আগে কিছু অল্প পুঁজির মানুষ আফগানিস্তানের কাবুল থেকে ব্যাবসা করার জন্য ভারতবর্ষে আসতো।তারা সাধারনত সেখান থেকে আনা মশলা, শুকনো ফল এবং আতর নিয়ে বিক্রি করতে আসতো।তাদেরই বলা হতো কাবুলিওয়ালা।

এখানে আমার ছেলেবেলার একটা স্মৃতীর কথা বলবো…. মুর্শিদাবাদের একটা গ্রামে আমার নানার বাড়ি। ছোটবেলায় দেখেছি, কাবুলিওয়ালা আসলে তিনি তাদেরকে মূল বাড়ির বাইরে বাংলা ঘরে থাকার জন্য জায়গা করে দিতেন। অবাক হয়ে দেখতাম তাদের বিশাল শরীর, কাবলি সালোয়ার, লম্বা কুর্তা আর মাথার পাগড়ি।

Kabuliwala in Kolkata

এরা প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে তাদের পন্য বিক্রির চেষ্টা করতো, যদিও তাদের সব পন্য বিক্রি হতোনা। পন্যগুলির মধ্যে থাকতো- উলের চাদর, উলের টুপি, হালুয়া, কিসমিস, পেস্তা, বাদাম, মক্কার তসবিহ ইত্যাদি। আর আমরা বাচ্চারা একরাশ কৌতুহল নিয়ে এই বিশাল লম্বা- চওড়া মানুষটির পেছনে পেছনে হাঁটতাম, সে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসতো, স্মৃতী বলতে এইটুকুই।

এবারে আসি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ‘কাবুলিওয়ালা’র কথায়। ১৮৯২ সালে কবিগুরুর ‘কাবুলিওয়ালা’ তাদের একটি সহমর্মী ও দীর্ঘস্থায়ী পরিচিতি এনে দিয়েছে আমাদের কাছে। রহমত খান নামে এক কাবুলিওয়ালার কলকাতায় আসে ফল বিক্রি করতে, সেই সময় মিনি নামের একটি বালিকার সাথে তার একটি সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়, মিনি’র মধ্যে সে খুঁজে পায় কাবুলে রেখে আসা তার নিজের মেয়েকে। মিনিকে সে প্রায়ই পেস্তা, কিসমিস খেতে দেয়,
এতে মিনির মায়ের বুকটা অজানা আশংকায় কেঁপে উঠে।কি জানি কি মতলব আছে এই লোকটার! ব্যাপারটা তিনি মিনির বাবার কানে তোলেন।
মিনির বাবা, যে কিনা এই গল্পের লেখক, তিনি পৃথিবীর অন্য সব বাবার মতোই এটাকে সন্দেহের চোখে দেখেন এবং মিনিকে তার সাথে দেখা করতে বাধা দেন।

আফগানিস্তান

একদিন রহমতের কাছে আফগানিস্তান থেকে একটা চিঠি আসে তার মেয়ের অসুস্থতার খবর নিয়ে, সে দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।একদিন এক ক্রেতার কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায় করতে গেলে সে তাকে অপমান করে। এতে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয় এবং হাতাহাতি পর্যায়ে পৌঁছে। রহমতকে সে অপমান করতে থাকলে রহমত তাকে ছুরিকাঘাত করে। আদালতে রহমতের উকিল তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু রহমত সব কিছু স্বীকার করে নেয়। বিচারক রহমতের সততায় সন্তুষ্ট হয়ে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে তাকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।

জেল থেকে ফিরে যখন সে যখন মিনির সঙ্গে দেখা করতে যায়, সেই চার বছরের মেয়েটি এখন চৌদ্দ বছরের কিশোরী। মিনি তাকে চিনতে পারে না। রহমত বুঝতে পারে, তার মেয়েও নিশ্চয় তাকে ভুলে গিয়েছে।

সে তখন মিনির বাবাকে তাঁর মেয়ের হাতের ছাপের ছবিটি দেখায় যেটা সে সবসময় নিজের সাথে রাখে।
মিনির বাবা কাবুলিওয়ালার মনের কষ্টটা বুঝতে পারেন।তাই পিতা-কন্যার যাতে দেখা হয় সে জন্য তিনি রহমতকে কিছু টাকা দেন এবং তার মেয়ের জন্য একটি উপহার দিয়ে দেশে ফিরে যেতে বলেন।

কাবুলিওয়ালা

এখন হারিয়ে গিয়েছে সেই সব স্বল্প পুঁজির ব্যাবসায়ী কাবুলিওয়ারা, যারা নিজেদের সংসার চালানোর জন্য বউ-বাচ্চাদের দেশে রেখে এসে দিনের পর দিন ভিনদেশে জিনিষপত্র বেচা-কেনা করতো। এখন হয়তোবা তারা নিজের দেশেই কিছু কাজ করে, আর কাজ শেষে বাড়ি ফিরে তাদের আদরের পূত্র- কন্যাদের কোলে বসিয়ে গল্পের আসর বসায়!