১৮৯২ সালে ফ্রিৎজ কাপের স্টুডিওতে তোলা আকাশচারী পার্ক ভান তাসেল এবং জিনেট ভান তাসেল এর আলোকচিত্র, ১৮৮৯ সালে প্রচারিত পার্ক ভান তাসেলের বেলুন প্রদর্শনীর একটি বিজ্ঞাপন, দি ইলাস্ট্রেটেড লণ্ডন নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত জিনেট ভান তাসেলের দুর্ঘটনা ও মৃত্যু্র সংবাদ।
পূর্বকথাঃ উনবিংশ শতকের শেষ এবং বিংশ শতকের শুরুর ঢাকা কেমন ছিল? ঢাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ কারা ছিলেন? কেমন ছিলেন তারা দেখতে? নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবন, বিনোদনের ব্যবস্থাই বা কেমন ছিল? এসবের উত্তর যদি আলোকচিত্রের মাধ্যমে জানতে চাই তাহলে একটিমাত্র নামই বার বার ঘুরে ফিরে আসবে- ফ্রিৎজ কাপ। জার্মান এই ভদ্রলোকের স্টুডিও ছিল কলকাতা আর দার্জিলিং এ। নবাব খাজা আহসানউল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় ফটোগ্রাফির সেই দুর্লভ যুগে ঢাকার ৮ নম্বর, ওয়াইজঘাট সড়কে কাপ গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব স্টুডিও।
স্টুডিওটির বিজ্ঞাপনে ফ্রিৎজ কাপ নিজেকে “Travelling photographer” হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে এই স্টুডিওর ফটোগ্রাফি সীমিত ছিল মূলত ঢাকাস্থ য়ুরোপীয় অধিবাসী আর স্থানীয় জমিদার/ অবস্থাপন্ন পরিবারের ভেতরে। ঢাকার নবাবের পারিবারিক ফটোগ্রাফার হওয়ার সুবাদে ফ্রিৎজ কাপ আহসান মঞ্জিল ও এর অধিবাসীদের প্রচুর ছবি যেমন তুলেছেন তেমনি এ অঞ্চলের বহু গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান এবং ঘটনাও তাঁর ক্যামেরাবন্দী করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- লর্ড কার্জনের ঢাকা আগমন, বঙ্গভঙ্গ ও এর রদ, ১৮৯৭ এর ভূমিকম্প, আসাম-বেঙ্গল রেললাইন স্থাপন ইত্যাদি।
খাজা আহসানউল্লাহর সাথে ফ্রিৎজ কাপের পরিচয় তাঁর নবাব হওয়ারও কয়েকবছর আগে, ১৮৮৯ সালে, কলকাতায়। খাজা আহসানউল্লাহ তখন কলকাতাকেন্দ্রিক ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইণ্ডিয়ার পরিচালকমণ্ডলীর মধ্যে একমাত্র ভারতীয়। ২৯, চৌরঙ্গী রোডে অবস্থিত ফ্রিৎজ কাপের স্টুডিও ‘মেসার্স এফ কাপ এণ্ড কোম্পানি’র সৌজন্যে সোসাইটি তখন বিনা ভাড়ায় এর দু’টি কক্ষ ব্যবহার করত। সেই থেকেই ফ্রিৎজ কাপের সখ্যতা গড়ে উঠে খাজা আহসানউল্লাহ এবং পুত্র খাজা সলিমুল্লাহর সাথে। ফ্রিৎজ কাপ ছিলেন উদ্যমী এক ফটোগ্রাফার। ফটোগ্রাফির সেই প্রাথমিক যুগেই তিনি ছবি তোলা নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করতে ভালবাসতেন। যেমন ১৮৯০ এর এক বিকালে তিনি মিস্টার পার্সিভাল স্পেন্সারের সাথে বেলুনে চেপে উড়ে গেলেন কয়েক হাজার ফিট উপরে,নিজ ক্যামেরায় প্রথমবারের মতন ধারন করলেন কলকাতার কিছু এরিয়াল ভিউ।
১৮৯২ সালের এক বিকেলে ফ্রিৎজ কাপের স্টুডিও ‘এফ কাপ এণ্ড কোম্পানি’তে উপস্থিত হলেন মার্কিন এক আকাশচারী পার্ক ভান তাসেল এবং সঙ্গে জিনেট ভান তাসেল। দু’জনই স্পেন্সারের পূর্বপরিচিত এবং সেই সূত্রেই এই স্টুডিওতে আসা। ছবি তোলার পাশাপাশি টুকটাক কথাবার্তায় জানা গেলো যে তারা গোটা ভারত জুড়ে বেলুনের খেলা দেখিয়ে তখন কলকাতায় এসেছেন।পার্কের খেলা দেখানোর শুরু মাত্র ৩০ বছর বয়সে। তবে এখন শরীর ভারী হয়ে যাওয়াতে বেলুনে বা প্যারাসুটে চড়া মুশকিল, তাই স্ত্রী জিনেটই খেলা দেখায়। কাছাকাছি আর কোনো প্রদর্শনীর সুযোগ না থাকলে দেশে ফিরে যাবেন। ফ্রিৎজ কাপ তাদের জানালেন ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহর কথা। খাজা আহসানউল্লাহ সেবছরই জানুয়ারি মাসে নবাব বাহাদুর উপাধি পেয়েছেন। নগরবাসীকে নিয়ে তিনি সেই খেতাব উদযাপনের জন্য তখন উন্মুখ। প্রায়শই নানাবিধ উৎসব আয়োজন তখন চলছে ঢাকাজুড়ে। ফ্রিৎজ কাপের পরামর্শে পার্ক ভান তাসেলকেই ১০০০০টাকার বিনিময়ে ঢাকায় বেলুনের খেলা দেখানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ করলেন নবাব আহসানউল্লাহ। ঠিক হল সে বছর মার্চ মাসের ১৬ তারিখ বিকেলে আহসান মঞ্জিলের সামনের মাঠে খেলা দেখানো হবে। বেলুনে চেপে উপর উঠবার পর প্যারাসুটে চড়ে লাফিয়ে পড়বেন জিনেট ভান তাসেল।
শ্বেতাঙ্গ রমণীর বেলুন থেকে লাফিয়ে পড়বার সংবাদ বেশ কয়েকদিন ধরে ঢাকাবাসীর মধ্যে ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হল। ১৬ই মার্চ বিকেলে নবাববাড়ি ও বাকল্যান্ড বাঁধ এলাকায় বিপুল লোক জমায়েত হল। তবে বাড়ির মহিলাদের বিনোদনের জন্য নবাব পূর্বে করা চুক্তির সাথে নতুন একটা অনুরোধ জুড়ে দিলেন – জিনেট যদি প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে নবাববাড়ির ছাদের উপর নামতে পারেন তাহলে তাকে অতিরিক্ত ৫০০০টাকা দেয়া হবে। পার্ক ভান তাসেল বেলুন উড়ানোর জন্য বুড়িগঙ্গার অপরপারকে বেছে নিলেন। যথাসময়ে বেলুন ফুলে পেছনের গ্রামগুলো ঢেকে দিল। বেলুন উড়ে চলল জিনেটকে নিয়ে বহু উপরে। প্রায় ৬০০০ফুট উপরে উঠবার পরে জিনেট প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে পড়লেন, কিন্তু মুশকিল হল প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাসে সেই প্যারাসুট ছিটকে গিয়ে আটকে গেলো নবাববাড়ি থেকে বহুদূরে শাহবাগের এক শিরিষগাছে। স্থানীয় ইংরেজ পুলিশ অফিসার তার বাহিনী নিয়ে উদ্ধারে গেলেন। বাঁশ এগিয়ে দিলেন জিনেটের নীচে নেমে আসার জন্য, কিন্তু নামবার সময় বাঁশের বাঁধন খুলে যাওয়ায় ১৫ফুট উপর থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন জিনেট। মেরুদণ্ডে তীব্র আঘাতে তিন দিন জ্বরে কাতরে ১৮ তারিখ মারা গেলেন জিনেট। নারিন্দার খ্রিস্টান গোরস্থানে তিনি সমাধিস্থ হন।
পুনশ্চঃ সে’বার পার্ক ভান তাসেল ফিরে গেলেন নিজ দেশে। এরপরেও আরো অনেক বছর তার বেলুনের খেলা দেখানোর ব্যবসা চালু ছিল। ১৯১০ সালেও তার খেলা দেখানোর রেকর্ড পাওয়া যায়। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে ব্যবসার খাতিরেই তিনি বিভিন্ন অল্পবয়সী মেয়েকে নিজ দলে ভাড়া করে নামের শেষে ‘ভান তাসেল’ যোগ করে দিতেন আর তাদের নিজ স্ত্রী, বোন, কন্যা বলে প্রচার করতেন। সে সকল রমণীর অধিকাংশেরই আসল পরিচয় হারিয়ে গেছে। জিনেট ভান তাসেলের আসল নাম অবশ্য পাওয়া গেছে- জিনেট রুমারি।
সহায়ক গ্রন্থঃ
১. ছবি তোলা বাঙালির ফটোগ্রাফি চর্চা- সিদ্ধার্থ ঘোষ, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮৮
২. ঢাকার নওয়াব পরিবারের ডায়েরি (১৭৩০-১৯০৩)- অনুপম হায়াৎ, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি, ২০১৮
৩. Art of India: Prehistory to the Present- Frederick M. Asher, 2002
৪. ঢাকার প্রথম আকাশচারী ভান তাসেল- শামীম আমিনুর রহমান, ২০০০।