আধুনিকতায় গা ভাসিয়ে বা বলতে পারি অত্যাধুনিকতার ফিরিস্তি তুলে হয়ত অনেক কিছু ভুলে থাকা/রাখা যায়, তবে শিখড়ের বন্ধন বলে মানব সমাজে যে চরম সত্য আছে সেটাকে মনে হয় জোর করে কৃত্রিমতায় ঢেকে, বাছ-বিচারের মাত্রায় রেখে, সামনে এগিয়ে যাওয়াটা অনেকক্ষেত্রেই বোধহয় সম্ভব হয় না। সম্ভব-অসম্ভব অবশ্য নির্ভর করে দেশ-কালের সমাজ-সংস্কৃতি দ্বারা। এক পৃথিবীর দুইভাগ অর্থাৎ পূর্ব-পশ্চিমের রেষারেষি-ঘেঁষাঘেঁষি’র কথা পৃথিবী আগে শুনে নি। আর আমরাও এক পৃথিবীর সন্তান হিসেবে এরকম বিভাজনের সম্মুখীন আগে হইনি। বর্তমানে সভ্যতার-ভব্যতার কথা বলে পৃথিবীর শ্রেণিবিভাজন-বর্ণবিভাজন-অর্থবিভাজন দ্বারা একের বিরুদ্ধে অন্যকে লাগিয়ে দিয়ে, লেলিয়ে দিয়ে, মারামারি-হানাহানি’র অতিক্ষুদ্র কারণকে উস্কে দিয়ে, ফায়দা লুটছে কতিপয় মানব নামে হুজুগে আছন্ন, সুযোগে ধূর্ত, দুর্যোগে সুবিধা হাসিলকারী আর নিয়মকে পাশ কাটিয়ে, অনিয়মের প্রবর্তনকারী মানব সমাজের শত্রু যারা আবার সমাজ-রাষ্ট্রের হর্তা-কর্তা-বিধাতা আর তাদের সার্বক্ষণিক সহায়তাকারী কিছু চেলা-চামুণ্ডাদের ষড়যন্ত্রে মানব জীবন অতিষ্ঠ, জীবন নিগৃহীত, জীবন নিষ্পেষিত। তারপরও বেঁছে থাকতে হয়, বেঁচে থাকার অদম্য বাসনা-কামনায় জরা-জীর্ণকে আগলে জীবনকে সামনে চালিয়ে নিতে হয়।  চাওয়া-পাওয়ায় হয়ত সামঞ্জস্যতা অনেকক্ষেত্রেই হয় না তবে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার আশাতেই মানুষ তার লালিত স্বপ্নের কাছাকাছি যেতে চায়। আর সেই আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের জন্যেই মানুষ বর্তমান দুঃখকষ্টকে মেনে নেয় ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়ার নিমিত্তে।

সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তরে একেকটি বিশেষ ঘটনা, বিশেষ ব্যক্তি তথা চরিত্রের সাক্ষাতকার অনেককিছু যা বর্তমানের সাপেক্ষে অসঙ্গতির আলোকে ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত দেয় আর তাতেই অনাগত কাল কোন দিকে তার গতি বদলাবে সেটা জানান দেয়। খানিকটা প্রকাশ্য, খানিকটা অপ্রকাশ্য বা প্রত্যক্ষের প্রতিতুলনায় পরোক্ষে যার অবস্থিতি তা অনেকের দৃষ্টিগোচর হলেও কেবল কতিপয় সেটাকে হেলাফেলা করার আপাত কোনো বিরুদ্ধ মত গ্রহণ করে না, আবার সেটাকে সরাসরি বাতিল করারও সাহস দেখায় না। অনেকদিনের শোক-তাপ যখন পুঞ্জিভূত হয়ে সমাজ কর্তৃক বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করে তখন সেটাকে আর জোরজবরদস্তির ভেড়াজালে বেঁধে রেখে বিকল্প কোনো পথের সন্ধান পাওয়াটা আপাতত দূরুহ হয়ে দাঁড়ায়। নিগৃহীতের অভিযোগ, তার সার্বিক অভাব-অনটনের তীব্রতা যখন চরমসীমা’র প্রত্যয়ন পায় তখন বিভিন্ন কল্পিত মধ্যস্থতাকারী’র সমাবেশ দেখা যায় যথোপযুক্ত সুরাহা করার জন্য। আর তাতেও যদি কাজ না হয় তখন শেষ চেষ্টা হিসেবে  হয় একেবারে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উড়িয়ে সবকিছুর কব্জাকারীকে উৎখাত করা, নয়ত নিজ জীবনকে ঐ রণের মাঠে উৎসর্গ করা। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যদি নেহাতই বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত হয় তখন আর উপরের গুলো বোধহয় ধোপে টেকে না।

সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তরে একেকটি বিশেষ ঘটনা, বিশেষ ব্যক্তি তথা চরিত্রের সাক্ষাতকার অনেককিছু যা বর্তমানের সাপেক্ষে অসঙ্গতির আলোকে ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত দেয় আর তাতেই অনাগত কাল কোন দিকে তার গতি বদলাবে সেটা জানান দেয়। খানিকটা প্রকাশ্য, খানিকটা অপ্রকাশ্য বা প্রত্যক্ষের প্রতিতুলনায় পরোক্ষে যার অবস্থিতি তা অনেকের দৃষ্টিগোচর হলেও কেবল কতিপয় সেটাকে হেলাফেলা করার আপাত কোনো বিরুদ্ধ মত গ্রহণ করে না, আবার সেটাকে সরাসরি বাতিল করারও সাহস দেখায় না। অনেকদিনের শোক-তাপ যখন পুঞ্জিভূত হয়ে সমাজ কর্তৃক বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করে তখন সেটাকে আর জোরজবরদস্তির ভেড়াজালে বেঁধে রেখে বিকল্প কোনো পথের সন্ধান পাওয়াটা আপাতত দূরুহ হয়ে দাঁড়ায়। নিগৃহীতের অভিযোগ, তার সার্বিক অভাব-অনটনের তীব্রতা যখন চরমসীমা’র প্রত্যয়ন পায় তখন বিভিন্ন কল্পিত মধ্যস্থতাকারী’র সমাবেশ দেখা যায় যথোপযুক্ত সুরাহা করার জন্য। আর তাতেও যদি কাজ না হয় তখন শেষ চেষ্টা হিসেবে হয় একেবারে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উড়িয়ে সবকিছুর কব্জাকারীকে উৎখাত করা, নয়ত নিজ জীবনকে ঐ রণের মাঠে উৎসর্গ করা। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যদি নেহাতই বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত হয় তখন আর উপরের গুলো বোধহয় ধোপে টেকে না।

সমাজ-সভ্যতাকে নির্মাণ-বিনির্মাণের কারিগর হিসেবে পরিচিত যারা, যাদের ত্যাগ-তিতিক্ষায় একটি সমাজ, একটি রাষ্ট্র তথা বিশ্বব্যবস্থা আলোকিত হয়, ব্যক্তিবিশেষের সার্বিক কল্যাণ হলেও যে সবসময়ই মূলস্রোত থেকে বিছিন্ন থেকে যায়, যার অবদান খুব কমই মানুষের মুখে প্রচারিত হয়, যাকে প্রত্যহ অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয় তিনি হলেন আমাদের শিক্ষক তথা বৃহত্তর অর্থে আমাদের শিক্ষক সমাজ। শিক্ষকের প্রতি সম্মান পৃথিবীর সব জায়গায়, সব সমাজে স্বীকৃত হয়েছে বটে তবে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির হিসেব করতে গেলে হতাশায় পতিত হতে হয়। জগতের আলোক বর্তিকা যার হাতে সমুজ্জ্বিত হয়, বাস্তবতার নিরিখে তার ঘরেই একটু কেরোসিনের অভাব থাকার কারণে কখনোসখনো আলো জ্বলে উঠে না। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে মুখস্থ  উপাধী সর্বদা প্রাপ্ত হলেও, যৎসামান্য সাহায্যের হাত কেউ ঘুণাক্ষরেও বাড়িয়ে দেয় না। কথায় কথায় শিক্ষকগুর’র মর্যাদার রঙে-চঙে কথার অবতারণা করলেও, সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর সেটা আর বেশিদিন স্থায়ী হয় না। শিক্ষক সবার পিতারুপে স্মরিত-বরিত হলেও, তাদের ভাই অর্থাৎ শিক্ষকের আপন সন্তানকে মরতে হয় বিনাচিকিৎসায় রোগে ভুগে। শিক্ষকের নিকট হতে শিক্ষার প্রেক্ষিতে উচ্চতর অবস্থায় পৌছা গেলেও, শিক্ষককে থাকতে হয় সেই জীর্ণ-শীর্ণ পর্ণকুটিরে। শিষ্যরা আধুনিক অশন-বসন-ভূষণের অভিযোজনে অভিযোজিত হলেও, গুরু তথা শিক্ষককে সেই ছেঁড়া-ছিন্ন কাপড়েই থাকতে হয়।  হাত ভর্তি অর্থ নিয়ে, বড় শপিংমল থেকে অনেককিছু কিনে টিপস হিসেবে রক্ষককে যা দেওয়া হয়, তার সমপরিমাণ পেলে শিক্ষকের মাস কাভার হয়ে যায়! অনেক টাকায় বিলাসবহুল জিনিস ক্রয় করে আরামসে জীবন যাপন করা যায়, অথচ শিক্ষককে কিঞ্চিৎ পরিমাণ টাকা সম্বল হিসেবে বাজার সওদা করতে গিয়ে হরহামেশাই দ্বিধা-ধন্দ্বে পড়তে হয় প্রয়োজন অনুযায়ী কোনটা আগে কিনবে তার ফায়সালা করার জন্য! মানুষের মিষ্টি মিষ্টি কথায় বিস্তর সম্মান পাওয়া গেলেও, করুণ-নিষ্ঠুর পৃথিবীর দ্বার অনেকসময় শিক্ষকের জন্য খোলা থাকে না। পূজো-পার্বণে, ইদ-উৎসবে সবার বাড়িতে জম্পেশ রান্নাবান্নার আয়োজন থাকলেও শিক্ষকের বাড়িতে আয়োজন মাত্র যৎসামান্য! নিজের জন্য ভালো কাপড়-চোপড়ের বালাই থাকে না, স্ত্রী-সন্তানের দাবির পূরণ হয় না, অসুখে চিকিৎসার সংস্থান হয় না  আর সর্বশেষে নির্জীব-নিষ্পাণ এই পৃথিবীর বুকে অপ্রকাশিত অভিযোগ রেখে, বিদায় নেয় অনেকটা সাধারণের অগোচরে। শেষ বিদায়ের প্রাক্ষালে তথাকথিত সুশীলদের আগমন হয় একটা পুষ্পস্তবক নিয়ে, একটু সস্তামার্কা স্মৃতিচারণ করে, শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি শুকনো সমবেদনা প্রকাশ করে তাড়াতাড়ি সে স্থান ত্যাগ করে! পড়ে থাকে শিক্ষকের দেওয়া উপদেশ, পড়ে থাকে শিক্ষকের পরিবারের প্রতি দেখভালের ব্যাপারটি। স্বর্গ-নরকের হিসেব-নিকেশ তখনকার মতো হয় কিনা জানি না, তবে পরপার থেকে সদ্য বিদায় নেওয়া শিক্ষক নামে ব্যক্তিটি আমাদের মানবতার, মানবিকতার আর মনুষ্যত্বের প্রতি একপ্রকার উপহাসের অভিশাপের বাণ ছুঁড়ে দেন  তা আপাত দৃষ্টিগোচর না হলেও পরবর্তী প্রজন্ম হাড়ে হাড়ে টের পায়। সমাজ যখন তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, সিস্টেম বা ব্যবস্থা যখন মূলস্রোতে বাহিত না হয়, তখন সমাজের অধিবাসী হিসেবে আমাদের যে সমূহ ধ্বংসের অশুভ ইঙ্গিত দরজায় কড়া নাড়ছে তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যে সমাজ, যে জাতি তার আপন লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে দৃঢ়ভাবে সকল প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়েছে তথা বর্তমানে যারা উন্নত সভ্যতার দাবিদার তাদের ইতিহাস ঘাটলে শিক্ষকের প্রতি সম্মাননার বিশেষ দিকটি খুব সহজেই চোখে পড়বে। অন্যদিকে, বেতাল হয়ে যারা তার উল্টোটা করেছে তাদের ভাগ্য এখনো সেই কণ্টকাকীর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। তাদের লক্ষ্য আছে, তবে সে লক্ষ্য পৌছার মতো ক্ষমতা নেই। তাদের সমূহ সম্ভাবনা আছে তবে সেটাকে যথোপযুক্ত ও যৌক্তিকভাবে ব্যবহারের কোনো সঠিক দিক-নির্দেশনা নেই। তাই তারা অধঃপতিত, তাই তারা নিমজ্জিত আর সর্বপরী তারা বিধ্বস্ত জাতি হিসেবে, সম্প্রদায় হিসেবে আর সামাজিক প্রাণী হিসেবেও বটে।

‘কোথাও কোনো রোমান্স নেই, খাটি বাস্তবতা, এই বাংলাদেশের কথা’ তালেব মাষ্টার কবিতার শেষ লাইন যদিও এটা তবে বাস্তবতার নিরিখে বলা যায় এরকম ঘটনার শেষ বলে কিছু হয় না। আজীবন জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া একজন ব্যক্তিত্ব, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত, ন্যূনতম মানবিক সাহায্য না পাওয়ার অন্তর্নিহিত বেদনা, আকালে ছেলে-মেয়ে হারানো বাবা, একজন কপর্দকহীন স্বামী বা তারও আগে একজন ব্যর্থ সন্তান ইত্যাদী নানা অভিধায় অভিষিক্ত করা যায় তালসোনাপুরের তালেব মাষ্টারকে। কতকিছু চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে অনায়াসে, উন্নতি-প্রমোশন সবার ভাগ্যে সুপ্রসন্ন হচ্ছে, অথচ নিতান্ত বরাত মন্দ শিক্ষার আলোকদিশারী তালেব মাষ্টারের। বারবার নিজের করুণ অবস্থার কথা লেখার জন্য বিভিন্ন জনের উদ্ধৃতি দিয়ে তাগাদা দিচ্ছেন অন্ততপক্ষে তার বর্তমান অবস্থার একটি কাহিনি রচিত হোক। সবারই তো হরহামেশাই হচ্ছে। আজকে যে উপর মহলের কর্তা হয়েছে, আজকে যে সুটেড-বুটেড্ হয়ে আইনব্যবসায়ী উপাধী পেয়ে  সমূহ সম্মানের অধিকারী হয়েছে, আজ যার দাপটে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে, আজকে যার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর অন্যের ভালো-মন্দের ফয়সালা হয়ে থাকে তাদের নিয়ে রচিত-বিরচিত হচ্ছে চিত্তাকর্ষক গল্পগাঁথা, নামের জয়ধ্বনি সবার মুখে মুখে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে  অথচ তাদের পেছনে যে ছিল, যার কল্যাণে তাদের আজ যশ-প্রতাপ-প্রতিপ্রত্তি সেই তালেব মাষ্টারকে নিয়ে লেখার, তার সম্পর্কে কিছুর বলার, তাকে নিয়ে একটু স্মৃতিচারণ করার মতো কেউ নেই! এই কি ছিল ভাগ্যের লিখন? এই তবে সমাজ-সভ্যতার রুচি? এই কি তবে শিক্ষাগুরু’র প্রতি মর্যাদার অলীক বিধান? কাকে জানাবেন সেই দুঃখ-বেদনার কথা? কে তার কষ্টের সাথী হয়ে ভাগাভাগি করে অন্তর্দহন থেকে তাকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিবে? উপর তলার অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিগণের নাম তালেব মাষ্টার উচ্চারণ করেছেন। তবে মনের মতো বা নিজ মনোবেদনা বুঝবার মতো, একই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিত্ব খুঁজতে গেয়ে তিনি তার কাঙ্খিত মানুষটিকে প্রথমে না পেলেও পরে যে একেবারে পেয়েছেন তেমনও নয়। তবে আশার পরবর্তী সোপান বা খুঁটি হিসেবে তিনি তার দাবিদাওয়া জানিয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাকে তার কাহিনি লেখার কথা বলতে গিয়ে কখন নিজের খেয়ালে অনর্গল জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাকে বর্ণনার আলোকে জ্বলন্ত-জাজ্বল্যমান চিত্র উপস্থাপন করে ফেলেছেন তার প্রতি দৃষ্টিপাত করেননি। তাই যে উদ্দেশ্য মানিক বাবুকে নিয়ে এসেছিলেন তার জীবন কাহিনিতে তা আর শেষ পর্যন্ত যথার্থ পূর্ণতা পায় নি। সচরাচর যেমন হয়ে থাকে আর কি! কোনো একাকী নিগৃহীত, নিষ্পেষিত ব্যক্তি যখন অন্যকারো সঙ্গ পাওয়ার তিব্রতা অনুভব করে,যার সান্নিধ্য পেতে সে সর্বক্ষণ প্রতিক্ষায় থাকে তাকে যদি দৈবক্রমে সে পেয়ে যায় তখন আর পূর্বেকার সিদ্ধান্তের বালাই থাকে না। অর্থাৎ মুখ্য চরিত্র তখন ঐ ব্যক্তি নিজে হয়ে দাড়ায়। তাই যাকে আনার/যার সঙ্গ পাওয়ার একান্ত কামনা-বাসনায় একসময় অস্থিরতা বিরাজ করত, সময়ান্তরে সেটা গৌণ হয়ে উঠে। তবে হ্যাঁ, নিজ লয়ের প্রতি অতটা অনিশ্চয়তা না থাকলেও নিজকে ছাপিয়ে কথিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি অনুরোধ করাটা অন্যকিছুর দিকের প্রতি নির্দেশ দেয় বলে আমার মনে হয়। একজন অক্ষম ব্যক্তির বাঁচার অবলম্বনের গ্যারান্টি কেবল দিতে পারে যার যথার্থই সক্ষমতা আছে, একজন নির্যাতিতের অধিকারের কথা সে-ই জোর দিয়ে বলতে পারবে যার সেরকম দক্ষতা আছে। তদ্রুপই যার সমাজে জানাশোনা আছে বা যে সমাজের গাঠনিক দিকের প্রতি ওয়াকিবহাল আছে, যাকে সমাজ সমীহ করে চলে কেবল সেই ব্যক্তির দ্বারা পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। আর উপরোক্ত কবিতা পাঠ করলে তেমনটাই উপলব্ধ হয়। সমাজের মূলস্রোতের সাথে মিশ না খাওয়া, আর্থিক অনটনে দিনাতিপাত করা শিক্ষক তালেব মাষ্টারের শোচনীয় অবস্থার কথা যেন সবার কাছে গুরুত্ব সহকারে পৌছে দেওয়া যায় তার নিমিত্তেই ঔপন্যাসিক তথা তৎকালিন সময়ে জনপ্রিয় মার্কসবাদী-সাম্যবাদী লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আহুত হন তালেব মাষ্টারের কাহিনিতে। অবশ্য তা আর হয়ে উঠে নি। নিজের জীবনব্যাপী দুর্দশার কথা, অতীতের দুঃখময় স্মৃতির রোমন্থন, বর্তমানের দারিদ্র্য পীড়িত অবস্থার ভয়াবহতা, ভবিষ্যতের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদী উদার আর নির্লিপ্তের মতো বলে গিয়েছেন। কোনো ঘটনার ভারিত্ব নেই, কোনো কিছুর প্রতি আক্ষেপ-বিদ্বেষ নেই, শুধুমাত্র ভাগ্যিগ নির্দেশনা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে তৎকালিন সমাজ ব্যবস্থাই ছিল প্রধানত দায়ী। কেননা, দীর্ঘ দু’শো বছরের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের করালগ্রাস থেকে মুর্মূষুপ্রায় সমাজ স্বাধীনতা লাভ করে বেনিয়া গোষ্ঠী ব্রিটিশদের কাছ থেকে। যেখানে ভঙ্গুরপ্রায় আর্থিক অবস্থা বিরাজ করছিল। সমাজ ব্যবস্থায় অস্থিরতা, অনিশ্চিয়তায় মানুষ দিগ্ববিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। যাইহোক, অবশেষে কাঙ্খিত স্বাধীনতা এসেছে। নতুন উদ্যমে দেশ তথা জাতি গঠনে মনোনিবেশ করার প্রয়োজনীতা দেখা দিল। কিন্তু মানুষকে মানুষের মতো বাঁচার যে মূল আনুষঙ্গিক উপাদান তথা অর্থনৈতিক উপাদানের অভাবের তীব্রতা ই তার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে মিইয়ে দেয়। স্বপ্নভঙ্গ ঘটে, ভালো করে বেঁচে থাকার আশায় নির্মমতার কালো ছায়া পড়ে। যার অবস্থিতি বর্তমানেও পরিলক্ষিত হয় আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়।

কবিতার কবি’র জীবনেও একটা ট্যাজেডি যে ঘটে  গেছে তা প্রারম্ভিকেই লক্ষ্য করা যায়। মানুষ, মানবিকতার সম্পর্ককে পাশ কাটিয়ে ধর্মের জিকির তুলে এক রাষ্ট্রের ভেতর আরেক রাষ্ট্রের জন্ম নেওয়ার মাধ্যমে কবিকে তার প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতন থেকে পূর্ববাংলায় ফিরে আসতে হয়। অনেকটা ক্ষোভ, অনেকটা মনোবেদনা আগেই অন্তরে প্রোথিত ছিল সন্দেহ নেই, তবে এখানে এসে যখন পত্রিকার মারফত খবর পেলেন তালসোনাপুরের তালেব মাষ্টারের আহুতি তখন আর মনের দুঃখ-বেদনাকে যারপরনাই ভদ্রতার খোলসে আটকে রাখতে পারেননি। অবিরাম লিখে গেলেন সদ্য মর্ত্য ছেড়ে যাওয়া, জাতির মেরুদণ্ডকে নির্মাণকারী শিক্ষক তালেব মাষ্টারকে নিয়ে। কবিতা পড়ার সময় মনে হয়েছে এখানে কথক স্বয়ং তালেব মাষ্টার যে নিজের জীবনে  শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন! একবারের জন্যেও মনে হয় নি বাংলাদেশের প্রথিতযশা সাহিত্যিক, সমাজচিন্তক ড. আশরাফ সিদ্দিকী স্যার লিখছেন বা বলছেন উপরোক্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। একজন কবি’র কবিতা লেখার সার্থকতা মনে হয় এমনই হয় যেখানে পাঠক তার সবটুকু দিয়ে উপলব্ধি করার সুযোগ পায়। আর তখনই কেবল কবি ও তার কবিতা অনেককাল যাবৎ বেঁচে থাকে পাঠকের অন্তরে।

সবশেষে বলা যায় আমরা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় পুরোপুরি পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারি নাই। যে ধরণের শ্রেণিহীন-বর্ণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আমাদের লালিত স্বপ্ন ছিল, যে ধরণের জাতিগঠনে আমাদের মধ্য স্পৃহা ছিল আর যেভাবে আমরা সমান মর্যাদায় বসবাস করব বলে দেশের পরে দেশ গড়েছি তার বাস্তবায়ন এখনো অধরাই থেকে গেছে। এখনো হাজারও তালেব মাষ্টারকে রোগে ভুগে, বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হয়। এখনো তালেব মাষ্টারের ছেলে-মেয়েকে অভাবের মধ্য দিনাতিপাত করতে হয়। এটা সবার জন্য লজ্জাজনক, এটা সভ্য জাতির জন্য মর্যাদাহানিকর। তাই আমাদের পরিবর্তন জরুরি, আমাদের সমাজের চিকিৎসা জরুরি আর সর্বপরী সমাজের মধ্যে সামাজিকতার চর্চা জরুরি।  তবেই দেশ-জাতি সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বিশ্বের সামনে দাঁড়াতে পারবে নচেৎ নয়।