জোড়া শিব মন্দিরে জোড়া সিংহের অলংকরণ কেন ? হঠাৎ করে এরকম এক অদ্ভুত  প্রশ্ন  করে বসেছিলাম যখন আমি একদিন  যশোরের জোড়া শিব মন্দিরে বেড়াতে গিয়েছিলাম আমার এক স্যারের সাথে। কিন্তু সেদিন কোন উত্তর পাইনি। তারপর কেটে গেছে বহু বছর। সিংহ হল পশুর রাজা, কে না জানে? তারা সমভূমি এবং ঘাসযুক্ত পাহাড়ে বসবাস করে। সিংহকে রাজত্ব ও সুরক্ষার পাশাপাশি প্রজ্ঞা এবং গর্বের প্রতীক হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতি যুগ যুগ ধরে বিবেচনা করে এসেছে। বৌদ্ধ ধর্মে সিংহ বোধিসত্ত্বের প্রতীক। বৌদ্ধ স্থাপত্যে সিংহের প্রতীককে ধর্মের রক্ষাকারী হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ঠিক সেরকমভাবেই হিন্দু  ধর্মেও সিংহ দেখা যায়। আমরা এখন কথা বলতে যাচ্ছি, যশোরের জোড়া শিব মন্দিরের সামনের দেয়ালে যে জোড়া সিংহের অলংকরণ করা হয়েছে, তাকে নিয়ে। কেন শিব মন্দিরে জোড়া সিংহ  আঁকা হল?

জোড়া শিব মন্দিরে জোড়া সিংহের অলংকরণ, Image Source:Face of Bangla

সিংহ তো শিবের বাহন নয়, তাহলে কী?

শিবের বাহন হল নন্দী নামে একটি পৌরাণিক ষাঁড় । আমরা পৌরাণিক কাহিনী  থেকে জানতে পারি যে, দুর্গার বাহন সিংহ। হিন্দু মহিলারা বিশ্বাস করেন যে, শিব লিঙ্গ উর্বরতার প্রতীক এবং তারা গর্ভধারণের আগে আগে শিব মন্দিরে পূজা করতে যায়। সেখান থেকে শিব মন্দিরে সিংহ ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া, শিবের আরেক নাম পশুপতি মানে পশুদের দেবতা, আর পশুর রাজা সিংহ, তাই সিংহকে অনায়াসে ব্যবহার করতেই পারে। অবশ্য আমাদের এই এলাকায় দুর্গার বাহন হিসেবে সিংহ শৌর্য-বীর্যের হলেও ভারতের হিমাচল প্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর, ও উত্তর ভারতের কোনো কোনো জায়গায় দেবী দুর্গার বাহন বাঘ। সকল দেবতারই বাহন থাকে। বাহন মানে যা বহন করে নিয়ে যায়। যেমন আরো বলা যেতে পারে গণেশের বাহন ইঁদুর, কার্তিকের বাহন ময়ূর ইত্যাদি। তেমনই দেবী দুর্গার বাহন সিংহ।

নন্দী শিবের বাহন

কালিকাপুরাণ মতে শ্রীহরি দেবীকে বহন করেছেন। এই হরি শব্দের এক অর্থ সিংহ। আবার শ্রীশ্রীচণ্ডীতে উল্লেখ আছে গিরিরাজ হিমালয় দেবীকে সিংহ দান করেন। শিবপুরাণ মতে, ব্রহ্মা দুর্গাকে বাহনরূপে সিংহ উপহার দিয়েছেন।

সিংহ, বিশেষত পুরুষ সিংহ হাজার হাজার বছর ধরে ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক বা থিম হিসাবে চালু রয়েছে। সর্বাধিক আলোচিত আইকনোগ্রাফিক বা ভাস্কর্য সিংহের উপস্থাপনাটি পারস্য সাম্রাজ্য  থেকে এসেছিল।  আমাদের সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় সিংহের বিভিন্ন ব্যবহার থেকে বোঝা যায়,  হয়তো একসময় সুন্দরবনে বা তার আশেপাশের জঙ্গলে সিংহ বসবাস করতো!  যেমন –  সিংহদরজা,   সিংহাসন,  সিংহমুখ । এছাড়া সিংহল নামে তো পুরো একটা দেশই রয়েছে, যার নাম এখন শ্রীলংকা।

যাইহোক, এবার আসা যাক, আমাদের জোড়া শিব মন্দিরের গল্পে এবং যশোরের বিখ্যাত জোড়া শিব মন্দির ছাড়াও আরো যেসব জায়গায় এই সিংহ ভাস্কয্, মূর্তি, প্যানেল ডেকোরেশন হিসেবে অঙ্কন করা হয়েছে। যথা: যশোরের আখড়াপাড়া মন্দির,  কুমিল্লা জেলার  লালমাই-ময়নামতীর আনন্দ বিহার, রূপভান মুরা ও শালবন বিহার, বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ের মানকালির কুন্ডো এবং নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারের পোড়ামাটির ফলকগুলিতে বিভিন্ন ধরণের সিংহের প্রতীকের ব্যবহার আমাদের অতীত গৌরবের কথা সাক্ষ্য দেয়।

প্রায় তিনশো বছরের পুরাতন এই জোড়া শিব মন্দিরটি  যশোরের মুড়লিতে রাজা লক্ষণ সেনের আমলে (১১৮৯ সন ?) নির্মিত । সাল ও শাসক বিষয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। তবে ছবিতে শকাব্দ হিসেবে রয়েছে 1704 এবং সন হিসেবে লেখা রয়েছে ১১৮৯।  তার সময়ে ভৈরব নদের পশ্চিম তীরে শ্রমজীবী শিবভক্ত প্রজাদের জন্য তিনি পাশাপাশি দুটি মন্দির স্থাপন করেন। যে কারণে এর নাম হয়েছে জোড়া শিব মন্দির। মন্দির দু’টির স্থাপত্য শৈলীতে রয়েছে অপূর্ব নিদর্শন।

তিনশো বছরের পুরাতন এই জোড়া শিব মন্দির, Image Source:Face of Bangla

এখন এই মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে সনাতন ধর্ম সংঘ। নিয়মিত সেখানে পুজা অর্চনা হয়। নতুনভাবে অনেক সংস্কারও করা হয়েছে। ফলে মন্দিরটির উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মন্দিরের জোড়া সিংহটি পিলাস্টার সহকারে একটি স্টাকো নকশা্।  সাধারণত সাদা চুন এবং ধূসর লাল রঙ দিয়ে তৈরি এই স্টাকো নকশা্টিতে আমরা দেখতে পাই একটি আসল সিংহ লাফ দেওয়ার ভঙ্গিতে রয়েছে। এর লম্বা লেজ সুন্দর করে উপরের দিকে বাকানো। এর পাঞ্জাগুলি চলমান অবস্থান প্রদর্শন করছে এবং তার পেছনের পায়ের নিচে একটি মকর রয়েছে। মকর হিন্দু পুরাণের মতে, একটি পৌরাণিক জীব। মকর গঙ্গা ও বরুণের বাহন। মকর হিন্দুদের প্রেম ও কামনার দেবতা কামদেবের প্রতীক।

নকশা্

যশোর জেলার আরো ছয়’টি  শিব মন্দিরে এই মোটিফটি ব্যবহার করতে দেখা গেছে। হয়তো দেশের আরো মন্দিরেই তা বেশ সুন্দর নকশা্ হিসেবে আঁকা হয়েছে। অন্যান্য  মন্দিরগুলোর নাম হল: শিলা রায় মন্দির, বিরামপুর; চাঁচড়া শিব মন্দির, চাচঁড়া; জোড়বাংলা শিব মন্দির, মুড়োলি; ইত্যাদি। শেষে বলা যেতে পারে যে, হিন্দু ধর্মের রীতিমত, মহিলারা শিবকে উপাসনা করেন এবং যেহেতু  শিব দুর্গার স্বামী, সেকারণেই দুর্গার বাহন সিংহ প্রতীককে  শিব মন্দিরের প্রধান দরজার উপরে অলংকৃত করা হয়েছে।  তবে যাইহোক এগুলো আমাদের ঐতিহ্য । এগুলো সংরক্ষণ করা আমাদেরই দায়িত্ব।

তথ্যসূত্রঃ

  1. Gupta, S. P., The Roots of Indian Art, B. R. publication, Delhi, 1980.
  2. Saifuddin chowdhury, Early Terracotta figurines of Bangladesh, Bangle Academy, Dhaka, 2000.
  3. Muhammad Shohrab Uddin and Shaermin Rezowana, “Animal (mammal) Representation in Somapura Mahabihara in situ Terracotta plaques”, Journal of Bengal Art, vol. 17, 2012.
  4. উইকিপিডিয়া।