এশিয়ান হাইওয়ে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে দাড়িয়ে আছি গাড়ীর জন্য। হঠাৎ মনে হলো, কেন এই মহাসড়কের নাম গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড? পকেট থেকে মোবাইল বের করে গুগলে সার্চ দিলাম জানার জন্য। দেখলাম এক বিরাট ইতিহাস। কত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যাক্তি হলে এরকম এক মহাসড়কের কথা চিন্তা করতে পারেন সেই মধ্যযুগে। হ্যাঁ! এই গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডটির বয়স প্রায় ৫০০ বছর হয়ে গেছে। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও দীর্ঘতম সড়ক পথ। এটি উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম অংশকে সংযুক্ত করে রেখেছে। এটি বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া হয়ে পাকিস্তানের পেশাওয়ারের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০০০ কি.মি. (প্রায়) পথ। বর্তমানে ভারতে জি টি রোড বললেও এর পুরাতন নামের মধ্যে ছিল উত্তরপথ, শাহ রাহে আজম, সড়কে আজম, বাদশাহি সড়ক।
জানা যায়, মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় থেকে গঙ্গার মুখ থেকে সাম্রাজ্যের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত প্রাচীন একটি পথ ছিল। আধুনিক সড়কটি সম্রাট শের শাহ শুরি তৈরি করেন। আধুনিককালে, ১৮৩৩ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে ব্রিটিশরা এর আরো সংস্কার সাধন করেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে সড়কটির নাম পরিবর্তন করে গ্র্যান্ড ট্র্যাংক রোড রাখা হয়। কালের আবর্তে বাংলাদেশ অংশের অনেকটা হারিয়ে গেছে এশিয়ার প্রাচীন ও দীর্ঘতম ‘সড়ক এ আজম’ বা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। দুঃখের বিষয়।
সুপ্রাচীন এই সড়কটি বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার আরো ৩টি দেশ ভারত, পাকিস্থান ও আফগানিস্থানে এশিয়ান হাইওয়ে হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশে এটা ‘শের শাহ সড়ক’ নামে পরিচিত। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার সোনারগাঁ হয়ে এবং যশোর ভেতর দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া ও পাকিস্তানের পেশোয়ারের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত এই সড়কটি। তবে, বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত যশোরের বেনাপোল হতে বাঘারপাড়া উপজেলা পর্যন্ত মাত্র ৩৭ কিলোমিটার বিস্তৃত শের শাহ সড়ক নামে আঞ্চলিক সড়ক হিসেবে চালু রয়েছে ।
শের শাহর সময় এটিই প্রধান সড়ক ছিল। সড়কটিকে কেন্দ্র করে বহু জনপদ, নগর ও ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে ওঠে। শের শাহ এই সড়কের ধারে ধারে নির্দিষ্ট দূরত্বে সরাইখানা, মসজিদ, মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য। আমরা আধুনিক কলে শের শাহের এই ব্যাবস্থাটি বিভিন্ন মহাসড়কে দেখতে পাই। শাহজাহানের তাজমহলের মতো গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড শের শাহের এক অমর কীর্তি। তিনিই এই রাজপথের নির্মাতা।
কে এই শের শাহ? শের শাহ সুরি ছিলেন দিল্লির একজন শক্তিশালী আফগান বিজয়ী। ১৪৮৬ সালে তিনি বিহারের সাসারামে এক আফগানের পশতুন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার দাদা ইব্রাহীম খান সুরি মোঘল আমলে নারওয়েল নামের এক গ্রামের জায়গীরদার ছিলেন। তার ছেলেবেলার নাম ছিল ফরিদ খান। একজন সাধারণ সেনা কর্মচারী হয়ে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাবাহিনীতে এবং পরে সেখানে তাকে সেনানায়কের পদে উত্তীর্ণ করে বিহারের শাসনকর্তা বানানো হয়।
তার শের নামের একটা গল্প লোকমুখে চালু আছে যে, তিনি একবার ভারতীয় জঙ্গলে একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘকে সম্পূর্ণ খালি হাতে হত্যা করেছিলেন। তারপর, সম্রাট বাবর একথা জানার পরে তাঁকে ‘শের’ উপাধি দিয়েছিলেন। ১৫৩৭ সালে নতুন মুঘল সম্রাট হুমায়ুন যখন অন্যত্র অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময় শের শাহ সুরি বাংলার রাজধানী গৌড় জয় করে বাংলায় সুরি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ।
এরপর বিহার ও জৈনপুর দখল করে নিলে শের শাহের আত্নবিশ্বাস আরো বেড়ে যায়। তারপর তিনি ১৫৩৯ সালে মোঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং চৌসার যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করে ভারতের সুরি বংশের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। নিজেকে নতুন সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন। শের শাহ সুরি কেবলমাত্র একজন মেধাবী রণকৌশলবিদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক ও যোগ্য সেনানায়ক। তার সাম্রাজ্য পুনর্গঠনের মধ্যেই পরবর্তীকালের বিশেষত আকবরের মুঘল সাম্রাজ্যের মূলভিত্তিটি গড়ে উঠেছিল। ১৫৩৯ থেকে ১৫৪৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তার পাঁচ বছরের স্বল্পকালীন রাজত্বে তিনি নাগরিক ও সামরিক প্রশাসনের এক নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন।
তিনি প্রথম রুপিয়া নামের মুদ্রার প্রচলন করেন, যা ভারতে আজও চালু রয়েছে। তিনি মোহর নামে ১৬৯ গ্রেইন ওজনের স্বর্ণমুদ্রা ও দাম নামে তাম্রমুদ্রাও চালু করেন। তাছাড়া তিনিই প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে চিঠি আদান-প্রদানের জন্য ঘোড়ার ডাক ব্যবস্থার প্রচলন করেন। তিনি হুমায়ুনের দিনা-পানাহ শহরকে নতুনভাবে তৈরি করে নাম দেন শেরগড়। তিনি গোটা রাষ্ট্রকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করেছিলেন। প্রতিটি প্রদেশকে আবার কয়েকটি সরকারে, প্রত্যেক সরকারকে কয়েকটি পরগণায় এবং প্রত্যেক পরগণাকে কতক গ্রামে ভাগ করেছিলেন। প্রদেশের শাসককে ইকতেদার বলা হতো। রাজস্ব ও বিচার বিভাগের প্রধানকে মুনসিফ-ই-মুনসিফান বলা হত। এভাবে সিকান্দারান, ফোতদার, আমিন, কারকুন, দেওয়ান প্রভূতি পদ সৃস্টি করে প্রশাসনের শক্ত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ৪ টি বিভাগ বা মন্ত্রণালয় চালু করেন, যেমন দলিল ও ভূমি মন্ত্রণালয়, সেনা মন্ত্রণালয়, রাজস্ব মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তিনিই প্রথম ভারতের সমগ্র জমি জরিপের কাজ শুরু করেন এবং প্রজাদের সুবিধার জন্য পাট্টা ও কবুলিয়াত দান, শস্য থেকে কর প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। খুব আধুনিক ছিল তার চিন্তাধরা।
শের শাহের এই গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক সড়কের পরিকল্পনা বিষয়ে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন, তাহলে আমি এমন একটি মহাসড়ক করতে চাই যেটা ভারত থেকে খাইবার গিরিপথ পাড়ি দিয়ে একেবারে আরব দেশের মক্কা নগরীতে গিয়ে শেষ হবে। যাতে আমার ভারতের মা-বোনেরা বোরকা পরে একা একাই নিরাপদে হেঁটে হজ্ করতে যেতে পারে।’ কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পুরো করতে পারেন নি। ১৫৪৫ সালে চান্দেল রাজপুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় কালিঞ্জর দুর্গে বারুদের বিস্ফোরণে শের শাহ সুরির মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র জালাল খান ইসলাম শাহ সুরি নাম গ্রহণ করে সুরি সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন। সাসারামে একটি কৃত্রিম হ্রদের মাঝখানে তার ১২২ ফুট উঁচু নয়নাভিরাম সমাধিসৌধটি আজও বিদ্যমান।
তথ্যসূত্রঃ
১। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ: মোগল পর্ব), এ কে এম শাহনাওয়াজ, ২০১৫, ঢাকা। ২। তারিখ-ই-শের শাহ, আব্বাস সারওয়ানী, সমতট প্রকাশনী, ২০১৫, ঢাকা।
৩। রিয়াজ-উস-সালাতীন, গোলাম হোসায়ন সলীম, অবসর প্রকাশনী, ২০০৮, ঢাকা।
৪। উইকিপিডিয়া।