পৃথিবীতে মনুষ্য সমাজের উৎপত্তি এবং বিকাশধারার যে সময়ে কোন লিখিত বিবরণ ছিল না সে সময় প্রাক-ইতিহাস পর্ব বলে পরিচিত। প্রত্নতত্ত্ব এবং নৃতত্ত্ব বলছে প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়। আর এর মধ্যে ২৪ লক্ষ বছরই কেটেছে কোন লিখিত ভাষা এবং প্রমাণাদি ছাড়া। লিখিত উপাদানের অভাবের কারণে সে সময় ব্যবহার করা মানুষের ব্যবহার্য সামগ্রী, স্থাপত্য, হাতিয়ার, গুহাচিত্র, কিংবদন্তির আশ্রয় গ্রহণ করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। এই প্রাক ইতিহাস যুগের মানুষগুলো তাদের জীবনের পুরোটা সময় কাটিয়ে দিয়েছিল পাথরের সাথে সখ্যতা গড়ে৷ পাথর দিয়ে অস্ত্রসস্ত্র তৈরি করে তখন তারা শিকারে বের হত, সংস্থান করত তাদের খাদ্য। খাদ্য সংগ্রহ ছাড়াও পাথর দিয়ে আগুন তৈরি করে সভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবারের মত তাক লাগিয়ে দিয়েছিল এই প্রাক ইতিহাস পর্বের মানুষ। পাথরের এই বহুল ব্যবহারের কারণে ঐতিহাসিকগণ এ বিশাল সময়কে নাম দিয়েছেন প্রস্তর যুগ। এই প্রস্তর যুগকে আবার দুইটি পর্যায়ে ভাগ করে নাম দেয়া হয়েছে পুরনো প্রস্তর যুগ এবং নতুন প্রস্তর যুগ। আজ আমরা জানব সেই পুরনো প্রস্তর যুগ এবং সে যুগের যত উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। 

পুরনো প্রস্তর যুগ কোথা থেকে এলো?

পুরনো প্রস্তর যুগ বা Paleolithic Age এসেছে গ্রিক শব্দ Palaious যার অর্থ প্রাচীন এবং Lithas অর্থ পাথর। তিন লক্ষ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকে দশ হাজার খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কাল পুরনো প্রস্তর যুগ বলে পরিচিত। নিয়ানডার্থাল, হাইডেলবার্গ এবং ক্রো-ম্যাগনননে বিভক্ত এ যুগের মানুষ। 

এ যুগের মানুষজন নিজেরা খাদ্য উৎপাদন করতে জানত না। তাই তারা স্বাভাবিকভাবেই পশু শিকারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে৷ পাথর দিয়ে তৈরি হাতিয়ার দিয়ে তারা পশু শিকার করত। বড় বন্য পশু ছাড়াও ছোট জন্তু যেমন খরগোশ,  বনমোরগ, হাঁস ইত্যাদিও তারা শিকার করত৷ অস্ত্রসস্ত্রের নমুনা এবং পশুপাখির পরিত্যক্ত হাড়, কংকাল দেখে ধারণা করা হয় পুরনো প্রস্তর যুগের মানুষরা দক্ষ শিকারি ছিল৷ অস্ত্র খুব একটা মসৃণ না হওয়ায় তারা একসাথে দলবদ্ধভাবে শিকার করত। ব্যক্তিগত সম্পদের কোন ধারণা না থাকায় শিকার থেকে প্রাপ্ত খাদ্য সবাই ভাগাভাগি করে খেত। পুরনো প্রস্তর যুগের শেষদিকে মাছ শিকারের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে।

পুরনো প্রস্তর যুগের মানুষদের নির্দিষ্ট কোন বাসস্থান না থাকার কারণে যাযাবর হয়ে ঘুরে বেড়াতো। যেখানে রাত হত সেখানেই তারা অস্থায়ী আশ্রয়স্থল নির্মাণ করত। এসময় মানুষ তৃণ অঞ্চল, নদী, সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল, পর্বত সংকুল এলাকা ও জলাভূমিতে বাস করেছে। প্রথমদিকে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটালেও একসময় মানুষ জীবজন্তুর কাছ থেকে নিজেদের রক্ষার্থে ঘর তৈরি করে ফেলে। উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে মানুষ সমতল ভূমিতে কুঁড়েঘর আকৃতির ঘর তৈরি করত। চেকোশ্লোভাকিয়ায় পুরনো প্রস্তর যুগের শিকারীদের ঘরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে৷ এসব ঘর ছিল আজকের দিনের তাঁবুর মত। এখানে পাওয়া কুটির পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, চারপাশে গোল করে চুনাপাথর ও কাদা মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা৷ তবে হিংস্র জীবজন্তু থেকে বাঁচার জন্য পুরনো প্রস্তর যুগের মানুষ পাহাড়ের গুহাকেই অধিকতর নিরাপদ বলে মনে করত। 

অরণ্যে বাস করা পুরনো পাথরের যুগের মানুষ প্রাথমিক সময়ে বস্ত্রহীন থাকলেও শেষদিকে এসে বিশেষ করে নিয়ান্ডার্থালরা শীত থেকে বাঁচার জন্য চামড়া দিয়ে গা ঢাকার পদ্ধতি অবলম্বন করে৷ গোড়ার দিকে গাছের ছাল বাকল এবং লতাপাতা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করলেও পরে আস্ত একটা পশুর চামড়া দিয়েই তারা বস্ত্র ব্যবহারের একটা উন্নত ধারণা সামনে নিয়ে আসে। তারও পরে হাড়ের তৈরি সুঁই ও শক্ত গাছের বাকল দিয়ে তৈরি সুতো দিয়ে তারা পুরো চামড়াকেই সেলাই করে নিতে শেখে।

এই যুগের মানুষেরা ভারী হাতিয়ারও ব্যবহার করেছিল। প্রথমদিকে পুরনো প্রস্তর যুগের মানুষদের ব্যবহৃত হাতিয়ার নিয়ে ধোঁয়াশায় ছিলেন প্রত্নতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ববিদরা। তারা মনে করতেন এই হাতিয়ারগুলো ছিল নিতান্তই পাথরের টুকরো৷ তবে পরবর্তীতে এই ধারণা পুরোপুরি পালটে যায়। বেশিরভাগ প্রত্নতত্ত্ববিদই বিশ্বাস করেন, প্রথম হিমযুগ শুরু হওয়ার আগেই মানুষ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করতে শিখেছিল। প্রথম দিকে পৃথিবীর সব জায়গার মানুষ হাতিয়ার তৈরির জন্য ব্যবহার করেছে চকমকি পাথর। এ সময় এক খন্ড বড় পাথরকে ভেঙে  প্রয়োজনীয় হাতিয়ার তৈরি করা হত৷  প্রস্তর যুগের আবিষ্কৃত হাতিয়ারের মধ্যে আঁচড়, বাটালি, শাবল, ছুরি, বর্শা, বল্লমও ছিল গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। 

পুরনো প্রস্তর যুগের যুগান্তকারী একটি উদ্ভাবন হচ্ছে আগুনের আবিষ্কার। ঠিক কবে থেকে মানুষ আগুন ব্যবহার করা শুরু করে তার ঠিকঠাক হদিস জানা না গেলেও পিকিং মানবরা যে আগুনের ব্যবহার জানত তা চীনের কু তিয়েন অঞ্চলের গুহা থেকে সর্বপ্রথম জানা যায়। প্রথমদিকে আদিম মানুষ আগুনের ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা রাখত না। বাইরে থেকে আগুন সংগ্রহ করে গুহার ভেতরে জ্বালিয়ে রাখত শুধু। আগুন আবিষ্কারের সূত্র ধরে মানুষ প্রথমবারের মত প্রকৃতির এক শক্তির উপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়ার এক বৈপ্লবিক পথ উন্মোচন করে৷ 


কেমন ছিল তাদের ধর্ম বিশ্বাস?

পুরনো প্রস্তর যুগের পূর্ববর্তী পর্যায়ে মানুষের মনে ধর্মের ধারণার উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেক নৃতত্ত্ববিদ মনে করে থাকেন। যদিও বর্তমানে ধর্ম বলতে যা বিদ্যমান তার উদ্ভব হয়েছে আরো পরে। ক্রো-ম্যাগনন জাতের মানুষ এক ধরণের অদৃশ্য শক্তিতে বিশ্বাস করত৷ তারা অলৌকিক শক্তি ও যাদুটোনায় বিশ্বাস রাখত। এ সময় মানুষের মধ্যে আত্মার অমরত্বের ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়৷ পুরনো প্রস্তর যুগের একেবারে প্রথম দিকে মৃতদের কবর দেয়ার রীতি প্রচলিত ছিল, মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যত্নসহকারে পালন করা হত। ফ্রান্সে নিয়ান্ডার্থালদের এক ডজনের বেশি কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। পুরনো প্রস্তর যুগের আবিষ্কৃত প্রায় প্রতিটি কবরখানায় জানোয়ারের কংকাল পাওয়া গেছে। এ থেকে ধারণা করা হত মৃতের জন্য কবরের খাদ্যের মজুদ রাখা হত। অনেক ক্ষেত্রে মৃতদেহকে হাত-পা মুড়ে এমন ভঙ্গিতে রাখা হত যে ভঙ্গিতে শিশু মায়ের পেটে থাকে। এ থেকে ধারণা করা হত, মৃত ব্যক্তি আবার জন্মলাভ করতে পারে৷ পুরনো প্রস্তর যুগের মানুষদের খাদ্য সংগ্রহের ধারা দুর্বল থাকায় তারা প্রাত্যহিক জীবনে যাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী হয়ে উঠে।

সেই পুরনো প্রস্তর যুগেই প্রোথিত করা হয়েছিল মানবজাতি ও মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার ইতিহাস। মানুষের প্রয়োজন আর বেঁচে থাকার তাগিদ থেকে আবিষ্কার হয় অনেক কিছু। যা আজ আধুনিক যুগে এসে মানুষের অসাধারণ মেধা ও দক্ষতায় এর পূর্ণতা লাভ করেছে।

তথ্যসূত্র

সভ্যতার ইতিহাস : প্রাচীন ও মধ্যযুগ

আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন ,  মোঃ আব্দুল কুদ্দুস সিকদার

https://www.britannica.com/event/Paleolithic-Period

https://www.khanacademy.org/humanities/world-history/world-history-beginnings/origin-humans-early-societies/a/paleolithic-culture-and-technology

 

শিউলি ফুলের বিষণ্ণতার গল্প

শরতের রাতের সৌন্দর্য বলতে যে ফুলকে বোঝানো হয়, তা হলো শিউলি ফুল। তবে এ সৌন্দর্য আনন্দের নয়, বেদনার প্রতীক। শিউলি ফুলের নাকি সব সময়ই মন খারাপ থাকে। সূর্যের ওপর তার এক রাশ অভিমান। তাই তো রাতের আঁধারেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করে সে এবং সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে ঝরে পড়ে।...

মিশরীয় সিন্ডারেলা

মিশরে তখন ১৬ তম রাজবংশের যুগ। পার্সিয়ান আক্রমনের সম্ভাবনায় দিন গুণছে মিশর। সে সময় মিশরীয় সৈন্যদের তুলনায় গ্রীক সৈন্যদের কদর ছিলো অনেক বেশি। কারণ গ্রীক সৈন্যদের দক্ষতার গল্প প্রচলিত ছিলো বিশ্ব জুড়ে। এমন সময় ফারাও এপ্রিয়েজকে হত্যা করে মিশরের নতুন ফারাও হলেন রাজবংশের...

প্রাচীন সভ্যতায় ঈশ্বরের ধারণার উৎপত্তি ও সংখ্যাগত অবনমন

যে কোন সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বহু ঈশ্বর বা গডের অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে ঈশ্বর সম্পর্কে এ ধারণা অনেকটাই পাল্টেছে। কেননা বর্তমান বিশ্বে বহু ধর্মমত এখনও বিদ্যমান থাকলেও ঈশ্বরের সংখ্যার বিষয়টি কমে এসেছে। একেশ্বরবাদ কিংবা বহুঈশ্বরবাদী...

হিন্দু দেব-দেবীর ধারণা প্রাচীন মধ্য এশীয় বিশ্বাসেরই প্রতিরূপ নয় তো?

সিংহবাহনের ওপর এক হাতে চাঁদ ও এক হাতে সূর্য নিয়ে চার হাতবিশিষ্ট এক দেবী যুদ্ধবাজ ভঙ্গিমায় আসীন নিজের সন্তানদের প্রতিরক্ষার জন্য। খুব পরিচিত লাগছে তাই না? নিশ্চয়ই দেবী দুর্গার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু এ তো দুর্গা নয়, ব্যাক্ট্রিয়ান মাতৃদেবী ‘নানায়াহ’ বা ‘ননা’...

মহাবীর কর্ণের অন্তিম যাত্রা

সূর্যদেব অস্তে চলে যাচ্ছেন। গোধূলিবেলার লালচে আলোতে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার এই জন্মের শত্রুকে। তার গান্ডিব ধরা উদ্ধত হাতে চকচক করছে অঞ্জলিক বাণ, যা আমার মস্তক ছেদ করার জন্য একটু পরেই ছুটে আসবে।পান্ডব বীর অর্জুন, যে আমার চরম শত্রু আবার আমার সহদর কনিষ্ঠ ভ্রাতা।ওই...

মেহেদী হাসান খান

মেহেদী হাসান খান ১৮ বছর বয়সের মেহেদী হাসান খান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন,কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নাই! কিন্তু কেন? তিনি নাওয়া- খাওয়া, পড়াশোনা বাদ দিয়ে একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে বাংলা ভাষায় লেখার জন্য লড়াই শুরু করলেন। একটাই জেদ, বাংলা...

ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সংগ্রহশালা- বলধা জাদুঘর

১৯২৫ সালের ঢাকা; ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে নারায়ণগঞ্জের দিকে কিছুদূর এগুলে উয়ারি। উয়ারির শেষ সীমানায় এক সরু রাস্তা চলে দিয়েছে নারিন্দার দিকে। সরু সেই রাস্তার একপাশে বহু পুরাতন খ্রিস্টান কবরখানা আর তার বিপরীতে উঁচু পাচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতর দোতলা...

সুন্দরবন ধ্বংসের ইতিবৃত্ত

ব্রাজিলের চিরসবুজ বিস্তৃত এমাজন (Amazon Rainforest) গহীন বনাঞ্চলকে বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, তেমনি সুন্দরবনও বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের এক অঙ্গ। এই ঘন বনাঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও এক প্রতিরোধ। সুন্দরবনকে ঘিরে আশেপাশের জনপদে ছড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। এমনি...

ঢাকার এক বিস্মৃত চিকিৎসক

দিনটি ছিল ১৫ই নভেম্বর ১৮৬৪ সাল, মঙ্গলবার। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থানের দীর্ঘ ঘাসের ঝোপে অবশ্য তখনই অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা হলে এই এলাকায় সহজে কেউ পা বাড়ায় না। কিন্তু সেদিন পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য- আছে ইংরেজ, আরমেনিয়, দেশী সব...

ঢাকার ঐতিহাসিক তারা মসজিদ

পূর্বকথাঃ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আরমানিটোলার মহল্লা আলে আবু সাঈদে তখন এক প্রভাবশালী জমিদারের বাস, নাম- মীর্জা গোলাম পীর। দাদা মীর আবু সাঈদ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা যুগে তুরস্ক থেকে এসে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। মীর্জা গোলাম পীরের আরেক নাম মীর্জা আহমেদ জান। তবে...