খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩ সাল। রোমের সিনেট ভবন। সুপার পাওয়ার রোমের সিনেটর ক্যাটো দ্য এল্ডার তার উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতার প্রতিটি লাইনে ঝড় তুলছিলেন। তার এ ধরনের বক্তৃতাগুলোর শেষ হতো একটি বাক্য দিয়ে- “আমি মনে করি, কার্থেজকে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে”। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। তার বক্তব্যের সাথে সুর মিলিয়ে অন্য সিনেটররাও জোর দিয়ে বাক্যটি উচ্চারণ করছেন।
ঠিক এভাবেই মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হলো বিশ্বের প্রাচীন আরেক সুপার পাওয়ার কার্থেজের বিরুদ্ধে। ভূমধ্যসাগরের এই সুপার পাওয়ারকে ধ্বংস করেই সৃষ্টি হয়েছিলো আরেক সুপার পাওয়ার রোমের। বলছি লাস্যময়ী কার্থেজ নগরীর উপর সৃষ্ট রোমানদের জেনোসাইডের কথা।
খ্রিস্টপূর্ব ১৪৬ সাল। সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হলো, কার্থেজের একটি মানুষকেও জীবিত রাখা যাবে না, একটি বাড়িও অক্ষত রাখা যাবে না। সেনাপতি সিপিয়ো ৮৫ হাজার সৈন্য নিয়ে কার্থেজের হার্বারগুলোকে তিন বছর অবরোধ করে রাখলেন। খাদ্য সরবরাহের চেইন বন্ধ হয়ে গেলো। ক্ষুধা, দুর্বলতা, রোগ-শোক এসে আক্রান্ত করতে শুরু করলো এক সময়ের সবচাইতে বিত্তশালী বাণিজ্যিক নগরীকে। ক্ষুব্ধ হতে শুরু করলেন সেই নগরীর ভুক্তভোগী মানুষেরা। কিন্তু তাদের ক্ষুব্ধতা প্রতিবাদের আকার ধারণ করবার সুযোগ পেলো না। অবরোধের তৃতীয় বছরের শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো কার্থেজে। ১৭ দিন জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হয়ে অভুক্ত ও নিস্তেজ মানুষগুলো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। এটি ছিলো তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধের অন্তিম ক্ষণ।
কার্থেজবাসী আসলে কারা? কি জানি আমরা তাদের সম্পর্কে? মোটের উপর কিছুই না। তাই তো চেয়েছিলেন রোমানরা। তাই তো আগুনের শিখায় দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা কার্থেজ নগরীর ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে মুছে দিতে ধ্বংস করে দেয়া হলো তাদের মহামূল্যবান লাইব্রেরিকে। কার্থেজেনিয়ানদের নিজের ভাষায় প্রাচীন বিশ্বের গৌরবময় ইতিহাসগুলো আমরা আর জানতে পারলাম না। শত্রুদলের লিখিত বিকৃত ইতিহাসের মাধ্যমে আজ জানতে হয় গ্লোবালাইজেশনের সূচনাকারী কার্থেজবাসী সম্পর্কে।
প্রাচীন বিশ্বের মাস্টার শিপ-বিল্ডার ছিলেন কার্থেজেনিয়ানরা। বলা হয়ে থাকে, মিশর, রোম, গ্রীস এরাই সভ্যতার জনক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কার্থেজই সভ্য ইতিহাসের শিক্ষক। পৃথিবীকে সংযুক্ত করবার ক্ষেত্রে তাদের অবদান অপরিসীম। অন্য দিকে, রোমকে সিভিলাইজেশনের ফ্ল্যাগ-বিয়ারার না বলে রুট-লেস নির্মম হত্যাকারী হিসেবে আখ্যায়িত করলে বেশি শোভনীয় হতো। একদল ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর উপর অপর এক ইউরোপীয় জাতির হঠকারীর উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত বহন করেন রোমানরা।
কার্থেজ ছিলো উত্তর আফ্রিকার উপকূলে অবস্থিত একটি ফিনিশীয় নগর রাষ্ট্র (বর্তমান তিউনিস)। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর দিকে ফিনিশীয় ব্যবসায়ীরা নিজেদের তৈরী এই কলোনির ছোট নৌ বন্দরটিতে এসে জাহাজে নতুন করে রসদ সরবরাহ ও জাহাজ মেরামতের খুঁটিনাটি কাজগুলো সেরে নিতেন। পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে আলেকজান্ডার কার্থেজের মাতৃশহর এবং শিল্প ও বাণিজ্যের নগরী টায়ারকে ধ্বংস করে দিলে বিত্তশালী ও অবস্থাপন্ন ফিনিশীয় উদ্বাস্তুরা এসে কার্থেজে আশ্রয় নেয়। সেই থেকে এই ছোট শহরটি ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে।
কার্থেজের এই উদ্বাস্তুরা যথেষ্ট ধনী ছিলেন। প্রাণপণ চেষ্টায় তারা ফিনিশীয় বাণিজ্যের নতুন কেন্দ্র হিসেবে কার্থেজকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কারুশিল্পে দক্ষতার জন্য তারা পরিচিত হতেন গিফটেড-ক্রাফটম্যান হিসেবে। গয়না, মাটির পাত্র, সিডর কাঠ দিয়ে তৈরী নৌকা –এগুলো সবই ছিলো কার্থেজের গৌরবময় পণ্য।
নিজেরা যেনো বাণিজ্য বিস্তারে মনোযোগী হতে পারেন, সে জন্য আফ্রিকার বার্বার রাজ্য থেকে ভাড়া করা সৈন্য নিয়োগ দিয়ে কার্থেজের শক্তি বৃদ্ধি করেন কার্থেজেনিয়ানরা। কার্থেজকে ভূমধ্যসাগরের রাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার কাজে নিয়োজিত হয় সেই সেনাবাহিনী। অল্প সময়ের মধ্যেই উপকূলের একটি ছোট শহর থেকে আয়তন ও মহিমায় ভূমধ্যসাগরের সবচাইতে ধনী ও শক্তিশালী শহরে পরিণত হয় কার্থেজ। দ্রুতই ফিনিশীয় ও আফ্রিকান সংস্কৃতির মেল্টিং-পটে পরিণত হয় শহরটি।
কার্থেজের অভিজাতেরা বিশাল প্রাসাদে বাস করলেও অপেক্ষাকৃত কম ধনীরাও সুন্দর ও আকর্ষণীয় বাড়িতে বসবাস করতেন। আর শহরের বাইরে কুঁড়েঘর বা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন দরিদ্র মানুষেরা। সামুদ্রিক বাণিজ্যের লাভজনক শুল্ক ও কলোনিগুলোর দেয়া কর থেকে শহরটি বিশাল বন্দরসমেত ২২০টি ডকের মালিক হয়ে ওঠে।
গ্রীক ভাস্কর্য দিয়ে তৈরী চকচকে বিশাল কলোনিওয়ালা বাড়িগুলো ছিলো নজরকাড়া। পোতাশ্রয় ছিলো দুটি -একটি বাণিজ্যের জন্য, আর অপরটি যুদ্ধ জাহাজের জন্য। নতুন সাজ-সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমে জাহাজ মেরামত ও জাহাজ রক্ষার কাজ ক্রমাগতভাবে চলতে থাকতো সেখানে। কার্থেজেনিয়ান জাহাজগুলো যখন ভূমধ্যসাগরের এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে যেতো, তখন সমুদ্রে তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠে চড়ে বেড়াতো নৌবাহিনী।
কি ছিলো না তাদের শহরে! বিনোদনের জন্য বিশাল থিয়েটার, ধর্মানুষ্ঠানের জন্য মন্দির, বিশাল অ্যাগোরা, নেক্রোপলিস সবই বিদ্যমান ছিলো কার্থেজে। শুধু ট্যারিফ, উত্তর আফ্রিকার উপকূলে সুবিধাজনক অবস্থান এবং সমুদ্র বাণিজ্যের জন্যই যে তারা এতো সমৃদ্ধ হতে পেরেছিলেন; তা কিন্তু নয়। কৃষিকাজেও তাদের দক্ষতা ছিলো অতুলনীয়। তাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ফসলের ক্ষেত হয়ে উঠতো সবুজ। খাল কেটে সেচের ব্যবস্থা করে আঙ্গুর, জলপাই ও বিভিন্ন সবজি ফলিয়ে অর্থনীতিকে তারা করে তুলেছিলো আরও সমৃদ্ধ। এছাড়াও কুমোরদের সুদক্ষ হাতের জাদুতে তৈরী মাটির পাত্র ওয়াইন ও জলপাই তেল দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ করে মেডিটেরিনিয়ান বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সরবরাহ করেও তারা আয় করে নিতেন প্রচুর মুদ্রা। এই মুদ্রা দিয়েই শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে উঠেছিলো কার্থেজে।
কার্থেজের বাণিজ্যের মাধ্যমে জন্ম হয়েছিলো শক্তিশালী ভূমধ্যসাগরীয় সংস্কৃতির। জমির উর্বরতা, চাষাবাদে তাদের দক্ষতা, আভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক বাণিজ্য কার্থেজকে ভূমধ্যসাগরের লর্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। তাদের সাথে পাল্লা দেবার মতো কোনো প্রতিযোগীও তখন ছিলো না। নৌ বাণিজ্যে তো কার্থেজ ছিলো অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক শহর।
কার্থেজের ধারাবাহিক ও অপ্রতিরোধ্য উন্নতি অন্যের চোখে ঈর্ষার জন্ম দিতো। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালে তাদের যখন রমরমা অবস্থা, রোম তখন ইতালির টাইবার নদীর উপর ছোট একটি নগর রাজ্য এবং কার্থেজের তুলনায় বেশ দুর্বল। কার্থেজবাসী যখন প্রাসাদ নির্মাণে সিদ্ধহস্ত, রোমানদের তখন বসবাসের জন্য ছোট কাঠের বাড়ি। হুমকি তো দূরের কথা, রোম তখন সামান্যতম চিন্তার বিষয়ও ছিলো না কার্থেজের জন্য। শান্তিচুক্তিও স্বাক্ষরিত ছিলো দুই দলের মধ্যে। চুক্তি অনুযায়ী কার্থেজ ইতালির বাণিজ্যের দিকে হাত বাড়াবে না। অন্য দিকে, রোমানরা পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের বাণিজ্যে হাত দিবে না। কিন্তু হায়! কার্থেজেনিয়ানরা ঘুণাক্ষরেও টের পান নি যে, রোমানরা তো কথা রাখার মানুষ নয় এবং কথা রাখেওনি তারা।
সম্প্রসারমান রোমানরা কার্থেজের বৈভবের উষ্ণতা অনুভব করতে পারছিলেন। সার্ডেনিয়ার কপার, টিন, সোনা ও রূপা নিয়মিতভাবে শক্তিশালী করে তুলছিলো কার্থেজেনিয়ানদেরকে। সেদিকে লোলুপ দৃষ্টি ফেললেন রোমানরা। তাছাড়া কার্থেজেনিয়ানদের শক্তি তাদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করলো। রোমের নিরাপত্তাহীনতা প্রবল আকার ধারণ করলো। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ইতালি জয় করে নিলেন রোমানরা। একটু একটু করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে লাগলেন তারা। কার্থেজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সুযোগ খুঁজতে লাগলেন রোমানরা। অবশেষে সমস্যার শুরুটা হলো সিসিলি নিয়ে।
সিসিলি আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে বড় দ্বীপ, যার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত ছিলো মেসানা। মেসানা ইতালির মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত একটি তিন মিটার চওড়া নগর রাষ্ট্র ছিলো। বোঝাই যাচ্ছে, সিসিলির কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া সক্রিয় ভলক্যানো মাউন্ট এটনার ছাইয়ের কারণে এখানকার জমি ভীষণ উর্বর। আর এ কারণে হাজার হাজার বছর ধরে সিসিলিতে পড়েছে বহিঃশক্তির নজর।
খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সাল থেকে সিসিলির মূল ক্ষমতা ছিলো ফিনিশীয়দের হাতে। আর টায়ারের পতনের পর সেই ক্ষমতা চলে গিয়েছিলো কার্থেজের নিয়ন্ত্রণে। বহু দিন ধরেই কার্থেজকে খনিজ সম্পদ দিয়ে সমৃদ্ধ করে রেখেছিলো সিসিলি। তাছাড়া সিসিলির বন্দরে কার্থেজেনিয়ান জাহাজগুলো রসদপূর্ণ হবারও সুযোগ পেতো। এই সমস্ত বিষয়গুলোই রোমকে অস্বস্তির মুখে ফেলে দিয়েছিলো। নিরাপত্তাহীনতা ও লোভ দুইয়ের সংমিশ্রণে রোম সিসিলি দখল করবার জন্য উঠে-পড়ে লাগলো। রোমের কিছু ব্যবসায়ী ব্যক্তিবর্গ পরিণত হলেন রাজনীতিবিদে। সিসিলির দখল মানেই যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে তা বুঝতে তাদের বেশি মাথা খাটাতে হলো না।
খ্রিস্টপূর্ব ২৮৫ সালে ম্যামারতিনরা সিসিলি দখল করে নিয়েছিলেন। সে সময় তাদের প্রতিপক্ষ ছিলো গ্রীক নগর রাষ্ট্র সিরাকুজ। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৬ সালে শ্বশুড় আঁগাথক্লেসের সম্মানে রাজা পাইরাস সিরাকুজের পক্ষে সিসিলি অবরোধ করেছিলেন। কিন্তু তখন তাকে কিছু ভুল বোঝাবোঝির কারণে সিসিলি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিলো। সেদিন পাইরাস আফসোস করে বলেছিলেন, এতো উর্বর একটি ভূমি একদিন রোম ও কার্থেজের ধ্বংসলীলার ভুক্তভোগী হবে। হয়েছিলোও তা-ই। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৪ সালে আবারও মেসানা অবরোধ করেন সিরাকুজবাসী, রাজা দ্বিতীয় হিয়েরোর নেতৃত্বে। আর এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ম্যামারতিনরা রোম ও কার্থেজের সহায়তার শরণাপন্ন হন। এদিকে কার্থেজেনিয়ান সেনা সিসিলিতে আগে এসে পৌঁছালেও ম্যামারতিনরা ইতালির অংশ হওয়ায় রোমের সহায়তাই গ্রহণ করেন। কিন্তু রোম ও কার্থেজের শান্তিচুক্তি অনুযায়ী, রোম কোনোভাবেই সিসিলিতে প্রবেশ করতে পারবে না। এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্তের বরখেলাপ হওয়ায় ক্ষুব্ধ কার্থেজ দ্বিতীয় হিয়েরোর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে মেসানা অবরোধ করে বসে। এরই মাধ্যমে শুরু হয় রোম ও কার্থেজের সংঘর্ষ, যা ইতিহাসে ‘পিউনিক যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
গ্রীকদের দেয়া ফিনিশীয়দের ‘ফিনিক্স’ নাম থেকেই ‘পিউনিক’ শব্দটির উৎপত্তি। দীর্ঘমেয়াদী এই পিউনিক যুদ্ধ তিনটি পর্যায়ে সংঘটিত হয়, যা যথাক্রমে প্রথম পিউনিক যুদ্ধ, দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ ও তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ২০ বছর ধরে স্থায়ী রোম-কার্থেজ সংঘর্ষের ফলে এক পর্যায়ে কার্থেজ বাধ্য হয় সিসিলিকে রোমের হাতে ছেড়ে দিতে। শুধু তা-ই নয়, ক্ষতিপূরণ হিসেবেও তাদেরকে দিতে হয়েছিলো বিশাল অঙ্কের ছাড়, সেই সাথে অসংখ্য শর্তের সাথে হতে হয়েছিলো চুক্তিবদ্ধ।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কার্থেজেনিয়ান সেনাপতি হ্যানিবলের বিষয়ে কিছুটা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি স্পেন হয়ে বৃত্তাকার পথে অগ্রসর হয়ে আল্পস পর্বত পাড়ি দিয়ে ইতালির দোরগোড়ায় পৌঁছেছিলেন। রোমানদের জন্য এই ঘটনা ছিলো কল্পনারও অতীত। এতো বিশাল দূরত্ব ডিঙ্গিয়ে রোম আক্রমণের সিদ্ধান্ত তাদেরকে হতবাক করে দিয়েছিলো। তবে যুদ্ধ পরিকল্পনার দাঁদনও কম দিতে হয় নি হ্যানিবলকে। খ্রিস্টপূর্ব ২১৮ সালে ১ লক্ষ ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে রওনা হন হ্যানিবল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তীব্র ঠান্ডায় প্রায় অর্ধেক সৈন্য, ঘোড়া ও হাতি মৃত্যুবরণ করে। তবে প্রতিকূল পরিবেশ কিংবা ব্যাপক মৃত্যুর হার কোনটিই তাকে বিন্দু পরিমাণ দমাতে পারে নি। বেঁচে থাকা সেনাবাহিনী নিয়েই ইতালি পৌঁছে যান হ্যানিবল। পথিমধ্যে উত্তর ইতালির পো উপত্যকার দুর্ধর্ষ উপজাতি গ্যালিকরা এসে তার সঙ্গে মিলিত হলে খানিকটা শক্তি ফিরে পান হ্যানিবল। সেবারের রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধে অবশেষে জয়লাভ করেন হ্যানিবল।
কৌশলী বুদ্ধিসম্পন্ন রোমানরা হঠাৎ-ই অভিনব এক পদ্ধতিতে যুদ্ধের গতি পরিবর্তনের চেষ্টা শুরু করেন। সিসিলির প্রতিরক্ষা বন্ধ করে তারা উল্টো দিকে, অর্থাৎ আফ্রিকার দিকে অগ্রসর হয়ে কার্থেজ আক্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। এতে বেশ বিপদে পড়ে যান হ্যানিবল। কারণ রোমানরা যখন কার্থেজের পাশে অবস্থান করছেন, তিনি তখন ইতালিতে। তিনি উপলব্ধি করলেন, স্বদেশ কার্থেজকে রক্ষা করতে হলে তাকে ইতালি ত্যাগ করে আফ্রিকায় ফিরে যেতে হবে।
খ্রিস্টপূর্ব ২০২ সালে হ্যানিবলের দল রোমানদের মুখোমুখি হলেন। রোমানদের শক্তিশালী অশ্বারোহী বাহিনী ছিন্নভিন্ন করে দিলো হ্যানিবলের দলকে। পরাজিত যোদ্ধা হ্যানিবলকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হলো রোমান সিনেট থেকে। হ্যানিবল স্থির করলেন, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু স্বয়ং কার্থেজবাসীই যখন তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে অস্বীকৃতি জানালেন, তখন রোমানদের হাতে অপদস্থ হয়ে অপমানজনক মৃত্যুলাভের চেয়ে আত্মহত্যাকে বেছে নেয়াই শ্রেয় মনে করলেন তিনি। নিজের চারপাশে শত্রুসৈন্যের উপস্থিতি তাকে বিষ পানে উদ্বুদ্ধ করলো। হারিয়ে গেলেন এক বীর যোদ্ধা।
ইতিহাসের প্রথম পরিব্রাজক ফিনিশীয়দের হাত ধরেই তো সাধিত হয়েছিলো সভ্যতার বৃহত্তম বিপ্লব ‘বর্ণমালা উদ্ভাবন’। তবে ইতিহাস তাদের সাথে সুবিচার করে নি। তাদেরই আবিষ্কৃত বর্ণমালা দিয়ে তাদেরই বিরুদ্ধে গ্রীক ও রোমানরা বিকৃত করেছে ইতিহাসকে। শত্রুপক্ষ কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারলেও, ডেমোক্রিটাসের কলমের মাধ্যমে তাদেরকে দেখানো হয়েছে আপন শিশুর হত্যাকারী হিসেবে। কিন্তু সত্যিটা হলো, বিশাল হৃদয়ের অধিকারী কার্থেজেনিয়ানরা যে দেশে গিয়েছেন, সে দেশের ঈশ্বরেকেই নিজেদের করে নিয়েছেন। রাজাদের পোশাকে পার্পল বা বেগুনী রঙের প্রচলনের শুরুটা লেবাননে হলেও পরবর্তীতে এক পর্যায়ে এটি কার্থেজেনিয়ানদের প্রধান অর্থকারী পণ্যে পরিণত হয়। তাদের আবিষ্কারের নেশা আমাদেরকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আবিষ্কারের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। চেনা জগৎ ছেড়ে অচেনা জগতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেবার মতো অসীম সাহস সে সময়ে আর কোনো জাতির মধ্যে এতো প্রবল ছিলো না।
লাইব্রেরির বই থেকে শুরু করে আজকের ডিজিটাল দুনিয়ার মোবাইল, কম্পিউটার -সবখানেই তাদের বর্ণমালা দাপটের সাথে অবস্থান করে চলেছে। তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবার জন্য এটুকু কারণই তো যথেষ্ট। আজ তাই হোমারের ইলিয়াডের ‘পার্পল পিপল’-দের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
রেফারেন্স: