ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় যে, প্রায় সব প্রাচীন অথবা নিকট-অতীত সভ্যতার রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল স্বৈরশাসন এবং একনায়কতন্ত্র, গণতন্ত্র ছিল না। সাধারণ জনগণ একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করেছে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য। বিংশ শতাব্দীতেই বিশ্বে পরিপূর্ণ গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। এই গণতন্ত্রের সঠিক জন্ম জানতে হলে আমাদেরকে উঁকি দিতে হবে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের গ্রীসে, সক্রেটিস-প্লেটোর সময়েরও আগে। যেতে হবে অতীতেরও অতীতে।
প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা প্রথম শুরু হয়েছিল আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ১৭০০ সালে, এখন থেকে তিন হাজার সাতশো বছর আগে। প্রায় একই সময়ে চীন ও ভারতেও সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়। তখনকার সময়ের গ্রীসের প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থার চিত্র উঠে এসেছে কিংবদন্তী লেখক এবং চিন্তাবিদ হোমের (Homer) মহাকাব্য “ট্রোজান ওয়ারে” (Trojan War)। হোমের কাব্যিক মূর্ছনা থেকে জানা যায়, এক সময় ঐ সমাজ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে গেলে পরবর্তী শত শত বছরের জন্য গ্রীস নিমজ্জিত হয় এক গভীর অন্ধকারে। তারপর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে খ্রীষ্টপূর্ব ৭০০ সালে গ্রীস আবির্ভূত হয় এক উপনিবেশীক শক্তি হিসেবে। ভূমধ্যেসাগর থেকে শুরু করে তুর্কী হয়ে ফ্রান্স পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করে গ্রীস। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক গ্রীসে এনে দেয় চীন মিশরের মতো দূরবর্তী দেশ থেকে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী। এই গভীর ব্যবসা-বাণিজ্য গ্রীসে সৃষ্টি করে এক নতুন সম্পদশালী জনগোষ্ঠী। আরম্ভ হলো সহজ ঋণ আদান-প্রদানের ব্যবস্থা। তখন সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্য ঋণ পাওয়া হয়ে উঠলো সহজ। অতি দ্রুত এক বিশাল সংখ্যক নাগরিক হয়ে পড়লো ঋণগ্রস্থ। এই ঋণগ্রস্থ জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ হলো ঋণ-দাসত্বে। সমাজ হয়ে গেলো অস্থির। অসন্তোষ দানা বাঁধলো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নতুন ঋণ-নির্ভর আর্থিক ব্যবস্থা অচিরেই সৃষ্টি করলো এক ভীতিকর অর্থনৈতিক সঙ্কট, যা গ্রীসকে নিয়ে গেলো গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। যে ঋণ-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে প্রথমে মনে করা হয়েছিলো ব্যক্তির সম্পদ আরোহনের সোপান, তা’ হয়ে দাঁড়ালো সমাজ ধ্বংসের প্রধান কারণ। কি বিচিত্র,তাই না?
দেশের এমনই ক্রান্তিলগ্নে, খ্রীষ্টপূর্ব ৫৯৪ সালে সোলন (Solon) নামে এক ব্যবসায়ীকে এথেন্সের শাসনভার দেওয়া হলো। তাঁর প্রধান দায়িত্ব হয়ে পড়লো ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা। ঋণগ্রস্ত বিশাল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করা। আধুনিক বিশ্বে অনেকের কাছে সোলন এক অজানা নাম, এমনকি আমার মতো রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রাক্তন ছাত্রের কাছেও। এর প্রধান কারণ হলো, সোলনের সময় তাকে নিয়ে কোনো কিছু তখন লেখা হয় নি। তাঁর মৃত্যুর পর প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস (Herodotus) এবং দার্শনিক-লেখক প্লুটার্ক (Plutarch) সোলনকে নিয়ে কিছু তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। কে ছিলেন এই সোলন, যার উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখেছিলো তখনকার সমাজ?
ধারণা করা হয়, সোলনের জন্ম খ্রীষ্টপূর্ব ৬৪০-৬৩০ সালের মধ্যে। তিঁনি ছিলেন একাধারে একজন কবি, ব্যবসায়ী, আইন প্রণেতা, এবং সর্বোপরি একজন জ্ঞাণী মানুষ। সোলন বুঝতে পারলেন যে, নৈতিক অবক্ষয়ে নিমজ্জিত এথেন্সের জনগণ তাঁর কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করছে। এথেন্সবাসী সোলনকে অনুরোধ করলো স্বৈরশাসক হতে, যাতে তিঁনি কঠিন হাতে গ্রীসের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারেন। তাঁর হাতে ন্যস্ত করা হলো এথেন্সের নিরুঙ্কুশ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা।
কিন্তু সোলন বিনয়ের সাথে একনায়ক স্বৈরশাসক হবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে প্রতিজ্ঞা করলেন যে, এথেন্সকে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ করে তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবেন। করেছিলেনও তাই। যেমন কথা, তেমন কাজ। যেসব এথেন্সবাসী ঋণের জন্য দাস হিসেবে এথেন্সের বাহিরে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, তাদেরকে ক্রয় করে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে এথেন্সে ফিরিয়ে আনলেন। এথেন্সে ঋণ-দাসত্ব পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেন। এথেন্সের সবার ঋণ পরিশোধ করে দেন। মুক্ত করেন জনগণকে ঋণের আবর্তিত ফাঁদ থেকে। তাঁর এই কাজগুলো তিঁনি এক কবিতায় বর্ণনা করেন, যা’র কিছু অংশ এখানে দেয়া হলো:
“ আমি এথেন্সকে আবার ফিরিয়ে দিয়েছি তাঁর মুক্ত নাগরিক
আবার ফিরিয়ে এনেছি যারা অন্যায়ভাবে বিক্রিত হয়েছিল,
যারা লজ্জাজনক দাসত্ব ভোগ করেছে
দিয়েছি তাদের মুক্তি । “
সোলনের এই জনপ্রিয় কাজকে বলা হয়, “Shaking-off of Burdens.” সোলন পরবর্তীতে যে কাজটি সম্পন্ন করেন, তা ছিল বিশ্বে প্রথম। তিনি এথেন্সের জন্য প্রনয়ণ করেন একটি লিখিত সংবিধান, যেখানে দেওয়া হয় জনগণের স্বাধীনতা। এই সংবিধান জনগণকে নিশ্চয়তা দেয় একটি ভারসাম্য গণতন্ত্রের। এই নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমস্ত পুরুষ নাগরিককে দেওয়া হয় ভোটাধিকার, বিচারে জুরিতে কাজ করার অধিকার, এবং অন্যের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার। আগে এই অধিকারগুলো ছিল শুধুমাত্র সমাজের বিশেষ শ্রেণীর জন্য সংরক্ষিত।
সোলনের ক্ষমতায় আসার আগে রাষ্ট্রীয় পদ সংরক্ষিত ছিল শুধুমাত্র সম্পদশালীদের জন্য। সোলনের নতুন সংবিধান অনুযায়ী শুধুমাত্র নির্বাচিত ব্যক্তিরাই রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবে। সোলন এখানেই থেমে থাকেন নি, সংবিধানকে দিয়েছেন পর্যাপ্ত রক্ষাকবচ। তিনি সংবিধানে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন যে, যদি নির্বাচনী কমিটি তাদের ধনী বন্ধুদেরকে অবৈধভাবে নির্বাচিত করার কোন আইন প্রনয়ণ করার চেষ্টা করে, তবে তা’ হবে আদালতে অগ্রহণযোগ্য। সোলন আরো ঘোষণা করেন যে, দশ বছরের জন্য সংবিধানের কোন আইন পরিবর্তন করা যাবে না। ঐ সময়ে সোলনের শাসনকালকে বলা যেতে পারে বিশ্বের গণতন্ত্রের জন্মকাল।
সংবিধান রচনার মাধ্যমে সোলন রাষ্ট্র শাসনের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা দিয়ে ক্ষমতা থেকে স্বেচ্ছায় বিদায় নেন। চলে যান দেশ ভ্রমণে। রচনা করেন অনেক কাব্য। সোলনের বিখ্যাত উক্তি, “এমনভাবে শাসিত হতে শিখো, যাতে তুমিও শাসন করতে পারো।” সোলনের চলে যাবার পর তাঁর সীমিত গণতন্ত্র স্থায়ী হয়নি বেশী দিন। কিন্তু বিশ্বের প্রথম স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয় সোলনের মৃত্যুর ৫২ বছর পর, আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৫০৮-৫০৭ সালে এথেন্সে, যার মূল ভিত্তি ছিল সোলনেরই প্রণীত সংবিধান। এর নেতৃত্ব দেয় গ্রীসেরই ক্লেইসথেনিস (Cleisthenes)। এবার চলুন এক ঝলক দেখে নেই আমাদের নিকট-অতীতের ইতিহাস এবং সোলোনের প্রভাব।
[ফাস্ট-ফরওয়ার্ড…]
মজার ব্যপার হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে সোলন ছিলেন একজন সত্যিকারের রাজনীতিবিদের রোল-মডেল। বিশেষ করে বেনজামিন ফ্র্যাঙ্কলিন, টমাস জেফারসন এবং জর্জ ওয়াশিংটনের মতো রাষ্ট্র নায়কের প্রিয় রাজনৈতিক বই ছিল “Life of Solon”, লেখক প্লুটার্ক (Plutarch)। আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে সোলনের কেন এতো জনপ্রিয়তা? কাকতালীয় ভাবে, প্রাচীন এথেন্সের মতো আমেরিকাও ১৭৮৬-১৭৮৭ সালে একই রকমের সাংঘাতিক এক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। সোলন যে ভাবে গ্রীসের সমস্যার সমাধান করেছিলেন, তখনকার আমেরিকার রাজনীতিবিদরাও ঐ একই উপায়ে তাদের সমস্যার সমাধান করেন। আমেরিকাতে তখন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কোনো সংবিধান ছিল না। ১৭৮৭ সালের সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ, ফিলাডেলফিয়া কনভেনশনে প্রথমবারের মতো রচনা করা হয় আমেরিকার সংবিধান, ঠিক যেমনটি করেছিলেন সোলন ২৩০০ বছর আগে।
সোলন গ্রীসকে রক্ষা করেছিলেন অবধারিত এক ধ্বংসাত্মক গৃহ যুদ্ধের হাত থেকে। শুধু কি তাই? সোলন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার তাত্ত্বিক ধারণা দিয়েই ক্ষ্যান্ত হন নি, তিনি বিশ্বকে দেখিয়ে গেছেন কিভাবে রাষ্ট্রচিন্তার তত্ত্বকে সফলভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। সোলন তর্কাতীতভাবে আজকের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এক কিংবদন্তী। কত জনই বা জানে সে কথা? পরিশেষে একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সোলন আসলে কোথা থেকে পেয়েছিলেন গণতন্ত্রের ধারণা, একটি সংবিধানের প্রয়োজনীতা, নির্বাচনের অপরিহার্যতা? প্রাচীন রাষ্ট্র চিন্তাবিদরা, যেমন সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টট্ল, এরা তো এসেছেন সোলনের কয়েক শো বছর পর। প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। ভেবে দেখার মতো বিষয় কিন্তু!
তথ্য সূত্র:
* Rhodes, P.:”Athenian Democracy,”Oxford University,2004.
* Tony Valerino, “Solon – Democracy Begins.” 2020.
* Wikipedia: Solon.