১৯৩৯ সালের মার্চের ২১ তারিখ | সকাল হতেই তৎকালীন জার্মান রাইখ চ্যান্সেলারীতে স্টাফ অফিসারদের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় | খুব গুরুত্বপূর্ণ এক সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা | তখনকার জার্মান জাতীর ক্ষমতাসীন দল নাৎসী পার্টির সব বড় বড় মাথা এবং সশস্ত্র বাহিনীর সব দুঁদে কমান্ডারদের এক টপ সিক্রেট মিটিং এ বসবেন প্রায় ছয় কোটি জার্মানের ভাগ্যনিয়ন্তা এডলফ হিটলার | যথারীতি নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হলো সেই কাংক্ষিত মিটিং | গুরুগম্ভীর সেই সভায় হিটলার পোল্যান্ডকে জার্মানির দানজিগ বন্দর নিয়ে চরমপত্র পাঠানোর বিষয়ে আলচনা করছিলেন | উপস্থিত সবাই আঁচ করতে পারলেন যে পোলিশ সরকার তাদের চরমপত্রকে খুব একটা আমলে নেবে না কারন পোলিশদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আছে সেইসময়ের দুই দুইটা পরাশক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স | এছাড়া পোল সীমান্তের ওপারে আছে বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন | তাই সবাই খুব চিন্তিত হয়ত শীঘ্রই বড় ধরনের একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে জার্মানি | হিটলার অবশ্য এসব খুব একটা আমলে নিলেন না | তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানালেন পোলিশদের এই মুহূর্তে চরমপত্র পাঠানো হবে | যেনো তারা ভয় পেয়ে দানজিগ বন্দরের উপর জার্মান কর্তৃত্ব মেনে নেয় এবং বন্দরের সাথে জার্মানির যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে একটা রেল পথ ও সড়ক পথ পোল্যান্ডের মধ্য দিয়ে নির্মান করার অনুমতি দেয় | হিটলারের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে উপস্থিত জেনারেলরা অস্বস্তিতে পড়েন | হিটলার তাদের মনোভাব বুঝতে পেরে দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা দেন যদি পোলিশরা আমাদের দাবি না মেনে নেয়, প্রয়োজনে আমরা পুরো পোল্যান্ড দখল করে ফেলবো | ব্রিটিশ আর ফরাসীদেরকে আমি ভয় পাই না | হারানো জার্মান ভূমি ফিরে পেতে আমি প্রয়োজনে পুরো বিশ্বের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত | ফ্যুয়েরারে ইষ্পাতসম ব্যাক্তিত্ব দেখে কুকড়ে গেলেন বাঘা জেনারেলরা | সেদিনই পোল্যান্ডকে জার্মানি তাদের চরমপত্র পাঠালো |
জার্মানদের সাথে পোলিশদের এই উত্তেজনার মূল কারন খু্ঁজতে আমাদের আরও একটু পেছনে যেতে হবে | প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির লজ্জাজনক পরাজয়ের পর ইউরোপে জার্মানির বিভিন্ন ভূখন্ড একে একে বিজয়ী শক্তির মধ্যে ভাগ হয়ে যায় | প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী মিত্র শক্তি ভার্সাই নামে অবমাননাকর চুক্তি জার্মানির উপর চাপিয়ে দেয় |এ চুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে প্রতিবেশি বেলজিয়ামের থেকে দূর্বল করে ফেলার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয় এবং এ লক্ষ্যে বিভিন্ন জার্মান ভূখন্ড প্রতিবেশিদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়া হয় | হিটলার ক্ষমতা পেয়েই জার্মানির হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করেন | একে একে অস্ট্রিয়া, চেকশ্লাভিয়ে, রাইনল্যান্ড প্রভৃতি দখলে নেয়ার পর হিটলারের দানজিগ বন্দরের উপর নজর পড়ে | মূলত দানজিগ বন্দর তৎকালীন লিগ অব নেশন্সের অধিকারে রাখা হয় আর পোল্যান্ডের এই বন্দরের করিডোর ও বন্দর ব্যাবহারের অবাধ অধিকার থাকে | ইতোমধ্যে বিভিন্ন অযুহাতে ভার্সাই চুক্তিকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে গোপনে ব্যাপক সামরিক শক্তি বাড়াতে থাকে জার্মানি | পোল্যান্ডকে গ্রাহ্য করার সময় তাদের কোথায় ? ২৬ শে মার্চ পোলিশ সরকার আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রদান করে | তারা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয় পোল্যান্ড নিজের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে জার্মানির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী | জার্মানির দাবি তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয় | তবে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পথ খোলা রয়েছে | পোলিশদের জবাব পেয়ে সিংহের মত গর্জে ওঠেন হিটলার | তিনি তার বিভিন্ন সেনানায়কদের পোল্যান্ডে সর্বাত্মক হামলার গোপন নির্দেশ দেন | জার্মানরা ব্যাপক সমর প্রস্তুতি নিতে থাকে | এদিকে ব্রিটেন আর ফ্রান্স দূর থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলো | তারাও পরিষ্কার ভাবে হুশিয়ারি দিলো যে এবার আর জার্মানীকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না, তারা তাদের মিত্র দেশ পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করবে | হিটলার এতে খুব একটা চিন্তিত হলেন না | তিনি তার ছক আগে থেকেই কষে রেখেছেন | তিনি তার প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার গোয়েবলসকে রাশিয়ায় স্টালিনের সাথে এক গোপন চুক্তির এজেন্ডা দিয়ে পাঠান | এটা ছিলো তার একটা দারুন কূটনৈতিক চাল | কারন কেউ ভাবতে পারে নি যে নাৎসী জার্মানি কম্যুনিস্ট রাশিয়ার সাথে এভাবে আতাঁত করতে পারে | মূলত হিটলার প্রথম থেকেই কম্যুনিজমের তুমুল বিরোধী ছিলেন, ক্ষমতা পেয়েই তিনি আগে কম্যুনিস্টদের শায়েস্তা করেছিলেন | কিন্তু এবারে হিসাব আলাদা | আক্রমণ করলে ব্রিটেন আর ফ্রান্স পোল্যান্ডের সাহায্যে এগিয়ে আসবে|
আবার পোল্যান্ডের ওপারে আছে রাশিয়া, তাদের সাথেও যুদ্ধ বেধে যেতে পারে | তাই হিটলার সব শত্রুকে একসাথে রণাঙ্গনে আনতে চাইলেন না | তিনি গোয়েবলস কে পাঠালেন স্ট্যালিনকে আশ্বস্ত করতে, যে তাদের সাথে যুদ্ধ করার ইচ্ছা নেই জার্মানির , বরং ভবিষ্যতে সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে একসাথে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে জার্মানি | এভাবে নাৎসী জার্মানির সাথে সোভিয়েত রাশিয়ার দশ বছর মেয়াদি অনাক্রমণ চুক্তি হয় | এতে করে পুরো বিশ্ব বিশেষত ব্রিটেন, ফ্রান্স হিটলারের কূটনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে ধাঁধায় পড়ে যায় | হিটলার তার বড় শত্রু রাশিয়ার সাথে চুক্তি করবেন, এটা তাদের ধারণার বাইরে ছিলো | মূলত হিটলারের উত্থানের পর তিনি যখন ভার্সাই চুক্তির একের পর এক শর্ত ভঙ্গ করতে থাকেন তখন তারা হিটলারকে থামানোর বদলে উলটা তাল দিয়েছে | তারা হিটলারকে পূর্বের রাশিয়ার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে চেয়েছিলো কারন তাদের সকলের মূল কাটা ছিলো রাশিয়া | তাদের নিজেদের দেশে বলশেভিকদের উত্থানের ভয় থেকে তারা রাশিয়াকে সন্দেহের চোখে দেখতেন | তাই হিটলারের উত্থানের পর যখন তার প্রতিবেশী দেশ গুলো বার বার নালিশ করছিলো তখন পশ্চিমারা সে ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামায় নি | এদিকে রুশ-জার্মান চুক্তিতে সবাই বিভ্রান্ত হলেও একজন কিন্তু নিজের হিসেব নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন, তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্ট্যালিন | ঝানু রাজনৈতিক ব্যাক্তি স্ট্যালিন কিন্তু বুঝেছিলেন হিটলারের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণ নীতির জন্যে একসময় তাকে হিটলারের মুখোমুখি করে দেবে | আর এসময় পশ্চিম ইউরোপের সবাই যে জার্মানদের সাপোর্ট করবে এটা তিনি বুঝতে পারেন | কিন্তু ভবিষ্যতে বড় রকম যুদ্ধ চালানোর মত সামরিক সামর্থ্য সে সময়ে রাশিয়ার ছিলো না | তাই তিনি তিনি প্রস্তুতি নিতে সময়কে কাজে লাগাচ্ছিলেন | জার্মানদের সাথে চুক্তি করে তার লাভ হলো অনেক | তিনি জানতেন আজ হোক কাল হোক জার্মানদের সাথে তার সংঘাত অনিবার্য | তাই তিনি প্রস্তুতির জন্যে সময় পেয়ে গেলেন, এর মধ্যে সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা এমন পর্যায়ে তিনি নিয়ে যেতে পারবেন যে তখন পুরো ইউরোপ যুদ্ধ করতে আসলেও তিনি যুদ্ধ করতে পারবেন | যদিও হিটলারের উত্থানে ভীত হয়ে স্ট্যালিন নিজেই আরো আগে ব্রিটেন ও ফ্রান্সে দূত পাঠিয়েছিলেন একটা ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদনের জন্যে | এতে এই তিন দেশের জার্মানদের মোকাবেলা করার কথা বলা ছিলো | কিন্তু ব্রিটেন আর ফ্রান্স রাশিয়ার সাথে কোনো চুক্তি করতে সেইসময়ে ইচ্ছুক ছিলো না | মরিয়া স্ট্যালিন তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই শত্রু জার্মানির সাথে হাত মেলান |
এদিকে হিটলার কিন্তু প্রথমেই পোল্যান্ড আক্রমন করলেন না | সবার সহানুভূতি জার্মান পক্ষে আনার জন্যে তিনি অতি গোপনে পোল্যান্ড সীমান্তে জার্মান বেতার কেন্দ্রের পাহাড়ায় থাকা সেনা ইউনিটের প্রধানকে এক গোপন নির্দেশ দিলেন | প্লান মোতাবেক জার্মানীর বিভিন্ন জেলখানা থেকে সাজাপ্রাপ্ত কিছু আসামীকে নিয়ে আসা হলো | রাতের অন্ধকারে জার্মানরা নিজেদের বেতার কেন্দ্রের উপর কয়েকটি শেল নিক্ষেপ করে আগুন লাগিয়ে দেয়| সীমান্তের অপর প্রান্তে পোলিশ সৈন্যরা অবাক হয়ে জার্মান বেতার কেন্দ্রটিকে জ্বলতে দেখে | পরদিন সকাল বেলা পুরো বিশ্ব জানতে পারলো বিনা উস্কানিতে পোলিশ সেনাবাহিনী কর্তৃক সীমান্ত অতিক্রম করে জার্মান বেতার কেন্দ্রটি আক্রান্ত হয়েছিলো এবং পরবর্তীতে সাহসী জার্মান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে তারা নিজেদের কিছু সৈন্যের লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে যায় | পরিকল্পনা মাফিক সাংবাদিকদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে তারা বেশ কিছু পোলিশ সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পড়া কিছু সৈন্যের মৃতদেহ দেখানো হয় | মূলত এরা ছিলেন বিভিন্ন জার্মান জেলে থাকা সাজাপ্রাপ্ত আসামী | জার্মান সাংবাদিকেরা কিন্তু তাদের ঠিকই চিনেছিলেন যে তারা হিটলারের বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী | কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুললেন না | দারুন এক নাটক মঞ্চায়িত হলো | এবার হিটলার দিলেন জ্বালাময়ী ভাষণ | তিনি বললেন যে আলোচনার আহবান জানানো সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে তার পির্তৃভূমিকে আক্রমণ করা পোলিশদের তিনি এবার উপযুক্ত শিক্ষা দিতে যাচ্ছেন | ইতমধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সিধান্ত নেয়া হয় যে জার্মানী যদি পোল্যান্ড আক্রমন করে তবে ব্রিটিশরা ও পোল্যান্ডের সাহায্যার্থে এগিয়ে যাবে | ফ্রান্স ও অনুরূপ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয় | হিটলার অবশ্য এসব হুমকী-ধামকিকে পাত্তা দিলেন না| ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর সকালবেলা জার্মানরা বাধ ভাঙ্গা নদীর পানির মত ঝাকে ঝাকে পোলিশ সীমান্ত অতিক্রম করে আক্রমণ করে | খড়-কুটোর মত ভেসে যায় পোলিশ সেনাবাহিনী | জার্মান ব্লিৎসক্রিগে ধ্বংস হয়ে যায় তাদের বিপুল পরিমান সামরিক স্থাপনা |এদিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স তাদের সৈন্য পোল্যান্ডের সহায়তায় মোতায়েন করতে চাইলে হিটলার গোপনে স্ট্যালিনকে পোল সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করে এগিয়ে আস্তে বলেন | স্ট্যালিন সাড়া দিলেন, তিনিও তার সৈন্যবাহিনীকে পোল সীমান্ত অতিক্রমের নির্দেশ দেন | এভাবে পুরো পোল্যান্ড কয়েকদিনের মধ্যে জার্মানী আর রাশিয়ার মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায় |
এভাবেই মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচাইতে ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে যা পরবর্তিতে ছয় বছর ধরে চলেছে | এ সময়ে জলে, স্থলে এবং অন্তরীক্ষে প্রচন্ড যুদ্ধ হয় মিত্র শক্তি ও অক্ষ শক্তির মধ্যে | প্রথমে ইউরোপে শুরু হলেও একে একে এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে | পৃথিবীর প্রায় সব স্বাধীন ও পরাধীন উপনিবেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে এ মহা যুদ্ধে | প্রায় ৭০-৮৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ও এটম বোমার ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে শেষ হয় এই মহাযুদ্ধ |