চলুন আমরা চোখ বন্ধ করে, কিছুক্ষণের জন্য কল্পনার জগতে চলে যাই। উনিশ শতক, হেঁটে যাচ্ছি বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে, একটু এগোলেই আমরা পুরনো ঢাকার পাটুয়াটুলিতে পৌঁছে যাবো, আর একটু এগোলেই জিন্দাবাজার লেন। সময়টা সন্ধ্যা, পাটুয়াটুলীর এই মোড়ে সুন্দর ব্যালকনিতে জাফরি কাটা বিশাল এক দোতলা বাড়ি। বাড়ির মালিকের অর্থের যে অভাব নেই তা বাড়ির সাজ-সজ্জা দেখলেই বোঝা যায়। দোতলা বাড়ির বাঁকানো সেগুন কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পরই পাওয়া যাবে সুন্দর সাজানো গোছানো এক বারান্দা, তারপর মাহফিলখানা। বাড়ির মনিব অন্দরমহলে বাস করে। নিচের ঘরগুলোতে থাকে কর্মী, ভৃত্য আর পোষ্যরা। এখনতো সন্ধ্যা তাই বাড়ি থেকে ভেসে আসছে নূপুরের আওয়াজ, গভীর রাত পর্যন্ত চলবে এই নাচ গানের আসর।

নাচ-গানের সুমধুর আওয়াজে পুরো এলাকা মুখরিত। সারেঙ্গী সেতারের মিষ্টি সুর বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। আমন্ত্রিত অতিথিরা ফুল ভালোবাসে। তাই হরেক রকমের ফুল ও ফুলের মালা নিয়ে বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছে ফুলওয়ালা। তারমধ্যে টকটকে লাল রংয়ের গোলাপ ফুলের চাহিদাই বেশি। পানওয়ালা পান সাজিয়ে বসে আছে। এগুলো কোন সাধারণ পান নয়। তিনদিন জাফরান ও গোলাপজলে ভিজিয়ে রাখার পরেই এই পানগুলো দিয়ে খিলি বানানো হয়। আর খিলি বানানোর সময় মিশিয়ে দেওয়া হয় অল্প আফিম।

নৃত্যরত বাইজি

বাড়িটি উচু প্রাচীর ঘেরা, প্রশস্ত তার অঙ্গন। এদিক ওদিক মশালের আলো। দরজায় দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে এক স্থুলকায় দারোয়ান। গায়ের রং তামাটে ,শক্ত, মুখ ভর্তি পান, মশালের আলোয় চিকচিক করছে হাতের আংটি। পূর্ণিমা রাত, চাঁদের আলোয় চারদিক উজ্জ্বল। ফিটেন গাড়ী থেকে নামছে দীর্ঘদেহী গৌড়বর্ণের, নীলাভ আঁখি বিশিষ্ট মানুষগুলো। অভিজাতদের পোশাকে চোখ আটকে যায়, কানে হীরের দুল, আঙ্গুলে পান্না, পূর্ণিমার আলোয় জ্বলজ্বল করছে। গলায় বাহারি মুক্তার মালা, কোমড়ে তলোয়ারতো আছেই।

দোরগোড়ায় রাখা গাড়ি থেকে নেমে নবাবজাদারা লোহার সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যাচ্ছে। আর মাহফিলখানা, এক বিরাট ঘর যেখানে আসর বসবে, সে যেনো মোমবাতির ঝাড়ের আলোয় উজ্জ্বল, এখানে ওখানে পিদিমদানের উপর জ্বলছে আলো। দেয়ালের কুলুঙ্গিতে রাখা জ্বলন্ত প্রদীপ। সেসব বাতি ঠিকমত জ্বলছে কিনা তা দেখাশোনায় ব্যস্ত কয়েকজন।

শ্বেতপাথরের বিরাট ঘরে পাতা রয়েছে মূল্যবান পারস্যদেশীয় কার্পেট, দরজা জানালায় মখমলের উপর সূক্ষ্ণ কাজ করা দামি পর্দা। কার্পেটের উপর পাতা নরম তুলার তৈরি কারুকাজ করা জাজিম। তার উপর মসলিনের সাদা চাদর। এই চাদরের উপর সোনার সুতার কাজ করা রেশমের আরেক চাদর পাতা রয়েছে। বাদশাহি ব্যাপার! এরই উপর একপাশে বসবেন বাড়ির মালিক, তাই সেদিকে দেয়া হয় মখমলে মোড়া বালিশ। যদি তিনি হেলান দেন! মেহমানদের জন্যও রয়েছে বালিশ। এতটুকু পড়ার পর কি মনে হচ্ছে? আমরা পাকিজা বা ওমরাওজান সিনেমার কোন এক শুটিংস্পট নিয়ে আলোচনা করছি?

হ্যাঁ, তাইতো মনে হচ্ছে। ঠিক ধরেছেন। তেমনই এক শুটিংস্পট তবে তফাৎ হচ্ছে, এটা সেলুলয়েডের পর্দা না, এখানে রক্তমাংসের শিল্পীরা অর্থের বিনিময়ে মনোরঞ্জন করতো অভিজাত লোকদের। এই শিল্পীদের বাইজি বলা হত। ঢাকার বাইজিদের বেশ স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। তাদের হাতের দোলা, মুখ এবং চোখ ও ঠোঁটের সুস্পষ্ট কম্পন মন্ত্রমুগ্ধ করতো সকলকে। রুচিসম্পন্ন ও মার্জিত নাচ-গান মানুষকে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যেতো। তাদের পোশাকের বাহার, চুরিদার পায়জামা, ঘেরওয়ালা পেশোয়াজ ওড়না, পায়ে চিকন নূপুরের ছন্দ অনেক রাজা-বাদশাদের সন্ধ্যার পর ঘরে থাকতে দিতো না। এক অমোঘ আকর্ষণে ছুটে আসতো তারা পাটুয়াটুলী এবং ওই জিন্দাবাজার এলাকার বাড়িগুলোতে। ঢাকার বাইজিদের নাচ ছিল ঢাকাবাসীদের বিনোদনের এক প্রধান মাধ্যম।

ভারতের উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, রাজস্থানে নাচকে পেশা হিসেবে নেওয়া হতো। তবে যেসব মহিলারা ধ্রুপদী নাচের এবং গানের জন্য ছোটবেলা থেকেই গুরুর শিক্ষা নিয়ে, দক্ষতার শীর্ষে নিজেদেরকে নিয়ে যেতে পারতো, তাদেরকে ‘বাই’ বলা হতো । আর ওইসব শাস্ত্রজ্ঞানে দক্ষ মহিলারা যখন নৃত্য গীতকে পেশা হিসেবে নিতো, তখন বাইয়ের পাশে “জি” লাগিয়ে তাদের বাইজি ডাকা হতো। এই পেশায় নর্তকীদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও নিষ্ঠা তাদেরকে প্রচুর বিত্তের অধিকারী হতে সাহায্য করতো।

এখন আসি, বাংলায় কিভাবে এই পেশার বিকাশ লাভ করলো। আমরা দেবদাসী সুন্দরী কমলার গল্প জানি। মহাস্থানগড়ের স্কন্ধের ধাপে কমলা ও তার নৃত্য ঝড় তুলতো। মন্দিরে আমরা বহু মূর্তি দেখতে পাই যেখানে নাচের মুদ্রায় দাঁড়িয়ে আছে কোন নর্তকী বা দেবী। এ থেকে বলা যায় দ্রোপদী নৃত্যের সাথে বাংলা বহু আগে থেকেই পরিচিত ছিল। তাছাড়া আমরা আরো জানতে পারি যে, সুলতানী আমলে বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বাংলা সফর করেন। তার ভ্রমণ কাহিনী রিহালাতে বাংলার কিছু সামাজিক বিষয়ের উপর তিনি দৃষ্টিপাত করেন। তার সময়ে সোনারগাঁওকে তিনি সমুদ্র নগরী এবং ঢাকাকে সোনারগাঁওয়ের পাশে বাজার নগরী বলে আখ্যায়িত করেন। তার বিবরণ থেকে বাংলায় দাসপ্রথার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই দাসেরা ফার্সি ভাষায় গজল গাইতে পারতো। তিনি তাদের কাছ থেকে আশুরা নামে এক যুবতীকে কিনেছিলেন। তারা রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত পেশাদার শিল্পী ছিলেন। এছাড়া ১৫ শতকে বাংলায় সুলতানের দরবারে চীনা দূত মাহুয়ান আসেন। তাদের আপ্যায়নের জন্য ভোজসভার আয়োজন করেন বাংলার সুলতান। সেই সময় অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য নাচ-গানের ব্যবস্থা করা হয়। তার দেখা নর্তকীদের সম্পর্কে তিনি বলেন যে, হালকা লাল রংয়ের ফুল তোলা জামা এবং রেশমের ঘাগড়া, গলায় হার, নীল আর দামি পাথর দেওয়া চুড়ি পরা অবস্থায় তাদেরকে দেখতে যেন অপ্সরীর মত লাগছিল।

বাইজি শিল্পী: চার্লস ডয়েলি, ১৮১০

মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর, ইসলাম খানের ঢাকার নৃত্যশিল্পীদের প্রচুর সুনাম শুনে তাদেরকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন তিনি তার দিল্লীর রাজদরবারের প্রেমরাঙ্গা নামের একজন দামী সংগীতশিল্পীকে ঢাকায় ইসলাম খানের কাছে পাঠান এবং প্রেমরাঙ্গা শিল্পীর বিনিময়ে কয়েকজন ঢাকার নৃত্যশিল্পীকে দিল্লীতে পাঠানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু ইসলাম খান সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি এই বিনিময় প্রথায় যাবেন না। সম্রাটকে ‘না’ বলার যোগ্যতাও ইসলাম খানের ছিল। কারণ, ইসলাম খান ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের ছোটবেলার খেলার সাথী। সত্যিই, তিনি দিল্লীর দরবারে কাউকে পাঠাননি বরং উল্টো প্রেমরাঙ্গাকে গুপ্তচর মামলায় কারাগারে বন্দি করে রাখেন। আসলে ঢাকার নৃত্যশিল্পীদের ইসলাম খানের দরবারের বাইরে অন্য কোথাও নৃত্য প্রদর্শন করা নিষেধ ছিল এবং এটা কড়াকড়িভাবে পালন করা হতো।

ঢাকা ছিল ইসলাম খানের রাজধানী। শাহ সুজা সেটাকে নিয়ে গিয়েছিল রাজমহলে কিন্তু এতে ঢাকার গুরুত্ব কোনোভাবেই কমেনি বরং সংগীতপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে আরো প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের পর লখনৌ এর গান ও নাচের পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তখন ঐ শিল্পীরা ধীরে ধীরে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ, ঢাকায় এসে আশ্রয় নেয়। ঢাকায় তাদের পৃষ্ঠপোষকতার মানুষের কোন অভাব ছিল না। নবাব পরিবার এবং তার বংশধরেরা, মোঘল বংশোদ্ভূত জমিদারেরা, ভাওয়াল রাজা, কাশিমপুর, পুবাইলের জমিদারদের নাম এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। শুধু স্থানীয় বাইজি নয়, ঢাকার নবাব বাদশাদের দেদার খরচের গল্প ছড়িয়ে পড়ায়, লখনৌ, বেনারস, পাটনা, বিহার, কলকাতা থেকে প্রতিষ্ঠিত বাইজিরাও ঢাকায় এসে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে নিজ দেশে ফেরত গিয়েছেন। এর মধ্যে আবার অনেকে ঢাকার চাকচিক্যে মুগ্ধ হয়ে পাটুয়াটুলী ও জিন্দাবাজার লেন এলাকায় বাড়িঘর কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করে থেকে গিয়েছিলেন। এই বাইজিরা যেমন নিজেদের বৈঠকখানায় মাহফিল করতো তেমনি আবার তারা বায়না নিয়ে জমিদার নবাবদের রংমহলেও বেড়াতে যেতেন।
ঢাকার বাইজিদের সাথে টেক্কা দিয়ে মুজরা (পারিশ্রমিক) করেন গহরজান। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের কিংবদন্তী গায়িকা। অল্প বয়সে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তি তাকে কিছুটা দাম্ভিক করে তুলে। নিজে যেহেতু ওয়াজেদ আলী শাহের দরবারে নাচ শিখেছিলেন, তাই তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, কোন ছোটখাটো জায়গায় গান করবেন না। ছোটখাটো বলতে ছোট জমিদার বা নবাবকেই বুঝিয়ে ছিলেন। এই গল্প বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ঢাকায় যে মুজরা তিনি করেছিলেন, সেটি কোন ছোট জমিদার দিতেই পারতেন না । ১৯০২ সালে গহরজানের প্রথম রেকর্ড বের হয় এবং তার জীবদ্দশায় তিনি ৩০ টির বেশী গানের রেকর্ড করেছিলেন। গহরজানের আশ্রয় থেকেই জদ্দন বাই বিভিন্ন মুজরায় অংশ নিতেন। আচ্ছা, জদ্দন বাই কে জানেন? তিনি ছিলেন ভারতের বিশিষ্ট নায়িকা নার্গিসের মা এবং জনপ্রিয় নায়ক সঞ্জয় দত্তের নানী।

যাই হোক, তাদের আয়ের হিসেব নিলে মাথা ঘুরে যাবে। বাইরে থেকে আসা ওইসব বাইজিদের পারিশ্রমিক ছিল আকাশছোঁয়া। তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী, দৈনিক পাচঁশ থেকে পনেরশ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক দেওয়া হতো। তাছাড়া তাদের সাথে আসা পুরো দলের অর্থাৎ যন্ত্রী, ভৃত্যদের খাবার, তাদের ঢাকা আসা-যাওয়ার খরচ সব মিলিয়ে বেশ মোটা অংকের টাকা গুনে গুনে তাদের হাতে তুলে দিতে হতো।

বিলিতি সাহেব, দিশি বাইজি, ১৮০০

আরেক নামকরা বাইজি ছিলেন, জানকীবাই ! হ্যা, ‘ছাপ্পান্ন ছুরি’র আসল নাম হচ্ছে জানকীবাই। জানকীবাই এর নাম ছাপ্পান্ন ছুরি রাখার পটভূমি ছিল বিস্ময়কর। জানকীর বাড়ি ছিল বেনারস। এলাহাবাদের মেয়ে হয়েও তিনি থাকতেন ঢাকায়। অসম্ভব গুণবতী এবং রূপবতী জানকী ছিলেন এক নবাবের হারেমের সদস্য। নবাব তার রূপে এতটাই দিওয়ানা ছিলেন যে তার কাছ থেকে যেনো কেউ তাকে নিয়ে না চলে যায় সেজন্য তিনি জানকীর শরীরে ৫৬ বার ছুরির আঘাত করে তাকে কুৎসিত করেছিলেন। এই কারণে তিনি “ছাপ্পান্ন ছুরি” নামে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি একদিনের জন্য ১৫০০ টাকা পারিশ্রমিক নিতেন। যোগ্যতার কমতি ছিল না তার। ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ এলাহাবাদে গেলে তার সম্মানে গানের আসরে গান করার জন্য ছাপ্পান্ন ছুরিকেই নির্বাচিত করা হয়। তিনি কবিতাও লিখতেন। তার কবিতার বইয়ের নাম ” দিওয়ানই জানকী”।

এবার আসি, ইন্দুবালার কথায়। সঙ্গীত জগতের এক নক্ষত্র। ডাক পড়তো নানান জমিদার বাড়ির অনুষ্ঠানে। ইন্দুবালা দেবী নাচগানের আসরে বাইজিদের চিরাচরিত প্রথা ভেঙেছেন। গহরজান এর সাথে বিভিন্ন আসরে গিয়ে তিনি শুধু গানই গাইতেন, নাচ তিনি কোনদিনই করেননি। তাও আবার প্রথা ভেঙে বাংলা গান৷ বিশেষ করে, নজরুলের গান। তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ঢাকায়। আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন কিনা তিনি ইতস্তত ছিলেন। ঢাকাতো তালের দেশ। সেই ঢাকাকে তার সুর দিয়ে মাতিয়ে তুলতে পারবেন কিনা, সেই দুশ্চিন্তায় তিনি কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, ঢাকা থেকে যশ নিয়ে ফেরত আসতে পারলে এই মন্দিরে এসে তিনি পুজো দেবেন।

অন্যান্য আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বাইজিদের মধ্যে ছিলেন আন্নু, গান্নু এবং নওয়াবিন নামের তিনবোন। তাদের রূপের ঝলকে ঝলমল করতো আসরগুলো। তিনজনের মধ্যে ছোট বোন ছিল বেশ যোগ্য। যোগ্যতা তাকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল। অর্জিত অর্থ দিয়ে শহরে বেশ পাকাপোক্তভাবে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করেছিল এই তিন বোন। বাগানবাড়ি থেকে শুরু করে সবই ছিল তাদের। ডাকসাইটে নওয়াবিন ও তার বোনেরা ১৮৮০ সালে ঢাকায় প্রথম নাটক মঞ্চায়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

আবার রাজলক্ষ্মীর জীবন দর্শন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে জীবনের আদর্শ কিছুটা শরৎচন্দ্রের নায়িকার মত ছিল। না, এই রাজলক্ষ্মী শরৎচন্দ্রের রাজলক্ষ্মী নয়, জিন্দাবাহারের বাইজি রাজলক্ষ্মীর কথা বলছি। পাঁচ-ছয়টি বাড়ির মালিক তিনি। ক্রমাগত দান ধ্যানে ব্যস্ত থাকতেন। ১৮৮৬ সালে ঢাকায় ভূমিকম্পে কালীবাড়ি মন্দির ভেঙে গেলো। আবার নতুন করে ঠিক করার জন্য অর্থের দরকার। কে দেবে? এগিয়ে আসলেন রাজলক্ষ্মী বাই। ঢাকায় পানি সরবরাহের প্রয়োজনে নবাবকে সাহায্য করার জন্য রাজলক্ষ্মী এবং আমিরজান ৫০০ টাকা করে অনুদান দিতে চেয়েছিলেন।

রাজবাড়ির উৎসবে…

ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য খান মাহমুদের ডায়েরি থেকে জানা যায়, ঢাকার নবাবেরা আহসান মঞ্জিলে এবং শাহবাগের ইসরাত মঞ্জিলে, দিলকুশার বাগান বাড়িতে বিভিন্ন সময় আয়োজন করতেন বড় বড় অনুষ্ঠানের। বাইজির নাচ ছিল তার মধ্যে একটি আবশ্যকীয় উপাদান। বিখ্যাত বাইজিদের অংশগ্রহণ যেনো মাহফিলগুলোকে অন্য আরেকটি উচ্চতায় নিয়ে যেতো। আর এটি যদি হতো নবাবের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান, তবেতো কোন কার্পণ্য হতেই পারেনা। আসর রঙিন করবার জন্য ডাক পান দেবী বালা। বিখ্যাত বাইজি তিনি। পিনপতন নীরবতায় চলে তার অনুষ্ঠান। মুগ্ধ দর্শক প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করে এ বাইজির চমক। কে এই দেবী বালা? জানতে ইচ্ছে করছে, তাই না? তিনি ঢাকার প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র (নির্বাক) “The Last Kiss” এর বিপ্লবী নায়িকা। ।

দেবাশিষ দাস, রিমেম্বারিং দা ম্যাগনিফিসেন্ট মোঘলস বই এ উল্লেখ করেন যে এক সময় ছিল যখন বাইজিদের এই পেশাকে এতোটা খারাপ চোখে মূল্যায়ন করা হতো না। তারা তখন শিল্পী হিসেবে বিবেচিত হতো। আমরা দেখেছি, মোঘল সম্রাজ্যে বাইজির সংস্কৃতি শুধু সন্মানেরই ছিল না, তারা এমন উন্নত কৃষ্টি, জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন ছিল যে অভিজাত পরিবারের মেয়েদের তাদের কাছে পাঠানো হতো নাচ-গান ও সংস্কৃতি শেখানোর জন্য। তাদের দর্শকরাও ছিলেন একেকজন নাচ-গানের বোদ্ধা এবং তারা নির্মল আনন্দ-বিনোদনের মধ্যেই থাকতো।

তারপর বৃটিশরা প্রথম যখন ভারতে আসে, তখন তারা তাদের পরিবারের অন্য সদস্য- তাদের বউ, বাচ্চা, ছেলেমেয়েদের সাথে করে নিয়ে আসেনি। এইসময় তারা মোঘলদের সাথে ওঠাবসা করার জন্য এবং বাণিজ্যের সুবিধার জন্য বাইজিদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতো। এমনকি সেসময় তারা অনেকে ঐসব বাইজিদের বিয়েও করেছিল। তাদের সম্পত্তিও দান করেছিল। জানা যায়, ১৮০৩ সালের পর থেকে যখন ইংরেজদের স্বজাতীয় মেমসাহেবরা ভারতে এসে বসবাস করতে থাকে তখন থেকে তারা ওইসব বাইজিদের সঙ্গ ছাড়তে শুরু করে এবং তাদের পতিতা হিসেবে প্রচার করতে থাকে এবং ইংরেজ সরকার এই বাইজি প্রথার উচ্ছেদ করতে ব্যস্ত হয়। এছাড়া, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর তারা বাইজিদের পুরো বিরোধী হয়ে যায়। কারণ, উত্তর ভারতে বাইজিরা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল এবং সিপাহী বিদ্রোহের সময় তারা সিপাহীদের অর্থ ও খাদ্য সরবরাহসহ আশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু এই বাইজিরা স্বাধীনতা আন্দোলনে মূল্যবান ভূমিকা পালন করলেও পরে তাদের নির্মম পরিবেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বৃটিশদের অপমান-অসহযোগিতা এবং নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধীরে ধীরে বাইজিরা একসময় হারিয়ে যায়।

তথ্যসূত্রঃ
হাকিম হাবিবুর রহমান, ঢাকা:পঞ্চাশ বছর আগে।
মুনতাসির মামুন, ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী।
খন্দকার মাহমুদুল হাসান, ঢাকা অভিধান।
দেবাশিষ দাস, রেড ফোট: রিমেম্বারিং দা ম্যাগনিফিসেন্ট মোঘলস।
উইকিপিডিয়া।