দে দোল দোল দোল,
তোল পাল তোল
চল ভাসি সবকিছু তাইগ্যা,
মোর পানিতে ঘর,
বন্দরে আসি তোর লাইগ্যা
দে দোল দোল দোল…..
ছেলেবেলায় শোনা এই গানটির মর্মার্থ ছিলো দেবীর প্রতি এক কুমারী মেয়ের আকুতি- ‘আমার বন্ধু সাগরে গিয়েছে, তাই হে গঙ্গা মা, তুমি তাকে রক্ষা কোরো’। এমন অসংখ্য গান-গল্প-গাঁথা-কাহিনী-কাব্য রচিত হয়েছে সমুদ্রের জীবনের সম্পৃক্ততাকে কেন্দ্র করে। চাঁদ সওদাগরের গল্পের কথাই ধরা যাক। তার বিশাল বিশাল ময়ূরপঙ্খী জাহাজগুলো পাল তুলে বাণিজ্য করতে যেতো দূর-দূরান্তে। এ সব কাহিনীগুলো ব্যক্তির নাবিক জীবনের একটি বড় অধ্যায়েরই পরিচয় তুলে ধরে আমাদের সামনে। আমাদের পূর্বপুরুষদের যে এক সময় একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নাবিক জীবনে বিচরণ ছিলো, তা খুব গভীরভাবেই এসব গান-গল্পগুলো থেকে উপলব্ধি করা যায়।
খুব বেশি দিন আগের কথা তো নয়। এই তো সেদিনও বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ছিলো একই ভূখণ্ড। সমুদ্র তীরবর্তী এই ভূখণ্ড ছিলো বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক কেন্দ্র। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী ভূখণ্ডের মতো উর্বর ও ধনাঢ্য অঞ্চল প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই বিদ্যমান ছিলো। এই শক্তিশালী ভূখণ্ডেরই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিলো কলিঙ্গ রাজ্য। হ্যাঁ, সেই কলিঙ্গের কথাই বলছি, যার বিরুদ্ধে মৌর্য সম্রাট অশোকের ধ্বংসাত্মক আক্রমণের কাহিনী সমগ্র বিশ্বে সুবিদিত।
কখনো কি ভেবেছেন, অশোক কেনো কলিঙ্গ আক্রমণ করেছিলেন? প্রাচীন উড়িষ্যারই একটি বিশাল অংশ জুড়ে বিস্তৃত কলিঙ্গ রাজ্যটি গঙ্গা থেকে গোদাবরী পর্যন্ত এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর থেকে অমরকন্টক পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। আর প্রাচীন উড়িষ্যা কিন্তু আজকের উড়িষ্যার মতো ছিলো না, এর ব্যাপ্তি দাক্ষিণত্যের দিকে ছিলো আরও বিস্তৃত। এমনকি আমাদের বাংলাদেশেরও বেশ অনেকখানি এলাকা জুড়ে উড়িষ্যার বিস্তৃতি ছিলো। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, আমাদের পূর্বপুরুষদের নাবিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কলিঙ্গ রাজ্যের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো। কলিঙ্গে ব্যবসা পরিচালনাকারী নাবিকদের তো আলাদা নামও দেয়া হয়েছিলো। বহিরাগতরা ‘কলিঙ্গ সাধু’ হিসেবেই এক নামে চিনতো তাদেরকে।
সমুদ্র বন্দরগুলোতে বাণিজ্য পরিচালনা করতে যাওয়া এই নাবিকেরা শুধু এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের পণ্যই বিনিময় করেন নি, বিনিময় করেছিলেন নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিও। একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, পাশাপাশি অঞ্চলগুলোর পরস্পরের মধ্যে কি অদ্ভূত মিল ও সমন্বয় ঘটে গেছে। ভাষার ক্ষেত্রেও এই প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট। যেমন, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ফেনীর ভাষা সাধারণভাবে প্রচলিত সমতল বাংলা ভূমির ভাষার তুলনায় কিন্তু অনেকটাই আলাদা। এই সবই হচ্ছে সমন্বয় ও বিনিময়ের চূড়ান্ত ফলাফল।
রোমান বাণিজ্য, সিল্ক রোড, চীনা বাণিজ্য প্রভৃতি নিয়ে বিভিন্ন সময় ব্যাপক আলোচনা চলেই থাকে। অথচ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্র বাণিজ্যের এতো সমৃদ্ধ একটি অধ্যায়ের গল্প কি করে যেনো আড়ালেই রয়ে যায়। ধারণা করা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই বাণিজ্যিক ইতিহাস সিল্ক রোডের বাণিজ্যের চেয়েও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ছিলো। এমনকি সে সময়টাতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার এই বাণিজ্য বিশ্বের অন্য যে কোনো অঞ্চলের ক্ষেত্রে মাতৃবাণিজ্যের ভূমিকা পালন করেছিলো।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার সাথে ছিলো কলিঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যবসা। ল্যাটিন ‘ইন্ডাস’ এবং ‘ন্যাসোস’ শব্দ দুটো থেকে উদ্ভূত ‘ইন্দোনেশিয়া’ শব্দটির অর্থও কিন্তু ‘ভারতীয় দ্বীপ’। সে সময়ে ইন্দোনেশিয়াকে ডাকা হতো ‘সুবর্ণ দ্বীপ’ নামে। ইন্দোনেশিয়ার বালিসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরো বেশ কিছু অঞ্চল, যেমন জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও, বার্মা বা বর্তমান মায়ানমার, সীলন বা বর্তমান শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি অঞ্চলগুলোর প্রায় হাজার বছর মেয়াদী বাণিজ্য চলমান ছিলো কলিঙ্গের সাথে। দারচিনি, এলাচ প্রভৃতি মসলা ছাড়াও মরিচ, সিল্ক, সোনা, কারুকাজযুক্ত অলঙ্কার, কর্পূর, হাতির দাঁত ইত্যাদি অসংখ্য পণ্যদ্রব্যের বাণিজ্য বহুল জনপ্রিয় ছিলো।
কলিঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থান তো অনুকূলে ছিলোই, সেই সাথে এখানকার নাবিকরাও কলিঙ্গকে সমৃদ্ধশালী করে তুলবার ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কলিঙ্গ সাধুদের চারিত্রিক চিত্রায়নে গবেষকরা বলেছেন যে, তারা ছিলেন সৎ, নীতিবান ও ব্যবসায়িক বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। মূলত কলিঙ্গ সাধুদের অসাধারণ অবদানই অঞ্চলটিকে দিয়েছিলো এক অন্য মাত্রা।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর দিকে এই অঞ্চলে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বন্দর গড়ে উঠতে দেখা যায়। ‘তাম্রলিপ্ত’ বন্দর ছিলো এদের মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়াও ‘মানিকপাটনা’, ‘চেলিতালো’, ‘পলুর’, ‘পিথুন্ডা’ প্রভৃতি বন্দরগুলো বহিরাগত রাষ্ট্রের সাথে ভারতবর্ষের, বিশেষ করে বাংলার সমৃদ্ধ এই অঞ্চলগুলোর যোগাযোগকে অত্যন্ত সহজ করে তুলেছিলো। সে সময়টাতেই চারটি ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিলো সুবর্ণ দ্বীপ, যা ছিলো একটি স্বতন্ত্র দ্বীপ রাষ্ট্র গঠনেরই প্রচেষ্টা। আর সেই প্রচেষ্টারই রূপায়ণ আজকের ইন্দোনেশিয়া।
তাম্রলিপ্ত বন্দরটি ছিলো কলিঙ্গের মূল প্রবেশদ্বার। এই বন্দরের মাধ্যমেই ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীরা কলিঙ্গে প্রবেশ করতেন। চীনা তীর্থযাত্রী ফা-হিয়েন তাম্রলিপ্তকে বৌদ্ধদের সামুদ্রিক বসতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই বন্দর থেকেই তিনি সীলনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন, যেটি বর্তমানে শ্রীলংকা।
টলেমীর বর্ণনায় জানা যায়, পলুর বন্দর থেকে মালয় উপদ্বীপে যাওয়ার একটি সহজ ও সরাসরি পথের অস্তিত্ব ছিলো। চীনা তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাং চেলিতালো বন্দরকে ব্যবসায়ীদের বিশ্রামস্থল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও ‘কলিঙ্গের মহানগরী’ বলে খ্যাত ছিলো পিথুন্ডা।
ভারতীয় নাবিক তথা ব্যবসায়ীরা গুরুত্বপূর্ণ এসব বন্দরের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে নিজেদের শক্তিশালী উপনিবেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং এই ধারাটি মধ্যযুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। উপনিবেশায়নের এই প্রচেষ্টাই চীন, তিব্বত, মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়াকে ভারতবর্ষের অধীনস্থ হতে সাহায্য করেছিলো।
ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ী এবং বহিরাগত ব্যবসায়ীদের কলিঙ্গ অঞ্চলের প্রতি মনোনিবেশের প্রবণতা এতোটাই বেশি ছিলো যে, এই অঞ্চলটি বাংলার সর্বাপেক্ষা অপরিহার্য রাজ্যে পরিণত হয়েছিলো। উর্বর ভূমি ও সুবিধাজনক সামুদ্রিক অবস্থান কলিঙ্গকে দিনে দিনে আরও বেশি শক্তিশালী করে তুলছিলো। বঙ্গোপসাগরের তীরে এতো বেশি কলিঙ্গ জাহাজ ভিড় করে থাকতো যে, সে সময় বঙ্গোপসাগরকে অনেকে ‘কলিঙ্গ সাগর’ নামেও চিনে থাকতো। সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ জয়ের আগেই ইতিমধ্যেই কলিঙ্গ পরিণত হয়েছিলো সংমিশ্রণের এক বিশাল সাম্রাজ্যে, যেখানে স্থানীয়দের সাথে বিদেশীদের ঐতিহ্যের মিশেল তৈরী হয়েছিলো।
দীর্ঘ উপকূলীয় দিগন্ত রেখাবিশিষ্ট বাংলার বিশিষ্ট এই কলিঙ্গ রাজ্যটি সমুদ্রের ওপর নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলো বাণিজ্যিক দক্ষতা ও উর্বরশৈলীর কারণে। মহাকবি কালিদাসের সংস্কৃত মহাকাব্য ‘রঘুবংশ’-এ কলিঙ্গের রাজাকে ‘সমুদ্রের প্রভু’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে কলিঙ্গ কতোটা প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো। ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতির বিনিময়ে কলিঙ্গের ভূমিকা এতোটাই শক্তিশালী ছিলো যে, বৌদ্ধ শাস্ত্র, জৈন শাস্ত্রসহ আরো অনেক ধর্মীয় শাস্ত্রে কলিঙ্গ ও এর নাবিকদের গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। হিন্দু পুরাণে তো কলিঙ্গ রাজ্যের ক্ষেত্রে ‘অসামান্য’, ‘অবিশেষ’ -এ ধরনের বিশেষ শব্দের বিশেষণও প্রয়োগ করা হয়েছে।
জানা যায়, কলিঙ্গের মতো হাতি বিশ্বের আর কোনো অঞ্চলে দেখা যায় নি। এই অঞ্চলের হস্তীবাহিনীর সামনে বিশ্বের আর কোনো সামরিক বাহিনী মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস পায় নি। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, বিশাল এই যুদ্ধ হাতিগুলোকে এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে নেয়া হতো কলিঙ্গের বহুতলবিশিষ্ট জাহাজগুলোর মাধ্যমে। সুতরাং কতো বিশাল ও কত মজবুত নির্মাণশৈলী এই জাহাজগুলোর ছিলো, তা এই ঘটনা থেকেই আন্দাজ করা যায়।
কলিঙ্গ ছিলো ভারতবর্ষ তথা সমগ্র বাংলার এক গৌরবময় প্রাচীন অঞ্চল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলে এমনি এমনি অশোক ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠেন নি। এই রাজ্যের দখল নেয়া এতো সহজ ছিলো না। আর এক বার জয় করতে পারলে বিশ্ববাণিজ্য হাতের মুঠোয় চলে আসা কোনো ব্যাপারই ছিলো না। এ কারণেই অশোক মরিয়া হয়ে আক্রমণ করেছিলেন কলিঙ্গ। অথচ ইতিহাসের এতো গুরুত্বপূর্ণ ও বাংলার এতো গৌরবময় অঞ্চলটির আদ্যোপান্ত নিয়ে খুব কমই আলোচনা হতে দেখা যায়। এমনকি যে শক্তিশালী রাজাকে ‘সমুদ্রের প্রভু’ মানা হতো, যার বিরুদ্ধে অশোকের এই আগ্রাসন, তার পরিচয় নিয়ে আজ অবধি সংশয়ের অবসান হয় নি। বাঙালি হিসেবে এই অবজ্ঞা ভীষণ দুঃখজনক। হয়তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই ইতিহাসের পাতা থেকে সমৃদ্ধশালী এই ইতিহাসকে প্রচ্ছন্ন করে দেয়া হয়েছে।
রেফারেন্স: