখনই কিন্তু তিনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নিজের মাতৃভুমি ও নিজের লোকদেরকে রক্ষা করার জন্য। এমন অসম সাহসী বীর যোদ্ধাকে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।