মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাসে ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত এই দুইশত বছর ছিলো অত্যন্ত গৌরবজ্জ্বল। কারন এই সময়ে বাংলায় ছিলো স্বাধীন সালতানাত। তুর্কি-আফগান বংশদ্ভূত এই সুলতানেরা ছিলেন ছিলেন এই বাংলার স্বাধীন সুলতান। প্রবল পরাক্রমশালী দিল্লী সালতানাতের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে প্রতাপের সাথে তাঁরা রাজত্ব করে গেছেন ইবনে বতুতার বর্ণনায় ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ এই দোজখকে। শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ ছিলেন মধ্যযুগে বাংলার একজন বিখ্যাত সুলতান। তিনি ছিলেন বিখ্যাত “ইলিয়াস শাহী” বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নাতি ছিলেন গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্ যিনি তাঁর মহত্ত্ব ও ন্যায়বিচারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

সোনারগাঁয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের চৌদ্দ শতকের সমাধি

ইলিয়াস শাহ্ সেই সময়ের অন্যতম যোগ্য ও প্রতিভাসম্পন্ন শাসক ছিলেন। বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান ফকর-উদ-দীন মুবারক শাহ ১৩৪৯ সালে মৃত্যুবরন করলে সোনারগাঁওয়ের মসনদে বসেন তাঁর বালক পুত্র ইখতিয়ারউদ্দীন গাজী শাহ্। তাঁর সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় না। ধারনা করা হয় ১৩৫২ সালে সাতগাঁও লাখনৌতীর সুলতান ইলিয়াস শাহ্ গাজী শাহকে ক্ষমতাচ্যূত করে সোনারগাঁওকেও নিজ সালতানাতভূক্ত করে “শাহ-ই-বাঙ্গালা” উপাধী ধারন করেন। এর আগে কোনো মুসলিম শাসক সমগ্র বাংলার বিভিন্ন জনপদকে একত্রিত করে শাসন করতে পারেন নি।

ইলিয়াস শাহ ই এক্ষেত্রে প্রথম সুলতান। প্রথম জীবনে তিনি “হাজী ইলিয়াস” নামে একজন সাধারন অমাত্য ছিলেন। কিন্তু কালক্রমে স্বীয় যোগ্যতায় তিনি পুরো বাংলার শাসনকর্তা হয়ে ওঠেন। তিনি বহু গুনে গুনান্বিত একজন সুশাসক ছিলেন। সিংহাসনে আরোহন করেই তিনি রাজ্যবিস্তারে সচেষ্ট হন। তিনি উড়িষ্যা ও দুর্গম নেপালে সফল অভিযান চালিয়েছিলেন। এছাড়া ত্রিহূত, কাশী, গোরক্ষপুর অভিযান চালিয়ে নিজ রাজ্যভূক্ত করেছিলেন সোনারগাঁও দখলেরও আগে। তাঁর এতসব কীর্তি সুদূর দিল্লী থেকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন আরেকজন, তিনি সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘোলক।

সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘোলক

এর আগে দিল্লী সালতানাতের সিংহাসনে ছিলেন খামখেয়ালী মুহাম্মদ বিন তুঘোলক। তিনি তাঁর শেষ সময়ে বিভিন্ন বিদ্রোহ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকার কারনে দূরবর্তী তৎকালীন বাংলা প্রদেশে নজর দিতে পারেন নি। ১৩৫১ সালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ফিরোজ শাহ দিল্লী মসনদে আসীন হন। তিনি সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বাংলাকে আবার তাঁর শাসনে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। পাশাপাশি তিনি ইলিয়াস শাহকে ও সমুচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে।

ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে ফিরোজ শাহের এই অভিযান নিয়ে জিয়াউদ্দিন বারানী সহ বেশ কয়েকজনের বিবরণী পাওয়া যায়। তবে সবগুলোই পক্ষপাতদুষ্ট। প্রায় সবগুলোতেই ইলিয়াস শাহকে ভীরু, কাপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে আধুনিককালে ইতিহাসবেত্তাদের অনুসন্ধান থেকে এটা মোটামুটি পরিস্কার যে ইলিয়াস শাহ মোটেই ভীরু ছিলেন না। তিনি রক্ষণাত্মক প্রতিরক্ষা কৌশল অবলম্বন করেছেন। তিনি জানতেন শক্তিশালী দিল্লী সেনাবাহিনীর সাথে সামনা সামনি যুদ্ধ করতে গেলে তাঁরও শক্তিক্ষয় হবে। তিনি তাঁর সামর্থ্যের পূর্ণ প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন কৌশলের সাথে । তিনি দিল্লী ফৌজকে বাংলার অভ্যন্তরে ঢুকতে দেন এবং বিখ্যাত একডালা দূর্গে সসৈন্যে অবস্থান করতে থাকেন।

একডালা দুর্গ

তখনকার দিনের একডালা দূর্গ ছিলো অত্যান্ত সুরক্ষিত একটি দূর্গ। তিনি জানতেন দিল্লী ফৌজ অনেক পথ অতিক্রম করে এসেছে এবং আসন্ন বর্ষাকালে তারা বিপর্যয়ে পড়বে। বেশকিছু সংঘর্ষের পর কিছু বন্দ্বী, কিছু লুটের মাল ও কিছু হাতি ছাড়া দিল্লী বাহিনী আর তেমন কিছুই পায় নি। পাশাপাশি তারা ইলিয়াস শাহেরও অবস্থান ও দূর্বল করতে পারে নি। এর মধ্য দিয়ে ফিরোজ শাহ্ ইলিয়াস শাহের বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা সম্পর্কে ধারণা পান। তিনি বুঝতে পারেন সহজে তিনি ইলিয়াস শাহকে পরাজিত করতে পারবেন না। দুই সুলতানের মধ্যকার এই সংঘাত সন্ধির মাধ্যমে মীমাংসা হয়। ফিরোজ শাহের সাথে থাকা সেই সময়ের লেখকরা বিভিন্ন বর্ণনায় ফিরোজ শাহকেই বিজয়ী বলে তাঁর মান রক্ষা করার চেস্টা করেছেন কিন্তু আদতে ইলিয়াস শাহকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করতে পারেন নি ফিরোজ শাহ।

আসলে এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই জয়লাভ করতে পারে নি। কিন্তু ইলিয়াস শাহ লাভবান হন। বস্তুত ইলিয়াস শাহ বাংলার মর্যাদা রক্ষা করে দিল্লীর সাথে সন্ধি করতে সমর্থ হন। তিনি দিল্লীতে তাঁর কয়েকজন পারিষদকে উপহার সহ পাঠান দিল্লীতে। ফিরোজ শাহ তাদের সাদরে আমন্ত্রন জানান এবং তিনিও বহুমূল্য উপহার দিয়ে নিজের দূত পাঠান বাংলায়। যদিও তারা বাংলায় পৌছানোর আগেই তিনি মৃত্যুবরন করেন। এর আগে বাংলায় দিল্লী কর্তৃক নিযুক্ত শাসকেরা বিদ্রোহ করেছে আবার দিল্লী থেকে তাদের দমনে বিশাল বাহিনী পাঠানে হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে,তাদের দমন করে আবার নতুন শাসক প্রেরিত হয়েছে। কিন্তু ইলিয়াস শাহকে ফিরোজ শাহ দমন করতে পারেন নি। অধিকন্তু ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলাকে একত্র করতে পেরেছিলেন।ইলিয়াস শাহ তাঁর শাসনামলে বাংলার সীমানা আরোও বৃদ্ধি করেন। এসময় কামরুপের কিছু অংশে বাংলার অধীনে আসে। অত্যান্ত দৃঢ় ব্যাক্তিত্ব ও অটুট মনোবলের অধিকারী ছিলেন তিনি।তিনি সূফী-সাধকদের অনেক সম্মান করতেন। তাঁর শাসনামলে বিখ্যাত সূফী ছিলেন শেখ রেজা বিয়াবানী (রহ:) । কথিত আছে, তিনি যখন একডালা দূর্গে অবস্থান করছিলেন ফিরোজ শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তখন শেখ রেজা (রহ:) এর মৃত্যু হলে সকল বিপদ তুচ্ছ করে ইলিয়াস শাহ ছদ্মবেশে জানাজায় শরিক হন।তিনি প্রজাবৎসলও ছিলেন। তাঁর প্রশাসনে অনেক উচ্চপদে হিন্দু কর্মচারী ছিলো।তিনি বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশ প্রতিষ্ঠা করেন।এ বংশ দুই পর্যায়ে বাংলা শাসন করে। মাঝখানে রাজা গণেশের বংশের শাসনকাল চলে।গৌরবের সাথে শাসন করে ১৩৫৭ সালে তিনি মারা যান।সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলার স্বাধীনতাকে অক্ষুন্ন রেখে রাজ্যবিস্তার করতে পেরেছিলেন দিল্লী সালতানাতের হুমকিকে উপেক্ষা করে, প্রয়োজনে যুদ্ধও করেছেন। বাংলার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। নি:সন্দেহে তিনি তাঁর সময়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন।