গৌতম বুদ্ধ, নাম শুনলে চোখে ভেসে আসে এক সৌম্যদর্শন ধ্যানী সন্ন্যাসীর চেহারা। যিনি শান্ত ও গম্ভীরভাবে বসে গভীর ধ্যানে মগ্ন রয়েছে। মুখে হালকা স্মিতহাস্যের আভাস।

হ্যাঁ, সেই সিদ্ধার্থ গৌতম, সেই ঐতিহাসিক চরিত্র, যিনি প্রায় ২৫০০ বছরেরও  আগে এই ভারতীয় উপমহাদেশে বিচরণ করেছেন। যিনি মগধের রাজা বিম্বিসার ও অজাতশত্রুর সমসাময়িক। যিনি প্রাচীন ভারতের এক রাজ্য কপিলাবস্তুর রাজকুমার, শাক্যবংশে জন্মগ্রহণকারী বলে শাক্যসিংহ বলে পরিচিত। তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতের এক জ্ঞানী, তপস্বী ও ধর্মগুরু ছিলেন। তিনিই ছিলেন বৌদ্ধধর্মের প্রবক্তা। তাঁর অসংখ্য ভক্ত ও অনুচর ছিল সে সময়। এমনকি রাজা বিম্বিসার ও ছিলেন তাঁর ভক্ত। আজও তাঁর অসংখ্য ভক্ত ও তাঁর মতের অনুসারী রয়েছে দুনিয়াজুড়ে।

মানবজীবনের দুঃখ,কষ্ট, যন্ত্রণায় বিচলিত হয়ে এসব থেকে মানুষের মুক্তির উপায় খুঁজতে গিয়ে তিনি সংসার, রাজ্যপাট সমস্ত ত্যাগ করে বেড়িয়ে পড়েন। এক রাতে ঘুমন্ত স্ত্রী ও সন্তানকে রেখেই বেড়িয়ে পড়েন জীবনের পরম সত্যের খোঁজ করতে।

গৌতম বুদ্ধ

বহুদিনের তপস্যা শেষে তিনি লাভ করেন বোধিসত্ত্ব বা বুদ্ধত্ব। তাঁর নাম হয় গৌতম বুদ্ধ।

গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে তো বটেই, এমনকি গোটা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য স্থানে অসংখ্যবার সিদ্ধার্থ গৌতমের মূর্তি বা ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি নির্মাণ হয়েছ এবং হয়ে আসছে।

গান্ধার থেকে প্রাপ্ত বুদ্ধমূর্তি; ১ম-২য় শতাব্দী

বেশিরভাগ বুদ্ধমূর্তিতে সাধারণত দুটো বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায় যা সাধারণত আমরা খেয়াল করি না। না, সেগুলো হাতের মুদ্রাও নয়, বসার ভঙ্গিও নয়। সেগুলো একেক সময়ে, একেক স্থানে বানানো মূর্তিতে একেক রকম।

বেশিরভাগ বুদ্ধমূর্তিতে, বিশেষ করে এই ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের বুদ্ধমূর্তি বা বুদ্ধের প্রতিকৃতিতে যে দুটো অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করা যায় তা হলো

১) অস্বাবাবিক লম্বা এবং বড় কান। আর

২)মাথাভর্তি শামুকের খোলসের মতো প্যাঁচানো ঘন কোঁকড়ানো চুল

গৌতম বুদ্ধের লম্বা কান ও শামুকের খোলসের মতো কোঁকড়ানো চুল

এই দুটো বৈশিষ্ট্য বেশ যত্নের সাথে অধিকাংশ বুদ্ধমূর্তি বা প্রতিকৃতিতে ফুটিয়ে তোলা হয় এবং তা বেশ প্রাচীন  কাল থেকেই হয়ে আসছে।

কিন্তু এরকমটা কেন করা হয়? এই দুটো বৈশিষ্ট্যের পিছনে কি কোনো কারণ বা কাহিনী আছে?

আছে, গৌতম বুদ্ধের এই লম্বা কান ও শামুকের মত প্যাঁচানো চুলের পিছনেও গল্প আছে।

প্রথমে আসি, বুদ্ধের কানের ব্যাপারে। মূর্তি বা প্রতিকৃতিগুলোয় যেরকম বড় কান এবল বেশ ঝোলা ও লম্বা কানের লতি দেখানো হয়, তেমনটা কিন্তু সাধারণ মানুষের হয় না। তবে কী গৌতম বুদ্ধের এমন লম্বা কান ছিল?? বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রগুলো বা পালি ধর্মসূত্রগুলোয় কিন্তু এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। লক্ষণা সূত্ত তে একজন মহামানবের প্রাথমিক ৩২ রকমের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হলেও বুদ্ধের লম্বা কানের ব্যাপারে কিছু বলা নেই। তবে আরো অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে পদ্মফুলের পাঁপড়ির মতো লম্বা এবং গোল কানের লতির কথা বলা আছে।

এই লম্বা কানের পিছনে দুটো প্রচলিত তত্ত্ব আছে।

প্রথমটি হলো, গৌতম যখন শাক্যবংশের রাজকুমার সিদ্ধার্থ ছিলেন, তখনো সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস নেননি, তখন অন্যান্য রাজারাজড়াদের মতোই বেশভূষা ধারণ করতেন। দামি রেশমি কাপড়, সঙ্গে দামী পাথর ভারী ভারী সোনা,রূপা,ধাতব গয়না।

সেকালের অন্যান্য রাজপরিবারের লোকদের মতোই কানে ভারী ভারী দুল পরতেন সিদ্ধার্থ। এই দুলের ওজনে কানের লতি ঝুলে যায়; কান হয়ে যায় বড়।

২৯ বছর বয়সে সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী হন,তখন এসব গয়না গাটি ও বহুমূল্য আভূষণ ত্যাগ করেন।

কিন্তু ঐ লম্বা ঝোল কানের লতি রয়েই যায়।

আরেকটা তত্ত্ব হলো, সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। এই জাগতিক জগতের প্রতি সমস্ত মায়া ত্যাগ করেছিলেন। জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়েছিলেন। ফলে সকল জীবের প্রতি তাঁর হৃদয়ে করুণা জাগ্রত হয়। তাঁর এই জ্ঞান, বিদ্যা, সকল জীবের প্রতি প্রেম ও করুণা প্রতীক ধরা হয় এই বড় ও লম্বা কানকে। কারণ তিনি নাকি সমস্ত জীবের দুঃখ দুর্দশার কথা ঐ কান দিয়ে শুনতে পেতেন। এ কারণেই  বুদ্ধের মূর্তিতে কান এত বড় করে বানানো হয়।

এই লম্বা কানকে শুভ চিহ্ন বলেও মনে করা হত।

বাম দিকে ৫ম শতাব্দীর মথুরা থেকে প্রাপ্ত বুদ্ধমূর্তি, ডানদিকে গান্ধার থেকে প্রাপ্ত ১ম-৩য় শতাব্দীর বুদ্ধমূর্তি

এবার বলা যাক গৌতম বুদ্ধের মাথার ঐ অদ্ভুত শামুকের খোলসের ন্যায় প্যাঁচানো চুলগুলো নিয়ে।

এগুলো কী আদৌ চুল, নাকি অন্য কিছু।

বৌদ্ধশাস্ত্র ও পালি ধর্মসূত্র, লক্ষণা সূত্ত অনুযায়ী গৌতমের মাথায় ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল ছিল। আর চুলগুলো মাথার উপরে জটার মতো করে বেঁধে রাখা হত।

যদিও সংসার ত্যাগের সময় তিনি মাথা মুড়িয়ে নেন।

তারপরও, মূর্তিতে যে কোঁকড়ানো চুল দেখানো হয় সেগুলো এমন শামুকের মতো অদ্ভুতভাবে প্যাঁচানো কেন??

এর পিছনেও একটা গল্প প্রচলিত আছে। ঐ গল্প অনুসারে এগুলো নাকি চুল নয় শামুক!

একদিন গৌতম বুদ্ধ আপনমনে কী যেন ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলেন। একসময় একটা গাছের নিচে ছায়ায় বসে তিনি ধ্যান করা শুরু করেন। ধ্যান করতে করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যাচ্ছে, অথচ তিনি ধ্যানেই বসে আছেন।

সময় যত গড়াচ্ছিল সূর্য ততই মাথার উপর উঠছিল, আর তার তেজ ও প্রখর হচ্ছিল। একটা সময় সূর্যের তীব্র রশ্মি গৌতমের চুলহীন মাথায় এসে সরাসরি পড়তে থাকে।

ঐ সময় একটা শামুক বুদ্ধের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল।

শামুকটা খেয়াল করলো যে তিনি গাছের নিচে বসে থাকলেও সূর্যের প্রখর রশ্মি তাঁর মাথায় এসে পড়ছে। শামুক ভাবলো এই প্রচণ্ড গরমে তাঁর পক্ষে ধ্যান করা কষ্ট হবে। আর যত সময় যাবে ততই রোদ আরও প্রখর হবে।

তাই শামুক ভাবলো তাকে কিছু করতে হবে। শামুকের দেহ সাধারণত ভেজাভেজা স্যাঁতস্যাঁতে হয়। রোদ এড়িয়ে ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে স্থানে থাকাই এদের স্বভাব।

সে ভাবলো তার এ ভেজা ঠান্ডা শরীর বুদ্ধকে রোদের তাপ থেকে রক্ষা করতে পারবে। তাঁর ধ্যানের অসুবিধা হবে না। তাই সে দ্বিতীয় কোনো চিন্তা না করেই গিয়ে ধ্যানরত বুদ্ধের মাথায় উঠে বসে। এই দৃশ্য দেখে অন্যান্য শামুকও প্রথম শামুককে অনুসরণ করে বুদ্ধের মাথায় গিয়ে চড়ে বসে। এভাবে ১০৮ টা শামুক হয়ে যায়। এতগুলে শামুকসহ বুদ্ধের মাথাটা প্যাঁচানো খোলসের টুপির মতো দেখাচ্ছিল।

শামুকগুলোর শীতল ভেজা দেহ কয়েকঘণ্টা পর্যন্ত রোদের তাপ থেকে বুদ্ধের মাথাকে রক্ষা করতে পেরেছিল। বুদ্ধের ধ্যানও ভাঙতে দেয়নি। কিন্তু তীব্র রোদের তাপে শামুকের দেহগুলো শুকিয়ে গেছিল। সন্ধ্যাকালে গৌতমের ধ্যান ভাঙলে তিনি দেখতে পেলেন তাঁর ধ্যান রক্ষার্থে ১০৮ শামুক জীবন দিয়েছে।

বুদ্ধের জন্য জীবন দেওয়ায় শামুকগুলো শহীদের মর্যাদা পায়।

শামুকের খোলসের মত চুল ও লম্বা কান সহ বুদ্ধমূর্তির মাথা; ৫ম শতাব্দী, গুপ্তযুগ, মথুরা।

এই হলো বুদ্ধের মাথার শামুকের মতো চুলের পিছনের গল্প। অবশ্য এই গল্পের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।

অবশ্য অনেকের মতে বুদ্ধের মাথায় এমন চুল আসলে গান্ধার শিল্পকলার দ্বারা প্রভাবিত। এজন্য এগুলোকে গ্রিকো-বুদ্ধিস্ট (Greeco-buddhist) শিল্প ও বলা হয়। আলেকজান্ডার এর ভারত অভিযানের(খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭-৩২৫) পর ভারতে বিশেষ করে উত্তর ও উত্তর পশ্চিম ভারতে গ্রিক স্থাপত্য ও শিল্পকলার প্রভাব পড়ে। যে কারণে গ্রিক ভাস্কর্যগুলোর অনুসরণে বুদ্ধমূর্তিতে  চুলগুলো কোঁকড়ানো দেখানো হত।

যেই রীতি পরবর্তীতেও রয়ে যায়। যদিও গান্ধার থেকে প্রাপ্ত ভাস্কর্যগুলোতে শুরুর দিকে বুদ্ধের চুল কোঁকড়ানো হলেও শামুকের খোলসের মতো প্যাঁচানো ছিল না। পরবর্তীতে  শামুকের খোলসের মত চুল দেখা যায়।

গান্ধার থেকে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব ১ম-২য় শতাব্দীর বুদ্ধমূর্তি; পাশের গ্রিক ভাস্কর্যের চুলের সাথে গভীর মিল রয়েছে।

তবে কারণ যাই হোক, এই কাজগুলো কিন্তু শিল্পীর অসামান্য শিল্প দক্ষতার পরিচয় দেয়। আর এর পিছনের গল্পগুলোও অনেক সুন্দর। যুগ কাল ছাপিয়ে বুদ্ধের মহান জীবন আর কীর্তির মতো এই শিল্প ও গল্পগুলো বেঁচে থাকে আমাদের মাঝে।

 

তথ্যসূত্রঃ

১) “লক্ষণা সূত্ত” – পালি গ্রন্থ

২) http://northcoastgardening.com/2010/08/buddhist-snail-martyrs/

ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপ এবং রাণী টিয়ে: যৌথ শাসনে মিশরের সবচেয়ে যোগ্য দম্পতি

মিশর আজ নতুন সাজে সেজেছে। চারদিকে তৈরী হয়েছে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। বাদ্য-বাজনার তালে তালে নৃত্য চলছে। পুরোহিতরাও শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে অপেক্ষা করছেন বর-বধূর জন্য। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রস্তুত হচ্ছেন ফারাও চতুর্থ থুতমোসের ছেলে তৃতীয় আমেনহোটেপ। খানিক...

সগডিয়ান মিউনের কাহিনী – পর্ব ২

আজ থেকে ১৭০০ বছর আগে কেমন ছিলো মানুষের জীবন? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা রাজা-রানি বা সম্ভ্রান্ত শ্রেণির কাহিনী শুনে থাকি আর সেসব জমকালো উৎসবমুখর জীবনের গল্প শুনতেই বোধ হয় বেশি ভালোবাসি। কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠের প্রাচীন বিশ্বে সাধারণ মানুষের জীবন কেমন ছিলো? কেমন ছিলো...

প্রাচীন সগডিয়ানার অজানা কাহিনী – পর্ব ১

জনবহুল ব্যস্ত নগরীর মধ্যেই এক বাড়ি থেকে ভেসে আসে নারীকন্ঠের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। আশেপাশের কৌতূহলী শিশুরা ভেতরে যেতে চাইলে বয়স্ক নারীরা তাদের বাধা দিয়ে অপেক্ষা করতে বললো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও একবার কান্নার শব্দ পায় ওরা। নবজাতক শিশুর। এবার ওরা ভেতরে ঢোকার অনুমতি পায়।...

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার প্রারম্ভ ও পতনের সারসংক্ষেপ

বিস্ময়কর নিদর্শন, আচার-অনুষ্ঠান ও মিথে ভরপুর এক সভ্যতার নাম প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা। এই সভ্যতা কিন্তু এক দিনে গড়ে ওঠে নি, আবার হুট করেই এর পতন হয় নি। ধীরে ধীরে বিকশিত হওয়া এই অভূতপূর্ব মিশরীয় সভ্যতা তৈরী করেছে নিজের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, যার মূল শেকড় ও শক্তি ছিলো...

আনখেসেনামেনের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি কি আইয়ির ষড়যন্ত্রের ফলাফল

সদ্য স্বামীহারা বিধবা রাণী আনখেসেনামেন। হঠাৎ করেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন মিশরের সবচেয়ে রহস্যময় ও কম বয়সী ফারাও তুতেনখামুন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে মৃত তুতেনখামুন ছিলেন নিঃসন্তান। তাই কোনো উত্তরসূরিও তিনি রেখে যেতে পারেন নি। আনখেসেনামেনের গর্ভপাতের ফলাফল দুই শিশু...