১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ডে জার্মান বাহিনীর আগ্রাসনের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।অন্যদিকে মিত্রপক্ষে ইংল্যান্ডের সাথে আমেরিকা ও রাশিয়ার যোগ দেওয়ার পর এটি অন্য মাত্রা পায়। সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশ তথা পুরো বাংলা ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টি করে একটা পর্যায়ে জাপানি বাহিনী নজর দেয় বাংলা ও আসামের সীমান্তবর্তী বার্মার দিকে। তখন থেকেই ভারতবর্ষের পূর্ব সীমানা সরাসরি যুদ্ধের শিকার হয়। পরাধীন এক জাতি হয়েও যুদ্ধের ভয়াবহতা গ্রাস করেছিল পূর্ব বাংলার সাধারণ অধিবাসীদের। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ যাবৎকাল পর্যন্ত সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ। যুদ্ধের সময়সীমা ছিল ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল।

শিল্পী জয়নুল আবেদীনের আঁকা যে দুর্ভিক্ষের ছবিটি আমরা দেখতে পাই, যেখানে কাক আর মানুষ একই সাথে ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে খাচ্ছে, সেটা সেই তেতাল্লিশের মন্বন্তরে ঘটে যাওয়া বিশ্বযুদ্ধের সময়ের উপর আঁকা। অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলার মহকুমা শহর মাদারীপুর, সেখান থেকে বেশ দুরে মাইজপাড়া নামের একটি গ্রামে এক ব্রাহ্মন পল্লীতে সুনীলের বসত ভিটা ছিল।তাঁর জন্ম হয় তাঁর মামা বাড়ি ফরিদপুর জেলার আমগ্রামে। তিনি গ্রামে খেলাধূলা, সাঁতার কাটা, মাছ ধরা এসব নিয়ে দিনগুলি বেশ আনন্দে কাটাচ্ছিলেন।

অবশ্য ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর প্রবল জনস্রোতের সাথে তাঁদের পরিবারকেও কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে চলে আসতে হয়। মাদারিপুরের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম টানের কথা তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরেছেন। এবারে আমরা কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শৈশবে দেখা সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কথা শুনবো—

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুটা দেখে গেছেন, তারপরই তাঁর মৃত্যু হয়।তখন সেটা ইউরোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিছুদিনের মধ্যে সেটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ভারতবাসীর কাছে এটা ছিলো কিম্ভুত যুদ্ধ। পরাধীন দেশ, সে আবার কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? তার কোন পক্ষ বা বিপক্ষে থাকার কথা নয়। কিন্তু শাষক শ্রেনী ভারতকেও যুদ্ধে জড়িয়ে নিলো, কারন এতো বড় উপনিবেশটির সম্পদ যুদ্ধের কাজে লাগাতে হবে।ভারতীয় সৈনিকদের রনক্ষেত্রে পাঠাতে হবে কামানের খাদ্য হিসাবে।

আমেরিকার যুদ্ধে যোগদান করা ও যুদ্ধে জাপান সিংগাপুর দখল করার পর কলকাতাতেও সাজ সাজ রব পড়ে যায়। পূর্ব রণাঙ্গনে জাপানীদের হাতে মার খাচ্ছে ইংরেজরা, হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে কলোনিগুলো। রেঙ্গুন পতনের পর মনে হলো জাপানিরা এসে দাঁড়ালো ভারতের দোরগোঁড়ায়, এরপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কলকাতা দখলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে। ইংরেজদের সাহায্য করবার জন্য এসে গেছে আমেরিকান বাহিনী, শহরের পথে পথে অনবরত ছুটছে সামরিক গাড়ি। রেড রোডকে রানওয়ে বানিয়ে সেখান থেকে উড়ছে বিমান। সন্ধের পর সারা শহর প্রায় নিষ্প্রদীপ, রাস্তার গ্যাসের আলোয় পরানো হয়েছে ঠুলি। সাধারন নাগরিকরা ঘরের মধ্যে বাতি জ্বাললেও জানালা খুলতে পারবেনা। এখন তখন বিকট শব্দে বেজে উঠছে বিপদ সংকেত জানানোর জন্য সাইরেনের মহড়া । ফাঁকা মাঠ আর পার্ক গুলিতে কাটা হয়েছে ট্রেঞ্চ, রাস্তার যেখানে সেখানে গাঁথা হয়েছে নতুন পাঁচিল। গোলাগুলি থেকে বাঁচবার জন্য সেগুলিকে বলে ব্যাফল ওয়াল।বাংগালীরা ঠাট্টা করে বলতো, বিফল প্রাচীর।

যুদ্ধে অনেক কিছু বদলায়, সবচেয়ে বেশি বদলায় মূল্যবোধ। প্রশাসনের দৃষ্টি অন্যদিকে থাকে বলে, সেই সুযোগ নিয়ে কিছু কিছু মানুষের অবদমিত লোভ, হিংসা, কাম প্রবৃত্তি প্যানডোরার বাক্সের ভয়ংকর পতঙ্গ গুলির মতো বেরিয়ে আসে। খাদ্য বস্ত্রের মজুদে যখন টান পড়ে, তখন শুরু হয় কালোবাজার। নারীদেহের ও বাজার তৈরি হয়। তাদের প্রকাশ্য বেলেল্লাপনা দেখলেও সরকার মুখ ফিরিয়ে থাকে। কলকাতা শহরে বারাংগনার সংখ্যা কম নয়, তাতেও প্রয়োজন মিটেনি।অর্থের লোভে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সুন্দরী কন্যারা প্রকাশ্যে টমিদের কন্ঠলগ্না হয়েছে। সমাজের নিয়ম- কানুন তখন অদৃশ্য। তবে সব সৈনিকই যে নারী সম্ভোগের জন্য উন্মত্ত ছিল তা বলা যায়না,বহুদূরে ফেলে আসা স্ত্রী- পূত্র- কন্যাদের জন্যও অনেকের মন কেমন করতো, প্রকাশ পেতো বাৎসল্যের ।ট্রেনের জানালায় কোন সৈনিকের ব্যাথাময় মুখ ও দেখা যেত, অনুগ্রহপ্রার্থী কোন ভিখারি বাচ্চার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতো। একবার খুলনা স্টেশনে একজন সৈন্য সুনীলের দিকে একটা চকলেট বার ছুঁড়ে দিয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরের বছর শীতকালে জাপানীরা কলকাতায় বোমা ফেলে গেল, একে আক্রমন বলা যায়না, কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাব। যেন বিমানে চড়ে আকাশে বেড়াতে বেড়াতে কলকাতা পর্যন্ত এসে দু’একটা বোমা ফেলে এদেরকে ভয় দেখিয়ে গেলো। এতে করে দারুন আতংক ছড়িয়ে পড়লো শহরে, এতদিন যুদ্ধ চলছিলো দুরে দুরে এখন বুঝি কলকাতা শহর ধ্বংস হয়ে গেল! প্রায় দুশো বছর আগে সেই যে সিরাজউদ্দৌলা কামাল দেগেছিলো , তারপর থেকে তো কলকাতার উপর কোন আক্রমন হয়নি। দিশেহারার মতো লোকজন কলকাতা ছেড়ে পালাতে লাগলো মধুপুর, দেওঘর, ঘাটশিলার মতো স্বাস্হ্যকর জায়গায়, কেউ কেউ পালালো গ্রামে গঞ্জে, শহর প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্যতম শিকার হন তাঁর বাবা, তিনি একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যাবার কারনে তিনি বেকার হয়ে পড়লেন।কোন রোজগার নাই, সংসার চালাবার সংগতি নাই তাই তিনি তাঁর পরিবারকে মাদারিপুরের গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। সেবারে সুনীল মাইজপাড়া গ্রামের বীরমোহন বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।টিনের চালের ঘর, বেশ পরিস্কার, পেছনদিকে টলটলে জলের সুন্দর একটা দীঘি, স্কুলটি বাড়ি থেকে বেশ দুরে , হাঁটা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিলনা, তাই হেঁটেই স্কুলে যেতে হতো।টাউন স্কুলে তাঁর কোন মুসলমান সহপাঠী ছিলনা কিন্তু এই স্কুলে হিন্দু – মুসলমান মিশানো ছাত্র ছিলো ।

স্কুলে যেতেন ঢেকিছাঁটা লাল চালের গরম ফেনা ভাত খেয়ে, সাথে আলুসেদ্ধ আর পুঁটিমাছ। কয়েক মাস পর শুধু ফেনাভাত। গ্রামে কোন যুদ্ধ নাই কিন্তু তবুও যুদ্ধের ধাক্কা এসে লাগে সেখানেও, প্রথম আঘাত হানে রান্নাঘরে। ক্রমে ক্রমে চাল একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল।রেঙ্গুন দখল করার পর জাপানি সৈন্যবাহিনী আসাম পেরিয়ে আসবে পূর্ব বংগে, তাই সরকার সেখানকার চারটি জেলার সমস্ত ধান চাল সরিয়ে নেয়।যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন করার জন্য বাজেয়াপ্ত করা হয় বহু নৌকা এবং কয়েক হাজার নৌকা একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এরকম কৃত্রিম অভাবের সময় শুরু হয় কালোবাজারি । চালের দর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। সোনার ভরি পঁয়তিরিশ টাকা চার আনা। বিয়াল্লিশ সালের ডিসেম্বর মাসে চালের মন তের থেকে চৌদ্দ টাকা, একবছরের মধ্যে তা পন্চাশ- ষাট, চট্টগ্রামে আশি টাকা, ঢাকায় একশো পাঁচ টাকা, শুরু হলো দুর্ভিক্ষ।

পরে অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন যে, তেতাল্লিশ সালে দেশে যে খাদ্যশষ্য মজুদ ছিল তা প্রয়োজনের পক্ষে যথেস্ট ছিলো, কিন্তু সরকার ও কালোবাজারিরা তার অনেক খানি সরিয়ে রেখেছিলো। আকাশ ছোঁয়া দামের ফলে তা চলে গিয়েছিলো সাধারন মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে কিন্তু মুষ্টিমেয় পয়সাওয়ালাদের সেটা কোন সমস্যা ছিলনা। তাঁর বাবা মাইনে পেতেন পঁয়তাল্লিশ টাকা। স্কুল বন্ধ তাই রোজগার ও বন্ধ। কোন উপায়ে মাঝে মাঝে কিছু টাকা পাঠাতেন, কখনো টাকা পাঠাতে পারতেন না।ঘরে তাঁর মায়ের নিঃশব্দ কান্না, তখন অসহায়ের মতো এগুলি তিনি তাকিয়ে দেখেছেন। তাঁর সেই নিষ্পাপ শৈশব কালে তিনি দেখেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা। পরে এমন অবস্থা হলো, যেহেতু তাঁদের চাল কেনার ক্ষমতা ছিলোনা, তাই শুধু আলু খেয়েই জীবন ধারন করতে হচ্ছিল। সকালে, দুপুরে, বিকালে, রাত্রে শুধু আলু সেদ্ধ, গরম গরম ফেনা ভাত খাবার জন্য প্রানটা ছটফট করতো। স্কুলেও পকেট ভরে আলু নিয়ে যেতেন, স্কুল থেকে নুন আর কাঁচা মরিচ দেওয়া হতো, শিক্ষকরাও পাঞ্জাবীর পকেট থেকে আলু বের করে খেতেন। ( তাঁর লেখায় পড়েছি, তারপর থেকে তিনি কোনদিনও তাঁর পাতের একটি ভাতও নষ্ট করতেন না)

তখন বাংলায় মুসলিম লীগ মিনিষ্ট্রি, কিছুদিন আগে ফজলুল হক কে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে , প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন খাজা নাজিমুদ্দিন, তিনি দুর্ভিক্ষ সামলাবার কোন ব্যবস্থাই নিতে পারছিলেন না, তার মধ্যে তখন হিন্দু মুসলমানের মাঝখানের ফাটল ক্রমশ বাড়ছিল। যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ মরে, কেউ সৈনিক হিসাবে প্রান দেয় কেউবা দেশ রক্ষার জন্য আত্মদান করে। সে সময় শুধুমাত্র খাদ্যের অভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রান দিতে হয়েছিলো, এইসব মানুষদের সাথে যুদ্ধের সাথে কোন সম্পর্ক ছিলোনা, তারা হাতে নেয়নি কোন অস্ত্র কিন্তু তবুও অনাহারে প্রান দিতে হয়েছিলো। সে সময় রাস্তায় রাস্তায় কঙ্কালসার মৃতদেহ, খিদের জ্বালায় মা বিক্রি করে দিচ্ছে তার সন্তানকে, স্বামী বিক্রি করে দিচ্ছে স্ত্রীকে, তারপরও কি তারা বাঁচতে পারবে? খালিপেট ডেকে আনছে নানারকম ব্যাধি যার কোন চিকিৎসা নেই। অন্তত সাতাশ লক্ষ নারী- পুরুষ- শিশু প্রান হারিয়েছিলো তেতাল্লিশ সালের এই কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কোন ইতিহাসে এদের নাম লেখা থাকবেনা।

তথ্য
অর্ধেক জীবন লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ইন্টারনেট