খ্রিস্টের জন্মেরও সাতশো বছর আগের গল্প বলছি। প্রাচীন এট্রারিয়া অঞ্চল, বর্তমান ইতালি। চলছে এক অভিনব শোভাযাত্রা, মৃত্যু শোভাযাত্রা। কি, অবাক হচ্ছেন? হয়তো ভাবছেন মৃত্যুর আবার শোভাযাত্রা কি করে হয়! আসলেই কিন্তু মৃত্যুকে উদযাপন করতো এট্রারিয়ার বাসিন্দারা। এট্রারিয়ার এই জনগোষ্ঠীকে বলা হতো এট্রাস্কান। সে যা-ই হোক, গল্পে ফিরে যাওয়া যাক। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সমস্ত কাজের তদারকি করছেন একজন এট্রাস্কান নারী। শোভাযাত্রার সামনেই রয়েছে শব নিয়ে যাবার খাটিয়া। মৃতের পরিবারের বাকি সদস্যরা সারিবদ্ধভাবে রঙিন কাপড় গায়ে দিয়ে সেজেগুজে নাচ-গান করতে করতে এগিয়ে চলেছে মৃতদেহের সাথে সাথে। পাড়া-প্রতিবেশী সবাই-ই অংশ নিয়েছে সেই শোভাযাত্রায়। আরও অনেক নারী-পুরুষ মিলিত হয়েছে উৎসবে। কারো হাতে বাঁশি, কারো হাতে খাবারের পাত্র। মৃতের বিদায় মুহূর্তে চলছে দারুণ পানাহারের আয়োজন। এ যেনো এক মহা আনন্দযজ্ঞ!

পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠে মৃতের জন্য তৈরী নেক্রোপলিসে রেখে আসা হচ্ছে খাবারের পাত্র, মৃতের পছন্দের খাবার, ওয়াইন, সোনার অলংকার, আয়না এবং হেলান দিয়ে আরাম করে বসে থাকার উপযোগী আরামকেদারা বা চেয়ার। নেক্রোপলিসের বিশাল দেয়ালে আঁকা আছে আনন্দের এসব খুঁটিনাটি।

মৃত্যু এবং জীবন দুটোই এভাবে উদযাপন করতো এট্রাস্কানরা। তারা বিশ্বাস করতো, মৃত্যু মানে শেষ নয়, বরং এটি আরও একটি জীবনেরই সূচনা, প্রথম জীবনের এক ধরনের পরিবর্তন। তারা বিশ্বাস করতো, তাদের পূর্বপুরুষেরা সবাই জীবিত ও স্বর্গে অবস্থান করছে এবং সদ্যমৃত এই ব্যক্তি এবার তাদের সঙ্গেই মিলিত হতে যাচ্ছে। তারা নিজেদেরকেই বিধাতা মনে করতো এবং বিশ্বাস করতো, জীবিত মানুষের ভালো-মন্দের সমস্ত দায়িত্ব মৃতেরা নেয়। তারা জানতো, জীবন সুন্দর। কিন্তু আবার এ-ও মানতো, মৃত্যু আরও বেশি সুন্দর। তাই কেউ মারা গেলে মনে কোনো দুঃখ-বেদনা স্থান পেতো না তাদের। বিশাল ভোজ ও পানাহারের মাধ্যমে মৃতের পছন্দের গানবাজনা বাজিয়ে উদযাপন করা হতো মৃত্যু উৎসব। কি এক অদ্ভূত সংস্কৃতি!

এট্রাস্কান সভ্যতা ফিকরনি সিসটা'

নভিয়াস প্লটিয়াসের ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য ‘ফিকরনি সিসটা’

আচমকাই হারিয়ে গিয়েছিলো এই এট্রাস্কান নামটি। তবে এতো বড় ও সমৃদ্ধ এক সভ্যতার অস্তিত্ব তো আর আজীবন আড়ালে থাকতে পারে না। তাই যেমন হঠাৎ করেই হারিয়ে গিয়েছিলো, তেমনি হঠাৎ করেই আবার পাওয়া গেলো সবকিছু। একে একে মিললো সমস্ত সূত্রের সমাধান। কারা এই এট্রাস্কান? হেরোডেটাস মনে করেন, তারা ছিলো এশিয়া মাইনরের আদিবাসী। বর্তমান জিন পরীক্ষার মাধ্যমেও হেরোডেটাসের কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়। তাদের গবাদি পশুগুলোর ডিএনএ টেস্ট থেকে জানা যায় যে, এরা পূর্ব থেকেই এসেছে। আর এট্রাস্কান মরদেহগুলোর ডিএনএ টেস্ট থেকে দেখতে পাওয়া যায় যে, তারা প্রাচীন তুরস্কের পূর্ব দিকে সমুদ্রতীরবর্তী ভূমি লিডিয়া থেকেই এসেছে। আঠারো বছরব্যাপী খরা ও দুর্ভিক্ষের কারণে সেখানকার সম্রাট তার সাম্রাজ্যের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সব উপকরণসমেত নৌকায় উঠিয়ে দিয়েছিলেন। একটি সুন্দর জীবন পাবার আশায় তারা অ্যানাটোলিয়া থেকে ইতালিতে এসে বসবাস শুরু করে।

এট্রাস্কানরা ইতালির দীর্ঘতম নদী টাইবারের উত্তর-দক্ষিণে আস্তে আস্তে নিজেদের বসতি গড়ে তুলেছিলো ঠিকই, কিন্তু সাম্রাজ্য গড়তে পারে নি। ছোট ছোট অনেকগুলো নগররাষ্ট্র মিলেই গড়ে উঠেছিলো এট্রাস্কান সভ্যতা। পাহাড়ের উপরিভাগ ও জলাভূমি সাফ করে বেশ চমৎকারভাবেই নিজেদের আবাসন গড়ে তুলেছিলো এট্রাস্কানরা। পাহাড় ও চারিদিকে সমুদ্র দিয়ে বেষ্টিত ছিলো বলে এট্রাস্কানদের বিদেশী আক্রমণের ভয় ছিলো না বললেই চলে। তবে এদের নগররাষ্ট্রগুলো ছিলো দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এট্রারিয়া ছিলো তাদের রাজ্যেরই রাজধানী।

পেনিনসুলায় এই এট্রাস্কানরাই ছিলো সবচেয়ে বেশি আধুনিক, মার্জিত, শিক্ষিত এবং আমুদে। যেনো সরাসরি স্বর্গ থেকে অবতরণ করে একগুচ্ছ মানুষ মিলে গড়ে তুলেছিলো এক অদ্ভূত সভ্যতা। সুন্দর রাস্তা তৈরী, জলাভূমি সাফকরণ, খাল খনন, সুন্দর শস্য উৎপাদন –সবকিছুই ছিলো এট্রাস্কানদের সভ্য বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ।

ব্রোঞ্জ যুগে তারা বসবাস করতো মাটির তৈরী গোলাকার কুঁড়েঘরে। ইতালির উর্বর মাটি, সমুদ্রের বিশাল সম্ভাবনা, বনভূমি, খনিজ এবং আকরকে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে শক্তিশালী এক জাতিতে পরিণত করে ফেললো এট্রাস্কানরা। তাদের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির রহস্য হলো মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা জাদুকরী এক আকরিক, আয়রন বা লোহা। এই লোহার মাধ্যমেই সমুদ্রপথে সমগ্র অঞ্চলব্যাপী অত্যন্ত শক্তিশালী ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করেছিলো এট্রাস্কানরা। নিজেদের উদ্ভাবিত নতুন ধরনের সব যন্ত্রপাতি দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো তারা বহিঃর্বিশ্বকে। এ যেনো সেই যুগের এক ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রিভোলিউশান!

তারা কৃষিকাজের জন্য লাঙ্গল তৈরী করেছিলো এবং অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করে ফসলে হয়েছিলো সমৃদ্ধ। লোহা দিয়ে বহু গৃহস্থালি যন্ত্র তৈরীর মাধ্যমে নিজেদের জীবনযাত্রাকে তারা অনেক উঁচুতে নিয়ে গিয়েছিলো।

এট্রাস্কান সভ্যতার তৈরী সিংহরূপী দানব

সিরিয়ার সিংহের অনুকরণে কখনো সিংহ না দেখা এট্রাস্কানদের তৈরী সিংহরূপী দানবমূর্তি ‘সিমেরা’

এট্রাস্কানদের খনিজের লোভে বাইরে থেকে অনেকেই তাদের ভূখন্ডে প্রবেশ করার চেষ্টা চালিয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু তারা প্রত্যেককে শক্ত হাতে দমন করে এসেছে সবসময়। যদিও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদের দ্বার ছিলো সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রতিবেশী রাজ্যের মনোহরি দ্রব্যের প্রতি নেশা থেকে তারা নিজেদের ধাতু এবং অন্যান্য খনিজ ও আকরিকের বিনিময়ে নিয়ে এসেছিলো হরেক রকমের খাদ্যসামগ্রী, জলপাই তেল, ওয়াইন ও গহনা। একটা পর্যায়ে সেসব সামগ্রীও নিজেরাই উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করে ফেলে এট্রাস্কানরা। একই সাথে ফরাসি ও গোলবাসীদের কাছে রপ্তানি করে আরও অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠলো তারা।

এমন কথাও কিন্তু শোনা যায় যে, ফরাসিদেরকে মদ্যপান করা শিখিয়েছেই এই এট্রাস্কান জনগোষ্ঠী। সমুদ্রপথে বাণিজ্যের সময় জলদস্যুদের মোকাবেলা করবার জন্য এট্রাস্কান ইঞ্জিনিয়াররা বানিয়ে ফেলেছিলো দুই পালবিশিষ্ট নৌকা, যার দ্রুতগামীতার সাথে হার মানতে বাধ্য ছিলো সেই সময়ের অন্য সব জলযান। পরবর্তীতে তাদের নৌকা বানানোর এই বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করেই রোমানরা হয়েছিলো সর্বেসর্বা।

রোমানদের থেকে এট্রাস্কানরা কতো বেশি উন্নত ছিলো তা একটি উদাহরণেই স্পষ্ট হয়। রোমানরা যখন মাটির তৈরী ঘরে থাকতো, তখন এট্রাস্কানরা ইটের তৈরী বাড়িঘর নির্মাণ করে থাকতো। তাদের জীবনধারণের সমস্ত প্রক্রিয়ায় ছিলো আধুনিকতার ছোঁয়া। হাজার হাজার ইটের তৈরী বাড়িঘর দিয়ে সুসজ্জিত ছিলো এট্রস্কানদের নগরী। পানির ব্যবস্থাপনা, সুয়েজ ব্যবস্থা ছিলো অসাধারণ।

একটা পর্যায়ে এট্রাস্কানদের শক্তি কমতে শুরু করলে রোমানরা শক্তি সঞ্চয় করে এগোতে শুরু করেছিলো ঠিকই, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত রোমান রাজাও ছিলো এট্রাস্কান। অর্থাৎ এট্রাস্কানদের শক্তি ও সামর্থ্য এতো বেশি ছিলো যে, রোমের ওপরও ছিলো তাদের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ।

এট্রাস্কান সভ্যতার চমৎকার শিল্পকলা

এট্রাস্কান পাত্রে চমৎকার শিল্পকলা

গ্রীক ও রোমানরা ছিলো এট্রাস্কানদের প্রতিবেশী। তারা ভীষণ ঈর্ষা করতো এট্রাস্কানদের। এট্রাস্কানরা নিজেদের ইতিহাস লিখে রাখে নি বলে তাদের সম্পর্কে আমরা জেনেছিই গ্রীক ও রোমানদের লেখা থেকে। তাদের উদারচিত্ত ও বৈষম্যহীন জীবনধারা এবং নারীদের অবাধ স্বাধীনতাকে গ্রীকরা নেতিবাচকভাবেই ফুটিয়ে তুলেছে নিজেদের লেখনীতে। এট্রাস্কান কবরগুলো যদি খুঁজে পাওয়া না যেতো, তাহলে হয়তো তাদের মতো এতো যোগ্য, উদার ও লিঙ্গীয় বৈষম্যহীন এক সমাজের অস্তিত্ব সম্পর্কে কখনো জানতেই পারতাম না আমরা। হয়তো আজও তাদেরকে আমরা গ্রীক ও রোমানদের দৃষ্টিকোণে অসভ্য ও বর্বর এক জাতি হিসেবেই দেখতে পেতাম। কথায় বলে না, বিজয়ীদের হাতে লেখা ইতিহাস বিকৃত হবার সম্ভাবনাই বেশি। এমনটাই হয়েছিলো এট্রাস্কানদের ক্ষেত্রে। তবে একদম হঠাৎ করেই পেয়ে যাওয়া এট্রস্কান নেক্রোপলিস, তাদের মাটির পাত্র, গহনা ও অন্যান্য দ্রব্যাদি আমাদেরকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক এট্রস্কান জাতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

এ কথা সত্য যে, এট্রাস্কানদের ছিলো নিজস্ব বর্ণমালা, যদিও তারা এটা গ্রহণ করেছিলো গ্রীকদের কাছ থেকে। গ্রীকদের বর্ণগুলোকে তারা কিছুটা পরিবর্তন করে নিজস্ব রূপ দিয়েছিলো। আর এ কারণেই তাদের ভাষা আজও আমাদের কাছে হয়ে আছে দুর্বোধ্য। পরবর্তীতে তাদের বর্ণমালাকে রোমানরা গ্রহণ করলেও ল্যাটিন ভাষার বহুল জনপ্রিয়তার কারণে এক পর্যায়ে হারিয়ে যায় এট্রাস্কান ভাষা। হারিয়ে যায় তাদের গান, তাদের কবিতা, তাদের নাটক, তাদের সমস্ত সাহিত্য। তবে এই বিলুপ্তির অন্ধকারেও আজও কিছু কিছু শব্দ ইউরোপ কিংবা বিশ্বের আরো অনেক জায়গায় আমরা ব্যবহৃত হতে দেখি, যার উৎস ছিলো এট্রাস্কানরা।

তাদের সমাধির মন্দিরগুলো ছিলো আশ্চর্যজনকভাবে গোছানো। গ্রীক স্থাপত্যের প্রভাবে গড়া মন্দিরগুলো দক্ষিণ দিকে মুখ করে তৈরী করা হয়েছিলো। সমাধিতে রাখা ছিলো চমৎকার সব দ্রব্যাদি -নকশা আঁকা মাটির পাত্র, ধাতুর তৈরী জিনিসপত্র, কারুকাজ করা পাথরের তৈরী জিনিসপত্র ও নানান ধরনের অলংকার। দেয়ালে থাকতো রঙিন সব চিত্র, নারী-পুরুষের ভালোবাসার ছবি। এ ছাড়াও স্বামী-স্ত্রীর সৌহার্দ্যপূর্ণ মিষ্টি প্রেমে মুখর সমাধিমূর্তি এবং ফ্রেস্কোও তৈরী করেছিলো তারা। সব জায়গায় যুগল প্রেমের ছবি প্রমাণ করে তাদের সম্পর্কের কেমিস্ট্রি ও গভীরতা। লিঙ্গীয় বৈষম্য ছিলোই না বললে চলে।

Fresco Painting in Triclinio Tomb of the Funerary Banquets

ট্রিক্লিনিও সমাধিতে ফ্রেস্কো পেন্টিং অফ দ্য ফানারারি ভোজ

প্রচুর আয়না পাওয়া গিয়েছে এট্রাস্কানদের। আয়নার পেছনেও পাওয়া গেছে চিত্রকলা। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে দেখা করতে যাবার আগে মৃত্যুপথযাত্রীর প্রয়োজন হতো এই আয়না। আয়নার উলটো দিকে কিছু লেখাও পাওয়া গেছে। এ থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, এট্রাস্কান নারীরা শিক্ষিত ছিলো। কোনো কোনো আয়নার পেছনে ‘লাসা’ নামের এক দেবতার ছবি আঁকা থাকতো, তার হাতে থাকতো পারফিউমের বোতল। মৃত্যুর পর সুগন্ধি সরবরাহ করা হবে –এমন বিশ্বাস থেকেই আয়নার পেছনে এই ছবিটি আঁকা হতো।

এট্রাস্কান সভ্যতায় সংস্কৃতির বিকাশ হয় দ্রুতগতিতে। বিপুল পরিমাণ অর্থ তারা আর্টের ওপরে খরচ করেছে। অসংখ্য রঙিন ছবি দেখতে পাওয়া গিয়েছে তাদের –ভোজসভার ছবি, খেলাধুলার ছবি, দৈনন্দিন জীবনযাপনের ছবি, চমৎকার রঙিন জামাকাপড় পরে নাচ-গানের দৃশ্য ও আরো অনেক অনেক বাস্তবতা ধরা পড়েছে তাদের চিত্রকলায়।

তারা নিজেদের জীবন ও মৃত্যু উভয়কেই ভালোবাসতো। নারী-পুরুষের সম্পর্ককেও তারা মর্যাদা দিতে জানতো। এট্রাস্কান সমাজে নারীদেরকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিবেচনা করা হতো। সম্পদ তৈরীর ক্ষেত্রেও কোনো বাধা ছিলো না। সামাজিক জীবন ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসে আনন্দ উপভোগ করার রেওয়াজ ছিলো এট্রস্কান সমাজে। থিয়েটার কিংবা চ্যারিয়ট রেইস দেখতে গিয়েও স্বামী এবং স্ত্রী একজন আরেকজনের গায়ে হেলান দিয়ে বসে সমস্তটাই উপভোগ করতো। সব জায়গায় এবং সব ক্ষেত্রে অবাধ বিচরণে বিশ্বাসী ছিলো এট্রাস্কানরা। খুব সম্ভবত চ্যারিয়ট প্রতিযোগীতার আবিষ্কর্তাও তারাই। নারী-পুরুষের এই অবাধ মেলামেশাকে গ্রীক বা রোমানরা কেউই ভালো চোখে দেখে নি, তারা প্রতিনিয়ত কটাক্ষ করে গেছে এই জাতিকে।

গ্রীক লেখকেরা তাদের ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে যেনো একটু বেশিই অতিরঞ্জন করে ফেলেছে। তারা এট্রাস্কানদেরকে স্বাধীনতা ভোগকারী ব্যভিচারী বলে আখ্যা দিয়েছে। গ্রীক বা রোমান নারীদের এই স্বাধীনতা ছিলো না বলেই হয়তো এমন সমালোচনা। গ্রীক নারীদের না ছিলো কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি, না ছিলো কোনো শিক্ষার সুযোগ। গ্রীক নারীরা সবকিছুতেই স্বামীর অধীনে থাকতো। বহুকাল পর্যন্ত এট্রাস্কানদের সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা প্রচলিত থাকলেও তাদের সমধিমন্দিরের আবিষ্কারে সব মিথ্যা প্রচারণা ধরা পড়ে যায়।

Sarcophagus of the Spouses

স্বামী / স্ত্রীর সারকোফ্যাগাস

এট্রাস্কান সমাজের নারীরা ধনী ছিলো, ঘোড়া চলাতে পারতো, সন্তানদের নামও মায়ের নাম অনুসারে হতে পারতো। নারীরা যে এট্রাস্কান যুগে প্রচন্ড মর্যাদা পেতো, তার একটা প্রমাণ হলো, এট্রাস্কান সভ্যতায় অনেক নারী প্রিস্ট ছিলেন।

গ্রীকদের সাথে এতো যুদ্ধ ও বৈরিতা থাকলেও বাণিজ্য কিন্তু ঠিকই চলতো। প্রতিটি গ্রীক বাড়িতে যেমন এট্রাস্কান মাটির পাত্র পাওয়া গিয়েছে, তেমনি এট্রাস্কান বাড়িতেও মিলেছে গ্রীক মৃৎপাত্র। এই বাণিজ্যিক যোগাযোগের মাধ্যমেই চলেছে তাদের সাথে জ্ঞান কিংবা ধ্যান-ধারণার আদান-প্রদানও। গ্রীকদের বর্ণমালাকে এভাবেই এট্রাস্কানরা গ্রহণ করেছিলো এক সময়। দূর-দূরান্তে ব্যবসা শুরু হলে তারা সিরিয়া পর্যন্তও পৌঁছে যায় এবং সেখান থেকে চিত্রকলার নানা কৌশলও শিখে নেয়। ক্রমে ক্রমে তারা এই চিত্রকলাকে উন্নতির পথেই নিয়ে যায়। ইতালিতে সিংহ পাওয়া না গেলেও সিরিয়া থেকে অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যমে ধাতুর তৈরী অসাধারণ সিংহের মূর্তি বানিয়ে ফেলেছিলো তারা। সোনার অলংকার তৈরীতে তাদের দক্ষতা ছিলো চোখে পড়বার মতো।

সেই এট্রাস্কানদের হেঁটে যাওয়া পথগুলো কিন্তু এখনো রয়েছে। তাদের সম্পর্কে জানবার পর যে কারো সেই পথ দিয়ে চলার সময় মানসপটে ভেসে উঠতে পারে, এট্রাস্কান নারী-পুরুষেরা স্বাধীনভাবে সেখান দিয়ে চলাফেরা করছে এবং একে অপরের প্রতি নিজেদের অনুভূতিগুলো স্বাধীনভাবে প্রকাশ করে চলেছে।

তাদের দাসরাও ছিলো স্বাধীনচেতা, উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দাস রাখার প্রথা ছিলো এবং দাসরা কোনো রকম বাধা ছাড়াই স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারতো। দাস-দাসীদেরকে তারা সম্মান করতো। এট্রাস্কান যুগে দাসরা সবাই স্বচ্ছল জীবনযাপন করতো। গ্রীক লেখকেরাও বলেছেন, এট্রাস্কানদের দাসদের দেখলে মনেই হতো না যে তারা পরাধীন। এমনকি বিশেষ পরিস্থিতিতে দাসদেরকে তারা পুরোপুরি স্বাধীনও করে দিতো।

এট্রাস্কানরা নৈতিকতায় বিশ্বাসী ছিলো। সবাইকে সৎ পথে থাকার শিক্ষা দিতো তারা। গাছের পাতা, নদী, সমুদ্র সবকিছুকেই তারা উপাসনা করতো। তারা বিশ্বাস করতো প্রকৃতির প্রত্যেক উপাদানই কোনো না কোনো নির্দেশ পাঠাচ্ছে তাদেরকে। পাখি কোন দিক থেকে উড়ে আসলো ও কোন দিকে চলে গেলো, এমন ছোট ছোট বিষয়গুলোও ছিলো তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

রোমানরা সাদা-বেগুনী-লাল তথা নানান রং এর রোব দিয়ে তৈরী ‘টোগা’ নামের যে কাপড় ব্যবহার করে থাকে, তার প্রচলন এট্রাস্কানদের অনুকরণেই হয়েছিলো। এ ছাড়াও রাস্তা তৈরীর জ্ঞান, অসংখ্য এট্রাস্কান শব্দ, মৃত্যু পরবর্তী প্রক্রিয়ার অদ্ভূত সব নিয়ম, মৃত্যুর বিজয়োৎসব পালন, রঙিন বস্ত্রের ব্যবহার, কুকুর পোষার প্রবণতা, স্পোর্টস, গ্ল্যাডিয়েটর্স –এসব কিছুই এট্রাস্কানদের থেকে একটু একটু করে মিশে যায় রোমান সংস্কৃতিতে।

Mirror Judgement of Paris Louvre

প্যারিস লুভরের মিরর জাজমেন্ট

কেনো হারিয়ে গেলো এতো আত্মবিশ্বাসী এক জাতি? অনেকেই বলে, সদাআনন্দময় ও বিলাসী জীবনে নিজেদেরকে বিলিয়ে দিয়েছিলো এট্রাস্কানরা। আশেপাশের শত্রুপক্ষ যে কখন এতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, সেটা বুঝতেই পারে নি তারা। নিজেদের মধ্যে ক্রমাগত অন্তঃর্যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষে তারা একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছিলো। তৈরী হচ্ছিলো বাণিজ্যিক দুর্বলতাও। আস্তে আস্তে সুযোগ বুঝে তাদের ছোট ছোট নগরগুলো নিজেদের দখলে নিতে থাকে রোমানরা এবং এক পর্যায়ে সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায় রোমানদের মধ্যে।

শেষ পর্যন্ত এট্রাস্কানদেরকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে দেয় রোমানরা। রোমানরা তাদের বিশাল জনসংখ্যা, হাজার হাজার পেটের খাদ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য আশেপাশের শস্যভান্ডারসম্পন্ন দেশগুলোর দিকে রাজনৈতিকভাবে দখলের জন্য অগ্রসর হতে থাকে। এট্রাস্কানরা এভাবেই রোমানদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। তাছাড়া এট্রাস্কানরা ছিলো ভীষণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তারা বিশ্বাস করতো যে, তাদের এই সভ্যতা এক হাজার বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে। এমনই বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারে বিশ্বাসও তাদেরকে রোমানদের কবল থেকে রক্ষা করতে না পারার জন্য দায়ী ছিলো।

সভ্যতার ইতিহাসে লৌহ যুগের সূচনাকারীরা শেষ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে নিজেদের আসল পরিচয়। আজও হয়তো এট্রাস্কান বংশোদ্ভূত কোনো নারী কিংবা পুরুষ রোমান পরিচয়ের আড়ালে জীবনযাপন করে যাচ্ছে। হয়তো সে নিজেও জানে না তার আসল পরিচয়। কিংবা কে জানে, হয়তো আমাদের মাঝেই রয়েছে কোনো এক স্বাধীনচেতা নারী, যার শরীরে বইছে এট্রাস্কান পূর্বপুরুষের রক্ত।

এট্রাস্কান পাত্র

লোহা ও মাটির তৈরী এট্রাস্কান পাত্র

রোমানদের আগ্রাসনে হারিয়ে গেলো আধুনিকতম এক সভ্যতা। টাস্কিনের হিলটপ সিটি আজ আর নেই। রোমানরা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে সেগুলোকে। তবে জোর গলায় বলা যায়, এট্রাস্কানরা না থাকলে রোমানদের জীবন এতো সহজ হতো না। রোমানদের বিশাল রাজত্ব গড়তে ও তাদের রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে গেছে এই এট্রাস্কানরা। একটু একটু করে এট্রাস্কানদের ভূখন্ড দখলের সাথে সাথে তাদের সমাজ-সংস্কৃতিও রোমানরা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে নেয়। আর পরবর্তীতে রোমানদের মাধ্যমেই এই জ্ঞান সমগ্র ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আজও কিন্তু সবই আছে, আমাদের মাঝেই উপস্থিত। কিন্তু আমরা জানতে বা বুঝতে পারছি না। হয়তো নিজেদের অজান্তেই কোনো এট্রাস্কান সংস্কৃতির অংশবিশেষ পালন করে আসছি আমরা দিনের পর দিন।

রেফারেন্সঃ