সূর্যদেব অস্তে চলে যাচ্ছেন। গোধূলিবেলার লালচে আলোতে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার এই জন্মের শত্রুকে। তার গান্ডিব ধরা উদ্ধত হাতে চকচক করছে অঞ্জলিক বাণ, যা আমার মস্তক ছেদ করার জন্য একটু পরেই ছুটে আসবে।পান্ডব বীর অর্জুন, যে আমার চরম শত্রু আবার আমার সহদর কনিষ্ঠ ভ্রাতা।ওই তো, অর্জুনের কপিধ্বজা রথের লাগাম হাতে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে স্থির হয়ে বসে আমাকে লক্ষ্য করছেন বাসুদেব।তিনি অর্জুনকে নিরস্ত্র এই আমার দিকে বাণ ছুড়তে নির্দেশ দিচ্ছেন। কুরুক্ষেত্রের এই মহাযুদ্ধে আমার ভূমিকা শেষ হওয়ার সময় চলে এসেছে। সকল দিব্যাস্ত্রকে আহবান করার বিদ্যা ভুলে গেছি আমি। আমার রথের চাকা মাটিতে ডেবে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও তা তুলতে পারছি না। এ আমার নিয়তির পরিহাস, আমার এই জন্মের দুর্ভাগ্য। যা আজন্ম আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আজ এই অন্তিম সময়ে নিরুপায় হয়ে, অসহায় অবস্থায় নিজের মৃত্যুক্ষণের অপেক্ষা করছি। আমি তো মহাপাপী, ধর্ম-অধর্মের এই যুদ্ধে আমি যে অধর্মের পক্ষ নিয়েছি। আমার পরিনতি আমাকে বরণ করে নিতেই হবে। সময়ের প্রয়োজনেই আমার এই পরাজয়। অর্জুন আমার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, চিরশত্রু আমার দিকে তাঁর অঞ্জলিক বাণ তাক করছে। তাঁর আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টিতে আমি যেনো বিষাদের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। হয়ত নিজের জাতশত্রুকে এমন অসহায়ভাবে বধ করতে তাঁর বিবেকে বাধছে। কিন্তু আমি জানি, অর্জুন ঠিকই কিছু মূহুর্ত পরে আমাকে হত্যা করবে। অর্জুনের মতো যোদ্ধার হাতে বীরগতিপ্রাপ্তিও একজন যোদ্ধার জন্যে গৌরবের।
আবার সে তো আমারই অনুজ। আচ্ছা, অর্জুন যখন জানবে যে সে তাঁর জ্যেষ্ঠকে হত্যা করেছে, তখন কি সে দু:খিত হবে..??? হয়তো হবে, কিন্তু তা দেখার সুযোগ আমার হয়ে উঠবে না।এই মূহুর্তে আমার দ্রৌপদীর কথা খুব মনে পড়ছে। আমিও তাকে অর্জন করতে গিয়েছিলাম স্বয়ংবরে। ওই প্রতিযোগিতা আমিই জিততাম, আমিই লাভ করতাম দ্রৌপদীকে কিন্তু সে ভরা সভায় আমাকে আমার জাত নিয়ে বিদ্রুপ করেছে। আমাকে সে প্রত্যাখান করতেই পারতো কিন্তু সবার সামনে প্রকাশ্যে আমার জন্ম পরিচয় নিয়ে আমকে অপমান না করলেও পারতো। তাইতো লম্পট দু:শাসন যখন তার বস্ত্রহরণ করছিলো, সীমাহীন ক্রোধে অন্ধ হয়ে আমি তাকে দুশ্চরিত্রা বলে গালি দিয়েছিলাম, নিজের ক্রোধকে আমি সংবরন করতে পারিনি। বিপদাপন্ন অসহায় এক নারীকে কোনরূপ সাহায্য না করে বরং তার চরিত্র নিয়ে কটু কথা বলে আমি পাপ করেছি, যা আমার মতো মহারথী যোদ্ধার মানায় না। আজ এই অন্তিম মূহুর্তে সম্ভব হলে আমার কৃতকর্মের জন্যে দ্রৌপদীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতাম। প্রচন্ড অনুশোচনা হচ্ছে আমার….
আমার জন্মদাত্রী মাতা কুন্তীর কথা মনে পড়ছে।মাতা কুন্তীর প্রতি আমার সকল অভিমান আজ মন থেকে মুছে গেছে। আজ এই মূহুর্তে তাঁর প্রতি আমার আর কোনো ক্ষোভ নেই। তাঁর চরণযুগলেও করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতাম…
আমার পালক মাতা রাধা মায়ের স্নেহ-মমতা ভরা মুখটা যেনো দেখতে পাচ্ছি সামনে, যার কারণে আমি রাধেয় নামে পরিচিত। এই পরিচয়টাই আমি বেশি ভালোবাসি। ছেলেবেলায় রাধা মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, তার কথার অবাধ্য হয়েছি আমার সহজাত দূরন্তপনায়। সবকিছুর জন্যে তাঁর কাছেও ক্ষমা চেয়ে নিতাম….
সেই সদাহাস্যজ্জল, অনিন্দ্যসুন্দর মুখটাও আমি যেনো দেখতে পাচ্ছি, যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। যে কোনোকিছুরই বিনিময় প্রত্যাশা না করে আমার হাত ধরেছিলো। আমার জীবনের ক্রান্তিকালে, সকল সংগ্রামে আমার পাশে থেকে আমাকে শক্তি যুগিয়েছে। এই কষ্টের জন্মের পর আবার যদি কোনো জন্ম থাকে তবে সেই জন্মেও আমি তাকেই খুঁজবো, তাকেই চাইবো….
প্রচন্ড ক্লান্তিতে আমার শরীর যেনো ভেঙ্গে আসতে চাইছে। সারা জীবন ছুটতে ছুটতে আমি শ্রান্ত, আমার জীবনের সমস্ত সংঘর্ষ, সংগ্রাম আজ শেষ হওয়ার পথে। আমার বিশ্রামের সময় চলে এসেছে। কিন্তু আমার কর্তব্য আমাকে অবশ্যই পালন করতেই হবে। আমি আমার রথের চাকা তোলার চেষ্টা করতেই থাকবো। শুধু একটা আক্ষেপ, আমার সামর্থের প্রকৃত প্রকাশ কোনোদিনই হলো না। যথার্থ মূল্যায়ন আমি কোনোদিনই পেলাম না। সমগ্র বিশ্ব জানবে মহারথী কর্ণ বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুনের নিকট পরাজিত হয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় আমার নাম লেখা থাকবে কোনো এক কোণে, আমার বীরত্ব নিয়ে কোনো চারণকবি সৃষ্টি করবে না কোনো গাঁথা, আমার কীর্তি নিয়ে কেউ গল্প তৈরী করবে না। হয়তো ইতিহাসে আমি চিহ্নিত হব এক দুরাচারী হিসেবে। কারণ আমি পাপী, অধর্মী। ধর্ম-অধর্মের এই যুদ্ধে আমি যে অধর্মের পক্ষ নিয়েছি। কিন্তু আমি আমার ধর্ম ঠিকই পালন করেছি। এক মুহূর্তের জন্যেও নিজের নীতি থেকে বিচ্যূত হই নি। দানকার্যকেই সবচেয়ে মহৎ জেনে এসেছি। আমার শরণাপন্ন কোন দানপ্রার্থীকে খালি হাতে ফেরাই নি কখনোই। এমনকি ছদ্মবেশী দেবরাজ ইন্দ্রকে চিনতে পেরেও আমার কবচ- কুন্ডল তাঁকে দান করে দিয়েছি। শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত মিত্র দুর্যোধনের জন্যেই লড়ে গেছি আমি, তাঁর সংকটকালে তাঁকে পরিত্যাগ করি নি, অস্বীকার করেছিলাম পান্ডব পক্ষে যোগদানের জন্য বাসুদেব ও আমার জন্মদাত্রী মাতা কুন্তীর অনুরোধও। তবে আমি ফিরে আসবো যুগে যুগে। আমারই মতো মানুষদের কর্মে, তাদের ব্যার্থতায়-হতাশায়, তাদের না পাওয়ার সমস্ত যন্ত্রণাতে আমিই কর্ণ হয়ে ফিরে আসবো।
অর্জুন বাণ নিক্ষেপ করেছে। মৃত্যু আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এই জন্মের সমস্ত গ্লানি কাটিয়ে আমি এই দু:খ কষ্টের পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছি। এটাই তবে মৃত্যু। সমগ্র সংসার জানবে ভগবান পরশুরাম শিষ্য অঙ্গরাজ কর্ণ নিজ কর্তব্য নির্বাহ করেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। সূর্যদেব আমার অপেক্ষা করছেন। আমাকে নিজের পিতার কাছে ফিরে যেতে হবে। বিদায়…