বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা বাণিজ্যশিল্প হলো কফি। আধুনিক ডায়েটের একটি প্রধান অংশ এই কফি ছাড়া অনেকের যেমন দিন শুরু হয় না, তেমনি অনেকের রাত জাগাও সম্পূর্ণ হয় না। বর্তমানে কফির যে জনপ্রিয়তা রয়েছে শুরুতে কিন্তু তেমনটা ছিল না। ক্যাথলিক খ্রিস্টানেরা প্রথমে তীব্র বিরোধিতা করে একে ‘ড্রিংক অফ দ্য ডেভিল’, অর্থাৎ ‘শয়তানের’ পানীয় বলে দাবি করেন । এমনকি একসময় নারীবাদীরা একে ‘গন্ধযুক্ত নোংরা কাদাপানি’ বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন। আমরা আজকে কফি আবিষ্কারের ইতিহাস সম্পর্কেই জানবো।
নবম শতকে ইথিওপিয়ায় বাস করতো খালদি নামের এক নিঃসঙ্গ মেষপালক। অন্যান্য দিনের চেয়ে তার ছাগলের পালের দুরন্তপনা একটু বেড়ে গেছে বলে তার মনে হয়। অনুসন্ধান করতে গিয়ে সে খেয়াল করে, লাল জামের মতো একটি ফল খাচ্ছে তার ছাগলেরা। ধর্মপ্রাণ খালদি সাথে সাথে সেই ফলটি নিয়ে হাজির হয় স্থানীয় মসজিদের ইমামের কাছে। কাঁচা খাওয়া অসম্ভব দেখে ইমাম আগুনে ছুঁড়ে দেন ফলগুলোকে। তার কাছে প্রথমে এগুলোকে শয়তানের প্রলোভন বলে মনে হয়েছিল কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আসতে লাগলো দারুণ সুঘ্রাণ, যা আজ জগদ্বিখ্যাত। ইমামের ছাত্ররা চিন্তা করে দেখলেন, সিদ্ধ করে খেলে কেমন হয়। যে-ই ভাবা সেই কাজ, রোস্ট করা বীজগুলোকে নিয়ে এক কড়াই গরম পানিতে সিদ্ধ করা হলো। এভাবেই তৈরি হয় পৃথিবীর প্রথম কাপ কফি।
আরেকটি উপকথাও আছে কফির আবিষ্কারকে ঘিরে। অনেকে বলেন, ওমর নামে ইয়েমেনেরই একজন শেখ প্রথম আবিষ্কার করেন কফির গাছকে। প্রার্থনার মাধ্যমে অসুস্থকে সুস্থ করার খ্যাতি ছিলো তার। নিজের জন্মভূমি মোকা থেকে তাকে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল ওসাবের মরুভূমিতে। একদিন ক্ষুধার তাড়নায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি কফিগাছের সন্ধান পান। মুখে দিয়ে তিতা লাগায় তিনি ফলগুলোকে পোড়াতে থাকেন। কিন্তু তাতে সেগুলো আরো শক্ত হয়ে যায়। পরে সেগুলোকে পানিতে মেশালে দারুণ সুগন্ধ ছড়ায় চারপাশে। এই পানীয় দারুণ শক্তি যুগিয়েছিল তাকে। এমনিভাবে তিনিই হয়তো বা পৃথিবীর প্রথম কাপ কফিতে চুমুক দিয়েছিলেন।
আবার অনেকে বলেন, ইয়েমেনের এক সুফি সাধকই নাকি কফি আবিষ্কার করেছিলেন। তার নাম ঘোতুল আব্দুল নুরুদ্দীন আবুল আল-হাসান আল-সাদিলি। ইথিওপিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। সুন্দর একটি পাখিকে অজানা লাল রঙের একটি ফল খেতে দেখে কৌতুহলী হয়ে সে নিজেও খেয়ে দেখেন সেটাকে। ফলে আগের কাহিনীর মতো সেও দারুণ তরতাজা অনুভব করেন।
যেহেতু কফি আবিষ্কারের সাথে মুসলমানদের নাম জড়িয়ে ছিল, তার ওপর এটি খ্রিস্টানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত পবিত্র পানীয় রেড ওয়াইনের জায়গা দখল করে নিচ্ছিল। তাই কট্টর ক্যাথলিকেরা একে ‘শয়তানের তিক্ত আবিষ্কার’ বলে ডাকতো। যেকোনো অনুষ্ঠানে এর ব্যবহারের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। কিন্তু ঠেকিয়ে রাখা যায়নি এর জনপ্রিয়তাকে। রহস্যময় প্রাচ্য পরিভ্রমণ করে বেড়ানো ইউরোপিয়ান পর্যটকেরা কারো তোয়াক্কা না করেই এর গুণগান করতে থাকলেন। এই নিয়ে দুই পক্ষের বিবাদ লেগে গেলে এগিয়ে আসেন তৎকালীন পোপ অষ্টম ক্লিমেন্ট।
তিনি কফির স্বাদ নিয়ে মুগ্ধ হয়ে যান। ঘোষণা দেন, কফি কেবল মুসলমানদের একার নয়, খ্রিস্টানদেরও পানীয়! রসিক পোপ বলেন, “শয়তানের পানীয়’ তো দেখছি দারুণ সুস্বাদু। আমাদের উচিত এটা দিয়ে ব্যাপটাইজ করা, তাহলে স্বয়ং শয়তানকেই ধোঁকা দেয়া যাবে!” তারপর থেকে কফিকে কিছুটা প্রশংসাসূচকভাবেই ‘শয়তানের পানীয়’ কিংবা ‘শয়তানের পেয়ালা’ নামে ডাকা হয়। ভারতবর্ষে চায়ের প্রচলন ব্রিটিশদের কারণে হলেও কফির প্রচলন কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসার বহু আগেই হয়েছিল। ১৬৭০ সালে বাবা বুদান নামের একজন ভারতীয় সাধু প্রথম কফির বীজ নিয়ে আসেন দক্ষিণ ভারতে। সেখান থেকেই তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভারতবর্ষে।
অথচ যে গতিতে কফির প্রসারকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তার দ্বিগুণ গতিতে বেড়েছে এর জনপ্রিয়তা। একসময় কফির প্রভাব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তা যেকোনো বিপ্লবের পেছনের শক্তি হিসেবে কাজ করতো। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় বিভিন্ন ধর্মীয় বয়ানের মূল অনুষঙ্গ ছিল এই কফি। তুর্কি ভাষায় কফি হাউজগুলোকে বলা হতো ‘ক্বাহভেহ খানেহ’। কফির তুর্কি নাম ‘ক্বাহভেহ’ এসেছে আরবি ‘ক্বাহা’ থেকে, এর অর্থ ‘যে পানীয় ক্ষুধা নষ্ট করে’। পরে তা ইতালিয়ান ভাষায় হয়ে যায় ‘ক্যাফে’। বিপ্লবীদের সংগঠিত হবার জায়গা হিসেবেও কফি হাউজগুলো বেশ জনপ্রিয় হতে থাকে। নিত্যদিনের বিনোদনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠতে থাকে এই কফি হাউজগুলো। তাই বিশ্বজুড়ে কোনো পানীয়ই আজ আর আধুনিক যুগে কফির সাথে পাল্লা দিতে পারছে না!