নীলের ঘরে দিলাম বাতি

     সাক্ষী থেকো মা ভগবতী।’

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। বছরজুড়ে উৎসবের শেষ নেই।

আর গ্রামবাংলার লৌকিক উৎসব আর পার্বণ তো অগণ্য।

বাঙালি হিন্দুদের তেমনি এক পার্বণ হলো নীলের পূজা। কালের চক্রে শহুরে হিন্দুসমাজে তেমন একটা প্রচলন আজকাল না থাকলেও বাংলার গ্রামাঞ্চলে কিন্তু এখনও প্রচলিত এই পূজা।

নীল পুজোটা আসলে কী?

নীল পুজো’ বা নীলষষ্ঠী বা নীলের ব্রত হলো বাংলার হিন্দুসমাজের এক লৌকিক উৎসব, যা মূলত নীল- নীলাবতীর বিয়ে’  বা শিব-দুর্গার বিবাহ বা শিবের বিয়ে নামে পরিচিত। সাধারণত চৈত্রসংক্রান্তির চড়ক উৎসবের আগের দিন অনুষ্ঠিত হয় এই পুজো ৷

নীল বা নীলকণ্ঠ মহাদেব শিবের অপর নাম। সেই নীল বা শিবের সঙ্গে নীলচণ্ডিকা বা নীলাবতী পরমেশ্বরীর বিয়ে উপলক্ষ্যে লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান সংঘটিত হয়। নীলপূজা সাধারণত সন্তানবতী হিন্দুরমনীরা তাদের সন্তানের মঙ্গলকামনায় পালন করে থাকেন।

নীল পূজার পিছনে একটা পৌরাণিক গল্প প্রচলিত।

পুরাকালে প্রজাপতি দক্ষ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। ঐ দক্ষযজ্ঞে তিনি সমস্ত দেবতাদের আমন্ত্রণ জানালেও নিজের জামাতা শিবকে আমন্ত্রণ করেননি। কারণ দক্ষ শিবকে পছন্দ করতেন না।  দক্ষের কন্যা সতী এর কারণ জানতে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলে দক্ষ শিবকে অপমান করে কটু কথা বলেন। সতী তাঁর স্বামী শিবের অপমাম সহ্য করতে না পেরে ঐ যজ্ঞস্থলে প্রাণত্যাগ করেন।

সেই সতীই পুণরায় নীলধ্বজ রাজার বিল্ববনে পরমা সুন্দরী কন্যারূপে আবির্ভূত হন। রাজা তাকে নিজ কন্যারূপে লালন-পালন করে শিবের সাথে বিয়ে দেন। বাসর ঘরে নীলাবতী শিবকে মোহিত করেন এবং পরে মক্ষিকারূপ ধরে ফুলের সঙ্গে জলে নিক্ষিপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন; রাজা-রাণীও শোকে প্রাণবিসর্জন দেন। শিব ও নীলাবতীরই বিবাহ-অনুষ্ঠানের স্মরণেই এই নীলপূজা অনুষ্ঠিত হয়।

নীলপূজার রীতিঃ

বাংলা গ্রামাঞ্চলে সব জায়গাতেই কমবেশি পালন করা হলেও পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান  উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা,  নদিয়া, হাওড়া; বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, বরিশাল এবং ত্রিপুরায় বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অধ্যুষিত এলাকাতেই নীলপূজা ব্যাপকভাবে পালন করা হয়। নদিয়া জেলার নবদ্বীপে গাজন উৎসবের একটি অংশ হিসাবে বাসন্তী পুজোর দশমীর ভোরে শিবের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

সাধারণত চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন করা হয়ে নীলের ব্রত। ঐদিন সারাদিন উপবাস করে বিকেলে শিবের মাথায় জল ঢালেন সন্তানবতী হিন্দু রমণীরা ৷ ‘নীলের ব্রতকথা’ শুনে সন্তানের কল্যাণার্থে প্রদীপ জ্বালিয়ে শিবপুজো করে সারাদিনের উপবাস ভঙ্গ করেন ৷

সাধারণত নিম বা বেল গাছের কাঠ দিয়ে নীলের মূর্তি তৈরি হয়। চৈত্রসংক্রান্তির বেশ কিছুদিন আগেই নীলকে মণ্ডপ থেকে নিচে নামানো হয়। নীলপূজার আগের দিন হয় অধিবাস; ঐদিন অধিক রাত্রে হয় হাজরা পূজা। হাজরা পূজা হলো বিয়ে উপলক্ষে সকল দেবতাকে আমন্ত্রণ করা। হাজরা পূজায় শিবের চেলা বা ভূত-প্রেতের দেবতাকে পোড়া শোল মাছের ভোগ দেওয়া হয়। পরদিন নীলপূজার সময় নীলকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে নতুন লালশালু কাপড় পরিয়ে সাজানো হয়। 

তারপর নীলসন্ন্যাসীরা ও শিব-দুর্গার সঙেরা একইরকম লাল কাপড় পরে পাগড়ি মাথায়, গলায় রুদ্রাক্ষমালা ও হাতে ত্রিশূল নিয়ে পূজার সময়ে সুসজ্জিত নীলকে নিয়ে গীতিবাদ্য সহযোগে বাড়ি বাড়ি ঘোরান এবং ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। এ সময় তাদেরে মুখে শোনা যায় এক বিশেষ ধরনের গান ৷ যা লোকমুখে নীলের গান’ বলেই পরিচিত ৷ তবে এই গানের আসল নামটি হল-অষ্টক গান’ ৷এদের দলপতিকে বলা হয় বালা। সাথে থাকে ঢাক-ঢোল, বাঁশী বাজনদারের দল এবং কাল্পনিক শিব-দুর্গার সাজে সঙেরা। এরা নেচে গেয়ে শিব-দুর্গার বিয়ে, তাঁদের বিভিন্ন সাংসারিক ঘটনা, শিব-দুর্গাকে নিয়ে প্রচলিত বিভিন্ন লৌকিক উপাখ্যান অভিনয় করে দেখান।

গৃহস্থ মহিলারা উঠানে আল্পনা দিয়ে নীলকে আহ্বান করে বরাসনে বসিয়ে তার মাথায় তেলসিঁদুর পরিয়ে দেন। এরপর নীলের গান শুরু হয়।

নীলের গানে সাধারণত শিব-পার্বতীর বিয়ের কথাই বর্ণিত হয়।

 এরপর ঘটা করে দেওয়া হয় নীল-নীলাবতীর বিয়ে।

বিয়ের পর নীলের গানে থাকে সংসারী হর-পার্বতীর কথা, শিবের কৃষিকাজ, গৌরীর শাঁখা পরা প্রভৃতি এবং ভিখারি শিবের সঙ্গে অন্নপূর্ণা শিবানীর দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানের কাহিনি। গানের প্রথম অংশ দলপতি বালারা এবং পরবর্তী অংশ অন্য নীলসন্ন্যাসীরা গেয়ে থাকেন।

গানের শেষে গৃহস্থরা সন্ন্যাসীদের চাল-পয়সা, ফল প্রভৃতি ভিক্ষাস্বরূপ ।

এরপর নীলের ব্রতকথা শুনে সন্ধ্যাবেলা পুজো দিয়ে

সন্তানের মঙ্গলকামনার্থে নীল-নীলাবতী তথা শিব-পার্বতীর সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে বলেন,

     নীলের ঘরে দিলাম বাতি

     সাক্ষী থেকো মা ভগবতী।’

এভাবেই সমাপ্তি ঘটে নীলের পূজার।

তথ্যসূত্রঃ

১) বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, দুলাল চৌধুরী,আকাদেমি অব ফোকলোর,কলকাতা।

২)বাংলার লৌকিক ধর্মসঙ্গীত

৩)বাংলার লৌকিক ব্রতকথা