জওহরলাল নেহরুর জন্ম হয় এলাহাবাদে, ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসের ১৪ তারিখে। তিনি একটি বিত্তবান যৌথ পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। জওহারলাল নেহরুর পরিবার ছিলেন কাশ্মীরি হিন্দু ব্রাহ্মন, তাঁদের পদবী ছিল কাউল। ছোটবেলায় তাঁকে স্কুলে না দিয়ে গৃহ শিক্ষক দিয়ে বাড়িতেই তাঁর পড়াশোনার ব্যাবস্থা করা হয়।
দু’শো বছরের ও আগে—আঠারো শো শতাব্দীর প্রথম দিকে তাঁর পূর্ব পুরুষরা কাশ্মীরের পাহাড়ি উপত্যকা থেকে সমৃদ্ধশালী সমতলে নেমে আসেন সুখ ও স্বাচ্ছন্দের খোঁজে। নেহরুর পূর্ব পুরুষ রাজ কাউল সংস্কৃত ও পারস্য ভাষায় পন্ডিত হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের পূত্র সম্রাট ফারুখসিয়ার যখন কাশ্মীর যান, তখন তিনি সংস্কৃত , ফারসি ভাষা এবং সাহিত্যে পারদর্শী রাজ কউলের পাণ্ডিত্যে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। সম্রাটের অনুরোধে, ১৭১৬ সালে এই কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারটি দিল্লীতে পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন। সম্রাট ফারুকসিয়ার তাঁকে বেশ কিছু জায়গা-জমির জায়গিরও দেন। যে জায়গাটিতে থাকার জন্য ফারুখশিয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সেটি ছিল একটি ছোট খালের ধারে খালকে ফারসি ভাষায় বলা হয় নাহার। এই নাহারের পাশের বাসিন্দা থেকে কাউলরা হয়ে গেলেন নেহরু। কাউল ছিল তাদের পারিবারিক পদবী এবং নেহরু দুই পদবী একসঙ্গে ব্যবহার করলেও পরে কাউল হারিয়ে যায়। থেকে যায় নেহরু। যা পরে ব্যবহার করতে শুরু করেন রাজ নেহরুর পুত্র গঙ্গাধর নেহরু । পরে তাঁর পুত্র মতিলাল নেহরু এবং তাঁর পুত্র জওহরলাল নেহরু।
১৮৬১ সালের ৬ মে আগ্রায় মতিলাল নেহরুর জন্ম হয়। তাঁর বাবা গঙ্গাধর নেহরু এবং মা জিওরানি ।মতিলালের জন্মের তিন মাস আগে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। তাঁর শৈশব কাটে রাজস্হানের ক্ষেত্রী শহরে । তিনি কানপুর থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘BAR AT LAW’ হন। তিনি ১৮৮৩ সালে আইন পাশ করে কানপুরে ওকালতি শুরু করেন এবং তিন বছর পর এলাহাবাদ চলে আসেন। ১৯০০ সালে এলাহাবাদে একটি পুরনো বাড়ি কিনে সংস্কার করে তার নাম দেন “আনন্দ ভবন”।
মহাত্মা গান্ধীর তত্ত্বাবধানে মতিলাল নেহরু জাতীয় কংগ্রেসের একজন প্রধান নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি ১৯১৯ সালে এলাহাবাদ থেকে একটি দৈনিক পত্রিকা বের করেন এবং ১৯১৯ ও ১৯২৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। ১৯৩১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মতিলাল নেহরু মৃত্যুবরন করেন।
জওহরলাল নেহরু ও তার দুই বোন বিজয়া লক্ষ্মী ও কৃষ্ণা ‘আনন্দ ভবনে’ পশ্চাত্য সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠেন। ইংরেজির সাথে সাথে তাঁদের হিন্দি ও সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হত। তখনকার ভারতের সবথেকে আধুনিক স্কুলে পড়ার পর প্রায় ১৫ বছর বয়সে নেহরু ইংল্যান্ডের হ্যারোতে চলে যান, সেখানে প্রকৃতি বিজ্ঞানের উপরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি কেমব্রিজেই ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করেন। ইংল্যান্ডে পড়ার সময় নেহরু ভারতীয় ছাত্র সংসদের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এই সময় তিনি সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন।
ভারতে ফিরে আসবার পরে ১৯১২ সালে একজন প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বাঁকিপুর কংগ্রেসে যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে একজন আইনজ্ঞ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সাথে সাথে নেহেরু ভারতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৬ সালে লক্ষ্মৌ সম্মেলনে পিতার হাত ধরেই নেহরু কংগ্রেসের রাজনীতিতেও যোগ দেন। ১৯১৯ সালে এলাহাবাদের হোম রুল লিগে তিনি সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। একই বছর অর্থাৎ ১৯১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জওহরলাল নেহেরু কমলাকে বিয়ে করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ছাব্বিশ আর তাঁর স্ত্রী কমলা’র বয়স ছিল প্রায় সতেরো। বিয়ের একুশ মাস পর কমলার গর্ভে তাদের একমাত্র কন্যা ইন্দিরা প্রিয়দর্শীনির জন্ম হয়। তিনি ১৯২০ সালে উত্তর প্রদেশের প্রতাপগড় জেলায় কিষাণ মার্চ সংগঠিত করেন। ১৯২০-২২-এর অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলিতে তিনি দু’বার জেলে যান।
তিনি ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ১৯২৬ সালে মাদ্রাজ কংগ্রেসে স্বাধীনতাই যে কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য সেটা তিনি ঘোষণা করেন।
১৯২৭ সালের অক্টোবরে মস্কোয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দশম বার্ষিকীতেও তিনি দেশের প্রতিনিধি হিসাবে যোগ দেন। ১৯২৮ সালে ২৯ আগস্ট সর্বদলীয় কংগ্রেসে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং ভারতীয় সংবিধানের সংস্কার সম্পর্কিত নেহরু রিপোর্টে স্বাক্ষর করেন। এই রিপোর্টটির নামকরণ করা হয় তাঁর পিতা শ্রী মতিলাল নেহরুর নামানুসারে। ঐ বছরই তিনি ‘ইন্ডিপেন্ডেস ফর ইন্ডিয়া লীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশের সমস্তরকম সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানিয়ে এই দলটি আন্দোলন শুরু করে। নেহরু ছিলেন লিগের সাধারণ সম্পাদক।
১৯২৯ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। ঐ অধিবেশনে ভারতের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানানো হয়। ১৯৩০-৩৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। আলমোড়া জেলে থাকার সময় ১৯৩৫-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি তাঁর আত্মজীবনী লেখার কাজ শেষ করেন। ১৯৩৬ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি সুইজারল্যান্ডের লোজানে তাঁর স্ত্রী কমলার মৃত্যু হয়, তখন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
১৯৪০ সালের ৩১ অক্টোবর বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণে ভারতকে বাধ্য করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ শুরু করার অপরাধে তাঁকে জেলে যেতে হয়, পরে ১৯৪১ সালে অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে তাঁকেও মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৪২-এর ৭ আগস্ট বোম্বাইয়ের কংগ্রেস অধিবেশনে ঐতিহাসিক ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন নেহরু। পরেরদিনই, অর্থাৎ ৮ আগস্ট অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে তাঁকে গ্রেপ্তার করে আহমেদনগর দূর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর এই কারাবাসের সময় ছিল দীর্ঘতম এবং এটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষবারের মতো কারাবরণ, সারা জীবনে তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল মোট ন’বার।
১৯৪৫ -এর জানুয়ারিতে মুক্তিলাভের পর আজাদ হিন্দ ফৌজের যে সমস্ত অফিসার ও জওয়ান দেশদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের আইনগত স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। চতুর্থবারের জন্য তিনি কংগ্রেস সভাপতি নিযুক্ত হন ১৯৪৬ -এর ৬ জুলাই।
ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে হবে- এ কথা তারা ১৯৪৫ সালের দিকে পুরোপুরি বুঝে গিয়েছিল। সেজন্য ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে কেবিনেট মিশন নামে একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে। এর কয়েক মাস পরেই জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হলেও মুসলিম লীগ প্রথমে তাতে যোগ দেয়নি। অনেক আলোচনার পর ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেয়। ততদিনে কলকাতা এবং নোয়াখালী সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটতে থাকে।
একদিকে যখন সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে, অন্যদিকে প্রশাসন তখন একটি গা ছাড়া ভাব নিয়েছে, প্রশাসনে থাকা ইউরোপীয়রা তখন কাজে মন দিচ্ছেনা কারণ তারা বুঝতে পারছিল, যে কোন সময় ব্রিটিশরা ক্ষমতাচ্যুত হবে।
তখনকার ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালের ৩০শে জুনের আগেই ভারতবর্ষের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশরা যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দিয়েছিল, সেখানে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে কিছু দপ্তর ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা সরদার প্যাটেল এবং অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মুসলিম লীগ নেতা লিয়াকত আলী খানকে।
১৯৪৭ সালের ২২শে মার্চ নতুন ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষে এসে পৌঁছান এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরিস্থিতির পুরোপুরি সুযোগ নিয়েছিলেন।র্নিবাহী পরিষদের সদস্যদের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্যের সুযোগে তিনি ধীরে ধীরে পূর্ণ ক্ষমতা নিজের আয়ত্বে নিয়ে নেন। মৌলানা আজাদ লিখেছেন, ‘’লর্ড মাউন্টব্যাটেন উভয়পক্ষকে খুশি রাখতে চেয়েছিলেন এবং তাদের বুঝিয়েছিলেন যে , পাকিস্তানের সৃষ্টি না হয়ে উপায় নেই। লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেসের সিনিয়র নেতাদের মনে পাকিস্তান সৃষ্টির বীজ বপন করেছিলেন’’।
মৌলানা আজাদের বর্ণনা অনুযায়ী, কংগ্রেস নেতা সরদার প্যাটেলের কারণেই এ পরিস্থিতির তৈরি হয়। কারণ সরদার প্যাটেল স্বরাষ্ট্র দপ্তর নিজ হাতে রেখে লিয়াকত আলী খানকে অর্থ দপ্তর দিয়েছিলেন।
তখন থেকে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে থাকে। ব্রিটিশ সরকারের নিয়োগ করা কেবিনেট মিশনের লক্ষ্য ছিল পুরো ভারতবর্ষকে অখণ্ড রেখে বিভিন্ন অঞ্চলে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীনতা দেয়া।
কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন নতুন ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল হওয়ার পর ইংরেজদের মাথায় ভিন্ন চিন্তা আসা শুরু করে। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে তখন অনেকগুলো বৈঠক করেন ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির তখনকার প্রেসিডেন্ট মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। লর্ড মাউন্টব্যাটেন মৌলানা আজাদকে বলেছিলেন, ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, কিন্তু তার আগে ভারতবর্ষে চলমান হিন্দু-মুসলমান সংঘাত বন্ধের জন্য একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। মৌলানা আজাদ মাউন্টব্যাটেনকে জানিয়েছিলেন, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যকার মত-পার্থক্য অনেক কমে এসেছে।
ব্রিটিশ কেবিনেট মিশন ভারত ভাগের ক্ষেত্রে বাংলা এবং আসামকে একসাথে রেখেছিল। কিন্তু কংগ্রেস এই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে। আসাম এবং বাংলা একসাথে থাকবে কি-না এ নিয়ে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে তীব্র মত-পার্থক্য শুরু হয়। দুই পক্ষের মত-পার্থক্য এমন একটি জায়গায় পৌঁছায় যে তখন তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
মৌলানা আজাদ প্রস্তাব করেছিলেন এ বিষয়টি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের উপর ছেড়ে দিতে। কিন্তু তখনকার কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা জওহরলাল নেহরু এবং সরদার প্যাটেল তাতে রাজী হলেন না। তারা এ বিষয়টিতে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের মধ্যস্থতা চাননি। এরই মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক খারাপের দিকে যাচ্ছিল। কলকাতা দাঙ্গার পর হিন্দু-মুসলমান সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী ও বিহারে।
ভারতীয় নেতাদের মধ্যে সরদার প্যাটেল,মাউন্টব্যাটেনের এ ধারণা সবার আগে গ্রহণ করেছিলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভারতবর্ষ ভাগ করার জন্য সরদার প্যাটেল আগে থেকেই মানসিকভাবে অর্ধেক তৈরি ছিলেন। প্যাটেল ধরেই নিয়েছিলেন, মুসলিম লীগের সাথে একসাথে কাজ করা যাবে না। সরদার প্যাটেল এক পর্যায়ে জনসম্মুখে বলেই ফেললেন, মুসলিম লীগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি ভারতবর্ষ ভাগ করতেও রাজী আছেন। এ কথা বলা খুব একটা ভুল হবে না যে সরদার প্যাটেলই ছিলেন ভারতবর্ষ ভাগের স্থপতি।
ভারতবর্ষ ভাগ করার ফর্মুলা বিষয়ে সরদার প্যাটেল মনস্থির করার পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন মনোযোগ দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহেরুর দিকে। এ ধরনের ফর্মুলার কথা শুনে প্রথমে নেহেরু খুব রেগে যান, কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন জওহরলাল নেহেরুকে ভারতবর্ষ ভাগ করার বিষয়ে ক্রমাগত বোঝাতে থাকেন। নেহেরুর রাগ না কমা হওয়া পর্যন্ত মাউন্টব্যাটেন তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
কিন্তু ভারত ভাগ করার বিষয়ে জওহরলাল নেহেরু শেষ পর্যন্ত কিভাবে রাজী হলেন?
মৌলানা আজাদ মনে করেন, এর দুটি কারণ আছে। প্রথমত, জওহরলাল নেহেরুকে রাজী করানোর বিষয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রীর একটি বড় প্রভাব ছিল। লেডি মাউন্টব্যাটেন ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতী। তাছাড়া তাঁর মধ্যে ছিল আকর্ষণীয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় যার মাধ্যমে সে নিজের দিকে অন্যদের আকৃষ্ট করতে পারতো।
লেডি মাউন্টব্যাটেনের সাথে তাঁর স্বামীর বোঝাপড়া খুব ভালো ছিল, যারা প্রথমে তাঁর স্বামীর কাজের সাথে একমত হতে পারতেন না, তাদের কাছে স্বামীর চিন্তা-ভাবনার কথা বলে তাদের রাজি করাতে পারতেন।
ভারত ভাগ করার পেছনে নেহরুর রাজী হবার আরেকটি কারণ ছিলেন কৃষ্ণ মেনন। এ ভারতীয় ব্যক্তিটি ১৯২০’র দশক থেকে লন্ডনে বসবাস করতেন। কৃষ্ণ মেনন ছিলেন জওহরলাল নেহরুর একজন বড় ভক্ত এবং নেহরুও কৃষ্ণ মেননকে খুবই পছন্দ করতেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নিলে ভারতবর্ষে যখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয় তখন নেহরু কৃষ্ণ মেননকে লন্ডনে হাই কমিশনার পদে নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণ মেননের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের আপত্তি ছিল। কারণ ১৯৩০’র দশকের প্রথম দিকে ব্রিটেনের লেবার পার্টির একটি প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে কৃষ্ণ মেনন ভারত সফর করেছিলেন। ১৯৪৬ সালের দিকে কৃষ্ণ মেনন যখন আবার ভারতে আসেন তখন লর্ড মাউন্টব্যাটেন বুঝতে পেরেছিলেন যে ভারত ভাগ করার বিষয়ে কৃষ্ণ মেননের মাধ্যমে নেহরুকে রাজী করানো যাবে।
মৌলানা আজাদ যখন জানতে পারলেন যে ভারত ভাগ করার বিষয়ে জওহরলাল নেহরু এবং সরদার প্যাটেল মোটামুটি একমত হয়েছে তখন তিনি ভীষণ হতাশ হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, ভারত ভাগ হলে সেটি শুধু মুসলমানদের জন্যই নয়, পুরো ভারতের জন্যই খারাপ হবে।
তাঁর দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের মূল সমস্যা ছিল অর্থনৈতিক। সাম্প্রদায়িক সমস্যা কোন বড় সমস্যা ছিল না। ভারত ভাগ করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিতে সরদার প্যাটেল এবং জওহরলাল নেহরুকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন মৌলানা আজাদ। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ভারত ভাগ করার বিষয়ে সরদার প্যাটেল এতোটাই অনড় ছিলেন যে তিনি অন্য কারো মতামত শুনতে মোটেই রাজি ছিলেন না।
সরদার প্যাটেলের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মৌলানা আজাদ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ” আমরা পছন্দ করি কিংবা না করি, ভারতবর্ষে দুটো জাতি আছে। হিন্দু এবং মুসলমানরা একজাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। যখন দুই ভাই একসাথে থাকতে পারে না, তখন তারা আলাদা হয়ে যায়। তাদের পাওনা নিয়ে আলাদা হয়ে যাবার পরে তারা আবার বন্ধু হয়ে যায়। কিন্তু তাদের যদি একসাথে থাকতে বাধ্য করা হয়, তাহলে তারা প্রতিদিন ঝগড়া করবে।প্রতিদিন মারামারি করার চেয়ে একবার বড় ঝগড়া করে আলাদা হয়ে যাওয়াটাই ভালো।”
মৌলানা আজাদের বর্ণনায়, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হয়তো ভারত ভাগ করার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, কিন্তু এখন সরদার প্যাটেল সে পতাকা বহন করছেন। ভারত ভাগ করার বিষয়ে সরদার প্যাটেল যেভাবে প্রকাশ্যে কথা বলতেন, জওহরলাল নেহরু সেভাবে বলতেন না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী পরিষদে মুসলিম লীগের সাথে একসাথে কাজ করতে গিয়ে নেহরুর তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রতিদিনই ঝগড়া হতো। সেজন্য জওহরলাল নেহরু মৌলানা আজাদকে বলেছিলেন ভারতবর্ষ ভাগ না করে কোন উপায় নেই। নেহরু মৌলানা আজাদকে অনুরোধ করলেন, তিনি যাতে ভারত ভাগের বিরোধিতা না করেন এবং বাস্তবতা মেনে নেন। নেহরু এবং সরদার প্যাটেলের এ অবস্থানের কারণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর পাকিস্তান সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে আরো জোরালো অবস্থান নিলেন।
জওহরলাল নেহরুকে সতর্ক করে মৌলানা আজাদ বলেছিলেন, ” আমরা যদি ভারত ভাগ করার বিষয়ে একমত হই তাহলে ইতিহাস কোনদিনও আমাদের ক্ষমা করবে না।” সরদার প্যাটেল ও জওহরলাল নেহরুকে বোঝাতে ব্যর্থ হবার পর গান্ধী ছিলেন মৌলানা আজাদের শেষ ভরসা।
একদিন মৌলানা আজাদ গান্ধীর সাথে দেখা করতে গেলে গান্ধী বলেন, ” ভারত ভাগের বিষয়টি এখন বড় একটি ভয়ের কারণ হয়েছে। মনে হচ্ছে সরদার প্যাটেল এবং জওহরলাল আত্নসমর্পন করেছে। আপনি এখন কী করবেন? আপনি কি আমার পাশে থাকবেন নাকি আপনিও মত পরিবর্তন করেছেন? কংগ্রেস যদি ভারত ভাগের প্রস্তাব মেনে নেয় তাহলে সেটা আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে হতে হবে। আমি যতদিন জীবিত আছি ততদিন ভারতবর্ষ ভাগ মানব না।”
কয়েকদিন পরে গান্ধী লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে দেখা করলেন। এরপর সরদার প্যাটেল গান্ধীর সাথে দেখা করে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করলেন। সে আলোচনার বিষয়বস্তু কি ছিল সেটা জানা যায়নি, কিন্তু এরপর যখন মৌলানা আজাদ গান্ধীর সাথে দেখা করলেন, তখন বিস্ময়ে হতবাক হলেন তিনি।কারণ ভারত ভাগ করার ফমূর্লা নিয়ে গান্ধীর আগের অবস্থান বদলে গেছে। তিনি ভারত বিভক্তি সমর্থন না করলেও, আগের মতো জোরালো বিরোধিতাও করছেন না। গান্ধীর এই মনোভাব দেখে হতাশ হয়েছিলেন মৌলানা আজাদ। গান্ধী জানালেন, তিনি প্রস্তাব করেছেন যাতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সরকার গঠন করে এবং তাঁর পছন্দ মতো ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রীসভা তৈরি করে। এ বিষয়টি গান্ধী লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে তুলে ধরেন এবং মাউন্টব্যাটেন তাতে রাজী হয়ে যান। লর্ড মাউন্টব্যাটেন মৌলানা আজাদকে বলেছিলেন, গান্ধীর প্রস্তাব যদি কংগ্রেস মেনে নেয় তাহলে ভারত বিভক্তি এড়ানো যেতে পারে। কিন্তু জওহরলাল নেহেরু ও সরদার প্যাটেল গান্ধীর প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তারা দুজনে মিলে গান্ধীকে তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহারে বাধ্য করেন। তখন গান্ধী বলেন, ভারতবর্ষ বিভক্তি অনিবার্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেটি কিভাবে ভাগ হবে।
মৌলানা আজাদ রাজী না থাকলেও ভারত ভাগ করার বিষয়ে কংগ্রেসের বাকি নেতৃত্ব সেটি গ্রহণ করেছে। কিন্তু তারপরেও মৌলানা আজাদ তাঁর শেষ চেষ্টা হিসেবে গান্ধীকে আবারো বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি গান্ধীকে বলেন, বর্তমানে যে অবস্থা চলছে সেটি আরো দুই বছর চলুক। প্রকৃত ক্ষমতা এখন ভারতীয়দের হাতে। এ পরিস্থিতি যদি দুই বছর পর্যন্ত চলে তাহলে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ এ সময়ের মধ্যে তাদের অবস্থান বদলে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতেও পারে। মৌলানা আজাদ ভেবেছিলেন, দুই বছর পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় থাকলে এক পর্যায়ে মুসলিম লীগ একমত হতে বাধ্য হবে। কিন্তু গান্ধি এ প্রস্তাব বাতিল করলেন না এবং কোন আগ্রহও দেখালেন না।
এক সময় ব্রিটিশ সরকারের সাথে আলোচনার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন লন্ডন চলে যান। মৌলানা আজাদ মনে করেন, মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভক্ত করার পক্ষেই ছিলেন এবং তিনি তাঁর পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকারকে বোঝাতে গিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৩০শে মে মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। ২রা জুন তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। তার পরের দিন ৩রা জুন মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা সম্বলিত ‘হোয়াইট পেপার’ বা ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করেন। সেখানে ভারতবর্ষ বিভক্তির রূপরেখা তুলে ধরা হয়। ব্রিটিশ সরকারের সে ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ অখণ্ড রাখার সব আশা শেষ হয়ে যায়।
মৌলানা আজাদ মনে করেন, ভারতবর্ষ ভাগ করার পেছনে ভারতীয়দের স্বার্থের চেয়ে ব্রিটিশদের স্বার্থ বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এজন্য শেষ পর্যন্ত বিচার বিশ্লেষণ করে তারা ভারত ভাগ করার দিকেই এগিয়ে যায়। ব্রিটিশরা মনে করেছিল, যদি অখণ্ড ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পায় তাহলে সে দেশটির উপর তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব থাকবে না। বিভক্ত ভারতবর্ষ ব্রিটেনের স্বার্থ হাসিল করতে পারবে বলেই তাদের ধারণা। মৌলানা আজাদ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, শেষ পর্যন্ত ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত হয়ে তার স্বাধীনতার মূল্য দিতে হলো। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তি এবং কংগ্রেস নেতা মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ বইয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত লেখা আছে। তাঁর মৃত্যুর ৩০ বছর পর বইটি পূর্ণাঙ্গ আকারে প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৮ সালে। তিনি ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির প্রেসিডেন্ট ছিলেন।সে সময় তিনি কংগ্রেস পার্টির পক্ষ থেকে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন।তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ফিরোজ বখত, কিন্তু যৌবনে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন মুহিউদ্দিন আহমেদ নামে। পরে তিনি ছদ্মনাম আবুল কালাম আজাদ হিসেবে পরিচিতি পান এবং সেটিই তাঁর পরিচয় হয়ে উঠে।
জওহরলাল নেহরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন। পরবর্তীকালে তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী ও পরে তাঁর দৌহিত্র রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
তথ্যসূত্র:
#bbc_news #Kolkata24 #উিএকিপিডিয়ি #পিএমইন্ডিয়া #অটোবায়োগ্রাফী_অব_জওহরলাল_নেহরু #ইন্ডিয়া_উইনস_ফ্রিডম_লেখক_মওলানা_আবুল_কালাম_আজাদ