হোয়াংহো নদীকে ‘চীনের দুঃখ’ কেনো বলা হয়, জানেন কি? কারণ ইতিহাসে ২৬ বার এই নদীর গতিপথ প্রচন্ডভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আর এই গতিপথ পরিবর্তনের ফলে মহাপ্লাবনে প্লাবিত হয়েছে চীনের অসংখ্য জমি-ঘর-বাড়ি-ক্ষেত। কর্দমাক্ত পীত বর্ণের ‘ইয়েলো রিভার’ খ্যাত চীনের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম নদীর গতিপথ বদলের সময় হওয়া ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্দশা প্রতিরোধে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন শুন। শুন ছিলেন চীনের আদি সমাজের নেতা। শুনের নির্দেশে গুন নামের একজন সম্মানিত ব্যক্তি হোয়াংহো নদীর তীব্র পানির স্রোত আটকানোর জন্য মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন। মাটির তৈরী এই বাঁধ টিকেছিলো মাত্র নয় বছর। এই নয় বছরে একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছে বাঁধটি। নয় বছর পর ঘটে যাওয়া আরও একটি মহাপ্লাবন চীনের মানুষের জীবন বিভিষীকাময় করে তুলেছিলো। চীনের অসহায় মানুষগুলোকে এই বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে আবির্ভূত হলেন একজন মহান ব্যক্তি, চীনের ইতিহাসের সর্বপ্রথম নায়ক ইয়ু দ্য গ্রেট।
ইয়ু ছিলেন গুনের ছেলে। উত্তরাধিকার সূত্রে ইয়েলো রিভারের পানিকে নিয়ন্ত্রণের গুরুদায়িত্ব তার ওপরই ন্যস্ত হয়। বাবার সাথে ছোট থেকেই কাজ করার সুবাদে অভিজ্ঞতাও ছিলো তার বিস্তর। তিনি অনেক ভেবে-চিন্তে কিছু চ্যানেল খননের কাজ শুরু করেন, যেগুলো নদীর পানিকে সাগরের দিকে নিয়ে যাবে। দীর্ঘ তেরো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অবশেষে তিনি সমর্থ হন হোয়াংহোর পানিকে নিয়ন্ত্রণ করতে। চীনের জনগণ আবেগের বশবর্তী হয়ে তাকে উপাধি দেন ‘দায়ু’, অর্থাৎ ‘মহান’।
আদি চৈনিক সমাজে যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব হস্তান্তরের নিয়ম ছিলো। আর সে সময় ইয়ুর চেয়ে যোগ্য ও দয়ালু আর কেউই ছিলেন না। ইয়ুর নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা, ব্যবস্থাপনা কৌশলের সুনিপুণতা এবং সমস্যা সমাধানে অসাধারণ পারদর্শিতা চীনের জনগণ সচক্ষে দেখেছিলো। তাই প্রাক্তন নেতা শুন ইয়ুকে পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনীত করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২০৭০ সালে মহান ইয়ু চীনের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করলেন, গড়ে তুললেন চীনের প্রথম সাম্রাজ্য, জিয়া সাম্রাজ্য।
জিয়া সাম্রাজ্যের সূচনা চীনের আদিবাসী রীতিকে একটি শ্রেণীবদ্ধ সুশৃঙ্খল সমাজে রূপান্তরিত করার প্রথম পদক্ষেপ ছিলো। জিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী করা হয় ‘ইয়াংচেং (বর্তমান হেনান প্রদেশের দেংফেং)’-কে। ইউ দ্য গ্রেট জিয়া সাম্রাজ্যকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার সুবিধার্থে নয়টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। এমন সুশৃঙ্খল সাম্রাজ্যবাদ চীনের ইতিহাসে এটাই প্রথম।
মহান ইয়ু শুধুমাত্র নামেই ‘গ্রেট’ ছিলেন না, তিনি সত্যিকার অর্থেই জনগণের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। নিজের বিয়ের মাত্র চার দিনের মাথায় তিনি বাড়ি ত্যাগ করেন এবং বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণে সফল না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ তেরো বছরেও তিনি বাড়ি ফিরে যান নি। এর মাঝে তিন বার নিজের বাড়ির সামনের পথ অতিক্রম করেছেন ইয়ু, অথচ জনসাধারণের প্রতি তার মায়া সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। তার অনুপস্থিতিতেই তার ছেলের জন্ম হয়েছে। এই সংবাদ পেয়েও তিনি বাড়ি ফিরেন নি।
মহাপ্লাবন নিয়ন্ত্রণের পর নদীর পানি ও মাটির সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে উত্তম ফসল উৎপাদন ও জমিতে সেচ দেয়ার অভিনব কৌশল রপ্ত করেন ইয়ু। সেই সাথে হাঁস ও রাজহাঁস পালন এবং মাছ চাষের মাধ্যমে জিয়া সাম্রাজ্যকে সমৃদ্ধি ও শান্তির শীর্ষে পৌঁছে দেন তিনি। নিজের ছেলেকে ‘কি’-কেও তিনি এ সমস্ত বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলেন, যেনো সাম্রাজ্যের অন্যান্য মানুষও কি এর কাছ থেকে শিখে কৃষিকাজ ও খামারবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে।
একজন যোগ্য শাসক শুধু রাষ্ট্রে শান্তি আনয়নেই ভূমিকা রাখেন না, রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার কথাও তার ভাবতে হয়। মহান ইয়ুও জিয়া সাম্রাজ্যকে সাংস্কৃতিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন, যা তার জ্ঞান ও যোগ্যতারই পরিচায়ক।
নিজের স্বার্থ-সুখ-পরিবারকে ত্যাগ করে জনগণের স্বার্থে সারা জীবন ব্যয় করার মতো শাসক ইতিহাসে খুবই বিরল। তবু আজও অনেকেই এই মহান শাসকের অবদানকে তো অস্বীকার করেনই, এমনকি তার অস্তিত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেন। হাতে গোণা মাত্র দু-একটি ওরাকল হাড় ছাড়া ইয়ু কিংবা জিয়া সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের পক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি বলে বহু পণ্ডিতেরা মত দিয়েছেন, ইয়ু এবং তার প্রতিষ্ঠিত জিয়া সাম্রাজ্যের কাহিনী –দুটোই কাল্পনিক। এ নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। অনেকে শ্যাং সাম্রাজ্যকেই চীনের প্রথম সাম্রাজ্য মনে করে থাকেন। তাদের কাছে আমি প্রশ্ন করতে চাই, হোয়াংহো নদী বা ইয়েলো রিভারের হিংস্র থাবা থেকে কেউ একজন তো নিশ্চয়ই চীনাদের বাঁচিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তি যে-ই হোক না কেনো, তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা কতোটা যুক্তিযুক্ত?
রেফারেন্স: