পূর্বে হিন্দুকুশ থেকে পশ্চিমে এশিয়া মাইনর পর্যন্ত বিস্তৃত এককালের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে ক্ষমতাশীল পারস্য কতোগুলো অভূতপূর্ব শহরের জন্ম দিয়েছে; যে সব শহরের গৌরব কোনোদিনও ম্লান হবার নয়। ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া সত্ত্বেও ইরানের পার্সেপোলিস আজও মাথা উঁচু করে নিজের অস্তিত্বের কথা জানান দিয়ে যাচ্ছে। এটাই প্রমাণ করে যে, পারস্যের আকেমেনিড সাম্রাজ্য কতোটা শক্তিশালী ও গৌরবান্বিত ছিলো।

সাইরাস দ্য গ্রেট

সমগ্র আকেমেনিড সাম্রাজ্য ‘সত্রপি’ নামের কতোগুলো অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত ছিলো। এই সত্রপিগুলোই মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে মহান শহরগুলোকে ধারণ করেছিলো। গুরুত্বপূর্ণ রাজধানী শহর পসারগাদেই ও পার্সেপোলিস থেকে শুরু করে সুসা ও ব্যবিলনের মতো প্রশাসনিক কেন্দ্র তথা সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পারস্য অর্জন করেছিলো। আজ আমরা পারস্যের আকেমেনিড সাম্রাজ্যের এমনই নয়টি গুরুত্বপূর্ণ শহর সম্পর্কে জানবো।

পারস্যের প্রথম মহান শহরপসারগাদেই

খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালে মিডিয়া বিজয়ের পর পারস্যের মহান সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেট পারস্যকে এক আশ্চর্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর এই মহান বিজয়কে গৌরবান্বিত করবার জন্য সম্রাটের আবাসস্থল হিসেবে তিনি একটি প্রাসাদ-শহর নির্মাণ করেন। পসারগাদেই-ই হলো সেই মহান শহর, আকেমেনিড সাম্রাজ্যের ইতিহাসে প্রথম রাজকীয় শহর।

সম্রাট সাইরাস পুলভার নদীর তীরে একটি উর্বর সমতল ভূমিকে পসারগাদেই শহর নির্মাণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। সাইরাসের ত্রিশ বছরের রাজত্বকালে সব সময় পসারগাদেই ছিলো আকেমেনিড সাম্রাজ্যের রাজকীয় ও ধর্মীয় কেন্দ্র।

পসারগাদেই এ সাইরাস দ্য গ্রেটের সমাধি

একটি শক্তিশালী দুর্গ শহরটিকে উত্তর দিকের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতো। পসারগাদেই এর প্রধান আকর্ষণ ছিলো একটি চমৎকার রাজকীয় উদ্যান। উদ্যানটি জ্যামিতিক প্যাটার্নে তৈরী করা হয়েছিলো এবং গাছের পাতাগুলোকে সতেজ রাখবার জন্য ওয়াটার-চ্যানেলও যুক্ত করা হয়েছিলো। উদ্যানটির আশেপাশের ভবনগুলো এমনভাবেই ডিজাইন করা হয়েছিলো, যেনো সেগুলো পার্কের সৌন্দর্যকে ম্লান না করে দেয়। অ্যাসিরীয়দের মতো মধ্যপ্রাচ্যের বহু শক্তিশালী সাম্রাজ্য পসারগাদেই এর উদ্যান থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলো।

সাইরাস দুটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন পসারগাদেই শহরে এবং বহিরাগত সম্মানিত ব্যক্তিদেরকে গ্রহণ করবার জন্য একটি আপাদান বা প্রবেশদ্বার হলও তৈরী করেছিলেন।

পসারগাদেই স্বয়ং সাইরাস দ্য গ্রেটের শেষ বিশ্রামস্থল হিসেবে পরিগণিত হবার গৌরব লাভ করেছে। পসারগাদেই-এ অবস্থিত সাইরাসের এই অতি সাধারণ অথচ মনোমুগ্ধকর সমাধিটি বর্তমানে ইরানের সবচেয়ে লালিত স্মৃতিস্তম্ভগুলোর মাঝে একটি।

আকেমেনিড সাম্রাজ্যের মুকুটরত্ন, মহান শহরপার্সেপোলিস

সাইরাস দ্য গ্রেটের ছেলে ক্যাম্বাইসেসের স্বল্পকালীন রাজত্বের পর পারস্যের আরেকজন মহান সম্রাট ডেরিয়াস দ্য গ্রেট আকেমেনিড সাম্রাজ্য অর্জন করেছিলেন। সম্রাট হিসেবে নিজস্ব গৌরবকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য তিনি পসারগাদেই থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে একটি অভূতপূর্ব শহর গড়ে তোলেন এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব ও অদ্বিতীয় এক প্রাসাদ নির্মাণ করেন তিনি শহরটিতে। শহরটির নাম ‘পার্সেপোলিস’। ডেরিয়াস তার প্রাসাদ-শহর পার্সেপোলিসকে আকেমেনিড সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত করেছিলেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৫১৮ সালে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই পার্সেপোলিস পারস্যের রাজকীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো। পর্বতের ছায়ায় একটি চিত্তাকর্ষক প্রাসাদ-কমপ্লেক্স তৈরীর কাজে নিয়োজিত কারিগর ও নির্মাতাদের একটি সম্প্রদায় ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছিলো পার্সেপোলিস শহরে।

পার্সেপোলিসের ধ্বংসাবশেষ, ব্লন্ডিনরিকার্ড ফ্রোবার্গের ছবি

পার্সেপোলিসে ডেরিয়াসের প্রাসাদটি ছিলো অভূতপূর্ব। এমন প্রাসাদ এর আগে আর কেউ তৈরী করে নি। সাইরাসের মতো তিনিও একটি আপাদান বা প্রবেশদ্বার হল নির্মাণ করেছিলেন। দূর-দূরান্ত থেকে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ডেরিয়াসের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে উপহার নিয়ে আসতেন। আপাদানে তাদের সকলের সারিবদ্ধভাবে আগমনের দৃশ্যটি নিশ্চয়ই ভীষণ আকর্ষণীয় ছিলো। বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতদের উপহার হাতে আসবার এই দৃশ্যটি পার্সেপোলিসের মূল প্রাসাদের দেয়ালে চিত্রিত করা হয়েছে, যা আজও টিকে রয়েছে।

ডেরিয়াসের মৃত্যুর পর পার্সেপোলিস আরও প্রসারিত হয়। ডেরিয়াসের ছেলে জারজেস তার বাবার চেয়েও বিশাল একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন নিজের জন্য।

জারজেসের উত্তরসূরীদেরও প্রত্যেকের নিজস্ব স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুলবার কথা ছিলো। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট আকেমেনিড সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে দৃষ্টিনন্দন এই পার্সেপোলিস পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

পারস্যের প্রশাসনিক কেন্দ্রসুসা

মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীনতম শহর সুসা সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৪২০০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এটি এলামাইট সভ্যতার রাজধানী ছিলো। সুসার ইতিহাসে বহু বার একে আক্রমণ এবং দখল করা হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০ সালে সাইরাস দ্য গ্রেট অতি প্রাচীন এই শহরটিকে দখল করেছিলেন। সাইরাসের মৃত্যুর পর তার ছেলে ক্যাম্বাইসেস সুসাকে আকেমেনিড সাম্রাজ্যের রাজধানী বানিয়েছিলেন। ডেরিয়াস দ্য গ্রেটের সময়েও সুসা ছিলো তার অন্যতম পছন্দের রাজকীয় শহর। তিনি সুসায় একটি নতুন প্রাসাদও নির্মাণ করেছিলেন। আর এই প্রাসাদ নির্মাণের জন্য তিনি সবচেয়ে উন্নত ও উৎকৃষ্ট মানের উপকরণ ব্যবহার করেছিলেন। ব্যবিলন থেকে আনা হয়েছিলো ইট, লেবানন থেকে সিডার কাঠ, সার্ডিস থেকে সোনা এবং মিশর ও নুবিয়া থেকে আনা হয়েছিলো আবলুস কাঠ, হাতির দাঁত ও রূপা। ডেরিয়াস সুসাকে একটি উপযুক্ত প্রশাসনিক কেন্দ্র বানাবার উদ্দেশ্যে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ১৭০০ মাইল বিস্তৃত বিশাল পথ রয়্যাল রোডের (সিল্ক রোডের আদি রূপ, যা পারস্যের দূরবর্তী বাণিজ্যিক শহরগুলোকে সংযুক্ত করেছিলো) একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিলো সুসা।

পারস্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র ‘সুসা’

তরুণ মেসিডোনিয়ান বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পারস্য অভিযানে সুসাকেও পদানত করেছিলেন, যদিও সুসায় তিনি পার্সেপোলিসের মতো ধ্বংসযজ্ঞ চালান নি। পার্থিয়া ও সেলিউসিডদের মতো পারস্য শাসনকারী পরবর্তী সাম্রাজ্যগুলোতেও সুসা সব সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ শহরের ভূমিকা পালন করেছে।

পারস্য সাম্রাজ্যের প্রথম বিজয়একবাটানা

পার্সিয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করবার উদ্দেশ্যে সাইরাস দ্য গ্রেট যখন মিডিয়া দখলের অভিযানে অগ্রসর হলেন, তখন তার প্রতিপক্ষ ছিলেন তার নানা অ্যাস্টিয়াজেস। গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের মতে, সাইরাসের জন্মের আগেই অ্যাস্টিয়াজেস স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তার নাতি বড় হয়ে তার সিংহাসন দখল করবে। এ কারণে অ্যাস্টিয়াজেসের মেয়ে মান্দানা সন্তান জন্ম দেবার পর পরই সেই নবজাতক শিশুকে হত্যা করার নির্দেশ দেন অ্যাস্টিয়াজেস। কিন্তু অ্যাস্টিয়াজেসের জেনারেল হারপ্যাগাস শিশুটিকে গোপনে অন্য পরিবারের কাছে রেখে আসেন। ফলে শিশুটি বেঁচে যায় এবং বড় হয়ে মহান সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেটে পরিণত হয়।

একবাটানা পারস্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর একটি

সঠিক সময়ে সাইরাস অ্যাস্টিয়াজেসকে পরাজিত করেন এবং মিডিয়ার রাজধানী শহর একবাটানা দখল করেন। সম্পূর্ণ আকেমেনিড শাসনামলে একবাটানা ছিলো পারস্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর একটি। শহরটি একই সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পারস্যের অধিকাংশ সম্রাটের জন্য একবাটানা ছিলো গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল।

হেরোডোটাসের মতে, একবাটানা শহরটি মূলত সাতটি রক্ষাবন্ধনী দ্বারা ঘেরাওকৃত একটি শক্তিশালী দুর্গ ছিলো। তবে অনেকে মনে করেন, হেরোডোটাসের এই মতবাদ অতিরঞ্জিতও হতে পারে।পারস্যের অন্যান্য শহরের মতো একবাটানাও আলেকজান্ডারের কাছে পদানত হয়েছিলো। এই শহরেই আলেকজান্ডার তার জেনারেল পার্মেনিয়নকে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন।

অর্থ উৎপাদনের ধনী শহরসার্ডিস

একবাটানা অধিকার করার পর সাইরাস পার্সিয়ান সাম্রাজ্যকে আরও বিস্তৃত করার জন্য অগ্রসর হন। সে সময় এশিয়া মাইনর ও আয়োনিয়ান গ্রীক শহরগুলোকে ঘিরে গড়ে ওঠা লিডিয়া রাজ্যের রাজা ছিলেন ক্রোয়েশাস। তিনি অ্যাস্টাইজেসের ভগ্নিপতি ও বন্ধু ছিলেন এবং পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চেয়েছিলেন। তাই সাইরাসের ওপর তিনি প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু সাইরাস প্রথমে থিমব্রিয়ার যুদ্ধে ক্রোয়েশাসকে পরাজিত করেন এবং এরপর তার পিছু নেন। সাইরাস জানতেন, সার্ডিসের মতো ধনী শহরকে পদানত করতে পারলেই পারস্য সমৃদ্ধির চূড়ায় পৌঁছাতে পারবে। ক্রোয়েশাসের পিছু পিছু গিয়ে তিনি সার্ডিসকে ঘেরাও করে ফেলেন। টানা ১৪ দিনের অবরোধের পর পদানত হয় সার্ডিস। এভাবেই খাদবিহীন সোনা ও রূপার মুদ্রা তৈরীর রাজ্য লিডিয়া অধিকার করেন সাইরাস।

 ধনী শহরসার্ডিস

পারস্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হতো সার্ডিস থেকে। সেই সাথে রয়্যাল রোডের শেষ শহর ছিলো এটি। আয়োনিয়ান বিদ্রোহের সময় গ্রীকরা একবার সার্ডিসকে পুড়িয়ে দিয়েছিলো। ডেরিয়াস দ্য গ্রেট সেই বিদ্রোহ দমন করেছিলেন এবং ইরেট্রিয়া ও এথেন্সের নগররাজ্যগুলো ধ্বংস করে এই ঘটনার প্রতিশোধও নিয়েছিলেন। এরপর সার্ডিসের পুনঃনির্মাণ হয়েছিলো এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৪ সালে আলেকজান্ডারের কাছে পদানত হবার আগ পর্যন্ত শহরটি আকেমেনিড সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো।

পারস্যের আধিপত্যের প্রতীকব্যবিলন

খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে সাইরাস একজন শান্তিপূর্ণ বিজয়ীর বেশে ব্যবিলন শহরে প্রবেশ করেন। মেসোপটেমিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর ব্যবিলন অধিকারের ঘটনা পারস্যকে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত করেছে।

ওপিসের যুদ্ধে রাজা নেবুনিদাসকে পরাজিত করবার পর সাইরাস ব্যবিলনের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যবিলন অধিকার করা এতো সহজ হবার কথা ছিলো না। দীর্ঘ অবরোধ দিয়েও একে ধরে রাখা যেতো না। তাই শহরের জনগণ যখন তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব পালনে ব্যস্ত ছিলো, তখন ইউফ্রেটিস নদীর গতিপথকে বিমুখ করে সাইরাসের বাহিনী ব্যবিলনের দেয়াল বিদীর্ণ করতে সক্ষম হয়।

সাইরাস এবং ডেরিয়াস উভয়েই ব্যবিলনের প্রতি সম্মান দেখিয়েছিলেন। ব্যবিলনের জনগণ নিজেদের সংস্কৃতি ধরে রাখবার অনুমতি পেয়েছিলো। উভয় সম্রাটই নিজ নিজ সময়ে ব্যবিলনের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসবগুলোতে যোগ দিতেন এবং ব্যবিলনের রাজা হিসেবে অর্জিত উপাধিটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছিলেন। ব্যবিলন পারস্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো এবং সেই সাথে ছিলো শিল্প ও শিক্ষালাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

দ্য ফল অফ ব্যাবিলন, ফিলিপস গ্যালের ছবি, ১৫৬৯

সাইরাস এবং ডেরিয়াস উভয়েই নিজ নিজ সময়ে ব্যবিলনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজ করিয়েছিলেন, যার মধ্যে অধিকাংশই ছিলো দেবতা মারদুককে শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে তৈরী। তবে জারজেসের শাসনামলে অতিরিক্ত করের বিরুদ্ধে ব্যবিলনের জনগণ বিদ্রোহ করেছিলো এবং দেবতা মারদুকের একটি পবিত্র মূর্তি ধ্বংস করে ফেলেছিলো। তাই জারজেস ক্ষুব্ধ হয়ে শহরটিকে কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন।

পারস্য অধিকারের পর আলেকজান্ডারের জন্য ব্যবিলন ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। তিনিও শহরটিতে কোনো রকম ধ্বংসযজ্ঞ না চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই ব্যবিলন অপরিবর্তিত অবস্থানে থেকে ক্রমশই উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়েছে।

মিশরের পার্সিয়ান রাজধানীমেমফিস

পারস্যের জন্য মিশর সব সময়ই ঝামেলাপূর্ণ ছিলো। সাইরাসের ছেলে ক্যাম্বাইসেস খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫ সালে মিশর অধিকার করে নেন। মিশরে পারস্যের শাসন শুরুর প্রথম পর্যায়ে মেমফিস ছিলো মিশরীয় সত্রপির রাজধানী। মেমফিস মিশরের প্রাচীনতম এবং গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে একটি। এই মেমফিস শহরেই সমস্ত ফারাওদেরকে মুকুট পরানো হতো। মিশরীয় দেবতা ‘তাহ এর বিখ্যাত মন্দিরটিও মেমফিসে অবস্থিত ছিলো।

স্তম্ভযুক্ত সভাঘরের ধ্বংসাবশেষ, মেমফিস

ডেরিয়াস দ্য গ্রেট যখন সিংহাসনে বসেন, তখন মিশরসহ অনেকগুলো সত্রপিতে বিদ্রোহ শুরু হয়। ডেরিয়াস মিশরীয় যাজকদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করে সেই বিদ্রোহ দমন করেন। তিনি তার সম্পূর্ণ শাসনামলে এই নীতি অব্যাহত রাখেন। তিনি সুয়েজ খালের কাজ শেষ করেন এবং মিশরীয় আইনগুলোকে বিধিবদ্ধ করেন। কিন্তু জারজেসের শাসনকালে মিশরীয়রা আবার বিদ্রোহ করলে জারজেস সেই বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করেন, যার ফল ভোগ করেন জারজেসের উত্তরসূরীরা। খ্রিস্টপূর্ব ৪০৫ সালে দ্বিতীয় আর্তাজারজেসের রাজত্বকালে মিশরের দ্বিতীয় নেকটানেবো ২৭তম আকেমেনিড রাজবংশকে উৎখাত করে নিজেকে ফারাও বলে ঘোষণা করেছিলেন। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৩ সালে তৃতীয় আর্তাজারজেস মিশরকে পুনঃরুদ্ধার করেন এবং ৩১তম রাজবংশ হিসেবে আকেমেনিড শাসনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু করেন। এ সময় তিনি মেমফিসকে রাজধানী হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু এটি অল্প সময় স্থায়ী হয়েছিলো। কারণ খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে মিশর স্বেচ্ছায় আলেকজান্ডারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো।

পারস্যের ফিনিশীয় নৌ ঘাঁটিটায়ার

সাইরাস যখন নবগঠিত পারস্য সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে ভূমি জয় করছিলেন, তখন লেবাননের উপকূলে ফিনিশীয় নগর-রাষ্ট্রগুলোকে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো। সাইরাস খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে টায়ার দখল করেছিলেন এবং প্রাথমিকভাবে ফিনিশীয় নগর-রাষ্ট্রগুলোকে তাদের স্থানীয় রাজাদের শাসনাধীন থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো।

ফিনিশীয়রা ছিলো প্রতিভাবান নাবিক এবং সফল ব্যবসায়ী। তাই ফিনিশীয় শহরগুলো পারস্যের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার সূচনা করেছিলো। সামুদ্রিক শামুক মিউরেক্স থেকে তৈরী বেগুনী রঞ্জক, রূপা ও আরো বেশ কিছু পণ্যের বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে টায়ার ক্রমশই সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী হয়ে উঠছিলো।

টায়ার এবং অন্যান্য ফিনিশীয় নগর-রাষ্ট্রগুলো আকেমেনিড সাম্রাজ্যের জন্য খুবই দক্ষ সামরিক সহযোগী প্রমাণিত হয়েছিলো। কিন্তু কার্থেজ আক্রমণের জন্য ক্যাম্বাইসেস যখন টায়ারের সহযোগিতা চাইলেন, তখন টায়ারবাসী তাদের বংশধরদের আক্রমণ করতে অস্বীকৃতি জানালো।

টায়ারের ধ্বংসাবশেষ

গ্রীস ও পারস্যের যুদ্ধের সময় ডেরিয়াস এবং জারজেস কর্তৃক নিয়োজিত নৌবাহিনীর একটি বড় অংশ ফিনিশীয়রা গঠন করেছিলো। পরবর্তী পারস্য শাসকদের অধীনে টায়ার বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ করেছিলো। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯২ সালের বিদ্রোহটি মূলত এথেন্স এবং মিশরের প্রভাবে সংঘটিত হয়েছিলো। বিদ্রোহ শেষ হওয়ার এক দশক আগেই টায়ার পারস্যের শাসন থেকে মুক্ত হয়েছিলো।

অন্য সবাই যখন আলেকজান্ডারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো, তখন একমাত্র টায়ারই আলেকজান্ডারকে প্রতিরোধ করেছিলো। আর এ কারণেই শহরটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে ধ্বংস হয়ে যায়।

পারস্য সাম্রাজ্যের গ্রীক শহরমিলেটাস

পার্সিয়ানদের আগমনের আগে, মিলেটাস এশিয়া মাইনরের উপকূলে আয়োনিয়াতে একটি সমৃদ্ধ গ্রীক উপনিবেশ ছিলো। শহরটি বাণিজ্য ও শিক্ষার কেন্দ্র ছিল এবং এখানেই প্রথম গ্রীক দার্শনিক থেলিসের জন্ম হয়েছিলো।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৬ সালে সাইরাস লিডিয়ার রাজা ক্রোয়েশাসকে পরাজিত করার পর মিলেটাস পারস্যের অধীনে চলে যায়। সমগ্র এশিয়া মাইনর পার্সিয়ানদের অধীন হয়ে যায় এবং মিলেটাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে কাজ করতে থাকে।

কিন্তু পারস্যের শাসকদের জন্য মিলেটাস তেমন একটা শান্তিপূর্ণ ছিলো না। এর কারণ হলেন অ্যারিস্টাগোরাস। তিনি ছিলেন মিলেটাসের স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তি। অ্যারিস্টাগোরাসের ওপর এথেন্স এবং ইরেট্রিয়ার সমর্থন ছিলো। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৯ সালে ডেরিয়াস দ্য গ্রেটের শাসনের বিরুদ্ধে আয়োনিয়ান বিদ্রোহকে উসকে দিয়েছিলেন তিনি। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৩ সালে লেইডের যুদ্ধে অ্যারিস্টাগোরাস পরাজিত হন।

মিলেটাসে প্রাচীন গ্রীক থিয়েটার

ডেরিয়াস মিলেটাসের সমস্ত পুরুষদেরকে হত্যা করেছিলেন এবং জীবিত নারী ও শিশুদেরকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করেছিলেন। তার ছেলে জারজেস যখন গ্রীস জয় করতে ব্যর্থ হলেন, তখন গ্রীক বাহিনীর একটি জোট মিলেটাসকে স্বাধীন করেছিলো। তবে মধ্যস্থতার মাধ্যমে কোরিন্থিয়ান যুদ্ধ শেষ হবার পর আকেমেনিড সাম্রাজ্য আবারো মিলেটাসের নিয়ন্ত্রণ অধিকার করেছিলো।খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৪ সালে আলেকজান্ডার মিলেটাস শহরটিকে অবরোধ করেছিলেন এবং তার মিলেটাস দখলের ঘটনা ছিলো পারস্যের পতনের সূচনামূলক পদক্ষেপ।

রেফারেন্স: