শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে বিভিন্ন সময় অসংখ্য আলোচনা হলেও যে মানুষটি এই ট্র্যাজেডিপূর্ণ সময়ে সারাটিক্ষণ শেষ সম্রাটের পাশে অবস্থান করেছিলেন, সেই মানুষটিকে নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হতে দেখা যায় না।
বলছি সম্রাজ্ঞী জিনাত মহলের কথা। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বুকভরা স্বপ্ন ও আশা নিয়ে ৬৫ বছর বয়সী মুঘল সম্রাটের সর্বকনিষ্ঠা স্ত্রী হিসেবে মুঘল পরিবারে যুক্ত হন জিনাত মহল।
কাব্য চর্চা ও সংগীতপ্রেমী এই সম্রাজ্ঞীর প্রতিটি কথাই যেনো ছিলো একেকটি সুরেলা কবিগান। নিজস্ব লাইব্রেরীতে ছিলো তার পছন্দের সংগ্রহ গুলো। বেশ ভালো দখল ছিলো তার উর্দু ও ফারসি ভাষাতে। কাব্যপ্রেমিক এই সম্রাজ্ঞী সে সময় ঘুণাক্ষরেও জানতেন না, ভবিষ্যতে কতো বিশদ এক ঐতিহাসিক দায়িত্বের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন তিনি।
সম্রাটের ছোট স্ত্রী হওয়ায় জিনাত মহলের আবদারের গুরুত্ব ছিলো অনেক বেশি। যে পথ দিয়ে তিনি পালকিতে চড়ে যেতেন, সেই পথেই ডঙ্কা বাজতো। ১৮৪৬ সালে লালকুঁয়োতে সম্রাট তার এই স্ত্রীর জন্য নির্মাণ করেছিলেন প্রাসাদ ‘জিনাত মহল’। সম্রাটের ওপর জিনাত মহলের প্রভাব এতোই বেশি ছিলো যে, নিজের গর্ভের সন্তানকেই মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী বানাবার ক্ষেত্রে একটি সুনিশ্চিত স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য হয়তো তার জন্য অন্য কিছুই লিখে রেখেছিলো।
আচমকাই চলে এলো ১৮৫৭ সাল। বদলে গেলো মুঘল সম্রাট, সম্রাজ্ঞী ও শাহজাদাদের ভবিষ্যৎ। সিপাহী বিদ্রোহে মুঘলদের কোনো হাত না থাকলেও সিপাহীদের বিপক্ষে যেতে পারলেন না তারা। আর এতেই ইংরেজদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ালেন মুঘলরা।
সম্রাজ্ঞী জিনাত মহল লালকেল্লার দরজা খুলে দিলেন মীরাটের সিপাহীদের জন্য। এ দিকে ৪০০ বছরের নিরস্ত্র নির্লিপ্ত জীবনযাপনে অভ্যস্ত মুঘলদের আগেরকার সেই যুদ্ধ দক্ষতা আর অবশিষ্ট ছিলো না। তাই ইংরেজদের সামনে তারা ছিলেন ভীষণ অসহায়। দিল্লি গেটের সামনে গুলি করে হত্যা করা হলো সম্রাটের দুই শাহজাদাকে।
৮২ বছর বয়স্ক সন্তানহারা অসুস্থ বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে ছেড়ে এক বারের জন্যও কোথাও যান নি জিনাত মহল। ইংরেজদের সাজানো একাধিক অপরাধের দোষে ৪১ দিন যাবৎ বিচার চলেছিলো অসহায় সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর বিরুদ্ধে। ১৯টি শুনানির পর তাদের শাস্তিও ঘোষণা করা হলো। নির্বাসিত করা হলো মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর এবং সম্রাজ্ঞী জিনাত মহলকে।
অপমান, লাঞ্ছনা ও বুক ভরা কষ্ট নিয়ে এক সময়ের স্বপ্ন বোনা ১৭ বছরের তরুণী ৩৪ বছর বয়সে এসে নিজের বৃদ্ধ ও অসহায় স্বামীর সাথে নির্বাসনের শাস্তি ভোগের জন্য রেঙ্গুনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন। সাথে ছিলেন তার দুই ছেলেও। পরিবারের আর কেউ যখন বৃদ্ধ সম্রাটের সঙ্গে নির্বাসনে যেতে রাজি ছিলেন না, তখন একমাত্র জিনাত মহলই সম্রাটের হাত ছেড়ে দেন নি।
রেঙ্গুনে যাবার চার বছর পর ভীষণ মানসিক কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকা সম্রাটের মৃত্যু হয়। জিনাত মহল বেঁচে ছিলেন আরো ২৪ বছর। কিন্তু এক বারও দেশে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেন নি তিনি। ১৮৮৬ সালে তার মৃত্যুর পরও স্বামীর পাশেই রেঙ্গুনে সমাধিস্থ হয়েছিলেন একরাশ দুঃখস্মৃতি বুকে বয়ে বেড়ানো সম্রাজ্ঞী জিনাত মহল।