ইতিহাসের অতলে হারিয়ে যাওয়া মহান সম্রাট অশোকের সন্ধানে – দ্য গ্রেট অশোক, প্রথম পর্ব

অনেকক্ষণ হলো সম্রাট অশোক কলিঙ্গ থেকে ফিরেছেন। ফেরার পর থেকেই তাকে লক্ষ করছেন স্ত্রী দেবী। সম্রাটকে অনেক বিষণ্ণ ও ক্লান্ত মনে হচ্ছে। চিন্তামগ্ন অশোকের কাঁধে হাত রাখলেন দেবী। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে স্ত্রীর দিকে ঘুরে তাকালেন অশোক। সম্রাটের এমন রূপ দেবী আগে কখনো দেখেন নি। সম্রাটের বিচলিত ও বিভ্রান্ত চোখ দুটো সব বলে দিয়েছে তাকে। সম্রাটের মনের অস্থিরতা বুঝতে পেরে দেবী তাকে গৌতম বুদ্ধের শেষ জীবনের একটি ঘটনা শোনাতে শুরু করলেন। ৮০ বছর বয়সে নিরামিষভোজী গৌতম বুদ্ধকে মগধের চন্দ নামক এক অচ্ছুত (নিচু জাতের) ব্যক্তি নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ করে শূকরমদ্যপ খাওয়ায়। সব কিছু বুঝেও চন্দের আমন্ত্রণ রক্ষা করা গৌতম বুদ্ধ এর পরপরই অসুস্থ হয়ে মারা যান। তবে মৃত্যুর আগে তিনি একটি কথা বলে যান। তিনি বলেন যে, পৃথিবীতে দুটো জিনিস খেয়ে তিনি সব চেয়ে বেশি তৃপ্ত হয়েছেন-  সুজাতার পায়েস এবং চন্দের শূকরমদ্যপ। দেবী সম্রাটকে বুঝিয়ে বললেন যে, মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ার মুহূর্তেও গৌতম বুদ্ধ নিজের মৃত্যুর জন্য কাউকে দোষারোপ বা দায়ী করে যেতে চান নি, আর এ জন্যই তিনি ছিলেন মহৎ। সম্রাট মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্ত্রীর কথা শুনছিলেন এবং হঠাৎ এক উপলব্ধি তার সমস্ত হৃদয় আচ্ছন্ন করে ফেললো। এই উপলব্ধির গভীরতা অনেক অনেক বেশি।

বর্তমানে কলিঙ্গ যুদ্ধের প্রান্তর।

বলছিলাম খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালের কথা, যখন মগধ ছিলো ভারতবর্ষের ১৬টি জনপদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। মগধ বলতে বিহার ও বাংলার অধিকাংশ অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে। এই মগধ প্রথমে ছিলো আর্যদের রাজ্য। মগধের উত্থানের কৃতিত্ব বৌদ্ধ ধর্মের আরেক পৃষ্ঠপোষক হর্য্যঙ্ক রাজবংশের রাজা বিম্বিসার এর। তিনি মগধকে উত্তর ভারতের রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত করেন। এরপর বিম্বিসারকে গৃহবন্দী করে তার ছেলে অজাতশত্রু রাজা হন এবং অজাতশত্রুর পরে নন্দ বংশের রাজা মহাপদ্মনন্দের দখলে চলে যায় মগধ। মহাপদ্মনন্দের পর তার ছেলে ধননন্দের শাসন শুরু হয় এবং মহাপদ্মনন্দের দাসী মুরার গর্ভে জন্ম নেয়া তার আরেক ছেলে ধননন্দের সৎ ভাই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যই পরবর্তীতে নন্দ শাসক দ্বারা অপমানিত পন্ডিত ব্যক্তি চাণক্যের সহায়তায় পরপর তিন দফা যুদ্ধ শেষে ধননন্দকে হারিয়ে মগধ দখল করেন।

দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার ভারতবর্ষের একের পর এক অঞ্চল দখল করতে করতে মগধের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধননন্দের বিপুল যুদ্ধশক্তির আশঙ্কা তার সৈন্যদেরকে সেদিকে ফেরাতে পারে নি। তাই পেছনে রেখে যাওয়া আলেকজান্ডারের অসম্পূর্ণ ভারত অভিযানে তিনি যেসব অঞ্চল নিজের আওতাধীন করেছিলেন, সেসব অঞ্চলে লুকিয়ে রেখেছিলেন বহুমূল্যবান ধন-রত্নের ভান্ডার।

আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর যেহেতু সেলিউকাস পেয়েছিলেন ভারতবর্ষের অংশ, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আলেকজান্ডারের সেই বহুমূল্যবান গুপ্তধনের মালিক সেলিউকাসেরই হবার কথা। কিন্তু আলেকজান্ডারের মৃত্যুর ঠিক পরপরই তার মতোই আরেক দিগ্বিজয়ীর উত্থান হয়েছিলো ভারতবর্ষে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যই ছিলেন সেই দিগ্বিজয়ী। তখন ভারতবর্ষ ছিলো খুবই সমৃদ্ধ। সামরিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষ ছিলো অদ্বিতীয়। লোহা উৎপাদনে মগধ ছিলো সেরা। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তার রাজ্যকে বিস্তৃত করতে করতে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মৌর্য সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন ও সেলিউকাসের মেয়েকে কৌশলে বিয়ে করে একটি মৈত্রীচুক্তি করেন এবং সেলিউকাসকে ভারতবর্ষ থেকে খালি হাতে নামমাত্র উপহার নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য করেন। ফলে সম্পূর্ণ গুপ্ত সম্পদের মালিক হন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

স্ত্রী দুর্ধরার গর্ভে জন্ম নেয়া চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের একমাত্র ছেলে বিন্দুসারের মোট একশো জন সন্তান ছিলো। এর মধ্যে বিন্দুসারের সবচেয়ে প্রিয় ছিলো তার বড় ছেলে সুসীম এবং সবচেয়ে অপ্রিয় ছিলো আজীবিক দার্শনিক মতবাদে বিশ্বাসী জনপদকল্যাণী ব্রাহ্মণ বংশের নারী সুভদ্রাঙ্গীর গর্ভে জন্ম নেয়া তার এক ছেলে, যার নাম রাখা হয় অশোক। ‘অশোক’ শব্দের অর্থ শোকবিহীন বা দুঃখবিহীন। ‘অশোকাবদান’ বইতে আছে, জন্ম নিয়ে মায়ের দুঃখ দূর করেন বলে মা তার নাম রেখেছেন ‘অশোক’।

অশোক ছি্লেন রুক্ষ ত্বকের অধিকারী, আর রুক্ষ ত্বক বিন্দুসারের চরম অপছন্দ। এ ছাড়াও অশোক ছোটবেলা থেকেই জেদী ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন, আর তার পছন্দের কাজ ছিলো প্রাণী শিকার। তিনি এতোটাই নিষ্ঠুর ছিলেন যে একটি সিংহকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিলেন। তবুও কোনো বিচিত্র কারণে এই অশোকই ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সবচেয়ে প্রিয় পৌত্র। গুরু ভদ্রবাহুর সঙ্গে চলে যাওয়ার ঠিক আগে মাত্র আট বছর বয়সের অশোককে তিনি তার তলোয়ার ও গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে যান এবং কখনো এগুলো ব্যবহার না করার উপদেশ দেন। ছেলে বিন্দুসারের হাতে সাম্রাজ্যের দায়িত্ব দিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সব বন্ধন পেছনে ফেলে চলে যান তার গুরুর সঙ্গে এবং এরই সাথে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনার মাধ্যমে শেষ হয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অধ্যায়।

সময়ের সাথে সাথে অশোক বড় হতে থাকেন, আর সিংহাসন লাভের সুপ্ত ইচ্ছা তার আরো তীব্র হতে থাকে। তার নিষ্ঠুরতার নিদর্শন তাকে মৌর্য সাম্রাজ্যের সেনাপ্রধানে পরিণত করে। নৃশংসতার সাথে একের পর এক যুদ্ধে জয়লাভ করতে থাকা অশোককে দেখে সুসীমের মনে ভীতি তৈরি হয়। সুসীম ভাবতে শুরু করেন, হয়তো সিংহাসন অশোকেরই হবে। কারণ সুসীমকে রাজা বানানো বিন্দুসারের ইচ্ছে হলেও যোগ্যতার বিবেচনায় সব মন্ত্রীরা অশোককেই রাজা হিসেবে দেখতে চাইতেন। তখন তক্ষশীলায় বিদ্রোহ শুরু হয়। সুসীমের ধারণা ছিলো, তক্ষশীলার বিদ্রোহ দমন করা অশোকের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই সুসীম বিন্দুসারকে বলে অশোককে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এদিকে তক্ষশীলার বিদ্রোহীরা নৃশংস অশোকের আসার খবর শুনে নিজ থেকেই থেমে যায় এবং অশোকের জন্য বিদ্রোহ দমন অনেক সহজ হয়ে যায়। তাই উদ্বিগ্ন সুসীম অশোককে কলিঙ্গ রাজ্যে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য বিন্দুসারকে রাজি করান। সেখানে গিয়ে অশোক রাজকুমারী কৌরভাকীর প্রেমে পড়েন এবং একে অপরের পরিচয় না জেনেই বিয়ে করেন তারা।

এরপর নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হলে উজাইন নগরীতে বিদ্রোহ দমনের জন্য বিন্দুসার অশোককে ডেকে আনেন। সেখানে গিয়ে অশোক বেশ আহত হন ও তার সুস্থ হতে অনেক সময় লাগে। আহত অশোকের চিকিৎসা করেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। এখানেই বৌদ্ধ ধর্মের নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে জানতে পারেন অশোক। তার সেবিকা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় দেবী নামক একজন মেয়েকে, যাকে পরবর্তীতে অশোক বিয়ে করেন।

উজাইন যুদ্ধের বছরখানেক পর বিন্দুসার ভীষণ অসুস্থ হয়ে মারা যান। এরপরই শুরু হয় সিংহাসন নিয়ে ভাইদের মধ্যে বিবাদ। তাই মাত্র ১৮ বছর বয়সে দ্বন্দ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অশোক নিজের আপন ভাই বীতাশোক বাদে বাকি সব সৎ ভাইকে হত্যা করেন।

রাধাগুপ্ত নামক একজন মন্ত্রী অশোককে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেন সিংহাসন লাভের ক্ষেত্রে। রাধাগুপ্তের পরামর্শেই সুসীমকে জ্বলন্ত কয়লা ভর্তি গর্তে ফেলে হত্যা করেন অশোক। সুসীমের সেনাপতি ভদ্রযুদ্ধ পরবর্তীতে বৌদ্ধ সাধু হয়ে যায়।

খোদাইকৃত সম্রাট অশোকের ফরমান। ছবিসূত্র: Wikimedia Commons

অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ৩০৪ সালে পাটালিপুত্রে জন্মগ্রহণ করা ইতিহাসের আদর্শ শাসক অশোক ৩৬ বছর বয়সে মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার রাজত্বকাল ছিলো খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৩২ সাল। সিংহাসনে আরোহণ করে রাধাগুপ্তকে তিনি নিজের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন।

শাসনভার গ্রহণ করার পরও তিনি টানা আট বছর সাম্রাজ্য পরিচালনায় চরম নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছেন। নৃশংস আচরণের জন্য ‘চন্ডাশোক’ নাম হয় তার (‘চন্ড’ শব্দের অর্থ প্রচন্ড বা ভয়ানক)। নিষ্ঠুর রাজ্য পরিচালনা নীতি ও সূক্ষ্ম রণকৌশলের প্রয়োগের মাধ্যমে অশোক ভারতবর্ষের প্রায় পুরোটাই দখল করতে থাকেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রতিষ্ঠিত বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যে তো তবুও তামিল ও কলিঙ্গ অঞ্চল বাদ পড়েছিলো, কিন্তু পাষাণ হৃদয় অশোক তা-ও মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হওয়া সম্ভব করেছিলো। ক্রমেই তিনি সাম্রাজ্যের পরিধি আরও বিস্তৃত করতে থাকেন। এমনকি পশ্চিমে বর্তমান ইরান ও আফগানিস্তান, আর পূর্বে বর্তমান বাংলাদেশ ও বার্মাও দখল করেন তিনি। ঐতিহাসিকদের মতে, কর্ণাটকে সোনা ও লোহার খনি ছিলো, আর মৌর্য সাম্রাজ্যের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে সেই খনির অধিকারও নিতে চেয়েছিলেন তিনি। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য অশোকই গড়ে তুলেছিলেন।

অশোক কি পরিমাণ নিষ্ঠুর শাসক ছিলেন, তা চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং- এর একটি বিবরণ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। হিউয়েন সাং জানান, রাজধানীর (পাটালিপুত্র) উত্তরে ‘অশোকের নরক’ নামক একটি জেলখানা ছিলো, যার শাস্তির কথা ৯০০ বছর পরও মানুষ ভোলে নি। সম্রাট অশোকের আদেশ ছিলো, কয়েদীদের কল্পনার অতীত অত্যাচার করে করে মেরে ফেলা। এ ছাড়াও একবার অশোকের প্রতি ভীষণ বিরক্ত তার উপপত্নীরা একটি অশোক বৃক্ষ নষ্ট করে ফেলে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অশোক তাদেরকে অগ্নিদগ্ধ করেন।

অশোকের প্রথম জীবনের নৃশংস আচরণে ইতি টানে কলিঙ্গের যুদ্ধ। অসম্ভব নিষ্ঠুরতার সাথে কলিঙ্গের যুদ্ধে জয়ী হন তিনি। মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকের বিবেচনায় কলিঙ্গ দখলে বেশি উৎসাহী ছিলেন অশোক। কলিঙ্গ খুবই সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল ছিলো। খ্রিস্টপূর্ব ২৬১ সালে সংঘটিত ইতিহাসখ্যাত নৃশংসতম এই যুদ্ধে কলিঙ্গ অঞ্চল ধুলোর সাথে মিশে যায়। কলিঙ্গের প্রায় সমস্ত বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো, এতো মানুষ হত্যা করা হয়েছিলো যে লাশের জন্য পা ফেলার জায়গাটুকুও ছিলো না। যুদ্ধ শেষে অশোক যখন কলিঙ্গের ক্ষয়ক্ষতি দেখার জন্য সেখানে গেলেন, তখন নিজের কৃতকর্ম দেখে তিনি নিজেই হতবাক হয়ে যান। নিজের নৃশংসতার সেই নিদর্শন এতোটাই ভয়ংকর ছিলো যে তৎক্ষণাৎ অশোকের বোধোদয় হয়। প্রচন্ড অনুতপ্ত অনুভব করেন ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম সম্রাট এবং সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যান সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষে। সেই সাথে শুরু হয় অশোকের জীবনের এবং উপমহাদেশের সম্পূর্ণ নতুন এক অধ্যায়।

বিমর্ষ ও অনুতপ্ত সম্রাট অশোক রাতারাতি পাল্টে ফেলেন শাসন নীতি। স্ত্রী দেবীর কাছ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের নিয়ম-নীতি শেখেন তিনি। বৌদ্ধ ধর্মের দীক্ষা তাকে সহনশীল করে তোলে। অশোকই ছিলেন ইতিহাসের প্রথম বৌদ্ধ শাসনকর্তা। তিনি ‘চন্ডাশোক’ থেকে ‘ধর্মাশোক (ধার্মিক অশোক)’ –এ পরিণত হন। বৌদ্ধনীতির ভিত্তিতে নতুন করে রাজ্য পরিচালনার নীতি তৈরি করেন তিনি। সেই সাথে সব বন্দীকে মুক্তি দেয়া হয়, এমনকি তাদের সম্পত্তি পর্যন্ত ফিরিয়ে দেয়া হয়।

কলিঙ্গ যুদ্ধে অশোকের বিপুল বাহিনী প্রায় এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করে এবং দেড় লক্ষ মানুষকে উড়িষ্যা থেকে নির্বাসিত করা হয়, যারা আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী বঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশে। চরম অনুতপ্ত অশোক এই নির্বাসিত মানুষদের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন এবং হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দেয়া গুপ্তধনের কথা। তিনি সেই বহুমূল্য সম্পদ নৌপথে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং বিক্রমপুরের একটি জঙ্গলে একটি নরশিশু ও একটি গোখরা সাপকে যখ বানিয়ে তা মাটির নিচে পুঁতে রাখেন। এরপর ঐ জায়গায় একটি বৌদ্ধ মন্দির তৈরি করে তার বেদীতে অশোক লেখের মাধ্যমে তিনি এই গুপ্তধনের ইতিহাস লিখে রাখেন, যেনো বাংলার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এটি উদ্ধার করে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারে। পরবর্তীতে বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে ৯৮২ সালে জন্ম নেয়া মহাপন্ডিত মহাপ্রাণ অতীশ দীপঙ্কর নিজের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের সেই বনের ভেতরের বৌদ্ধ মন্দিরটিতে ধ্যান করতে গিয়ে অশোকের রাখা গুপ্তধন খুঁজে পান এবং কোনো অসৎ লোকের হাতে যেনো এটি না পড়ে, সে জন্য তিনি বেদীসহ মন্দিরের গায়ে খোদাই করা সব লেখা একাই মুছে ফেলেন। এরপর একটি পান্ডুলিপিতে গুপ্তধনের অবস্থান, উদ্ধারের উপায়, ধন-রত্নের তালিকা, পরিমাণ ও নিজের অভিজ্ঞতা লিখে রাখেন। তিব্বতের রাজার অশেষ অনুরোধে শেষ জীবনে তিব্বতে যাওয়ার আগে সেই পান্ডুলিপি তিনি নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘নালন্দা বিহার’ এর আচার্যের কাছে দিয়ে যান।

কলিঙ্গ যুদ্ধের পর হঠাৎ উপমহাদেশে এক ধরনের শান্তি বিরাজ করতে থাকে। জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে সহনশীল ও ধার্মিক অশোক একের পর এক মহৎ কাজ করতে থাকেন। সাম্রাজ্যের চেহারাই পাল্টে ফেলেন তিনি। তিনি সৎ ভাইদেরকে হত্যা করার সময় এক ভাইয়ের স্ত্রী তার শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই শিশু বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আশ্রমে বড় হয় এবং ১৩ বছর বয়স হওয়ার পর অশোক তার পরিচয় জানতে পেরে তাকে ও তার মা-কে সাম্রাজ্যে ফিরিয়ে আনেন। এদিকে দক্ষিণের সামান্য অঞ্চল দখল করা বাকি ছিলো অশোকের, কিন্তু তিনি আর কোনো ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পক্ষে ছিলেন না। তাই তিনি সেটুকু বাদ দিয়েই সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। জায়গায় জায়গায় বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন ও পথিকদের জন্য বিনামূল্যে রাত যাপনের জায়গা বা বাড়ি নির্মাণ করেন অশোক। এ ছাড়াও প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ করার ফরমান জারি ও নিরামিষভোজী আহারের প্রচলন করেন তিনি। সাম্রাজ্যে শান্তি আনয়নের ফরমানও জারি করেন অশোক এবং পাঠশালা ও হাসপাতাল নির্মাণ করেন। তিনি পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর সাথে শান্তি চুক্তি করেন এবং তাদেরকে উপমহাদেশের সম্পদ ভোগ করারও অধিকার দেন।

অশোকস্তম্ভ

জায়গায় জায়গায় পাথরের স্তম্ভ নির্মাণ করে ‘অহিংস নীতি’ সম্বলিত ফরমান খোদাইয়ের নির্দেশ দেন অশোক। এই ৪০-৫০ ফুট উচ্চতার পাথরের স্তম্ভগুলোই উইলিয়াম জোনসের অনুসন্ধানের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলো। এগুলোকে ‘অশোকস্তম্ভ’ বলা হয়। অশোক এ-ও নিশ্চিত করেছিলেন যে স্তম্ভে খোদাই করা লেখাগুলো যেনো প্রতিটি অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় সহজ ও সাবলীলভাবে লেখা হয়। অশোকের জারি করা ফরমানে মোট ১৪টি নীতি ছিলো।

অশোক ধর্মীয় স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রাণী বলি নিষিদ্ধ করার জন্য ব্রাহ্মণ সমাজ এবং শিকারী ও জেলেরা তার উপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ছিলো। আর এ কারণেই ব্রাহ্মণদের লেখায় অশোকের তেমন জায়গা হয় নি এবং উপমহাদেশের আদর্শ সম্রাট অশোকের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের বিলুপ্তি এতো সহজে সম্ভব হয়েছিলো।

অশোক দরিদ্র ও বয়স্কদের বিশেষ সুবিধা দিয়েছিলেন এবং জায়গায় জায়গায় মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ছাড়াও পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের বাধ্যতা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা, জাত-কুল-ধর্ম নির্বিশেষে সবার প্রতি সহমর্মিতা, সব জায়গায় ফলদায়ক ও ছায়াদানকারী বৃক্ষ রোপণ, জায়গায় জায়গায় কূপ খনন ইত্যাদি বিষয়ে আইনও প্রণয়ন করেছিলেন তিনি।

বর্তমান ভারতের জাতীয় পতাকায় ২৪টি নৈতিক উপাদান সম্বলিত অশোকের ধর্মচক্র আঁকা আছে এবং অশোকের আমলে নির্মিত একটি ভাস্কর্যকেই ভারতের জাতীয় প্রতীক বানানো হয়েছে। ভাস্কর্যটিতে চারটি সিংহ একে অপরের সাথে পিঠ মিলিয়ে দাঁড়ানো। অশোকের আমলে এটি মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটালিপুত্রে স্থাপন করা হয় এবং বর্তমানে এটি সারনাথ জাদুঘরে রাখা আছে।

ধর্মচক্রের প্রকৃত রূপ

অধিকাংশের ধারণা, কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোকের সহনশীল হওয়ার কারণ অনুতাপ নয়, বরং তার সহনশীলতা ও ধার্মিক মনোভাব ছিলো কূটনীতিরই একটি অংশ। কারণ জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়েও তার নির্দেশ অমান্যকারী কিংবা তার অপছন্দের ব্যক্তিকে বিভিন্ন অজুহাতে বা নামমাত্র কারণে তিনি কঠোর হাতে দমন করেছেন। এমনকি বাংলায় গুপ্ত সম্পদ স্থাপনের সময় সেই কাজে নিয়োজিত প্রত্যেককে তিনি হত্যা করেছিলেন যেনো এই কাজের কোনো সাক্ষী না থাকে।

প্রায় ৪০ বছর যাবৎ রাজত্ব করা সম্রাট অশোকের উপাধি ছিলো ‘দেবনামপ্রিয়’ বা ‘প্রিয়দর্শী’। ‘দেবনামপ্রিয়’ অর্থ হলো ‘যিনি দেবতাদের প্রিয়’। পুরাণ অনুসারে, অশোককে নাকি দেবতারা সহায়তা করতেন। অশোকের স্ত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অসন্ধিমিত্রা, দেবী, কৌরভাকী, পদ্মাবতী এবং তিষ্যরক্ষা। আর তার সন্তানদের মধ্যে মহেন্দ্র, সংঘমিত্রা, তিবল, কুণাল ও চারুমতী হলেন উল্লেখযোগ্য। মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রাকে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অশোকের মৃত্যুর পর মৌর্য সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট হয় তার পৌত্র এবং কুণালের ছেলে দশরথ মৌর্য। কিন্তু অশোক মারা যাওয়ার পর থেকেই দুর্বল হতে থাকে এই সাম্রাজ্য এবং ৫০ বছরের মধ্যেই পতন হয় বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের।

সম্রাট অশোকের হারানো ইতিহাস এতো বিস্তৃতভাবে জানা সম্ভব হয়েছে উইলিয়াম জোনসের উদ্যোগ ও জেমস প্রিন্সেপের নিরলস পরিশ্রমের ফলে। প্রিন্সেপ মারা যাওয়ার পর অশোক ও বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ের চর্চার কেন্দ্র ছিলো দুইজন চীনা ব্যক্তির কিছু লেখা, ৫ম শতকের ফাহিয়ান এবং ৭ম শতকের হিউয়েন সাং এর লেখা।