খ্রিস্টপূর্ব ১৯ শতক। গ্রীসের এথেন্স। ৮৫ জন শ্রমণ বৌদ্ধ ভিক্ষু ও অসংখ্য কৌতূহলী এথেন্সবাসীর ভিড়ের মধ্যমণি হয়ে আছেন একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, নাম জার্মানোচেগাস। তিনি এক মনে প্রার্থনায় রত। প্রার্থনা শেষে নিজের গায়ে পবিত্র পানীয় ছিটিয়ে দিলেন। এরপর খোখার রাজপুতদের প্রচলিত রীতি অনুসারে প্রথমেই নিজের কিছু চুল কেটে আগুনে পোড়ালেন তিনি। অবশেষে প্রস্তুত করে রাখা চিতায় শুয়ে পড়লেন নিজ থেকেই। কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন নিজের শরীর। আগুন দেয়া হলো চিতায়। একজন সাহসী খোখার রাজপুতের মতোই যন্ত্রণার কোনো ছাপ না দেখিয়ে নিজেকে অমর করবার প্রত্যাশায় অগ্নিদগ্ধ করলেন এই সন্ন্যাসী, বহু বছর আগে ঠিক যেমনটা করেছিলেন আলেকজান্ডারের বন্ধু তক্ষশীলার কালানোস। নিজেকে অমরত্বের পথে ধাবিত করবার জার্মানোচেগাসের এই প্রক্রিয়াটির সম্পূর্ণ বর্ণনা দিয়েছেন ম্যাকক্রিন্ডল। সন্ন্যাসীর এই আত্মহননের নিয়ম-নীতির মাঝে লাহোরের খোখার রাজপুতদের ছাপ এতো তীব্র কেনো! কে এই জার্মানোচেগাস? কি তার পরিচয়? সুদূর এথেন্সেই বা তিনি কেনো গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, জার্মানোচেগাস একজন শ্রমণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। তবে মূলত তিনি ছিলেন একজন খোখার রাজপুত, যারা ‘দত্ত’ উপাধিভুক্ত। কারবালার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিশ্বনবী মুহাম্মদের নাতি হুসেইনের সাথে হুসেইনের প্রতিরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়া সাত জন হিন্দু খোখার রাজপুতও প্রাণ দিয়েছিলেন, যাদের উত্তরসূরিদেরকে হুসেইনি ব্রাহ্মণ বলা হয়। কিভাবে বা কখন জার্মানোচেগাস বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন, তা জানা যায় নি। তবে অমরত্ব লাভের উদ্দেশ্যে নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে আত্মহত্যার রীতি শ্রমণ ও মহাযান উভয় বৌদ্ধাদর্শেই দৃশ্যমান।
খোখার বংশের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে লাহোর। পরবর্তীতে তারা পাঞ্জাবে স্থায়ী হয়। এদের ভয়ংকর প্রতাপ ও অসম সাহসিকতার গল্প ছিলো বিশ্ববিখ্যাত। মহারাজা রণজিৎ সিং বলেছিলেন, “আমি ভয় করি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে এবং খোখার রাজপুতদেরকে”। আলেকজান্ডারের কাছে পরাজিত পাঞ্জাবের রাজা পোরাসও ছিলেন এক অদম্য সাহসী দৃষ্টান্ত। পরাজিত হয়েও তিনি আলেকজান্ডারের সামনে নতি স্বীকারে নারাজ ছিলেন। মৃত্যুর আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও একজন রাজার সম্মানই তিনি পেতে চেয়েছিলেন আলেকজান্ডারের কাছ থেকে এবং নির্ভীকভাবে তিনি নিজের মনের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। আলেকজান্ডারও তার ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে তার রাজ্যের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
বলা হয়ে থাকে, জার্মানোচেগাসকে রাজা পোরাসই রোমান সম্রাট অগাস্টাসের দরবারে দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। তবে এ নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। অনেকে বলেন, তাকে তামিল পাণ্ড্য সাম্রাজ্য থেকে পাঠানো হয়েছিলো। ভান্দরকার ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইউনিট থেকে প্রকাশিত আর. এন. দান্দেকারের ‘সাম অ্যাসপেক্টস অফ দ্য ইন্দো-মেডিটেরিনিয়ান কন্ট্যাক্টস’ শিরোনামের গবেষণাপত্রটিতে বলা হয়েছে যে, পাণ্ড্য সাম্রাজ্যের দূত জার্মানোচেগাস খ্রিস্টপূর্ব ২৫ সালে বার্গোসা ত্যাগ করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ২১ সালে সুমোসে সম্রাট অগাস্টাসের জন্য অপেক্ষা করেন। তবে উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষের বার্গোসা (বর্তমান বারুচ) থেকে আসা এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে পাঞ্জাব কিংবা তামিলনাডু যেখান থেকেই পাঠানো হোক না কেনো, এই ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রাচীন ভারতবর্ষের সঙ্গে গ্রীস বা রোমের শক্তিশালী যোগাযোগেরই সাক্ষ্য দেয়। জানা যায়, সম্রাট অগাস্টাসের জন্য ভারতবর্ষ থেকে পাঠানো উপহারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো একটি দৈত্যাকৃতির অজগর সাপ, একটি বিশাল কচ্ছপ এবং পায়ের সাহায্যে তীর ছুঁড়তে পারদর্শী একজন হাতবিহীন বালক।
খ্রিস্টপূর্ব ১২ শতকের এথেন্সের সবচেয়ে প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ কবরস্থান কেরামিকোসই হয় জার্মানোচেগাসের শেষ আবাসস্থল। সুদূর ভারতবর্ষ থেকে আসা এক সন্ন্যাসীর এমন নির্বিকার আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে হতবাক এথেন্সবাসী তাকে নিজেদের শহরেই সম্মানের সাথে সমাহিত করেছিলো।
পাকিস্তানি সাংবাদিক মজিদ শেখ সর্বপ্রথম জার্মানোচেগাসের এই সমাধিটি খুঁজে পেয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে ইউরোপে হাইকিং করতে গিয়ে এই সমাধি আবিষ্কারের অভিজ্ঞতার কথা তিনি পাকিস্তানের ‘ডউন’ পত্রিকায় লিখেছেন। বিস্ময় তাকেও ঘিরে ধরেছিলো সে সময়। পরবর্তীতে কৌতূহল ও দায়িত্বের বশবর্তী হয়ে এথেন্সে শায়িত সন্ন্যাসীর আসল ইতিহাস উদ্ধারে মনোযোগী হন এই সাংবাদিক।
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারতবর্ষ থেকে প্রেরিত জার্মানোচেগাসের মিশনটির উদ্দেশ্য ছিলো বিশাল ও অর্থবহ। ভারতবর্ষ ও রোমের মধ্যে এক শক্তিশালী কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনই এর মূল লক্ষ্য ছিলো। আজকের দিনে আমরা যে গ্লোবালাইজেশনের কথা বলে থাকি, তা বেশ প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত হয়েছিলো এবং আমাদের এই ভারতবর্ষও ছিলো এই প্রাচীন বিশ্বায়নের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
রেফারেন্স: