পূর্বকথাঃ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আরমানিটোলার মহল্লা আলে আবু সাঈদে তখন এক প্রভাবশালী জমিদারের বাস, নাম- মীর্জা গোলাম পীর। দাদা মীর আবু সাঈদ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা যুগে তুরস্ক থেকে এসে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। মীর্জা গোলাম পীরের আরেক নাম মীর্জা আহমেদ জান। তবে ঢাকাবাসীর কাছে তিনি মীর্জা সাহেব নামেই পরিচিত। ত্রিপুরা আর বাকেরগঞ্জে তাঁর বিশাল জমিদারি আর সেই জমিদারি আয়ের অধিকাংশ তখন তিনি ব্যয় করতেন ঢাকাবাসীর জন্য। দু-চারটি উদাহরন দেয়া যায়- মহানবী (সাঃ) এর সম্মানে প্রতি রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম বারোদিন নিজ তদারকিতে বিশাল বিশাল হাড়িতে রান্না করা পোলাউ, কোরমা তিনি পাঠিয়ে দিতেন ঢাকার সকল মহল্লায়। ঢাকাবাসী বছরের একয়টি দিন ভালমন্দ খেতে পেয়ে তৃপ্ত থাকতো, একটা উৎসবের আমেজ বিরাজ করত সবদিকে। প্রতি বছরই মহররম মাসের প্রথম দশদিন তিনি ঢাকার দুস্থলোকজনের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতেন। বেগমবাজারের করতলব খান মসজিদ নিজে অর্থে সংস্কারের পাশাপাশি ঢাকার মুসল্লীদের জন্য গড়ে তুলেছিলেন নতুন দু’টি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ- একটি বুড়িগঙ্গার তীরে নলগোলায়, অপরটি আরমানিটোলায়। আরমানিটোলার মসজিদটি মীর্জা সাহেবের মসজিদ নামে স্থানীয়দের কাছে পরিচিতি পায়।

তারা মসজিদ বারান্দা

মীর্জা গোলাম পীরের মৃত্যুর  প্রায় সাত দশক পরে আদিতে সাদামাটা আরমানিটোলার সেই মসজিদের সংস্কার ও অলংকরনের দায়িত্ব নেন মাহুতটুলির এক ব্যবসায়ী, নাম- আলীজান ব্যাপারী। সাবান আর তামাকের ব্যবসা ছিল তাঁর, ছিলেন মহল্লা সর্দারও। তাঁর এক ডাকে সাড়া দিয়ে হাজির হত গোটা মহল্লার লোক।  কিন্তু জীবন যাপনে ছিলেন একদমই সাদাসিধে। তাঁর পরনে থাকত লুংগি, পাঞ্জাবি, মাথায় গোল কাপড়ের টুপি আর পায়ে পাম্প-সু। এই আলীজান ব্যাপারীই পুরানো সেই মসজিদকে নতুন করে তুললেন। মসজিদের পূর্বদিকে পাঁচ খিলানের এক বারান্দা যোগ করে মুসল্লী ধারন ক্ষমতা দ্বিগুণ করলেন। আর এরপর শুরু করলেন ‘চিনি টিকরি’র কাজ।

১৯৩০ এর দশকে ‘চিনি টিকরি’র কাজ খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। প্রচুর টাকাকড়ি খরচ করে তিনি জাপানি আর বিলেতি নক্সা করা চীনামাটির টালি আনালেন। মসজিদের পাশে স্তুপ করে রাখা সেসব টুকরার বেশীরভাগই সাদা, মাঝে মাঝে কিছু নীল আর সবুজও ছিল। দু’জন অভিজ্ঞ ওস্তাগার মাসের পর মাস সময় নিয়ে টুকরোগুলো প্রয়োজনমত কেটে মসজিদের গায়ে ফুটিয়ে তুলতে থাকলেন লতা, পাতা, ফুল আর চাদঁ-তারা। প্রথম শেষ করলেন গম্বুজের কাজ; এরপর কাজ ধরলেন নীচের ভাগে। তারার সার্বজনীন ব্যবহারে মসজিদের রূপটাই পালটে গেল, সাথে নামটাও। ঢাকাবাসীর কাছে মীর্জা সাহেবের মসজিদের নতুন নাম হল- তারা মসজিদ।

১৯৭২ সালের আলোকচিত্রে ঢাকার ঐতিহাসিক তারা মসজিদ, আলোকচিত্রীঃ হুবার্ট লিঙ্ক

তারা মসজিদের সেই অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে কবি শামসুর রাহমানের অসাধারণ স্মৃতিচারণ এখানে উল্লেখ করছি- “…সে কী রূপ! কতদিন মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকেছি ওর গম্বুজের দিকে। সূয্যিমামা অন্ধকার গুহায় লুকানোর আগে তাঁর শেষ হাসিটুকু যখন ঝরিয়ে দিতেন সিতারা মসজিদের গম্বুজে, তখন মনে হতো গম্বুজগুলো যেন মস্ত পাখি, সোনালি নদীতে নেয়ে উঠেছে, এক্ষুণি পাখা মেলে উড়তে শুরু করবে আবার। কখনো-কখনো আবার এক ঝাঁক কবুতর এসে বসতো মসজিদের গম্বুজে। শাদা, কালো, খয়েরী, ধূসর- কত রঙের পায়রা। গম্বুজে গম্বুজে ছড়ানো। গোধূলির জবাফুলের মতো আলো, কবুতরের ঝলসানি, মসজিদের তারা- এই সবকিছু কেমন ঘোর লাগিয়ে দিত চোখে।“