পারস্যে বিভিন্ন ফুলের সুবাস থেকে গন্ধ এবং আতর বার করার পরম্পরা চলে আসছে বহু পুরোনো কাল থেকে। পারস্যে ফুলের মধ্যে গোলাপের স্থান অনন্য। ফলে ক্রমশ গোলাপের গন্ধ, জল এবং আতর নানান সামাজিক এবং দরকারি আচার উৎসবের অনন্য অংশ হয়ে উঠতে থাকে। পাতন করে পাওয়া গোলাপ জলের নাম হয় গোলাপ পাশ। মুঘল শাসকেরা গভীরভাবে কৃষ্টি অনুসরণ করত। ফলে মুঘল দরবারি এবং সামাজিক অনুষ্ঠানেও গোলাপ, গোলাপজল, সাজানোগোজানো গোলাপজলের পাতে ইত্যাদি বড় ভূমিকা পালন করতে থাকে। পারস্যে, পারসিক তির মাসের ১৩তম দিনে আবইপাশা উৎসব পালন করা হত। অনেকটা ভারতীয় হোলি উৎসব আকারের। কিন্তু হোলিতে গুলাল ব্যবহার হত আর আবইপাশায় গোলাপ জল ছেটানো হত।

মুঘল রাজত্বে সম্রাট আকবর হোলি উৎসবের পাশাপাশি এবং অনুকরণে দরবারে গোলাপ জল ছিটিয়ে গোলাপ উৎসব পালন করার পরম্পরা শুরু করেন। উৎসব উপলক্ষ্যে দরবারি মুঘল অভিজাত এবং মুঘল শাহী সদস্যরা পরস্পরের দিকে গোলাপ জল ছিটিয়ে আনন্দ উৎসব পালন করতেন। উৎসব উপলক্ষ্যে সম্রাটকে একটা সোনার ওপরে মণিমুক্তোর কাজ করা গোলাপজল, নানান ফলের সিরাপ, জুজুবে ফুল এবং অন্যান্য সুগন্ধ ভর্তি পাত্র উপহার দেওয়া হত। রাইভ্যাল হিন্দু কিংডম এন্ড সুলতানস বইতে হরবংশ সিংহ ভাটিয়া লিখছেন — on the return of Humayun from the Bihar campaign, his mother organized a grand banquet in his honour. The soldiers and the market people were especially commanded to decorate their lodgings and shops, which gave the thoroughfares of the city a beautiful appearance. A special throne was constructed in the banquet hall, to receive the Emperor. It was furnished with cushions and pillows of brocade…. Other articles of the furniture, namely, candle stands, ewars, wash basins, goblets, rose-water sprinklers, etc, were all worked in gold and enamel (বিহারের যুদ্ধ শেষে হুমায়ুন ফিরে এলে, তাঁর মা বিজয়ী পুত্রের সম্মানে একটি বিশাল ভোজসভার আয়োজন করেন। সেনা ব্যারাকে থাকা সেনারা এবং দোকানদারেরা তাদের বাসস্থান এবং কাজের জায়গা আলোকমালায় সাজান। রাস্তাগুলো নানান রঙ্গিক আলো ইত্যাদি দিয়ে সাজানোয় গোটা শহরটা নতুন করে সেজে উঠল। ভোজসভায় সম্রাটের সম্মানে একটা বিশেষ সিংহাসন তৈরি করানো হয়। সিংহাসনটি সুসজ্জিত জরির কাজের বালিশ এবং কুশনে সাজানো। ভোগগৃহে সোনায় রূপোয় আর এনামেল করা নানান আসবাব, মোম্বাতিদানি, বদনা, হাত ধোয়ার দানি, পানপাত্র, গোলাপজল ছেটানোর পাত্র রাখসা ছিল)।

তাছাড়া সম্রাট জাহাঙ্গির তার স্মৃতিকথা তুজুকইজাহাঙ্গিরিতে ৯ বছরের সিংহাসনে আরোহণের বছরের স্মৃতি কণ্ডুয়ন করে লিখছেন দরবারে বিশদে মজলিসইগুলাবপাশি আয়োজন করা হত। মজলিস অর্থে উৎসব, বৈঠক ইত্যাদি। অতীতের আবইপাশান উৎসবের স্মৃতি লিখনে লিখছেন ১৪ তারিখে (১৬১৪-র খুরদর্দ মাসে) মুঘল দরবারে গুলাব পাশ উৎসব আয়োজিত হত। অতীতে এর নাম ছিল আব-পাশ এবং সে সময়ে এই উৎসব পালন করা মুঘল সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরম্পরা ছিল। রামপুর রাজা লাইব্রেরিতে প্রদর্শিত একটি ছবিতে দেখি মুঘল দরবারিরা উৎসবের পোষাকে উৎসব পালনে সেজেগুজে দরবারে এসেছেন। দরবারে প্রচুর গোলাপ ফুল ছড়ানো রয়েছে।

জাহাঙ্গিরের পরে তাঁর উত্তরপ্রজন্ম শাহজাহান এবং আওরঙ্গজেব উৎসাহভরে উৎসব পালন করতেন। সম্রাটের সঙ্গে মুঘল জেনানার মহিলা আর অভিজাতরাও দল বেঁধে উৎসবে মেতে উঠতেন প্রতিবছর। কোনও কোনও ঐতিহাসিক একে আবইপাশান বলছেন কেউ বলছেন ইদইগুলাবি বা গোলাপজলের উৎসব।

ওপরের আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে প্রায় প্রত্যেক মুঘল সম্রাটই পারসিক রীতিনীতি অনুসরণ করে ১৬-১৭ শতাব্দজুড়ে গোলাপজল উৎসব পালন করেছেন। শুধু মুঘল দরবারই নয়, দক্ষিণেও রাজদরবারগুলোয় গোলাপজল এবং তৎসংলগ্ন নানান আচার ইত্যাদি অনুসৃত হয়েছে। এই উতসব/আচারের সঙ্গী হিসেবে গোলাপজল রাখার এবং ছিটোনোর কারুকার্যকরা পাত্রও কারিগরদের দিয়ে বানানো হয়েছে। দক্ষিণে বদরে বিদরি গুলাব পাশ তৈরি হয়েছে রূপো বা ব্রাস এমন কী সোনার সঙ্গে নানান ধাতু জুড়ে সংকর ধাতু তৈরি করেও।

বিদরিতে যে গোলাপ পাশ তৈরি হয়েছে তাতে দস্তার ভাগ বেশি থাকে। তবে তার সঙ্গে মাঝে মাঝে সামান্য পরিমানে তামা, টিন মেশানো হত। ওপরে মিহি কাজগুলো মূলত রূপো দিয়ে হত। বিদরির গুলাব পাশ-এর আধারের ওপরের মিহি কাজ অনুপ্রাণিত হয়েছে গয়নার আকার, কাপড়ের ফুলেল কাজ বা স্থাপত্যের ওপর কাজ থেকে। পারসিক প্রভাব ছাড়াও উসমানিয়, ভারতীয় এবং চিনা আঙ্গিকের নানান ডিজাইন থেকে। তাছাড়া গুলাব পাশের ওপরে মিনাকারির কাজও খুব জনপ্রিয় আজও। আগরা, লাহোর এবং দিল্লির মুঘল কারখানায় গুলাব পাশের ওপরে এনামেলিং করে তার ওপর মিহি ধাতুর কাজ করা হত।