মনে আছে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ এর কথা? সময়টা তখন বাংলা ১১৭৬ সন, যে কারণে নামটাও হয়েছিলো ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’। হ্যাঁ, বাংলার সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কথাই বলছি, যার কারণ হিসেবে ব্রিটিশরা প্রাকৃতিক বিপর্যয়কেই প্রচার করে গিয়েছে ঢালাওভাবে। কিন্তু আসলেই কি শুধু বন্যাই ছিলো এই দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ? প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো কতোই ঘটে যায়, কিন্তু প্রাচুর্যে ভরপুর বাংলায় দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া কি এতো সহজেই পড়তে পারে?
একটু ভালো করে ভেবে দেখুন, তখন ইংরেজি ১৭৭০ সাল। ‘লর্ড রবার্ট ক্লাইভ’ নামটির সঙ্গে তো আমরা সবাই পরিচিত। পলাশীর যুদ্ধের সাথে এই ব্যক্তির সরাসরি সম্পর্ক ছিলো। ১৭৫৭ সালে সংঘটিত এই যুদ্ধে ক্লাইভের ধূর্ত ষড়যন্ত্রের কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ই তো বাংলার উপর ব্রিটিশদের আধিপত্যের আনুষ্ঠানিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। এরপরই ১৭৫৮ সালে বাংলার গভর্নরের দায়িত্ব দেয়া হয় ক্লাইভকে। তারপর ১৭৬৫ সালে আরও একবার বাংলার গভর্নর হিসেবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় এই ব্যক্তি।
বাংলার পুতুল নবাবের হাতে তখন নামমাত্র ক্ষমতা। আসল ক্ষমতা ছিলো ক্লাইভের হাতে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বৈত শাসন ব্যবস্থায় বাংলায় প্রশাসনিক কাজ, রাজস্ব আদায়, ব্যয় ইত্যাদি সমস্ত কিছুর কর্তৃত্ব চলে যায় কোম্পানির হাতে। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই ক্লাইভ খাজনা আদায়ের নামে শুরু করে অত্যাচার ও অবাধ লুন্ঠন। দুই দফায় বাংলার গভর্নর হয়ে বাংলার মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করে ইউরোপের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের একজনে পরিণত হয় ক্লাইভ। আর এর ফলেই বাংলার মানুষের জীবনে নেমে আসে দুঃসহ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।
ওদিকে ক্লাইভ বিপুল সম্পদ নিয়ে ফিরে যায় ব্রিটেনে, আর এদিকে বাংলার এক কোটিরও বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষগ্রস্ত হয়ে মারা যায়। আর ক্লাইভের এই কৃতকর্মকে ধামাচাপা দেবার জন্য শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। ১৭৬০ সালে রোমান পোশাক পরিহিত চারটি মার্বেল মূর্তি তৈরী করে কোম্পানি, যার মধ্যে একটি ছিলো ক্লাইভের মূর্তি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদেরকে নতুন গঠিত এশীয় সাম্রাজ্যের সৃজনকর্তা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যই এই মার্বেল মূর্তিগুলো তৈরী করেছিলো। আর ক্লাইভকে তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলো সাহসী বীর সৈনিক হিসেবে। ১৭৬৪ সালে ক্লাইভের মূর্তিটিকে লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে স্থাপন করা হয়।
১৭৭১ সালে ব্রিটেনের কথিত হিরো রবার্ট ক্লাইভের ইমেজে আঘাত করে বসে ‘টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি’ নামের একটি সাময়িকী। ১৭৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সাময়িকীর মূল কাজ ছিলো শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের জীবনের স্ক্যান্ডালগুলোকে ব্যাঙ্গাত্মক গল্পের আকারে প্রকাশ করা। এই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ক্লাইভের স্মৃতিকথায় ক্লাইভকে নাম দেয়া হলো ‘নিরো এশিয়াটিকাস’, অর্থাৎ এশীয়দের ঠকানো নিরো। এই ‘নিরো’ ছিলো মূলত পঞ্চম রোমান সম্রাট ‘নিরো ক্লডিয়াস সিজার অগাস্টাস জার্মানিকাস’। সম্রাট নিরো চোখের সামনে রোমকে আগুনে পুড়তে দেখেও নির্বিকারভাবে ‘ফিডল’ নামের একটি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে যাচ্ছিলো। রোমান পোশাক পরিহিত ক্লাইভকেও তাই সেই নিরোর সাথেই তুলনা করেছে ‘টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি’ ম্যাগাজিন।
শুরু হলো ক্লাইভকে নিয়ে তুমুল সমালোচনা। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হাল ছেড়ে দেয় নি। ক্লাইভের ক্ষুণ্ণ ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করাই যেনো তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো। আরও একটি প্রতিকৃতি তৈরী করালো তারা। এবারেরটি ছিলো একটি চিত্রকর্ম, যেখানে ক্লাইভ বাংলার নবাবের কাছে অসুস্থতার জন্য কর্মবিরতিতে থাকা ব্রিটিশ সৈন্যদের দুর্দশা ব্যক্ত করছে এবং যার মাঝে একজন বিধবা নারীকেও নবজাতক সন্তান কোলে নিয়ে ও অন্যান্য সন্তানদের মধ্যমণি হয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। এই চিত্রকর্মটির মাধ্যমে কোম্পানি বোঝাতে চেয়েছে যে, দুস্থ সেনাদের জন্য নবাবের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করতে গিয়ে ক্লাইভ এক মানবেতর দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে। চিত্রকর্মটি ১৭৭২ সালে তৈরী করানো হয় রয়্যাল অ্যাকাডেমীর চিত্রাঙ্কনের প্রথম অধ্যাপক অ্যাডওয়ার্ড পেনিকে দিয়ে। তৈরী হয়ে যাবার পর প্রধান কার্যালয় ইস্ট ইন্ডিয়া হাউজে নেয়ার আগে চিত্রটিকে রাখা হয় ব্রিটিশ অ্যাকাডেমীর বাৎসরিক প্রদর্শনীতে, যেনো জনপ্রিয় এই প্রদর্শনীতেই হাজার হাজার মানুষের চোখে পড়ে যায় পেইন্টিংটি।
‘টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি’ এবারও সুযোগ হাতছাড়া করলো না। ১৭৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলো একটি কার্টুন, যার শিরোনাম ছিলো ‘দ্য ইন্ডিয়া ডিরেক্টরস ইন দ্য সুডস’। কার্টুনটিতে এক দল মৃত নবাবদের দেখা যায়, যাদের দেখে ক্লাইভ ভয়ে পেছনের দিকে লাফিয়ে সরে যাচ্ছে। ভূতের আদলে দাঁড়িয়ে থাকা নবাবরা আসলে দুর্ভিক্ষ কবলিত বাঙালিরই প্রতিনিধিত্ব করে।
সত্যকে কখনো মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা সম্ভব নয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিথ্যাচার, নিজেদেরকে বড় করে দেখানো, ক্লাইভের অন্যায় লুন্ঠনকে প্রশ্রয় দেয়া, বাংলার দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে প্রকৃতিকে দায়ী করা ইত্যাদি কোনো প্রচেষ্টাই কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারে নি। ক্লাইভ বাংলার মানুষের মনে তো ঘৃণাভরে জায়গা করে নিয়েছিলোই, এমনকি নিজের দেশের মানুষের কাছেও সে ভালোবাসা পায় নি। ক্লাইভ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উভয়েই তাদের মর্যাদা হারিয়েছিলো, যেটা প্রকৃতপক্ষেই তাদের প্রাপ্য।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই মনে করে থাকে যে, ব্রিটিশদের কাছে আমাদের বহুলাংশে কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। কারণ হিসেবে তারা ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপকতা, রেল লাইন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে দর্শিয়ে থাকে। এমনকি অনেকে তো ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিতকরণের জন্যও ব্রিটিশদেরকে সাধুবাদ জানিয়ে থাকে। খুবই দুঃখজনক বিষয়! বাস্তবতা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। কতো ভারতীয়, কতো বাঙালির জীবন ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যে এই মানুষরূপী দানবেরা দায়ী, তা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। ব্রিটিশদের অবদানগাঁথার ভুল ধারণা থেকে অচিরেই বের করতে হবে এই প্রজন্মকে, পরিচিত করাতে হবে প্রকৃত সত্যের সাথে।
রেফারেন্স: