আব্বাসীয় খিলাফতের  পঞ্চম খলিফা হারুন অর রশিদের রাজত্বকালকে (৭৮৬-৮০৯) ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলে মনে করা হয়। তার আমলে শক্তিশালী এই খিলাফত রাজনৈতিক ভাবে এবং শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় নিজেকে মেলে ধরেছিল। আব্বাসী রাজধানী বাগদাদ হয়ে উঠেছিল সমকালীন বিশ্বের এক সমৃদ্ধ শহর। কিন্তু এই স্বর্ণযুগ বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যায় যখন হারুন অর রশিদের মৃত্যু হয়। ৮০৯ সালে খলিফার মৃত্যু হলে বিশাল এই সাম্রাজ্য দ্রুতই গৃহযুদ্ধের অস্থিরতার মুখে পতিত হয়। আর এই গৃহযুদ্ধের মূল চরিত্র ছিলেন হারুনেরই দুই পুত্র, আমিন ও মামুন।  এই দুইজনের পক্ষে আবার প্রভাবশালী আমির ওমরাহরা জড়িয়ে পড়লে গৃহযুদ্ধ একটি কাঠামোগত রূপ লাভ করে।

আব্বাসীয় গৃহযুদ্ধর আগের মানচিত্র

আব্বাসীয় খিলাফতের মানচিত্র

হারুন অর রশিদ তার পুত্রদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধের ব্যাপারে আগে থেকেই সচেতন ছিলেন। তাই তিনি এর একটা ভারসাম্যপূর্ণ সুরাহা করতে ৮০২ সালে তার দুই পুত্রকে নিয়ে হজ্ব করতে মক্কা যান। সেখানে তিনি তার পুত্রদের উদ্দেশ্যে একটি শপথনামা পেশ করেন। এই শপথনামায় প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য লিপিবদ্ধ ছিল এবং কে কোন অঞ্চলে শাসন করবে সে ব্যাপারেও স্পষ্ট উল্লেখ করে দেয়া হয়েছিল। দুই পুত্রই এই শপথনামায় স্বাক্ষর করে বাবার আরোপিত নিয়ম ও আদেশ মানার প্রতিশ্রুতি দেন। আমিন, মামুন ও কাসিম তিনজনই ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন মাতার সন্তান। আমিনের মাতা ছিলেন আরব নারী জুবাইদা, যিনি আবার দ্বিতীয় আব্বাসী খলিফা আল মনসুরের নাতনি ছিলেন। ফলে আমিন উত্তরাধিকারী হিসেবে বিশুদ্ধ আব্বাসী অধিকার বহন করছিলেন। মামুনের মাতা ছিলেন পারস্যবাসী মারাজিল, যিনি খলিফা হারুনের উপপত্নী ছিলেন। অনেক সূত্র বলছে, মারাজিল ছিলেন খোরাসানী বিদ্রোহী নেতা উস্তাদসীস এর কন্যা। অনেক ঐতিহাসিক আবার মারাজিল আদৌ মামুনের মাতা কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কাসিম উত্তরাধিকার মনোনয়নের এই অনুষ্ঠানে মক্কায় ছিলেন না এবং পরবর্তীতে গৃহযুদ্ধের উত্তপ্ত ঘটনা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন।

হারুন অর রশিদের শপথনামায় স্পষ্টভাবে উত্তরাধিকারের দায়িত্ব ও নিয়মবিধি লিপিবদ্ধ করা ছিল। আমিনকে খিলাফতের প্রধান উত্তরাধিকার করে রাজধানী বাগদাদে তার আসন ঘোষণা করা হয়। পুরো ইরাক ও খিলাফতের পশ্চিমাঞ্চলের বেশিরভাগ অঞ্চলে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। আমিনের মৃত্যু হলে মামুন স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই অঞ্চলের শাসক হবেন। এর আগে মামুনকে খিলাফতের পূর্বাঞ্চলের বিশেষ করে খোরাসানের স্বায়ত্তশাসিত  শাসক হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। খোরাসানের কর প্রদেশের অভ্যন্তরেই থাকবে এবং আমিনের কোন এজেন্ট মামুনের অনুমতি ছাড়া খোরাসানে প্রবেশ করতে পারবে না। এছাড়া মামুন তার সেনাবাহিনীকে স্বাধীনভাবে যেকোন অভিযানে প্রেরণও করতে পারবেন। তৃতীয় পুত্র কাসিমকেও স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা দিয়ে উত্তর সিরিয়া ও বাইজান্টাইন সীমান্তবর্তী অঞ্চল তার কাছে সমর্পণ করা হয়।

আব্বাসীয় গৃহযুদ্ধ আগের বাগদাদ

আব্বাসীয় দের সময়ের বাগদাদের মানচিত্র

আপাতদৃষ্টিতে হারুন অর রশিদের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলে বুঝা যায় তিন পুত্রকে সাম্রাজ্য ভাগ করে তিনি বোধহয় একটি সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বণ্টনে সাম্য ছিল না। ফলে প্রকৃত অর্থে তিনি অবচেতন মনে বিভেদের বীজই রোপণ করে দিয়ে যান। হারুনের মৃত্যুর পর আমিন ও মামুনের পেছনে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল প্রভাবশালী আমির ওমরাহ জড়ো হতে থাকেন। এক পর্যায়ে আমিন ও মামুনের সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গ প্রকাশ্যে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েন। আমিনের পক্ষে বাগদাদের আমিরদের সমর্থন ছিল যারা ছিল জাতিতে আরব। এছাড়া খোরাসানী বিদ্রোহীদের উত্তরসূরী আবনা নামের এক অভিজাত সামরিক গ্রুপও আমিনকে সরাসরি সমর্থন দেয় এবং পুরো আব্বাসী খিলাফতের খলিফা হিসেবে আমিনকে বসানোর পরিকল্পনা করতে থাকে। এই আবনারা ছিল খুব শক্তিশালী। ৭৫০ সালে তারা উমাইয়াদের উৎখাত করতে ভূমিকা রেখেছিল। ইরাকে ছিল তাদের অবস্থান এবং বাগদাদের প্রায় পুরোটা ও সিরিয়ার রাক্কা শহর তাদের প্রভাব বলয়ে পড়ে গিয়েছিল। এদিকে মামুনের পেছনে ছিল প্রভাবশালী বার্মাকি উজির পরিবার। আব্বাসী শাসনে এই বার্মাকিদের উত্থান অনেকটা নাটকীয়ভাবে। আব্বাসী প্রশাসন তারা পরিচালনা করতো এবং সাম্রাজ্যে ও সম্রাটের ওপর তাদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। তারা এমনকি সম্রাটের ছেলেদের গৃহশিক্ষকও ছিল। এমনকি আমিনের গৃহশিক্ষকও ছিল একজন বার্মাকি। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি আবনা’র দিকে ঝুঁকে পড়েন। বার্মাকিরা জাতিতে ছিল পারসিয়ান। ফলে মামুনের পারসিয়ান রক্ত তাদেরকে মামুনের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল। সম্ভবত মামুনকে উত্তরাধিকারের মর্যাদা দেয়ার পেছনে বার্মাকি ও তাদের সমর্থকদের তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন খলিফা হারুন। খোরাসানীরা সবসময় মনে করতো সাম্রাজ্যে তাদের প্রদেশকে আলাদা মর্যাদা দেয়া উচিত কেননা এখান থেকে আব্বাসী আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল। খলিফা হারুন বার্মাকি ও আবনাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রশমনের স্বার্থেও সাম্রাজ্যকে দুই পুত্রের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। মক্কায় স্বাক্ষর করা সেই শপথনামায় আমিন অঙ্গীকার করেছিলেন যে তিনি কখনো খোরাসান বিষয়ে কোনকিছুতে হস্তক্ষেপ করবেন না। শপথনামায় এও উল্লেখ করা হয়েছিল যে, আমিন যদি তার এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন তবে খলিফা হিসেবে তার কোন বৈধতা থাকবে না। মামুনও এই বলে স্বাক্ষর করেছিলেন যে, তিনি তার ভাইয়ের প্রতি আনুগত্য পোষণ করবেন এবং কখনো তার বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ করবেন না। তিনি এটাও অঙ্গীকার করেছিলেন যে, আমিনের কোন সামরিক সহায়তার দরকার পড়লে মামুন তা সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবেন।

তবে তাদের এই অঙ্গীকার কেউই রক্ষা করতে পারেননি। হারুন অর রশিদের জীবদ্দশায় খোরাসানে অস্থিরতা দেখা দিলে তিনি সেখানে বিদ্রোহ দমাতে নিজেই এক বাহিনী নিয়ে রওনা হয়ে যান। ৮০৯ সালে খোরাসানে থাকা অবস্থায়ই হারুন অর রশিদের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তার অধীনে থাকা ধনসম্পদ ও সেনাবাহিনী তিনি পুত্র মামুনকে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু কৌশলে আমিন নিজেই এই ধনসম্পদ ও সেনাবাহিনী হস্তগত করেন। ফলে ভ্রাতৃকলহ প্রকাশ্য হয়ে উঠে। আমিনের উজির ছিলেন ফজল বিন রাবি নামের একজন বার্মাকি বিরোধী। তিনি আমিনকে ব্যবহার করে নিজে প্রভূত ক্ষমতার মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তার উস্কানিতে আমিন তার ভাই মামুনকে বাগদাদে ডেকে পাঠান। কিন্তু মামুন খোরাসানের নিরাপত্তার কথা ভেবে রাজধানী মার্ভ ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। আমিন রাবির পরামর্শে মামুনকে উত্তরাধিকার হিসেবে বাদ দিয়ে তার দুই পুত্রের মনোনয়ন ঘোষণা করেন। ফলে গৃহযুদ্ধ আর এড়ানো সম্ভব হয়নি।

আব্বাসীয় গৃহযুদ্ধ শেষ

জনগণ ৮১৩ সালে আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে

তিক্ততা এতোই বেড়ে উঠেছিল যে ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই অস্ত্র নিতে আর কেউই কুণ্ঠাবোধ করেনি। ৮১২ সালে আমিন তার সেনাপতি আলী ইবনে ঈসার নেতৃত্বে ৫০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী রায় শহরে পাঠান। বিপরীতে মামুনের সেনাপতি তাহির বিন হোসাইনও আরেকটি বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। তাহির আমিনের বাহিনীকে পরাজিত করলে নতুন আরেকটি সেনাদল পাঠানো হয়। এই নতুন বাহিনীকেও মামুনের সেনাপতি তাহির পরাজয়ের স্বাদ দেন। এরই মাঝে মামুনের প্রধান সেনাপতি হারসামা রাজধানী মার্ভ থেকে পারসিক সেনাদল নিয়ে হুলওয়ান নামক জায়গায় ঘাঁটি স্থাপন করেন। তাহিরকে আহওয়াজ ও সুসার দিকে পাঠালে বাগদাদ দখলের মঞ্চ প্রস্তুত হয়। ৮১২ সালেই মামুন নিজেকে আমিরুল মুমেনীন উপাধিতে ভূষিত করেন। পারস্যবাসী তাকে খলিফা হিসেবে স্বাগত জানায়। মামুনের সেনাপতিরা এদিকে পুরো আব্বাসী সাম্রাজ্যেই নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে আমিনের কর্তৃত্বকে দুর্বল করে তুলে। এক পর্যায়ে কোণঠাসা খলিফা আমিন তার মাতা জুবাইদা ও তার পরিবার নিয়ে খলিফা মনসুর নির্মিত মদিনা আল মনসুর দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আমিন তার ভাইয়ের ওপর বিশ্বাস রেখে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু একদল দুষ্কৃতিকারী  তাকে রাতের আঁধারে হত্যা করে বসে। মামুন এই ঘটনায় খুবই ব্যথিত হন এবং হত্যাকারীদের শাস্তি দেন। আর এর সাথে এই গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে, আরবের উপর বিজয় অর্জিত হয় পারসিক মুসলমানদের। মামুন হন আব্বাসী আমলের অন্যতম স্মরণীয় খলিফা।

তথ্যসূত্র