ভারতীয় পুরাণের এক অমূল্য নিদর্শন হচ্ছে মহাভারত। প্রাচীন ও সুবিশাল এই মহাকাব্যটিকে গন্য করা হয় পৃথিবীর প্রাচীন চার বিখ্যাত মহাকাব্যের একটি হিসেবে। এই বিশাল কাহিনি-কাব্যের পাতায় পাতায় আছে রাজনীতি, কূটনীতি, দর্শন, যুদ্ধ,ভালোবাসা, রাজাদের বীরত্বগাঁথা ইত্যাদি। বলা হয় যা ভারতবর্ষে আছে তার সবকিছুই মহাভারতে বর্ণিত আছে। মহাভারতের অসংখ্য কাহিনির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে উর্বশি-পুরুরবার কাহিনি। স্বর্গের অপ্সরী উর্বশির সাথে মর্ত্যের মানব পুরুরবার এই প্রেম কাহিনি কিংবদন্তি হয়ে আছে। এখানে সেই গল্পই সংক্ষেপে আলোচনার প্রয়াস করা হয়েছে।
উর্বশি ছিলেন স্বর্গের অপ্সরী। তিনি অমরাবতীতে দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের দেবসভায় অন্যতম প্রধান অপ্সরী ছিলেন। অপ্সরীরা মূলত ইন্দ্রের সভায় নৃত্য-গীতের মাধ্যমে দেবতাদের মনোরঞ্জন করে সভার শোভা বর্ধন করতেন। তারা ছিলেন অনিন্দ্যসুন্দরী ও ছলাকলায় পারদর্শী। পুরাণ মতে, এই অপ্সরীদের উৎপত্তি নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত আছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি মত হচ্ছে, অপ্সরীরা অপ অর্থাৎ পানি থেকে তৈরি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে অপ্সরীদের নিয়োজিত হতে দেখা যায়। বিভিন্ন দেবতাদের আদেশে বিভিন্ন কার্য সমাধা করতে বা বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন দেবতা বা মুনি-ঋষির অভিশাপে স্বর্গচূতি ঘটে তাদের। অনেক সময় কোনো ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে ধরায় মনুষ্য জন্ম নিতে হয় তাদের, পরে শাপ কেটে গেলে আবার স্বর্গে ফেরত চলে যেতেন তারা। স্বর্গের প্রধানতম অপ্সরীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন উর্বশি, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচি প্রমুখ।
এই গল্পটি উর্বশির সাথে রাজা পুরুরবার। রাজা পুরুরবা মহাভারতের বিখ্যাত এক রাজা।তিনি ছিলেন চন্দ্র বংশীয় প্রথম রাজা। চন্দ্রদেবের পুত্র বুধ ও মনুর কন্যা ইলার পুত্র হচ্ছেন এই পুরুরবা। পুরাণে বর্ণিত বিখ্যাত অনেক রাজা যেমনঃ যযাতি, দুষ্মন্ত, দুষ্মন্ত পুত্র ভরত (যার নাম অনুসারে এই ভূখন্ডের নাম ভারত) প্রমুখ এই পুরুরবা রাজার বংশধর ছিলেন।এছাড়া মহাভারতের বিখ্যাত দুই বংশ যেমন কৌরব, পান্ডব সহ শ্রীকৃষ্ণের যাদব বংশ সবই এই পুরুরবার বংশধর। তবে সব কিছু ছাপিয়ে পুরুরবা বিখ্যাত হয়ে আছেন উর্বশির প্রতি তার নিখাদ ভালোবাসার জন্যে। এই গল্পের শুরুটা হয় এরকম, দেবরাজ ইন্দ্র অন্যান্য সকল অপ্সরীদের থেকে উর্বশিকে বেশি পছন্দ করেন। উর্বশির প্রতি ইন্দ্রের এই অতিরিক্ত মনযোগ সহ্য হলো না অপর দেবতাদের। একদিন অতি তুচ্ছ কারণে বরুণ দেবতার অভিশাপ প্রাপ্ত হয়ে স্বর্গচ্যূত হয়ে মনুষ্যলোকে চলে আসে উর্বশি। এখানে কোনো এক সময়ে পুরুরবার সাথে দেখা হয় উর্বশির। প্রথম দর্শনে মুগ্ধ হয়ে উর্বশির দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন রাজা পুরুরবা। মুগ্ধ হয়ে উর্বশির ডাগর চোখের দিকে তাকিয়ে যেনো হারিয়ে যান রাজা। ঘনকালো লম্বা চুলের গভীরে যেনো সব কিছু ভুলে ডুব দিতে চান রাজা পুরুরবা। এদিকে সুদর্শন রাজাকে দেখে উর্বশিও মুগ্ধ। রাজা চাইলেন উর্বশিকে চিরকালের জন্যে নিজের করে পেতে। বিয়ের প্রস্তাব দিলেন রাজা।উর্বশিও সম্মতি জানালেন কিন্তু সাথে দিয়ে দিলেন অদ্ভুত তিন শর্ত। শর্ত গুলো হচ্ছেঃ
১. উর্বশির প্রিয় দুইটি মেষ শাবক সবসময় তাঁদের শয্যার দুই পাশে বাধাঁ থাকতে হবে। কখনও মেষ শাবকদ্বয়ের স্থান পরিবর্তন করা চলবে না।
২. নিজেদের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ছাড়া রাজা কখনো কোনো অবস্থাতেই উর্বশির সামনে পোশাক ছাড়া উপস্থিত হতে পারবেন না।
৩. উর্বশি শুধুমাত্র ঘি আহার করবেন। অন্য কোনো খাদ্য তিনি গ্রহণ করবেন না।
এই তিনটি শর্তের কোনো একটিতেই ব্যত্যয় ঘটলে উর্বশি ছেড়ে চলে যাবেন রাজা পুরুরবাকে। পুরুরবা বিনা সংকোচে সব মেনে নেন। উর্বশির শর্তে রাজি হয়ে তাকে বিয়ে করেন রাজা। নিজের স্বপ্নকন্যাকে রাণিরূপে পেয়ে মহাসুখে বেশ কবছর অতিবাহিত করলেন। উর্বশিও খুশি।কিন্তু খুশি নন দেবরাজ ইন্দ্র সহ স্বর্গের অন্যান্য দেবতারা। যে ছিলো ইন্দ্রের রাজসভার প্রধান আকর্ষন সেই উর্বশিকে হারিয়ে দেবতারাও অস্থির হয়ে আছেন। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো অন্যের বিবাহিত স্ত্রীকে কেড়ে নেয়া যায় না, যতই হোক না সে অপ্সরী। সবকিছু চিন্তা করে দেবতারা ঠিক করলেন যদি পুরুরবাকে দেয়া উর্বশির শর্তগুলার খেলাপ করা যায় তাহলে উর্বশি নিজেই পুরুরবাকে ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হবে। ইন্দ্র এবারে স্বর্গের গন্ধর্বদের পাঠালেন বিশেষ পরিকল্পনা করে। উল্লেখ্য যে, অপ্সরীদের মত গন্ধর্বরা এক বিশেষ শ্রেণী।তবে এরা পুরুষ। এরা মূলত স্বর্গের সভার গায়ক ও বাদক।
ইন্দ্রের পরিকল্পনামত গন্ধর্বেরা গভীর রাতে সুকৌশলে পুরুরবার প্রাসাদে তার শয়নকক্ষে প্রবেশ করলো। পুরুরবা এবং উর্বশি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সুযোগ বুঝে গন্ধর্বরা উর্বশির একটি মেষ শাবক তুলে নিয়ে পালালো। সেই সময়ে মেষ শাবকের ডাক শুনে উর্বশি ও রাজার ঘুম ভেঙে গেলো। প্রিয় মেষ শাবকটি এইভাবে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে দেখে চিৎকার করে উঠলো উর্বশি। কিন্তু রাজা শর্ত ভঙ্গ হওয়ার ভয়ে শোয়া থেকে উঠলেন না। কারণ সেই সময়ে তার গায়ে কোনো পোশাক ছিলো না। এবারে সুযোগ বুঝে গন্ধর্বরা বাকি মেষ শাবকটিকেও তুলে নিয়ে পালালো। চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন উর্বশি। এখন আর স্থির থাকতে পারলেন না রাজা। উর্বশির কান্না তার আর সহ্য হল না। তিনি সেই অবস্থাতেই অস্ত্র নিয়ে দুর্বৃত্তদের ধাওয়া করতে উদ্যত হলেন। সেই সময়ে দেবতারা বজ্রপাত ঘটালেন। ফলে উর্বশি রাজার সম্পূর্ণ অনাবৃত শরীর দেখে ফেললেন। হতবুদ্ধি রাজার তখন সেইসব নিয়ে ভাবার সময় ছিলো না। তিনি স্ত্রীর প্রিয় শাবকচোরদের পিছু ধাওয়া করতে ব্যস্ত ছিলেন। এদিকে উদ্দেশ্য সফল হওয়াতে গন্ধর্বেরা শাবকদুটিকে সেখানে রেখেই পালিয়ে যায়।রাজা যখন শাবক দুটিকে নিয়ে ফেরত আসে তখন দেখে যে উর্বশি আর নেই। কারণ রাজা ইতোমধ্যেই শর্ত ভঙ্গ করে ফেলেছেন। তাই প্রিয়তমা উর্বশি তাকে ছেড়ে চলে গেছে।
প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়লেন রাজা। কোনোকিছুতেই মন দিতে পারলেন না। সবসময় তার মন প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকেই খুঁজে ফেরে। রাজকার্য ফেলে রেখে তিনি পাগলের মত খুঁজে বেড়াতে লাগলেন উর্বশিকে বিভিন্ন জায়গায়। অবশেষে এক জায়গায় উর্বশিকে খুঁজে পেলেন রাজা। কিন্তু একি! উর্বশি যেনো রাজাকে দেখে এড়িয়ে যেতে চাইছে। রাজা উর্বশির কাছে কাতর কন্ঠে তার কাছে ফিরে আসার অনুরোধ জানান। নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান। রাজার এমন করুন দশা দেখে উর্বশিও খুব কষ্ট পেলেন। তিনি রাজাকে বোঝালেন যে, কিছু ভুলের আসলে মাসুল হয় না। তিনি আর রাজার জীবনে ফেরত আসতে পারবেন না। কিন্তু রাজা নাছোড়বান্দা। তিনি বাঁচবেন না উর্বশিকে ছাড়া। তখন উর্বশি রাজাকে বোঝালেন যে, তার গর্ভে রাজার সন্তান আছে।ঠিক এক বছর পর তিনি রাজার কাছে এসে রাজাকে তার সন্তান দিয়ে যাবেন এবং রাজার সাথে একটি রাত কাটাবেন। এছাড়া আর কোনো কিছু করার নেই। দেবতাদের নিয়ম এমনই।এর বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। কিছুটা আশান্বিত হয়ে রাজা পুরুরবা চলে আসেন প্রাসাদে।হোক না একটা রাতের জন্যে।তাও তো তিনি তার ভালোবাসাকে কাছে পাবেন। এভাবে এক বছর পর উর্বশি তাদের প্রথম সন্তান আয়ুকে রাজার কাছে নিয়ে আসেন এবং তার সাথে এক রাত অতিবাহিত করেন।এই আয়ুর পুত্রই বিখ্যাত রাজা যযাতি, যিনি নিজের বার্ধক্য পুত্রকে দিয়ে পুত্রের যৌবন গ্রহন করেছিলেন এবং পরে তার থেকেই কুরু, পান্ডব, পাঞ্চাল ইত্যাদি বিখ্যাত বংশের উৎপত্তি। যাহোক, এভাবে উর্বশি আরোও ছয় বছর ও ছয় রাত রাজাকে দিলেন এবং তাদের প্রতি বছর একটি করে মোট সাত পুত্র সন্তান জন্মে। কিন্তু ব্যাকুল রাজা প্রেয়সীকে চিরকালের জন্যে পেতে চান। রাজার এই আকুলতা ও গভীর প্রেম স্পর্শ করে দেবতাদের। তারা উর্বশির মাধ্যমে রাজা পুরুরবাকে জানিয়ে দেন যে, একটা উপায়ে রাজা উর্বশির সাথে স্থায়ীভাবে থাকতে পারেন। কিন্তু সেই জন্যে তাকে একবারের জন্যে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে। প্রেমিক পুরুরবা রাজি হলেন তার রাজ্যপাট, ভোগ-বিলাস, সন্তান সব ছেড়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্যে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে। তার এই ত্যাগ দেখে দেবতারা সন্তুষ্ট হন এবং মৃত্যুর পর পুরুরবা উর্বশির সাথে চিরকালের জন্যে ইন্দ্রলোকে অবস্থান করেন।
প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি মহাকবি কালিদাস পুরুরবা-উর্বশির এই কাহিনী নিয়ে “বিক্রম উর্বশি” নামক নাটক রচনা করেছেন। যদিও কালিদাসের কাহিনী কিছুটা আলাদা ছিলো শুরুর দিকে। মূলত উর্বশির অভিশাপ প্রাপ্তির পেছনের কাহিনী বিভিন্নরকম বর্ণনা পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যে, কেশী নামক এক অসুর উর্বশিকে হরণকালে পুরুরবা উদ্ধার করলে তারা একে অপরের প্রতি অনুরোক্ত হন।পরে স্বর্গে অভিনয়কালে উর্বশি ভুলে পুরুরবার নাম বললে তখন দেবতা বরুণ-মিত্র তাকে মনুষ্য জন্ম নিয়ে পুরুরবার স্ত্রী জীবন অতিবাহিত করার অভিশাপ দেন। পুরুরবা ও উর্বশির এই কাহিনী মহাভারত ছাপিয়ে যুগে যুগে চর্চিত হয়ে আসছে স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যকার প্রেমের কাহিনী হিসেবে। এই কাহিনী যেনো রূপক অর্থে প্রেমের ক্ষেত্রে সকল ব্যবধান, সকল বাধাঁকে অতিক্রম করার প্রেরণা দেয়।