আমাদের গাজীর পট আজ আমাদের কাছে নেই। পটচিত্রটি আজ ব্রিটিশ জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে। ব্রিটিশরা বিশ শতকের প্রথম দিকে সেটি লন্ডনে নিয়ে যায়। এছাড়াও আশুতোষ মিউজিয়ামে একটি এবং দুটির বেশি গাজীর পট গুরুসদয় দত্ত যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। আমাদের এত মূল্যবান সম্পদ কেন আমাদের জাদুঘরে থাকবে না? নিজ সম্পদ হারিয়ে আমরা হতাশাগ্রস্ত। আমরা দুর্ভাগা জাতি, ঐশ্বর্য্যশালী হয়েও আমাদের বহু মূল্যবান সম্পদগুলো ধরে রাখতে পারিনি। আমরা জোড় দাবি জানাই, ঐ পটচিত্র গুলোকে ফেরত আনার জন্য। যদি কোহিনুরের জন্য ভারত দাবি জানাতে পারে, তবে পটচিত্রের জন্য নয় কেন? গাজীর পটের কথা বলতে গেলে, আমাদের জানতে হবে, কে এই গাজী? গাজী আমাদের লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য। বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া লোকজ গল্পের নায়ক গাজী। এখানে গাজীর ওপর চিত্র আঁকা হয়েছে। যা সঙ্গীতের সাথে পটুয়ারা দেখান। গাজী পীর ইসলামের একজন সেবক ছিলেন। তিনি সত্যপীর ও জিন্দাপীর নামেও পরিচিত। তিনি বাঘের পিঠে চড়ে সুন্দরবন এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। জানামতে, বৈরাগ নগরের শাসক ছিলেন সিকান্দার। তার ছিল তিন ছেলে। তার প্রথম ছেলে জুলহাস শিকার করতে গিয়ে হারিয়ে যান। তার দ্বিতীয় ছেলে ছিলেন গাজী। কালু ছিলেন তাদের পালিত ছেলে। কালু গাজীর সঙ্গী ও কালু দেওয়ান নামে পরিচিত। রাজা সিকান্দার যখন গাজীকে রাজ্য চালানোর ভার দেন, তখন গাজী কালুকে সাথে নিয়ে সুন্দরবনে পালিয়ে যান। ঝিনাইদহ জেলার ইতিহাস থেকে জানা যায়, তের শতকে বারোবাজার এলাকায় যেসব সূফি, পীর ইসলাম প্রচারে অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে গাজীই ছিলেন প্রধান। তারা ফকির বেশে বহু এলাকা ভ্রমণ করে ব্রাহ্মণনগরে আসেন। ব্রাহ্মণনগরের রাজা ছিলেন মুকুট রায়। তাঁর মেয়ে চম্পাবতী। চম্পাবতীকে প্রথম দেখায় গাজীর ভালো লেগে যায়। সে চম্পাবতীকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু বাঁধা হয় ধর্ম। শুরু হয় যুদ্ধ। গল্পে আছে, মুকুট রায়ের কুমির বাহিনি আর গাজীর বাঘ বাহিনির মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। যাকে বাংলায় বলে, বাঘে-কুমিরের যুদ্ধ। যুদ্ধে গাজী মুকুট রায়কে পরাজিত করে এবং চম্পাবতীকে বিয়ে করেন। তারপর তারা ঝিনাইদহের জেলার বারোবাজারে বসবাস শুরু করে। সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়। ঐ এলাকার শ্রীরাম রাজার বীর দিঘির দক্ষিণ দিকে তাদের কবর রয়েছে। বর্তমানে সেটি গাজী-কালু-চম্পাবতীর মাযার নামে পরিচিত। এইসব গল্প থেকেই গাজী-কালু গীতিকা, পাঁচালী, নাটক, পালা ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে সেসব কাহিনী সুপরিচিত। একসময় গাজীর পট বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে বিনোদনের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল। আগেকার বায়োস্কোপের মত। আজকে আমরা সাংস্কৃতিক দৈন্যদশায় ভুগছি। শুধুমাত্র আমাদের নিজেদের সম্পদ হারানোর কারণে। তুর্কি-আফগান আমলে বারোবাজার মুসলিম শাসনের কেন্দ্রস্থল ছিল। আসলে ইসলাম যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তখন পীর-সুফিরা ইসলাম প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তাদের উদার কথা ও বাণী অন্যদের ইসলাম গ্রহণে আকর্ষন করে। গাজী-কালু-চম্পাবতীর গল্প ইসলামের উদারনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রমান করে। এই গল্প থেকে এটাও আমরা দেখতে পাই যে, গাজী ও চম্পাবতী দুজন আলাদা ধর্মের হয়েও তাদের মিলন ও সম্পর্ক। পূর্ববঙ্গে মুসলমান জনসমষ্টির সংখ্যা গরিষ্ঠতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুফিরা যে সক্রিয় ভ‚মিকা রেখেছিল তার উদাহরন হচ্ছে এই গাজীর গল্প। সকলকে গ্রহণ করার ক্ষমতা ছিল ইসলামের। জাত নিয়ে কোন বাঁধা ছিল না। তবে আশার বাণী হচ্ছে, বর্তমানে চারুকলার ছাত্ররা পহেলা বৈশাখ উৎসবে বিভিন্ন দেয়ালে এবং সরাতে গাজীর পটের চিত্র আঁকেন। যার মাধ্যমে তারা কিছুটা হলেও আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনছে।