মুঘল জেনানার মহিলারা যে শুধুই বিলা-ব্যসনে, বেলেল্লাপনায় বা শুধুই বৌদ্ধিক চর্চায় দিন কাটাতেন না সেটা আমি আগে জাহানারা আর জগত গোঁসাইএর বন্দুক চালনার দক্ষতা নিয়ে আলোচালনা করতে গিয়ে বলেছি। আজকে আলোচনা করব আরেক বীর মুঘল মহিলা বিদুষী জাহানজেব বেগমের কথা। তিনি শুধু তাঁর পিসি বিদুষী ধর্মপ্রাণ জাহানারার হাতে বৌদ্ধিক সৌন্দর্যেই উদ্ভাসিত হলেন না, তিনি তিন তিন বার দিনের পর দিন বিশাল মুঘল সেনাবাহিনী সামলেছেন; একই দক্ষতায় তিনি শাহজাদার বাড়িঘরদোরও সামলান।
সম্রাট আলমগির আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা আজমের স্ত্রী, শাহজাদা দারাশুকোর কন্যা জাহানজেব বানু বেগম বা জানি বেগম মুঘল ইতিহাসে প্রায় অচর্চিত মুঘল চরিত্র। জাহানজেব বানু বেগমের মা ছিলেন শাহজাদী নাদিরা বেগম। জাহাঙ্গিরের দ্বিতীয় সন্তান, শাহজাহানের বড় সৎভাই শাহাজাদা মহম্মদ পারভেজের কন্যা। দারাশুকো ছিলেন শাহজাহা আর তার দিদি জাহানারা বেগমের খুবই প্রিয় এবং মুঘল সাম্রাজ্যে অনেকেরই ধারণা ছিল শাহজাহান এবং জাহানারা বেগমের আশীর্বাদ থাকায় এবং বংশের বড় ছেলে হওয়ায় তিনিই আগামী দিনের সিংহাসনের অধিকারী।
নাদিরা বেগম ১৬৫৯এ বিসূচিকা রোগে মারা যান। কিছু দিন পরে দারাশুকোর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আওরঙ্গজেব সিংহাসনে আরোহন করলেন। ততদিনে বাবা-মাকে হারিয়ে জাহানজেব অনাথ হয়ে পড়েন। আওরঙ্গজেবের সঙ্গে জাহানজেবের প্রথম দরবারি সাক্ষাৎ বিদেশি মুসাফিরেরা লিখেগেছেন। জাহানজেব এতদিনে ক্ষমতায় উঠে আসা পিসি রোশেনারা বেগমের জেনানায় থাকতে শুরু করেন; শোনা যায় রোশেনারা তাঁকে ভাল চোখে দেখতেন না।
আওরঙ্গজেব জাহানজেবকে তার ঠাকুর্দা শাহজাহানের বন্দীশালা আগরা কেল্লায় পাঠালেন। সেখানে ঠাকুর্দার সঙ্গে ছিলেন তার আরেক পিসি শাহজাদী জাহানারা বেগম। জাহানারা তাঁকে নিজের কন্যার মত মানুষ করা শুরু করেন। ওবিবাহিত বিদুষী ধর্মপ্রাণ জাহানারার হাতে তাঁর নবজন্ম হয় – সৌন্দর্যে এবং বৌদ্ধিকভাবেও। এবং পরের স্তবকে আমরা দেখব জাহানজেব শুধু শারীরিক সৌন্দর্যে বা মানসিক বুদ্ধিমত্তাতেই ধনী ছিলেন না, তিনি সৈন্য পরিচালনাতেও অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি তিন তিনবার প্রতিষ্ঠিত সেনাপতির অনুপস্থিতিতে মুঘল সেনাবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৬৮১তে শাহজাদী জাহানারা মারা যাওয়ার আগে ৩ জানুয়ারি ১৬৬৯এ আওরঙ্গজেব আর দিলরাস বানু বেগমের পুত্র শাহজাদা আজমের সঙ্গে জাহানজেবের বিবাহ দিয়ে যান। এই বিবাহ খুবই জাঁকজমক করে অনুষ্ঠিত হয়। স্বামী-স্ত্রী দুজন দুজনকে ভাল বাসতেন। জানি বেগম ছিলন ঐরঙ্গজেবের প্রিয়তম বৌমা। ১৬৭০এ তাঁদের প্রথম পুত্র বিদর বখতের জন্ম হয়। নাম রাখেন আওরঙ্গজেব। এই তিনজনকে আওরঙ্গজেব অতিরিক্ত ভালবাসতেন। বৃদ্ধ বয়সে বিদর বখত আওরঙ্গজেবের সহায় হন।
১৬৭৯এ পিতার ডাকে শাহজাদা আজমকে মুঘল সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে যাওয়ার তিন সপ্তাহ জাহানজেব বানু বেগম বিশাল মুঘল বাহিনী সামলেছিলেন। তিন বছর পর মারাঠা বাহিনীর ঝটিকা আক্রমনে বিদ্ধস্ত মুঘল বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে সামলেছিলেন – এক হাতে বর্শা আর অন্য হাতে বিষাক্ত পান নিয়ে – যাতে যুদ্ধে মুঘল বাহিনী হারলে পান আর বর্ষা, দুটোই নিজের দেহে প্রবেশ করিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিতে পারেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর ডাকে উদ্বুদ্ধ মুঘল বাহিনী প্রায় জিতিতে বসা মারাঠা বাহিনীর বিরুদ্ধে অসামান্য জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল। ১৬৮৫-৮৬তে আবার তিনি মুঘল সেনাবাহিনীর বাহিনীর হাল ধরলেন। মুঘল বাহিনী বিজাপুর আক্রমন করেও হেরে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়।
রণনীতিতে তিনি যেমন রণরঙ্গিনী ছিলেন তেমনি শাহজাদার বাড়িঘর সামলাতেও তার জুড়ি ছিল না। ১৭০২তে স্বামী শাহজাদা আজমের সঙ্গে কোকা[তুতো ভাই] ভাই শিকার বিশেষজ্ঞ হেদায়াতুল্লা প্রশিক্ষিত বাজ নিয়ে গিয়েছেন শিকার করতে। দুরন্ত হাওয়ার জন্যে বাজ কোনও শিকারই করে উঠতে পারছিল না। আজম তার তুতোভাইকে গালি দেওয়া শুরু করলে মীর হেদায়াতুল্লা বললেন বাতাসকে শিক্ষিত করার কোনও জ্ঞান শাহজাদা যদি তাকে দিতে পারেন ভাল হয়, তাহলে তিনি আজমের শিকার ধরে দেখিয়ে দিতে পারেন। আজম কোকাকে তার প্রশাসনের কাজ থেকে তাড়িয়ে দেন। শেষে কোকাস ভাইকে ফিরিয়ে আনতে জাহাঁবাজকে হাল ধরতে হয়। তিনি আজমকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তাঁকে ফেরত আনেন।
১৭০৫এ ডান দিকের স্তনে ফোঁড়া হয়। ফরাসি ডাক্তার মঁসিয়ে মার্টিন জানান জেনানায় তার এক ইন্দো-পর্তুগিজ মহিলা আত্মীয় শাহাজাদীকে প্রথমে পরীক্ষা করবেন। তারপরে চিকিৎসা শুরু হবে। সেই মহিলা শল্য চিকিৎসা, হাজিকা করবেন। তার সমীক্ষা অনুযায়ী তিনি ওষুধ দেবেন। শাহাজাদী মদ্যপায়ী মহিলার ছোঁয়া নিতে অস্বীকার করেন। দুবছর ধরে ফোঁড়ার যন্ত্রণা সয়ে তিনি ১৭০৫এ মারা যান।
গুলবদন হুয়ায়ুন নামায় বলেছিলেন মহিলাদের জেনানায় ঢুকিয়ে দেওয়ার আকবরের সিদ্ধান্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারন হবে। হয়ত তাই হয়েছিল।