পীচগাছের শাখা দিয়ে তার নিজ হাতে তৈরি দুই কাঁটা বিশিষ্ট ফর্ক (fork)-টি তার  গলার মধ্যদিয়ে আমূল্ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাঁটাটি তাকে মাটির সঙ্গে রীতিমতো গেঁথে ফেলেছে। তার নিজের হাতে তৈরি কাঁটালতার বরশী তার বুকে বিদ্ধ হয়ে আছে। কাঁটার অলঙ্কারে কেউ যেন তাকে সাজিয়ে রেখেছে। রীতিমত অত্যাচার করে লোকটিকে নৃশংসভাবেই হত্যা করা হয়েছে। মৃত লোকটির শীতে জমাটবাঁধা চেহারায় রীতিমত আতঙ্কের ছাপ। ১৯৪৫ সালে ঠিক এভাবেই চার্লস্‌ ওয়আল্‌টনের মৃতদেহটি আবিষ্কৃত হয়। আর বৃটেনে সম্ভবতঃ ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে ডাইনি হিসাবে অভিযুক্ত-এটাই শেষ বলি।

            গোয়েন্দা বিভাগে তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্ট ফেবিয়ান, যিনি বিখ্যাত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ‘ফেবিয়ান’ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন-বহুদিন এই অপরাধের বিষয়ে অনুসন্ধান চালান, কিন্তু কে যে এমন নির্মম কাজের হোতা এর পেছনে কারণটাই বা কি-তার রহস্য উদঘাটন করা তার মত ঝানু গোয়েন্দার পক্ষে সম্ভবপর হল না। রহস্য রহস্যাবৃতই রয়ে গেল। রোমহর্ষক  এই চরম বর্বরতার স্বাক্ষর হিসেবে এই মৃত্যু জনমনে এক অশরীরি আতঙ্কের সৃষ্টি করল। এর কার্যকারণ নির্ণয়ের নির্ণয়ের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। রহস্য আর উন্মোচিত হলো না।

                  স্থানীয় লোকের কাছে ওয়ালটন একজন নিরীহ গোবেচারা লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার ব্যবহারে মোটামুটি সকলেই সন্তুষ্ট ছিলেন। ইংল্যান্ডের গ্রামে বসবাসকারী লোক যাদের গায়ে এখনও  পুরোপুরি আধুনিকতার বাতাস লাগেনি- ঠিক তাদের মতই ত ছিল তার আচার-আচরণ। তিনি তার ভাইঝিকে নিয়ে ওয়ারউইকশায়ারে  খড়ে ছাওয়া  একটা কুঁড়েঘরে বাস করতেন। আশেপাশের বিভিন্ন খামারে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে আয় করতেন যথেষ্ট। বন্ধু ভাবাপন্ন সহজ সরল পরিশ্রমী লোক ছিলেন তিনি। এই পরিশ্রমের কারণে তার দেহ ও মন উভয়ই সচল থাকে। পরম শান্তিও- যতদূর জানা যায় তাকে ঘিরে ছিল।

               স্থানীয় পানশালায় তাকে ক্বচিৎ কখনো কখনো তাকে দেখা গেলেও তাকে মদের  পরিবর্তে গ্যালন ভর্তি আপেলের রস কিনতে ই দেখা যেত। সেই আপেলের রস বোঝাই গ্লাস নিয়ে বাড়িতে রান্নাঘরের আগুনের পাশে বসে বসে আয়াস করে তা পান করতে তিনি ভালোবাসতেন।  তিনি এমন একজন লোক ছিলেন সকলে যাকে নিজের ভেতরে মগ্ন থাকা বলে তিনি তাই ছিলেন।

           মানুষের সঙ্গ ওয়ালটনকে যতনা  টানতো  গ্রামের প্রকৃতির প্রতি তার টান ছিল অসীম। তিনি একাকী প্রকৃতির আনাচে কানাচে ঘুরে বেরিয়ে গভীর পরিতৃপ্তি পেতেন। তিনি মাঠে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুরে বেড়াতেন। বুনো পাখির সঙ্গে আপন মনে কথা বলতেন। আরো বিস্বয়ের  ব্যাপার এই  যে- তিনি বিশ্বাস করতেন, বনের পাখিরা তার কথা বুঝতে পারে। তাদের মধ্যে যেন একটা সমঝোতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কুকুর  পোষার  দিকে তার কোন দিন তেমন কোন আগ্রহ ছিল না।  কিন্তু তার বাড়ির পিছনে তিনি ব্যাঙের  বংশ বৃদ্ধির সুযোগ করে দিতেন। স্থানীয়ভাবে একটি কাহিনী প্রচলিত ছিল যে ক্ষুদে ক্ষুদে লাঙ্গল যুতে দিয়ে  এই ব্যাঙদের  দিয়ে তিনি মাছ চাষ করাতেন।

               ফেব্রুয়ারী মাসের কোন এক শীতার্ত দিনে সারাদিন কাজের পর ওয়ালটন আর ঘরে ফিরে এলোনা। অনুসন্ধানকারীরা তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ একটি উইলো গাছের তলায় আবিষ্কার করল।  এই নিষ্ঠুর ও মর্মন্ততদ মৃত্যুর উপর ভিত্তি করে ডোনাল্‌ড্‌  ম্যাককর্মিক  একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি দাবী  করেন যে এই হত্যাকারী সম্বন্ধে তিনি ভালই ধারণা করতে পারেন এবং ফেবিয়ানও  অনুরূপ  দাবি করেছিলেন ।

         কিন্তু এই হত্যার বিরুদ্ধে কোনো রকম সাক্ষী-প্রমাণ উপস্থিত করা সম্ভব হলো না। এ মৃত্যু চিরদিনের জন্য রহস্যবৃত হয়েই রইলো। কেবল ওয়ালটনের পাখ-পাখালির সঙ্গে আলাপচারিতা , ব্যাঙ  দিয়ে হালচাষ,  ভৌতিক ফিসফাস কথা-বার্তার গল্পগুলো এ কথাই রটাতে  থাকে যে, যেহেতু সে একজন ডাইনি ছিল -সে কারণেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।