সিল্ক রোড, এক সুপার হাইওয়ে। মানবজাতির ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সিল্ক রোড বাণিজ্য এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক বিস্তারের ক্ষেত্রে বিশ্বের ইতিহাসে অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে। তবে একদিনেই তো আর এই সিল্ক রোড তৈরী হয় নি। বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের প্রচেষ্টায় এ ধরনের নেটওয়ার্কগুলো তৈরী হয়েছিলো এবং এদের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের কাজটি সম্ভব হয়েছিলো। এর ফলে প্রাচীন সভ্যতাগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের পথ সুগম হয়েছিলো।
সিল্ক রোডের উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা প্রদানকারী একজন ব্যক্তি ছিলেন ঝাং-কিয়ান। মার্কো পোলো সিল্ক রোডে বিচরণেরও প্রায় ১৩০০ বছর আগে ঝাং-কিয়ান এই সিল্ক রোডের পথ ধরে হেঁটে গিয়েছিলেন।
ছোট ছোট চোখের একদল মানুষের দেশ চীন। চীন তখন হান রাজবংশের সম্রাটদের মাধ্যমে শাসিত হচ্ছিলো। হান রাজবংশের শুরু থেকেই জিওংনু বা হুণ উপজাতির অত্যাচারে জর্জরিত ছিলো চীন। এই উপজাতীয় দলের অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভের জন্য এমন কোন পন্থা অবশিষ্ট ছিলো না যা তারা অবলম্বন করেন নি।
সম্রাট য়ু-ডি খ্রিস্টপূর্ব ১৪১ সালের দিকে হান রাজবংশের সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জিয়ংনুদের অত্যাচার থেকে রাজ্যকে মুক্ত করবার জন্য তিনি উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন। পূর্ববর্তী সম্রাটেরা এ ক্ষেত্রে হার মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু সম্রাট য়ু-ডি ছিলেন এ ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। য়ু-ডি অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী এক রাজ্য গঠন করতে পেরেছিলেন এবং তিনি রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ সচেষ্ট ছিলেন।
জিওংনুদেরকে মোকাবেলা করবার জন্য য়ু-ডি বেশ আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। আর এ জন্য যথেষ্ট সামরিক প্রস্তুতিও তিনি গ্রহণ করলেন। সেই সাথে তিনি পার্শ্ববর্তী অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন বা মিত্রতা গড়ে তুলবার চেষ্টা শুরু করলেন, যেনো সকলে একত্রিতভাবে জিওংনুদের অত্যাচার থেকে চীনকে রক্ষা করতে পারেন। ঠিক এমন সময়ই দৃশ্যপটে আসলেন ঝাং-কিয়ান।
ঝাং-কিয়ান সম্রাটের রাষ্ট্রদূত নির্বাচিত হলেন। দেখতে ছোটোখাটো মানুষ হলেও তিনি অত্যন্ত শিক্ষিত, দক্ষ এবং মিষ্টিভাষী ছিলেন। যে কোনো রাজ্যের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার কথোপকথনের জাদুই ছিলো যথেষ্ট। লেখাপড়া শেষ করে জীবিকার তাগিদে প্রাসাদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। ঝাং-কিয়ানের নেতৃত্বে প্রায় ৩০০ সদস্যের একটি দল খ্রিস্টপূর্ব ১৩৮ সালে লংসি থেকে পশ্চিমের দিকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু নতুন গন্তব্যে তাদের জন্য অপেক্ষা করে ছিলো কঠিন এক সারপ্রাইজ। যাদেরকে দমন করবার উদ্দেশ্যে ঝাং-কিয়ানের এই যাত্রা, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তিনি ও তার দল সেই জিওংনুদের হাতেই বন্দি হলেন।
বন্দি অবস্থায় প্রায় ১০ থেকে ১২ বছর কাটাতে বাধ্য হলেন ঝাং-কিয়ান, যদিও সে সময়ের ইতিহাস বেশ অস্পষ্ট। হয়তো তারা বন্দি ছিলেন, কিংবা আংশিক মুক্ত ছিলেন। কেননা সেখানে অবস্থানকালে ঝাং-কিয়ান বিয়েও করেছিলেন এবং তার একটি সন্তানেরও জন্ম হয়েছিলো। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে এক মুহূর্তের জন্যও তিনি তার ভ্রমণের আসল উদ্দেশ্য ভোলেন নি। তিনি শুধু সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুণছিলেন। আর সেই সুযোগ যখন আসলো, তখন তিনি তার পরিবারকে নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন।
বন্দি দশা থেকে মুক্তির পর নিজ দেশে ফিরে না গিয়ে সম্রাটের পূর্ব ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি ফেরঘানা উপত্যকার দাউয়ানে গিয়ে পৌঁছেন এবং সেখানে তিনি গ্রীক নাগরিকদের একটি দলকে দেখতে পান, যারা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে দাউয়ানে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। তার লিখিত ভাষ্য অনুযায়ী, এই গ্রীকদের নগর জীবন ছিলো ভীষণ আধুনিক।
ফেরঘানা ছিলো শক্তিশালী ঘোড়ার জন্য ভীষণ প্রসিদ্ধ এক এলাকা। গল্প প্রচলিত আছে যে, তাদের তেজি ঘোড়ার শরীর থেকে নাকি লালচে তরল নির্গত হতো, যা দেখে মনে হতো তাদের ঘামের সাথে রক্ত নির্গত হচ্ছে।
ফেরঘানার গ্রীক মানুষেরা ঝাং-কিয়ানের সাথে একত্র হয়ে জিওংনুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে তখনই রাজি হন নি। কিন্তু ঝাং-কিয়ানকে তো থেমে গেলে চলবে না। বর্তমানের কাজিখিস্তানের ইউয়েচি অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হলেন। ঝাং-কিয়ানের বর্ণনা থেকেই আমরা সর্বপ্রথম ঐ অঞ্চলের মানুষগুলো সম্পর্কে জানতে পারি। তার লিখিত বর্ণনার উপর ভিত্তি করে অনেকেই মনে করেন, বর্তমান তারিম বেসিনের ককেশীয় মমিগুলো হয়তো ঐ অঞ্চলের মানুষেরই ছিলো। তবে এখানেও কিছুটা হতাশ হলেন ঝাং-কিয়ান। ক্ষুদ্র সেই জনগোষ্ঠীর নেতা ছিলেন অপেক্ষাকৃত দুর্বল। তিনিও ঝাং-কিয়ানের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে সামরিক যুদ্ধে যাওয়ার ক্ষেত্রে অপারগতা জানালেন।
তবে এখানে কিছুটা আশার আলোও মিলেছিলো। যুদ্ধে যেতে রাজি না হলেও গোত্রনেতার আপ্যায়নে এক বছরের মধ্যে ঝাং-কিয়ান ইউয়েচিদের সাথে ঐ এলাকা এবং আশেপাশের অন্যান্য জাতির সংস্কৃতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে সিল্ক রোডের বিকাশকে সহজতর করে তোলেন।
প্রায় ১২ বছর পর তার ১০০ জন সহযাত্রীর মধ্যে মাত্র একজনকে নিয়ে দেশে ফিরেন ঝাং-কিয়ান। বাকিরা আর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার জন্য জীবিত ছিলেন না। নিজের অজান্তেই দূত ঝাং-কিয়ান সিল্ক রোডের বিকাশের ক্ষেত্রে বিশাল এক দায়িত্ব পালন করেন। তার ট্র্যাভেল বুকে সেন্ট্রাল এশিয়ার ভ্রমণের পথ এবং মানুষের বিবরণগুলো পড়ার পর হাজার হাজার মানুষ ঘর ছেড়ে ভ্রমণে বের হবার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন। ব্যাক্ট্রিয়া, ফেরঘানা, সগডিয়ানার এসব অঞ্চলগুলোর সাথে বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য তার লিখিত বিবরণগুলো ভীষণভাবে সমাদৃত হয়েছিলো। যদিও সময় স্বল্পতার জন্য তিনি বেশ কিছু দেশের নাম উল্লেখ করলেও সেসব দেশে সফর করতে পারেন নি। ভারতবর্ষ, মেসোপটেমিয়া, পার্থিয়া –এই নামগুলো তিনি তার ট্র্যাভেল নোটে লিখে গিয়েছেন।
এবার আসা যাক তার কৃষি বিপ্লবের গল্পে। বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণের সময় তিনি ঐ সমস্ত দেশ থেকে আঙুর, আলফা, ডালিম ইত্যাদি সংগ্রহ করে নিজ দেশে নিয়ে যেতেন এবং পরবর্তীতে সেই পণ্যগুলো উৎপাদনের মাধ্যমে চীনে বিরাট এক কৃষি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন তিনি। তারই সহযোগিতায় চীন তখন কৃষিপণ্য উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো।
তা ছাড়াও ঝাং-কিয়ানের কূটনৈতিক জ্ঞান ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বিশাল ভূমিকা রাখায় সম্রাট য়ু-ডি তাকে প্রাসাদের উচ্চতর গ্র্যান্ড মাস্টার হিসেবে সম্মানিত করেছিলেন, যা তার কর্মজীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ১১৯ সালে ‘উসুন’ নামের এক ইন্দো-ইয়োরোপীয় গোষ্ঠীর সাথে নতুন করে সম্পর্ক তৈরীর জন্য ঝাং-কিয়ানকে আবারও ৩০০ সদস্যের একটি দলের সাথে পশ্চিমে পাঠানো হয়েছিলো। ইতিমধ্যেই জিওংনুদের অঞ্চলটি হান সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে যাওয়াতে কোনো রকম বাধা ছাড়াই নিরাপদে ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলেন তারা। তবে তার ভাগ্য সে সময় প্রসন্ন ছিলো না। উসুন অঞ্চলে তারা যখন পৌঁছলেন, তখন সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে। ঐ রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের হান রাজবংশের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা থাকলেও সময়টি তখন তাদের জন্য উপযুক্ত ছিলো না।
তবে পরবর্তীতে অন্যান্য বহু জাতি চীনের সম্রাটের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছিলো, যা ছিলো সম্পূর্ণরূপে ঝাং-কিয়ানের কৃতিত্ব। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ঝাং-কিয়ানের প্রচেষ্টার কারণে পশ্চিমের সাথে চীনের সম্পর্ক স্থাপন ও বিস্তারের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী হাজার বছরের জন্য বাণিজ্য ও জ্ঞান স্থাপনের এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক হিসেবে প্রস্তুত হতে থাকে সিল্ক রোড।
ব্যাকট্রিয়ান শহরে চাইনিজ পণ্যের বাজার তার চোখেই পড়েছিলো। তিনি দেখেছেন, সেখানে চাইনিজ সিল্ক উচ্চ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। তিনি আরও জানতে পারলেন, এই সিল্কগুলো ভারতবর্ষ থেকে আসে। বোঝা গেলো, ইন্ডিয়া হয়ে এই পণ্যগুলো ব্যাকট্রিয়াতে আসছে এবং উচ্চমূল্যের বাজারটি ব্যাকট্রিয়াতে তৈরী হয়ে গেছে। বহু বছর আগে যে পথ দিয়ে ঝাং-কিয়ান গিয়েছিলেন, সেই পথ দিয়েই বৌদ্ধ ধর্ম এসে প্রবেশ করেছিলো চীনে।
দ্বিতীয় অভিযান থেকে দেশে ফিরে আসার এক বছরের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন ঝাং-কিয়ান। তিনি জীবনে প্রচুর কষ্ট করেছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন চীনকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু মৃত্যুর আগেও তার মনে সংশয় ছিলো। তিনি ভেবেছিলেন, এই বিপদসংকুল ভ্রমণ সত্ত্বেও চীনের উন্নয়নে তেমন কোনো অবদান তিনি রাখতে পারেন নি। দুঃখভারাক্রান্ত মনে নিজের এই মিশনকে তিনি ‘ব্যর্থ মিশন’ বলে অভিহিত করেছিলেন, যদিও ইতিহাস বলছে অন্য কথা।
মৃত্যুর কয়েক শতাব্দী পরও তার সমাধি পরিদর্শনের জন্য হাজার হাজার মানুষের ভীড় তার সফলতাকে প্রমাণ করেছিলো। হয়তো পরপার থেকে এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে তার আক্ষেপ কিছুটা হলেও ঘুঁচেছে।
বিশ্বের সাথে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ঝাং-কিয়ানের ভূমিকা আজ অনস্বীকার্য বলে প্রমাণিত। বর্তমানে ঝাং-কিয়ানের সমাধিকে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যবাহী স্থান বলে অভিহিত করা হয়। তিনি চীনে আজ জাতীয় বীর হিসেবে বিবেচিত। বিভিন্ন সাম্রাজ্যের সাথে সৎ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক সহজতর করবার জন্য চীন তার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে।