১৯১০ সালে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী সৈন্যদের হাতে কোরিয়া উপদ্বীপের জসন সাম্রাজ্যের যবনিকাপাত হয়। অর্থাৎ কোরিয়া জাপানের দখলে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের আগ পর্যন্ত কোরিয়া জাপানের অধীনে শাসিত হতে থাকে। এতদ্বসময় ধরে কোরিয়ানদের উপর জাপানিদের আগ্রাসন চলতে থাকে নানান ভাবে। কোরিয়ানদের সংস্কৃতি, ভাষার উপর বিভিন্ন কায়দায় জাপান হানা দিতে থাকে৷ কোরিয়ান জনগণকে মানুষ বলে গণ্য করতে পারত না তারা। আর এজন্য সম্ভব অসম্ভব সব ধরণের নির্যাতনই তাদের উপর চালাত আজকের শান্তিপ্রিয় জাপানিজরা। এমন অবস্থায় মুক্তির সুবাতাসের সন্ধান করছিল নিপীড়িত কোরিয়ানরা। সেই সুযোগও এসে পড়ে। ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা চালায় তখন জাপান বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করে এবং জাপান সাম্রাজ্যের পতন হয়। জাপানের পরাজয় কোরিয়ানদের মনে আশার সঞ্চার করে। স্বাধীনতার পরশ পাথর যেন অল্প দূরত্বের হাতছানি মনে হয় কোরীয় উপদ্বীপের এই মানুষগুলোর কাছে। কিন্তু সহসাই স্বাধীনতার সম্ভাবনা তো উবে গেলই উপরন্তু দুই পরাশক্তির খেলনা হিসেবে কোরিয়া ব্যবহার হতে থাকল। জাপানের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে কোরিয়া প্রস্তুত হতে থাকল ভাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। প্রাণ হারায় দুই কোরিয়ার প্রায় আড়াই মিলিয়ন মানুষ। ইতিহাস এর নাম দিয়েছে কোরিয়া যুদ্ধ।
কোরিয়া যুদ্ধ কি অবশ্যম্ভাবী ছিল?
কোরিয়া যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ছিল কিনা এমন প্রশ্নের দায় এড়াতে পারেনা দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের এই দুই দেশ জোটবদ্ধ থাকলেও যুদ্ধ শেষে পরাজিত শক্তিগুলোর দেশগুলো ভাগ করে নেয়ার এক গোপন যুদ্ধে মেতে উঠে সাম্যবাদী চিন্তার ধারক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পুঁজিবাদী ভাবধারা পুষ্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার এই শীতল যুদ্ধে বলির পাঁঠা হয় কোরিয়া উপদ্বীপ।
যেভাবে যুদ্ধ শুরু হয়
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে কোরিয়া দখলের পায়তারা করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। কোরিয়া দখলের এমন নীরব খেলায় প্রথমেই আঘাত হানে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক । কোরিয়া উপদ্বীপে কোন মার্কিন ঘাটি না থাকায় উত্তর দিকে সোভিয়েত সৈন্যরা এগিয়ে যেতে থাকে এবং কোরিয়ায় থাকা অবশিষ্ট জাপানিজ সৈন্যদের হত্যা করা শুরু করে। সোভিয়েতের কোরিয়া অভিমুখে সামরিক কায়দায় গমনকে আগ্রাসী বিবেচনা করে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যেতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। একদিকে উত্তর অভিমুখী সোভিয়েত ইউনিয়ন আর অন্যদিকে দক্ষিণ অভিমুখী যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের দখল কর্মকাণ্ড চালাতে চালাতে একসময় ৩৮ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা বরাবর এসে মিলিত হয়। এই ৩৮ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখাই ছিল দুই কোরিয়ার সংযোগস্থল। দখলদার দুই দেশ এবার শীতল যুদ্ধ বাদ দিয়ে আলোচনার টেবিলে বসে৷ উদ্দেশ্য কোরিয়াকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব অনুযায়ী ৩৮ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা বরাবর কোরিয়াকে ভাগ করে দেয়া হয় যার দক্ষিণাংশ পাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তরাংশ সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর এরই সাথে কোরিয়া উপদ্বীপ স্বাধীনতার কোন স্বাদ না পেয়েই বিভাজনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে যায়। ক্যালেন্ডারে সময় তখন ছিল ১৯৪৮ সাল। কিন্তু তবুও যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত নতুন সরকার গঠন করে কোরিয়াকে একীভূত করার চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু উভয় গোষ্ঠীই চেয়েছে কোরিয়ায় নিজেদের ভাবধারার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। আর এজন্য উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম ইল সাং কে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থন দেয় তার সমাজতন্ত্র ঘেঁষা নীতির কারণে। অপরপক্ষে দক্ষিণ কোরিয়ায় জাতীয়তাবাদী নেতা স্নিনমান রি কে সর্বাত্মক সমর্থন দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই দুই বছর দুই কোরিয়ার একত্রীকরণ নিয়ে অনেক দরকষাকষি হয়। কিন্তু কোন আলোচনাই আলোর মুখ দেখতে পারেনি। এমন সময় সহসাই ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে বসে। আকস্মিক এই আক্রমণে দক্ষিণ কোরিয়া হতচকিত হয়ে পড়ে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় সমগ্র দক্ষিণ কোরিয়া উত্তরের দখলে চলে আসে। উত্তর কোরিয়াকে প্রকাশ্য সমর্থন দেয় রাশিয়া ও চীন। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার আক্রমণকে ইচ্ছাকৃত আগ্রাসন দাবি করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নিয়ে কয়েকটি দেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ শুরু করলে অক্টোবর নাগাদ উত্তর কোরিয়া পিছু হটতে শুরু করে। এরই মাঝে আঘাত পালটা আঘাতে কোরিয়ানদের ইতিহাসে রক্তক্ষয়ী অধ্যায় লিখা হতে থাকে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ম্যাগ আর্থারের জায়গায় নতুন জেনারেল হিসেবে আসেন এম.বি রিগওয়ে। যুদ্ধ বাদ দিয়ে তিনি ভেতরে ভেতরে শান্তিচুক্তির প্রস্তাব করেন। শান্তি আলোচনা চলতে থাকে দুই বছর। অবশেষে ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই উভয়পক্ষ যুদ্ধবিরতি চুক্তি সাক্ষর করে। তার অব্যবহিত পর থেকে ৩৮ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ মেনে দুই কোরিয়া স্বাধীন হয়ে পড়ে যার উত্তরাংশ সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ভাবধারা মেনে চালিত হয় এবং দক্ষিণাংশ মার্কিন পুঁজিবাদী ভাবধারায় চালিত হয়।
যেই কোরিয়া উপদ্বীপ জাপানের বাহুডোর বের হয়ে ভেবেছিল স্বাধীনতার আস্বাদ গ্রহণ করবে বিশ্ব রাজনীতির নিষ্ঠুর বাস্তবতায় সেই কোরিয়া হয়ে গেল দুই ভাগ। ইতিহাসের এমন দুর্দিন থেকে বেরিয়ে এসে দক্ষিণ কোরিয়া এখন পৃথিবীর মধ্যে অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে সমৃদ্ধ একটি দেশে পরিণত হয়েছে। বিপরীতে উত্তরে শুধুই হতাশা৷ বিপর্যস্ত অর্থনীতি, সামাজিক অস্থিরতায় জর্জরিত উত্তর কোরিয়া এখন ব্যর্থতার বুনন ছাড়া আর কিছুই না।