ইতিহাসের অনন্য সমরনায়ক ও রোমের প্রথম একচ্ছত্র অধিপতি দিগ্বীজয়ী জুলিয়াস সিজারের হত্যাকান্ড নিমিষেই বদলে দিলো ক্লিওপেট্রার নিয়তি। সিজারের ভালোবাসায় সিক্ত ক্লিওপেট্রা তার শক্তিতেই শাসন করছিলেন মিশরকে। কিন্তু এখন জুলিয়াস সিজারের মৃত্যু ক্লিওপেট্রার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। আর তাই মিশর এবার সম্পূর্ণরূপে রোমানদের দখলে। নতুন সম্রাট হলেন জুলিয়াস সিজারের মনোনীত উত্তরাধিকারী গাইয়াস অক্টাভিয়াস ওরফে অগাস্টাস। ইতিহাসের পাতায় রোম, রোমান রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে মানুষের মনে অমর করে রাখবার কৃতিত্ব তারই। দম্ভ করেই তিনি বলেছিলেন, “আমি রোমকে পেয়েছিলাম একটি কাদামাটির শহররূপে, আর রেখে যাচ্ছি মার্বেলের নগরীরূপে”।
বিচক্ষণ সম্রাট অগাস্টাস শুরুতেই ভাবলেন রোমান নাগরিকদের জীবনযাত্রার উন্নয়নের কথা। গল তো জয় হলো, মিশরও আয়ত্তে এলো, তবে এবার আর কোনো সময়ক্ষেপণ নয়, নিজের দায়িত্ব পালনের দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করলেন অগাস্টাস।
যেই ভাবা সেই কাজ। বিভিন্ন দেশে দূত প্রেরণ করলেন তিনি। ভারতবর্ষেও পাঠালেন। তবে প্রথমেই ভেবে রেখেছিলেন যে, ইস্ট থেকে ব্যবসা শুরু করবেন তিনি। আর ভারতবর্ষের সাথে একটি অভিনব বাণিজ্যের বাসনা তো তার মনে শুরু থেকেই পুঞ্জীভূত ছিলো। ভারতবর্ষের সাথে সুন্দরভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য তিনি গ্রহণ করলেন বিভিন্ন উপযোগী পদক্ষেপ। ভারত উপমহাদেশ ও তার আশেপাশের অঞ্চলের প্রসাধন সামগ্রী, মনোহর দ্রব্য, কারুশিল্প প্রভৃতি আমদানির জন্য তিনি গ্রহণ করলেন বিশেষ বাণিজ্য নীতি এবং এই বাণিজ্যের ধারাকে ফলপ্রসূ করবার জন্যই উপমহাদেশে বিশেষ দূত প্রেরণ করেছিলেন সম্রাট অগাস্টাস।
বাণিজ্য সংক্রান্ত ধারাবাহিক এই বিবরণীগুলো আমরা পেয়েছি তামিল সঙ্গম সাহিত্য এবং প্লিনি, টলেমী ও স্ট্র্যাবোর গ্রন্থগুলো হতে। এছাড়াও মিশরে বসবাসরত এক অজ্ঞাতনামা গ্রীক নাবিকের লেখা গ্রন্থ ‘পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সী’ ছিলো তখনকার নাবিকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ম্যানুয়াল। বিভিন্ন সময়ে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোও ইন্দো-রোমান বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রমাণ বহন করে।
সত্যিকার অর্থে, ইতিহাস লিখে রাখার অভ্যাস আমাদের ছিলো না, এটি আমরা শিখেছি পাশ্চাত্য হতে। আর এ জন্যই আমাদের ইতিহাস কিছুটা ইউরোসেন্ট্রিক ধাঁচের। লিখিত দলিল না থাকার কারণেই আমরা একটি দীর্ঘ সময় ব্যর্থ হয়েছি উপমহাদেশের সাথে বহিরাগত বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলোর সম্পর্ক অনুধাবন করতে এবং নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্য সম্বন্ধে সচেতন হতে। পরবর্তীতে বহুবিধ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে যখন বিভিন্ন সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের নিদর্শন মিলতে লাগলো, তখনই গবেষকরা আমাদের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। নতুন করে ইতিহাস গড়ার পদ্ধতি কেমন হবে তা বোঝাতে গিয়ে ইতিহাসবিদগণ বলেছেন যে, বর্তমান ভৌগোলিক সীমারেখার ভিত্তিতে এই উপমহাদেশের ইতিহাস গড়তে গেলে তা আমাদের জ্ঞান, চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সীমাবদ্ধ করে দিবে। সুতরাং ভারতবর্ষের বর্তমান ম্যাপকে সামনে রেখে এর ইতিহাস তথা উপমহাদেশের নৌবাণিজ্যের ইতিহাস গড়া সম্ভব হবে না। সঠিকভাবে উপমহাদেশের শক্তি ও সাফল্যকে জানতে হলে জাপান থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত পুরোটাকে একটা ভূখন্ড বিবেচনা করতে হবে। সে সময় বিভিন্ন রাষ্ট্র বা রাজ্য আলাদা থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সবগুলো রাজ্যের মধ্যে যোগসূত্র বিদ্যমান ছিলো।
আমরা যদি উপমহাদেশের ম্যাপের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো, শুধু উপরিভাগের অংশটি হিমালয় পর্বত দিয়ে আবৃত, বাকি বেশিরভাগটাই সমুদ্র দিয়ে পরিবেষ্টিত। মানুষ অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসে এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ সবসময়ই প্রকৃতিকে জয় করার কামনা করে। সুতরাং এই উপমহাদেশের সাথে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের যে যোগাযোগ ছিলো তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
এই নৌবাণিজ্যের ইতিহাস কিন্তু বেশ প্রাচীন। বহু আগে থেকেই এই উপমহাদেশে নৌবাণিজ্য চলে আসছে, যার অনেক প্রমাণও আমরা পেয়েছি বিভিন্ন পুরাতত্ত্ব থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশের পণ্যসামগ্রীর গল্প আমরা শুনেছি সোলায়মান ও শীবার রাণী বিলকিসের রাজত্বকালেও। জানা যায়, জ্ঞানী রাজা সোলায়মানের বুদ্ধি পরীক্ষার জন্য শীবার রাণী তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন এবং উপঢৌকন হিসেবে অন্যান্য মূল্যবান জিনিসের পাশাপাশি উপমহাদেশ থেকে এক বিশাল গাড়িভর্তি মসলাও আনিয়েছিলেন। মিশরের রাণী হাতশেপসুতও লোহিত সাগরে তার পাঁচটি জাহাজ পাঠিয়েছিলেন এই উপমহাদেশের মসলার জন্য। তারও আগে, হরপ্পা সভ্যতার সাথে ব্যবিলন, মেসোপটেমিয়া প্রভৃতির বাণিজ্যিক সম্পর্কেরও প্রমাণ মিলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের ওমান এবং ইরানের সর্বত্রই হরপ্পার প্রত্নসামগ্রী ছড়িয়ে আছে। সুমেরীয় নথিপত্রে যে ‘মেলুহা জনগোষ্ঠী’ এর উল্লেখ আছে, যাদের সাথে সুমেরীয়দের ছিলো বাণিজ্যিক সম্পর্ক, তারা হরপ্পা অঞ্চলেরই অধিবাসী ছিলো। বিভিন্ন প্রত্নবস্তুই এর প্রমাণ বহন করে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরেই উপমহাদেশের সাথে এই বৈদেশিক বাণিজ্যের ধারা চলমান। এটি আমাদের জন্য গর্ব করার মতো বিষয় যে, অনেক প্রাচীনকাল থেকেই এই উপমহাদেশের বাণিজ্যিক ইতিহাস ছিলো অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
বাণিজ্য তো আলেকজান্ডারের সময়েও ছিলো, কিন্তু ইন্দো-রোমান বাণিজ্যের মতো এতো ব্যাপক পরিসরে আর কোনোকালেই বাণিজ্য হয়ে ওঠে নি। ইতিহাসে এই যুগান্তকারী মোড় নিয়ে আসার পেছনে অনেক বড় অবদান রেখেছেন হিপ্পোলাস নামক একজন নাবিক। তিনি মৌসুমী বায়ুর গতিবিধি আবিষ্কার করে সমুদ্রপথের বাণিজ্যকে দিয়েছেন একটি সংক্ষিপ্ত ও সমৃদ্ধ রূপ। এর আগে সমুদ্রপথে যতো বাণিজ্য হয়েছে, তা ছিলো অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ, অনেক ঘুরে সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে হতো। কিন্তু মৌসুমী বায়ুর গতিপথ আবিষ্কার হওয়ায় এই দূরত্ব অনেক কমে গিয়েছিলো, যার ফলে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাতায়াত হয়ে উঠেছিলো অনেক সহজ।
এবার আসা যাক ইন্দো-রোমান বাণিজ্য প্রসঙ্গে। এক্ষেত্রে সময়টা খুবই লক্ষণীয় বিষয়। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে ২৫০ খ্রিস্টাব্দ। রোমান সাম্রাজ্য তখন জৌলুসের চূড়ায়। একই সাথে এশিয়া মহাদেশও বেশ স্থিতিশীল, শক্তিশালী মহাজনপদগুলো ও মৌর্য সাম্রাজ্যে গড়ে উঠেছে যথোপযুক্ত রাজনৈতিক ভিত্তি, রাস্তাঘাটেও নিশ্চিত হয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা। চায়নার উত্থান, খনিবিদ্যা ও ধাতুবিদ্যার জ্ঞানের অগ্রগতি, সব মিলিয়ে একটি সুষ্ঠু ব্যবসাবান্ধব পৃথিবী তৈরী হয়ে গিয়েছিলো। কল্পনার অতীত এমন বাণিজ্যিক প্রসার এর মাধ্যমে উপমহাদেশ লাভ করেছিলো অফুরন্ত রপ্তানি আয় এবং এই রপ্তানি আয় ও সবল রাষ্ট্রীয় ভিত্তির সম্মিলনই হয়ে ওঠে উপমহাদেশের শক্তির প্রধান উৎস। সৃষ্টি হয় অগণিত নতুন নতুন পেশা এবং কারুশিল্পে দেখা দেয় লক্ষণীয় উন্নয়ন। প্রাক-মৌর্য যুগে যেখানে প্রায় ১২টি পেশা ছিলো, সেখানে ইন্দো-রোমান বাণিজ্যের পর এই সংখ্যা ৩৬-এ উন্নীত হয়েছে। পরবর্তীতে ‘মিলিন্দা পানহা’ বা ‘মিলিন্দার প্রশ্ন’ থেকে ৭৫টি বৃত্তির খবর পাওয়া যায়, যার মধ্যে ৬০টিই ছিলো কারুশিল্প সম্পর্কিত। যে অর্থ ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিলো, তা ব্যয় হতো কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য। মৌর্য ও গুপ্ত যুগের মধ্যবর্তী এই সময়ে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে গড়ে উঠেছিলো নতুন শিল্প ও বাণিজ্যকেন্দ্র। সেই সাথে তৈরী হয়েছিলো সুরক্ষিত নগরী, যার ফলে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের পথ হয়ে উঠেছিলো অত্যন্ত প্রশস্ত।
বাণিজ্যিক প্রসারের এই চিত্র নিশ্চয়ই মনে কৌতুহল জাগ্রত করে। গ্রীক ম্যানুয়াল ‘পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সী’ –তে দেয়া বাণিজ্যিক পথনির্দেশনা, উপকূলবর্তী বিভিন্ন বন্দরের অবস্থান, বন্দরে পৌঁছাবার পথের বর্ণনা, বন্দরের বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য, সেখানকার রাজনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি সবকিছুর স্পষ্ট বিবরণী তখনকার বণিকদের হাতে তুলে দেয়া হতো। মিশরীয় ও গ্রীকদের সাথে তো ভারতবর্ষের পূর্বপরিচয় ছিলোই, তার সাথে আবার হিপ্পোলাসের কল্যাণে যোগ হয়েছিলো মৌসুমী বায়ুর গতিবিধি সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান। এই মৌসুমী বায়ুর গতিপথকে ব্যবহার করেই বণিকরা খুবই কম সময়ে ভারতবর্ষে যাতায়াত শুরু করেছিলো। তাই এই আবিষ্কারই ছিলো ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। দীর্ঘ সময়ের বাণিজ্যের এমন আকস্মিক দ্রুততা প্রাপ্তির কারণেই গ্রীস ও রোমের মতো প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সভ্যতাগুলোর সাথে ভারতবর্ষের অদৃশ্য বাণিজ্যিক সাঁকো গড়ে ওঠে। রোমের প্রায় ১২টির মতো বড় বড় জাহাজ প্রতি বছর এসে হাজির হতো ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিম উপকূলে এবং তাদের এই পদচারণা ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশেও সমান তালে দেখা যেতো।
ইন্দো-রোমান বাণিজ্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এটাই ছিলো যে, এর পুরোটাই সংগঠিত হতো সমুদ্রপথে। উপমহাদেশের মানচিত্রের দিকে লক্ষ করলেই দেখা যায় যে, উপকূলজুড়ে প্রায় ২০০টিরও বেশি ছোট-বড় বন্দর গড়ে উঠেছিলো বাণিজ্যিক সহায়তার জন্য। উত্তর ভারতবর্ষের তুলনায় দক্ষিণ ভারতবর্ষে রোমান স্বর্ণমুদ্রা ও প্রত্নবস্তু বেশি পরিমাণে প্রাপ্তির এটিও একটি কারণ হতে পারে।
একবার হঠাৎ করেই নতুন এক সমস্যা তৈরী হয়েছিলো। তখন চাইনিজ সিল্ক ছিলো ইউরোপীয়ানদের জন্য এক মহার্ঘ্য বস্তু। কিন্তু পার্থিয়ানদের দস্যুতার কারণে এর নিরবচ্ছিন্ন রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়। এ জন্য ব্যবসায়ীরা একরকম বাধ্য হয়েই এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য নতুন পথ খুঁজতে শুরু করলো। পান্ডু ও গান্ধারের রাজারা ব্যবসার প্রসারে উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সম্রাট অগাস্টাসের দরবারে দূত পাঠিয়েছিলেন। ফলে এই ক্ষেত্রেও নৌবাণিজ্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো। ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ থেকে দেখা যায় যে, এশিয়ার স্থলপথের বাণিজ্যের তুলনায় দক্ষিণ পথের সমুদ্রবাণিজ্য অনেক বেশি সুরক্ষিত ছিলো। তখন জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাণিজ্য-জাহাজে সৈন্যদলও পাঠানো হতো।
ইন্দো-রোমান বাণিজ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভারতবর্ষ ছিলো মূলত দাতা এবং রোমানরা ছিলো গ্রহীতা, অর্থাৎ ভারতবর্ষে রপ্তানি হতো বেশি এবং আমদানি হতো কম। ভারতবর্ষ এতো সমৃদ্ধ ছিলো যে, খুব কম জিনিসই রোমানদের কাছ থেকে কিনতে হতো। হাতে গোণা অল্প যেসব জিনিস ভারতবর্ষে আমদানি হতো, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো ঘোড়া, শূরা বা মদ, অলিভ অয়েল, রাজাদের হারেমের জন্য নারী এবং পাহারাদার কিংবা দেহরক্ষী হিসেবে সৈন্য। আদিতে গ্রীকরা এশিয়ার ‘আয়োনিয়া’ দ্বীপে বসবাস করতো বলে তাদেরকে ‘আয়োনিয়ান’ বলা হতো। মূলত ‘আয়োনিয়ান’ শব্দটি হতে ‘যবন’ শব্দটির উৎপত্তি হলেও তখন রোমানদের ক্ষেত্রেও এই নামটি ব্যবহার করা হতো। সঙ্গম সাহিত্য থেকে পাওয়া যায়, “…the cool sweet-selling wine brought by the Yavanas and drank daily from the golden cups…”। ভারতবর্ষের অধিবাসীরা ইটালিয়ান ওয়াইন খুব পছন্দ করতো। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন হতে শূরা খাওয়ার সুসজ্জিত পাত্রও পাওয়া গিয়েছে। সঙ্গম সাহিত্য থেকে আরও জানা যায়, তখনকার তামিল রাজারা ঘোড়া খুব পছন্দ করতো। আর তাই ভারতবর্ষে আমদানিকৃত দ্রব্যের মধ্যে ঘোড়া ছিলো উল্লেখযোগ্য পণ্য। এছাড়াও সুন্দর মুখের গড়ন ও সুঠাম দেহের অধিকারী যবনদেরকে নিজেদের দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দিতে বেশ পছন্দ করতেন তখনকার প্রভাবশালী রাজারা। যবনরাও বিশ্বস্ততার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করতো।
রোমানরা ভারতবর্ষ থেকে আমদানি বেশি করতো বলে স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে তাদেরকে পণ্যসামগ্রী কিনতে হতো, আর ভারতবর্ষের তেমন কেনার কিছু ছিলো না বলে ক্রমেই তাদের অর্জিত অর্থ বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছিলো। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে ভারতবর্ষে পাওয়া গিয়েছে প্রচুর রোমান স্বর্ণমুদ্রা। ভারতবর্ষের দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিলো গোলমরিচের। এ কারণে গোলমরিচকে বলা হতো ‘যবনপ্রিয়’। ভারতীয় দারুচিনিরও ভীষণ কদর ছিলো রোমানদের কাছে। এছাড়াও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো- পেরিডট, রঙিন টেক্সটাইল, কাঁচা কাঁচ, সালফাইড, অ্যান্টিমনি, মুক্তা, হীরা, হাতির দাঁতের কারুশিল্প, চাইনিজ সিল্ক, গাঙ্গেয় নার্ড, কচ্ছপের খোলস, নীলকান্তমণি, তামা, টিন, সীসা, প্রবাল, রিয়েলগার ইত্যাদি।
‘পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সী’ এবং টলেমীর ‘জিওগ্রাফিয়া’ বই থেকে মালাবার উপকূলে ‘মুজিরিস’ নামক এক বন্দরের হদিস পাওয়া যায়। সঙ্গম সাহিত্যেও তার উল্লেখ রয়েছে। এই বন্দরের সঠিক অবস্থান বহুদিন অজানা ছিলো। সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এর অবস্থান নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। বিদেশী নাবিকদের জন্য মুজিরিসে অগাস্টাসের একটি মন্দির ছিলো বলে সঙ্গম কবিরা উল্লেখ করেছেন এবং সম্প্রতি প্রাপ্ত মুজিরিসের অবস্থানের সাথে এই তথ্যের মিল রয়েছে। ভিয়েনা জাদুঘরে রক্ষিত প্যাপিরাসে লিখিত একটি চুক্তিপত্রের সাথেও রয়েছে এই তথ্যের সাদৃশ্য। প্যাপিরাসে লিখিত সেই চুক্তিপত্র অনুযায়ী, আলেকজান্দ্রিয়ার একজন ব্যবসায়ী মুজিরিস থেকে ঋণ নিয়ে গাঙ্গেয় সুগন্ধি, হাতির দাঁত এবং কাঁচ দিয়ে ব্যবসা করেছিলেন।
ঐতিহাসিক এই নৌবাণিজ্য সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ ও গৌরবান্বিত করলেও রোমান অর্থনীতিতে তা ফেলেছিলো ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব। রোমানরা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণমুদ্রা রপ্তানি করার ফলে আরও স্বর্ণমুদ্রা তৈরীর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ আর অবশিষ্ট ছিলো না। প্লিনি তো মন্তব্য করেই ফেললেন, “সামান্য কিছু মসলার জন্য আমার অর্থনীতিকে এই নারীরা পঙ্গু বানিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছে”। প্লিনি এবং অন্যান্য কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভারতের সাথে কৃত বাণিজ্যের উপর এক প্রকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা বেশি দিন ফলপ্রসূ হয় নি। ভারতীয় এবং ইহুদী উভয় দলই খুব দ্রুত চোরাচালানের পথ খুঁজে বের করে। ফলে সম্রাটের পুরো প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। তাই কিছু দিন পর আবারও বাণিজ্য শুরু হয়, কিন্তু বিনিময়ের ক্ষেত্রে স্বর্ণমুদ্রার সোনার পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এরও প্রমাণ মিলেছে। ইতিহাসবিদগণ রোমান সাম্রাজ্যের পতনের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে ইন্দো-রোমান নৌবাণিজ্যকে অনেকাংশে দায়ী করেছেন।
ভারতীয় উপমহাদেশের ৫০০০ বছরের ইতিহাসের ধারাবাহিক বিবরণীর এটি একটি অংশমাত্র। এই ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।