১৯১৫ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ প্রথম লেখা হয়, তখন সত্যজিতৎ রায়ের জন্মও হয়নি। তিনি যখন একটু বড় হয়ে উঠলেন তখন তাঁর ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোরের লেখা গুপী গাইন গল্পটি পড়লেন এবং অন্ধ ভক্ত হয়ে গেলেন।
১৯৬৩ সালে তিনি ঠিক করলেন এই গল্পের ছবি বানিয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকীতে ছবিটি হলে মুক্তি দিয়ে সবাইকে চমকে দিবেন। এদিকে ছেলে সন্দ্বীপও তাঁর কাছে আবদার করছিলো একটা ছোটদের ছবি করার জন্য। কিন্তু বিভিন্ন রকমের ব্যাস্ততার কারনে এই গল্পটির চিত্রনাট্য লেখা হয়ে উঠেনি। ছবিটা করতে করতে তাঁর তিন বছর সময় লেগে গেলো। তিনি ১৯৬৭ সালে ছবিটির চিত্রনাট্য লেখা শেষ করেন।
শুটিং শুরু করেন ১৯৬৮-এর জানুয়ারিতে। বীরভূমের ভাগমুন্দি আর নতুন গাঁ, শিমলার কাছে কুফরি জয়েসলমীর থেকে কুড়ি মাইল দূরের মহানগর ও বুঁদি-তে আউটডোরের শুটিং হয়েছিল এই ছবির। আগেই ঠিক করেছিলেন ছবিটা হবে গাননির্ভর। সে জন্য চিত্রনাট্য লেখা শুরু করার আগেই লিখে ফেলেন ছয়খানা গান, এবং শুটিং শুরু করার আগেই সেগুলো রেকর্ড করাও শেষ করলেন।এবং গানগুলিকে মানানসই জায়গায় বসানোর কথা চিন্তা করেই তিনি চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন।
তবে উপেন্দ্রকিশোরের গুপী গাইনের গল্পের সঙ্গে ‘সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘গুপী গাইন বাঘা বাইনের’ গল্প কিছুটা অন্যরকম করে করলেন। ছবি শুরু করা থেকে মুক্তি দেওয়া পর্যন্ত তঁকে একটার পর একটা বাধার দেওয়াল টপকাতে হয়। ছবি বানাতে প্রথমেই দরকার একজন প্রযোজক। প্রথমে আর ডি বনশালের প্রযোজনার কথা থাকলেও সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি সরে যান। পরে অন্য আর একটা সংস্থার কাছে গেলে তারাও তাঁর ডাকে সাড়া দেয়না।
তিনি পড়লেন মহা মুস্কিলে। সে সময় তিনি সাড়া পেলেন বম্বের বিখ্যাত অভিনেতা-প্রযোজক রাজ কাপুরের কাছ থেকে, কিন্তু তিনি বলেন, ছবি প্রযোজনা করতে তিনি রাজী আছেন যদি ‘গুপি এবং বাঘা’ এই প্রধান দুটি চরিত্রে তাঁর বাবা পৃথ্বীরাজ কাপুর ও ভাই শশীকাপুরকে নেয়া হয়।কিন্তু সত্যজিৎ রায় সেই প্রস্তাবে রাজি হননি।অবশেষে চার লাখ রুপির বাজেটে পূর্ণিমা ফিল্মস ছবিটি করতে এগিয়ে আসে। এরপর তিনি ঠিক করেন কিশোর কুমারকে দিয়ে এই ছবিতে অভিনয় ও গান দুটোই করবেন কিন্তু ব্যস্ততার কারনে কিশোর কুমার সেটা করতে পারেন নি। তারপরও ছবিটি মুক্তি দেয়া নিয়ে আবার গন্ডগোল লাগে, সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তির কথা থাকলেও সম্পাদনার কাজ সময় মতো শেষ না হওয়ার কারনে সেটা পিছিয়ে চলে যায় ডিসেম্বরে।
তত দিনে ‘পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র সংরক্ষণ সমিতি’ করা নিয়ে পরিচালকদের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়েছে। তাঁদের মতভেদের কারণে ছবিটি আর মুক্তির মুখ দেখতে পাচ্ছিলোনা, পিছাতে থাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ। এতসবের মধ্যেই ছবিটির সেন্সর হয়, এবং বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব থেকে আমন্ত্রণ আসে। সত্যজিৎ রায় ‘গুপী গাইন- বাঘা বাইন’ নিয়ে সংবাদপত্রে মজার মজার বিজ্ঞাপন দিতে থাকেন। অবশেষে সব টালবাহানা অবসানের পর ১৯৬৯-এর ৮-মে পঁচিশে বৈশাখ, বৃহস্পতিবার মিনার, বিজলী, ছবিঘর ও ইংরেজি সাবটাইটেলসহ গ্লোবে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায়ের গুপি গাইন বাঘা বাইন ছবিটি। ছবিটি মুক্তির পর একটি প্রেক্ষাগৃহে একটানা ৫১ সপ্তাহ চলেছিল ছবিটি। বাংলা ছবির ক্ষেত্রে যা একটি রেকর্ড। অনেক দিন টিকে ছিল এই রেকর্ড।
১৬ মে কলকাতার সব পত্রিকায় ‘গুপী গাইন’- বাঘা বাইন’ এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা বের হয়। সত্যজিৎ রায় ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘সেরা ফিচার ফিল্ম’ ও ‘সেরা পরিচালক’ পুরস্কার জেতেন।। দিন দিনে ছবির গানগুলি তুমুল জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। ছবিতে গান গেয়েছেন অনুপ ঘোষাল, এই ছবিতে গেয়েই তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান। এই ছবির গান রেকর্ডিংয়ের সময় অনুপ রবীন্দ্রভারতীতে এমএর ছাত্র, প্লেব্যাকের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। সত্যজিৎ রায় তাকে হাতে ধরে সবকিছু শিখিয়ে দেন। এক সাক্ষাৎকারে অনুপ বলেন, “তিনি আমাকে গল্পটি বলে বুঝিয়ে দেন কোন অবস্থায় কিভাবে গানটি করতে হবে। গানের রিহার্সাল চলে একটানা ২৪ দিন। প্রথম গেয়েছিলাম ‘ভূতের রাজা দিল বর’। গানটির মুখরা অংশের পর ভায়োলিনের সুর কি ভোলা যায়?” ছবির গানগুলোতে ভারতের সেরা যন্ত্রীরা অংশ নেন, যা জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা বলে মনে করেন তিনি। তবে সত্যজিৎকে নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সবাই সত্যজিৎকে দুনিয়ার অন্যতম সেরা নির্মাতা বলে থাকে। কিন্তু সুরকার হিসেবেও যে তিনি অসামান্য, সেটাও বলা করা উচিত ছিলো।’
‘বাঘা’র চরিত্র করবে রবি ঘোষ করবে এটা নিশ্চিত হওয়ার পর খোঁজ চললো গুপির। অবশেষে পাওয়া গেল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের বিজ্ঞাপন বিভাগের কর্মচারী তপন চট্টপাধ্যায়কে।তিনি একসময় সন্দেশ পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিভাগেও কাজ করেছিলেন, সেইসূত্রে সত্যজিৎ রায়ের সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিল। হাল্লা ও শুন্ডি রাজার চরিত্রে প্রথমে ভাবা হয়েছিল ছবি বিশ্বাসকে, আর হাল্লা মন্ত্রী হবেন তুলসী চক্রবর্তী। পরে দুজনেই মারা যাওয়ায় সন্তোষ দত্ত ও জহর রায়কে এই চরিত্রের জন্য নির্বাচন করা হয়। এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি এই ছবির শুধু গান নয়, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, এমনকি ভূতের রাজার সংলাপ নিয়েও এলপি বের করেছিল।এটিই প্রথম বাংলা ছবি, যার ছবির গান নিয়ে রেকর্ড তো অনেক হয় কিন্তু এলপি সেই প্রথম। ২০০৩ সালে দি একাডেমি ফিল্ম আর্কাইভ ছবিটি সংরক্ষণ করে। এই ছবিতে ভূতের নাচ হয়েছিলো ঝাড়া সাড়ে ছয় মিনিট।
সত্যজিৎ রায় নিজে ভূতের রাজার গলায় কন্ঠ দেন। হাল্লা রাজা, শুণ্ডি রাজার কাপড়- চোপড় , তাঁদের সিংহাসন, মুকুট, বরফের কিম্ভূত ড্রেস, চশমা, জুতা সবই পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের বানানো, এগুলি তিনি দুই তিন সেট করে তৈরি করিয়েছিলেন। কোন কারনে যদি একটি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আরেকটি দিয়ে যাতে কাজ চালাতে পারেন। এমনটা হয়েছিল, বরফের মধ্যে একজনের যাদুর জুতা হারিয়ে গিয়েছিল, পরে স্পেয়ার জুতা দিয়ে কাজ চালাতে হয়। দেশের মতো বিদেশেও সাড়া ফেলে ‘গুপী গাইন’- বাঘা বাইন’ ১৯৬৯ সালের ২৬ জুন বার্লিন উৎসবে প্রতিযোগিতা বিভাগের ছবির প্রদর্শনী উদ্বোধনই হয় এ ছবি দিয়ে। সেবার উৎসবে সত্যজিতের সঙ্গে ছিলেন ছেলে সন্দীপ, প্রধান দুই অভিনেতা তপেন চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ এবং প্রযোজকরা।
এরপর ১৯৮০ সালে মুক্তি পায় ছবিটির সিক্যুয়াল ‘হীরক রাজার দেশে’। ট্রিলজির শেষ ছবি ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’ মুক্তি পায় ১৯৯২ সালে।এটি পরিচালনা করেছেন সন্দীপ রায়। একটা ভালো ছবি হলে আমরা সেটা একটানা দেখে শেষ করি, কিন্তু এইসব ছবির পিছনে কত গল্প, কত পরিশ্রম, কত সময় লাগে,ছবি দেখার সময় সে সব কথা আমরা চিন্তাও করিনা।
তথ্যসূত্র
Internet
dailyo.in
roar media