এটা সেই দিনের কথা যখন আমি খুব ছোট ছিলাম। কিন্তু আমার মনে আছে, আমি কারো অপেক্ষায় ছিলাম। এই সময় পশ্চিম দিক থেকে তিনটে ঘোড়ায় চেপে তিন জন আসলো। জানি না! কিসের অপেক্ষায় আমার ও মন সেদিন অস্থির হয়ে ছিল। শুধু মনে হতো, লাসা  ( তিব্বতের রাজধানী) আমায় ডাকছে।বাবা মা আমাকে নিয়ে তখন খেতে বসেছিল। হঠাৎ করে দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। বাবা দরজা খুললে তিন জন আগুন্তক ঘরে ঢুকলো। বাবা বললেন ওরা লাসায় যাচ্ছে , আজ রাত টা এখানে থাকবে। আমাদের এলাকা থেকে লাসা ছিল অনেক দূরে। পথিমধ্যে অনেক অচেনা মানুষ এরকম আশ্রয় নিয়েই থাকে। এটা কোন আশ্চর্য ব্যাপার না। কিন্তু অবাক করার বিষয় , তাদেরকে আমার খুব আপন মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কত কালের চেনা এরা আমার।তার মধ্যে একজনের গলায় একটি মালা দেখে মনে হলো ,এতো আমার মালা।

মহাযান বৌদ্ধ ত্রিমূর্তি – বোধিসত্ত্ব মৈত্রেয়, বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী, গান্ধার। Source: commons.wikimedia.org

তার কাছে চাইলাম । চাইতে ই উনি মামলাটি দিয়ে দিলেন। তার আগে বলতে বললেন তিনি কে। আমার মুখ দিয়ে আনমনে বেরিয়ে গেল,সেরা লামা। আমি কিভাবে ওনাকে চিনলাম আমি নিজেও মনে করতে পারি না।পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা ঘরে গিয়ে দেখি  একটি টেবিলের উপর অনেক কিছু রাখা আছে। তার মধ্যে কিছু কিছু জিনিস আমার পরিচিত লাগলো। যেগুলো আমার কাছে পরিচিত লাগলো, সেইগুলো ঐ তিন ব্যক্তি এর ভিতর,যার সাথে আমি কাল কথা বলেছিলাম , তার হাতে দিলাম। ঐ গুলো নেবার পর,উপস্থিত সবাই আমাকে প্রণাম করলো। পরে জানলাম যেগুলো আমি তাদের হাতে দিয়েছি, সেগুলো সবকিছু ত্রয়োদশতম দালাইলামার ছিল।সেরা লামা মূলত দালাইলামার

সম্রাট আটলান খানের সাথে দালাইলামা; Source: wikimedia.org

পুণর্জন্ম  কে খুঁজতে এখানে এসেছিল। এবং বলা হলো আমি ই নাকি সেই পুনঃ আবির্ভাব। ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্রের মতো মহাসমারোহে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো । মনে হলো আমি একাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।দালাইলামার প্রথাটি শুরু হয়েছিল ৭০০ বছর আগে থেকে।দালাইলামা অর্থাৎ জ্ঞানের সমুদ্র পদবি টা ১৫৭৫ সালে মুঘল নেতা আলতাই খান প্রথমে দেন।দালাইলামা অর্থাৎ জ্ঞানের সমুদ্র পদবি টা ১৫৭৮ সালে মুঘল নেতা আলতান খান প্রথমে দেন।এই সময় আলতান খান ও তার পুরো সম্প্রদায় বুদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। তার বুদ্ধ ধর্মের জ্ঞান লাভের বিনিময়ে , পুরো তিব্বতের সুরক্ষার দায়িত্ব নেন।এবং এই পদবি তৃতীয় দালাইলামা সোনাম গিয়াৎস কে দেন। সেই থেকে অবলোকিতেশ্বর এর রূপে দালাইলামাকে তিব্বতের বুদ্ধ ধর্মের মধ্যমনি বলা হয়।

ত্রয়োদশ দালাইলামা থুবতেন গিয়াৎসো

লাসাতে বিশাল রাজপ্রাসাদ আর হাজার লোকের মধ্যে আমি একা হয়ে গেছিলাম। মায়ের কথা ,আমাডো এর কথা আমার খুব মনে পড়ত। আমার লামা     হওয়ার কোন ইচ্ছা তখন ছিল না। তবে বুদ্ধ ধর্মের কাহিনী গুলো আমার খুব ভালো লাগতো। কিভাবে গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর ১১০০ বছর পর । বুদ্ধ ধর্ম ভারত থেকে তিব্বতে চলে আসলো শুনতেই অবাক লাগতো।ধর্ম শাস্ত্র ছাড়া ভুগোল, জোতির্বিদ্যা, দর্শন শাস্ত্র, বিজ্ঞান সহ অনেক কিছু আমাকে পড়াতে লাগলো। আমি আস্তে আস্তে সব বুঝলাম এবং বদলাতে শুরু করলাম।এতো বলা হলো চতুর্দশ দালাইলামার নিজস্ব বিবরণ। আমরা কি জানি! দালাইলামা কে খোঁজার জন্য তিব্বত থেকে সুদূর আমাডো জেলায় মঠের লোকেরা কিভাবে পৌঁছালো! চলুন চলে তাই, সেই গল্পে।

রহস্যময় ‘লামও-লা-সো’ সরোবরের; Source: pinterest.com

তিব্বতের বৌদ্ধধর্ম এর মহাযান পন্থীরা বোধিসত্ত্ব মতবাদে বিশ্বাস করে অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস সাধু বা সন্ন্যাসী জগতের মুক্তির জন্য বারবার জন্ম গ্রহণ করবেন।১৯০০ শতাব্দী অবধি  ত্রয়োদশতম দালাইলামা ছিলেন। তার মৃত্যুর পরপরই চতুর্দশ তম দালাইলামা খোঁজার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ত্রয়োদশতম দালাইলামা মৃত্যুর পুর্বে তার পরবর্তী জন্মের  ব্যাপারে কিছু ইঙ্গিত দিয়ে যান। যেমন মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে  তীব্বতী দের ঐতিহ্য  ছিল,  মৃত দেহ কে দক্ষিণ দিকে মুখ করে রাখা। ত্রয়োদশতম দালাইলামার মুখ ও দক্ষিণ দিক করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু একদিন সকালবেলা দেখা গেল তার মুখ পুর্বে ঘুরে গেছে। বিষয়টি বোঝার জন্য একটি যজ্ঞের আয়োজন করল তারা।তার মাধ্যমে উত্তর – পুর্ব দিকে কোথাও পরবর্তী দালাইলামার পূণর্জন্ম এর ইরশাদ পেল।তবে এর কোনো আমল তারা পরের দুই বছর এও পেল না। তবু ও হাল না ছেড়ে প্রধান লামা ভবিষ্যত জানার জন্য আরও ও সংকেত পাবার আশায় শত শত কিলোমিটার দূরে পবিত্র হ্রদ লাটস ই  তে জান।

 

টাকসার গ্রাম

তিব্বতি দের বিশ্বাস ছিল এই হ্রদের স্বচ্ছ পানিতে ভবিষ্যত দেখা যায়।লামা সেখানে ধ্যান করে একটি স্বর্ণ খচিত মঠ আর চৈনিক ধাঁচের খামার বাড়ি দেখতে পান। অর্থাৎ আমার বাড়ি।এই পুরো দৃশ্যপটে তিনি দেখতে পান আ কা মা লেখাটি। যাই হোক ,এর পরেই লামারা ১৯৩৭ সাল  থেকেই বিভিন্ন অভিযাত্রি দলে বিভক্ত হয়ে  আমার খোঁজ এ বের  হয়ে পড়েন।প্রতিটা দলের সাথেই দেয়া হয় পূর্ববর্তী দালাইলামার ব্যবহার করা কিছু জিনিসপত্র। অবশেষে তারা তিব্বত ছাড়িয়ে হাজার মাইল দূরে আমার গ্রাম চীনের আমাডো  এর কাছে একটি স্বর্ণ খচিত তিন তলা বিশিষ্ট মঠ দেখতে পান। তার কাছে ই ছিল আমার বাসা।

 

টাকসারের এই বাড়ীতে জন্ম গ্রহন করেন চর্তুদশ দালাইলামা

স্থানীয় লোকজনের কাছে তারা জানতে পারে যে তীব্র শীতের রাতে আমি জন্মেছিলাম , সে রাতে নাকি ঘরটি আলোকিত হঠাৎ করেই আলোকিত  হয়ে পড়ে। ব্যস,  পুরো দৃশ্যপটের সাথে তাদের লামার ঐশী নির্দেশনা যেমন মিলে গিয়ে তারা যেমন সচেতন হন। তেমন গ্রামের মানুষের কাছে এমন ঘটনা শুনে তারা নিশ্চিত হোন। পরের দিন অভিযাত্রি এর ছদ্মবেশে আসেন আমার বাসায়। আমি ও কেমন যানি অপেক্ষায়  ছিলাম তাদের জন্যে। তার পরের ঘটনা গুলো শুরুতেই বলেছি আমি। কিভাবে আমাকে যাচাই করা হলো। কিভাবে আমি নির্বাচিত হলাম পুরো বিশ্বের চতুর্দশ তম দালাইলামা রুপে।

 

ভারপ্রাপ্ত দালাইলামা ছিলেন তিব্বতের সুবিখ্যাত এবং ঐতিহাসিক রিটিং মঠের লামা রিটিং রিনপচে

বর্তমান এ দালাইলামার বয়স ৮৪ বছর। ৯০ বছর বয়সে তিনি জানাবেন। তিনি পুণরায় জন্মগ্রহণ করবেন কি করবেন না। তার পরবর্তী জন্ম সংক্রান্ত আলোচনা ছাড়াও তার ঘটনাময় জীবন নিয়ে নানা দিক দিয়ে জ্ঞান লাভ করলেও প্রতিটা শিক্ষিত মানুষ উপকৃত হবে আশা করি।

 

চর্তুদশ দালাইলামা তেনজিন গিয়াৎসু

 

তথ্যসূত্রঃ
১. www.somewhereinblog.net