নজরুলকে বলা হয় ‘বিদ্রোহী কবি’। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ই (১৯২১) নিশ্চয় তাঁর এই পরিচয় লাভের প্রাথমিক ও প্রধান উৎস বা উপলক্ষ ছিল। তবে কেবল সে কারণেই তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ নন। বাংলা কাব্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘অসির ঝনঝনা’ নজরুলের কাব্যেই প্রথম এবং অদ্যাবধি সবচেয়ে প্রবলভাবে শোনা যায়। ‘বিদ্রোহী’ ছাড়াও তাঁর অগ্নি-বীণা (১৯২২) কাব্যগ্রন্থের আরো কিছু কবিতায়, বিষের বাঁশি (১৯২৪), ভাঙার গান (১৯২৪) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে এই সুরটিই প্রবল। তখনকার ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের পটভূমিতে নজরুলের রচনার এই বিদ্রোহী সুর হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি পাঠকের মনে সহজেই সাড়া জাগায়, বিপুল উদ্দীপনার সঞ্চার করে। না হলে কবিতা ও গান মিলিয়ে নজরুলের প্রেম-বিরহ বা অন্য বিষয়ের কবিতা তাঁর বিদ্রোহ বা গণজাগরণমূলক রচনার চেয়ে বেশি বৈ কম হবে না। কিন্তু নজরুলকে যা বাংলা সাহিত্যে তাঁর পূর্বসূরি ও সমসাময়িক অন্য কবিদের তুলনায় স্বতন্ত্র করেছে, অনন্যতা দিয়েছে, সে তাঁর এই বিদ্রোহ-বিপ্লবের কবিতাই। সেই অর্থে তিনি বিদ্রোহী কবি। আর এই পরিচয়ই তাঁকে বাংলা সাহিত্যে যেমন অমরত্ব দিয়েছে, তেমনি আজও লোকপ্রিয় করে রেখেছে।
নজরুলের এই অনন্যতা বা বৈশিষ্ট্য, এর জন্যই জীবনানন্দ দাশ, নজরুলের কবিতা সম্পর্কে যাঁর অভিমত হলো ‘চমৎকার, কিন্তু মানোত্তীর্ণ নয়’ (‘নজরুলের কবিতা’) , নজরুলের রচনায় যিনি ‘মহাকবিতার গভীর প্রসাদ ও প্রতিশ্রুতি’ দুয়েরই অভাব লক্ষ করেছেন (‘কবিতা পাঠ : দু’জন কবি’) , তিনিও বলতে বাধ্য হয়েছেন : “আমাদের দেশে কাজী নজরুলের কবিতার জন্যে সাধারণ পাঠক যে আকর্ষণ বোধ করেন, অন্য কারো কবিতার জন্যে তা করেন কিনা সন্দেহ।” (‘ক.পা.দু.ক.’) এবং “নজরুল ইসলামের আত্মপ্রত্যয় ছিল। সৎ প্রেরণাই মানুষের ও শেষ বিশ্লেষণে মানুষ সমাজের মর্মকথা — এই ঘোষণায় তাঁর অপূর্ব বিশ্বাস ছিল। … বাংলার এ মাটির থেকে জেগে, এ মৃত্তিকাকে সত্যিই ভালোবেসে আমাদের দেশে উনিশ শতকের ইতিহাসকেন্দ্রিক শেষ নিঃসংশয়তাবাদী কবি নজরুল ইসলাম। তাঁর জনপ্রেম, দেশপ্রেম, পূর্বোক্ত শতাব্দীর বৃহৎ ধারার সঙ্গে সত্যিই একাত্ম। পরবর্তী কবিরা এ সৌভাগ্য থেকে অনেকটা বঞ্চিত বলে আজ পর্যন্ত নজরুলকেই সত্যিকারের দেশ ও দেশীয়দের বন্ধু কবি বলে জনসাধারণ চিনে নেবে।” (‘ক.পা.দু.ক.’)
‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখা (১৯২১) ও প্রকাশ থেকে গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগদান (১৯৩২) পর্যন্ত মাত্র এই এক দশকই ছিল বলতে গেলে নজরুলের কাব্যচর্চার কাল। এরপরও তিনি অবশ্য কবিতা লিখেছেন, তবে তা প্রধানত কাব্যগীতি। নজরুলের গ্রামোফোন কোম্পানিতে চাকরি (চুক্তিভিত্তিক) নেওয়ার পেছনে হয়তো জীবিকার তাগিদই ছিল প্রধান। কৃষ্ণনগর থেকে ফিরে আসার পর কলকাতায় স্ত্রী, শাশুড়ি ও দুই পুত্রকে নিয়ে তখন তাঁর অভাবের সংসার। কবিতা লিখে আজও জীবন নির্বাহ করা যায় না, সেদিনও যেত না। তারপরও কেবল জীবিকার প্রয়োজন ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের মোহ তাঁকে পরবর্তী চেতন দিনগুলোতে গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে জুড়ে রেখেছিল ভাবলে ভুল করা হবে। সংগীত রক্তে ছিল, তাঁর সম্পর্কে এমন কথা হয়তো বলা যাবে না। তবে আশৈশব তিনি সংগীতের প্রতি টান অনুভব করেছেন। শুধু যে লেটোর দলেই তিনি তাঁর সংগীত প্রীতি ও প্রতিভার পরিচয় দেন, কিংবা পল্টন জীবনে গানবাজনার চর্চা বজায় রেখেছিলেন, তাই নয়। পল্টন থেকে ফিরে আসার পর তিনি যখন কলকাতায় মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকছেন, সাহিত্য সাধনায় পূর্ণোদ্যমে আত্মনিয়োগ করেননি, নিজে হয়তো দু-চারটার বেশি গানও লেখেননি, তখনও আসরে-আড্ডায় গান গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। সে সময় বেশিরভাগ তিনি রবীন্দ্রসংগীতই গাইতেন, শ্রোতা ও সমাবেশ বুঝে (যেমন শ্রমিক মহল্লায়) কখনো হিন্দি গানও। তখনও তিনি কবি বা লেখক হিসেবে তত পরিচিত নন, সবার কাছে গায়ক হিসেবেই তাঁর সমাদর ছিল।
গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার পর বাজার চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বহুরকম গান তাঁকে লিখতে হয়েছে সত্য। বাণীর মূল্যে যার সবগুলো হয়তো খুব উচ্চমানের হয়নি। নজরুলের লেখা তেমন অনেক গানের সঙ্গে আজ হয়তো আমাদের পরিচয়ও নেই। নজরুলের লেখা তিন বা সাড়ে তিন হাজার গানের মধ্যে কতগুলো গান আমাদের কজনের শোনার সৌভাগ্য হয়েছে? জীবনের এই পর্বে তিনি কাব্যচর্চা থেকে প্রায় দূরে সরে এসেছিলেন। তাঁর নতুন কোনো কবিতার বই এসময় বেরোয়নি। বিশেষ উপলক্ষে (যেমন রবীন্দ্র-প্রয়াণ) এবং গীতিসংকলনের উৎসর্গপত্রে ছাড়া আলাদাভাবে কবিতা লেখেনওনি তেমন। কিন্তু কবিতা ছেড়ে তাঁর এই গানের জগতে মগ্ন হওয়া, একে কি আমরা তাঁর সৃজনপ্রতিভার বিচ্যুতি হিসেবে গণ্য করবো? কোন যুক্তিতে? রেকর্ড কোম্পানি এবং বেতার, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের জন্য লেখা নজরুলের গানও কি আমাদের সংস্কৃতিকে বিপুল ও গভীরভাবে সমৃদ্ধ করেনি? বুদ্ধদেব বসু নজরুলকে ‘রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষার প্রথম মৌলিক কবি’ (‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’) এবং ‘একই সঙ্গে লোকপ্রিয় কবি ও ভালো কবি’র স্বীকৃতি দিয়েও (‘নজরুল ইসলাম’) বলেছেন, নজরুলের কবিতায় ‘কোনো পরিণতির ইতিহাস পাওয়া যায় না’ (‘ন.ই.’) —
“আগাগোড়াই তিনি প্রতিভাবান বালকের মতো লিখে গেছেন, তাঁর নিজের মধ্যে কোনো বদল ঘটেনি কখনো, তাঁর কুড়ি বছর আর চল্লিশ বছরের লেখায় কোনোরকম প্রভেদ বোঝা যায় না।” (‘র.ও.উ.’) বুদ্ধদেব বসুর মতে বরং “গানের ক্ষেত্রে নজরুল নিজেকে সবচেয়ে সার্থকভাবে দান করেছেন। তাঁর সমগ্র রচনাবলির মধ্যে স্থায়িত্বের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি তাঁর গানের।” (‘ন.ই.’) প্রশ্ন হলো, নজরুল কি তবে তাঁর এই কাব্যচর্চার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন? ছিলেন একজন প্রকৃত আত্মসচেতন শিল্পী? সৃষ্টিশীলতার উত্তরপর্বে তাই কবিতা থেকে সরে এসে গানেই নিজের প্রতিভা ও প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেছিলেন? কবিতায় যে বৈচিত্র্য তিনি আনতে পারেননি, যে ভাঙাগড়া বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেননি, জানতেন গানে তা পারবেন?
নজরুল শুধু গান লেখেনই নি। নিজের ও অন্যদের লেখা গানের সুর করেছেন। নিজ হাতে অনেক গানের স্বরলিপিও করেছেন। প্রশিক্ষক হিসেবে শিল্পীদের গান শিখিয়েছেন। তারপর তাঁর তত্ত্বাবধানেই সে সব গান রেকর্ড করা হয়েছে। বাংলা গানে তাঁর মতো এত সুর বৈচিত্র্যের পরিচয় তাঁর আগে বা পরে আর কেউ দিতে পারেন নি। কতরকম সুরের গানই না তিনি লিখেছেন : আধুনিক, ঝুমুর, খেয়াল,ধ্রুপদ, টপ্পা, গজল, রাগপ্রধান, ভাঙা খেয়াল প্রভৃতি। একদিকে উপমহাদেশীয় সংগীত ঐতিহ্যের সঙ্গে বাংলা গানের সংযোগ ঘটিয়েছেন। অন্যদিকে বাংলা লোকগান, আরব-ইরানি সংগীত এমনকি পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গেও তাঁর যে সামান্য পরিচয় ছিল, তারও সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তাঁর লেখা ও সুর দেওয়া গানে। অর্থাৎ, শুধু ‘গ্রামোফোন কোম্পানির ফরমাশে যান্ত্রিক নিপুণতায় গান উৎপাদন’ করে গেছেন (বুদ্ধদেব বসু, ‘ন.ই.’), তাঁর সম্পর্কে এমন ধারণা মোটেও ঠিক নয়। এর পেছনে তাঁর প্রাণের আবেগ, স্ফূর্তি এবং শৈল্পিক দায়বোধও কাজ করেছিল। এ প্রসঙ্গে গ্রামোফোন কোম্পানিতে নজরুলের কাজের ধরন সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী নানা জনের অভিজ্ঞতার যে-বয়ান পাওয়া যায়, তা থেকে মাত্র একজন শিল্পী ইন্দুবালার স্মৃতিচারণার কিছু অংশ আমরা এখানে উদ্ধৃত করছি :
কাজীদার একটি জিনিস দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। শুধু আমি কেন, আমার মতো অনেকেই হতো। রিহার্সেল-ঘরে খুব হৈ-হুল্লোড় চলছে, নানা জনে করছে নানা রকম আলোচনা। কাজীদাও সকলের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করছেন, হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন। একধারে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন খানিক। অনেকে তাঁর এই ভাবান্তর লক্ষ্যই করলো না হয়তো। কাজীদার সেদিকে খেয়াল নেই। এত গোলমালের মধ্যেও তিনি একটুক্ষণ ভেবে নিয়েই কাগজ-কলম টেনে নিলেন। তারপর খসখস করে লিখে চললেন আপনমনে। মাত্র আধঘণ্টা। কি তারও কম সময়ের মধ্যে পাঁচ-ছ’ খানি গান লিখে পাঁচ-ছ’জনের হাতে-হাতে বিলি করে দিলেন। যেন মাথার মধ্যে তাঁর গানগুলি সাজানোই ছিল, কাগজ-কলম নিয়ে লিখে ফেলতেই যা দেরি। … আর শুধু কি এই? সঙ্গে সঙ্গে হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে সেই পাঁচ-ছ’জনকে সেই নতুন গান শিখিয়ে দিয়ে তবে রেহাই দিতেন তিনি। গান লেখার সাথে সাথে সুরও তৈরি করে ফেলতেন কাজীদা। অপূর্ব সব সুর — যার তুলনা হয় না।
এই বর্ণনা থেকে কি মনে হয় রেকর্ড কোম্পানির জন্য যে অজস্র গান নজরুল লিখেছেন তার পেছনে তাঁর জীবিকার তাগিদ বা আর্থিক স্বচ্ছলতার আকর্ষণ একমাত্র ভূমিকা পালন করেছিল? কিংবা চাকরির রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে তিনি তা করেছিলেন? বলা যায় সংগীতের ব্যাপারে আপন আগ্রহ ও সৃজনপ্রতিভাকে কাজে লাগাবার একটা সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন এই রেকর্ড কোম্পানিতে। ১৯৩৬ সালে ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে নজরুল অবশ্য বলেছিলেন, “সিংহ আজ হিজ মাস্টার্স ভয়েসের ট্রেডমার্কের সঙ্গে এক গলাবন্ধে বাঁধা পড়েছে।” রবীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে এবং প্রতিভা বসুকেও একবার তিনি এমন কথা বলেছেন বলে জানা যায়। তাঁর নিজের বলা এই কথাগুলোকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে আমরা এই পর্বে নজরুলের সৃষ্টির মাহাত্ম্যকে মনে হয় কিছুটা খাটো করে দেখেছি। তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে গণ্য করেছি অনেকটা লোকরুচি, বাজার চাহিদা বা বণিকপুঁজির কাছে কবির বিদ্রোহী সত্তার আত্মসমর্পণ হিসেবে।
রেকর্ড কোম্পানির জন্য ছাড়াও নজরুল বেতারের জন্য গান লিখেছেন। বেতারের বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান পরিকল্পনা, পরিচালনা ও উপস্থাপন করেছেন। নিজে সে সব অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন। এমন দুটি অনুষ্ঠান ‘হারামণি’ ও ‘নবরাগ-মালিকা’র জন্য যথাক্রমে লুপ্তপ্রায় বা অপ্রচলিত রাগ-রাগিনী উদ্ধার এবং নতুন রাগ ও সুর সৃষ্টি করেও তার ভিত্তিতে গান লিখেছেন তিনি। যদিও সে সব গানের অনেকগুলোই হারিয়ে গেছে, উদ্ধারের কোনো সম্ভাবনাও নাকি আর নেই। সতেরটির মতো নতুন রাগ তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, বাংলা সংগীতে যা তাঁর একটি মৌলিক অবদান। নজরুল নিজে হারমোনিয়াম, ঢোল, বাঁশি, বেহালা, অরগ্যান, ব্যাঞ্জো ও কর্নেট — দেশীয় ও পাশ্চাত্য ধরনের মিলিয়ে এই সাতটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। এত সব যোগ্যতা নিয়ে তাঁর পূর্বে, সমসময়ে কিংবা পরে কজন বাংলা সংগীতের জগতে পা রেখেছেন? রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বাঙালিকে তাঁর গান গাইতে হবে। প্রায় অনুরূপ আত্মবিশ্বাস নিয়ে নজরুলও বলেছেন, ‘সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই। তবে সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি।’ কিন্তু আমরা বোধহয় তাঁর এ কথাটাকে মনোযোগে নিইনি।
নজরুল যখন রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হন, বাঙালি মুসলমান সমাজে তখনও সংগীতচর্চা বিরোধী মতটি বেশ প্রবল। গানবাজনা জায়েজ কি না তা নিয়ে সমাজের শিক্ষিত অংশের মধ্যে বিতর্ক চলছে। মৌলানা আকরম খাঁ কিংবা শিখা গোষ্ঠীর লেখকরা সাময়িকপত্রে প্রবন্ধ লিখে পরিস্থিতির সামান্যই পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছেন। কোরান-হাদিস থেকে উদাহরণ দিয়েও সংগীতের ব্যাপারে মুসলমান মানসের দ্বিধাদ্বন্দ্ব তাঁরা দূর করতে পারেননি। এ অবস্থায় নজরুল এলেন এবং যাকে বলে জয় করলেন। ইসলামি গান লিখে অচিরকালের মধ্যেই তিনি সংগীতকে বাঙালি মুসলমানের ঘরে ঘরে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। বিদ্রোহ-বিপ্লব কথাগুলোকে আমরা সাধারণত তার রাজনৈতিক তাৎপর্যেই বিচার করতেই অভ্যস্ত। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের তখনকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক পটভূমিতে নজরুলের এই কাজটিও যে কত বড় একটা বিপ্লব ছিল, আমরা কি তা উপলব্ধি করতে পারি? হ্যাঁ, এর জন্য প্রচুর ইসলামি গান নজরুলকে লিখতে হয়েছে। এমনকি হিন্দু শিল্পীদের দিয়েও নাম বদলে সে সব গান রেকর্ড করিয়েছেন তিনি। এর পাশাপাশি নজরুল অনেক শ্যামা সংগীত ও কীর্তনও রচনা করেছেন। সেগুলোও ভক্তহৃদয়ে একই রকম সাড়া জাগিয়েছে।
অবশ্য আমাদের এক শ্রেণির পণ্ডিত ও সমালোচকের দৃষ্টিতে নজরুলের এই শ্যামা সংগীত বা কীর্তন রচনা হলো বাঙালি সংস্কৃতির আবহমান ঐতিহ্যের ধারায় একটি স্বাভাবিক ঘটনা, অর্থাৎ উত্তরাধিকার হিসেবে তাকে গ্রহণ ও অনুসরণ। অন্যদিকে ইসলামি গান রচনাকে তাঁরা মনে করেন যেন একটি আরোপিত ব্যাপার। সরাসরি না বললেও, ঠারেঠুরে একথাটাই বোঝাতে চান। ফলে একেও তাঁরা বিদ্রোহী কবির একরকম বিচ্যুতি বা আপোস হিসেবেই গণ্য করেন। তাঁদের সঙ্গে তর্কে না গিয়েও বলব, এই ইসলামি গান রচনার ক্ষেত্রেও নজরুল যে কত বড় কাণ্ড ঘটিয়েছেন, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। শরাব ইসলামে নিষিদ্ধ পানীয়, অথচ নজরুল কিনা সেই শরাবের সঙ্গে খোদাপ্রেমের তুলনা দিয়ে লিখলেন : ‘খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে’ বা ‘এ কোন মধুর শরাব দিলে আল আরাবি সাকি’! নজরুলের এই গান শুনে ধর্মানুরাগী মুসলমানের মন সেদিন ভক্তি-বেহুঁশ হয়েছে, আজও হয়। কিংবা নজরুল যখন লেখেন ‘রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার’ তখন তাঁর গানের সে আকুতি কি ধর্মের শাস্ত্রীয় বা মৌলবাদী ব্যাখ্যার সঙ্গে মেলে? কিন্তু ধর্মপ্রাণ মানুষকে তা ঠিকই আপ্লুত করে। এও কি শাস্ত্রানুগত বা একান্তভাবে আচারশাসিত ধর্মের বিরুদ্ধে একরকম বিদ্রোহ নয়? নজরুলের পক্ষেই যা করা সম্ভব হয়েছে। সে সাহস ও শক্তিমত্তা (আমি এখানে সাহিত্যিক অর্থেই কথাটা বলছি) তাঁর ছিল বলেই পেরেছেন। ইসলামি গানেও কেবল আরব-ইরানের আবহই তিনি নিয়ে আসেননি। বাঙলার আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে তার সমন্বয় সাধনের কাজটিও তিনি কী চমৎকারভাবে করতে পেরেছেন তার একটি উদাহরণ ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ এই অত্যন্ত জনপ্রিয় ইসলামি গানটি। যেখানে মা যশোদার কোলে কৃষ্ণের আবির্ভাবের বিষয়টির সাযুজ্য পাওয়া যায়। শিল্পী হিসেবে কতটা আত্মবিশ্বাস থাকলে এটা করা সম্ভব?
সংগীতের ব্যাপারে নজরুলের আত্মবিশ্বাসের উদাহরণ হিসেবে এখানে কেবল একটি ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করছি। আমরা জানি নজরুল মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। নাটক ও চলচ্চিত্রের জন্যও তিনি গান লিখেছেন। সে সব গানে সুর দেওয়া ছাড়াও বেশ কয়েকটি নাটক ও চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি ছবিতে গায়কের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন তিনি। নিজে একটি ছবি (‘ধ্রুব’, ১৯৩৪) পরিচালনাও করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘গোরা’ চলচ্চিত্রের (১৯৩৮) সংগীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। নরেশ মিত্র ছিলেন ছবিটির পরিচালক। তো ছবিটি মুক্তি পাওয়ার আগের দিন বিশ্বভারতীর সংগীত বোর্ডের তরফে ছবির গানের সুর নিয়ে আপত্তি তোলা হয়। তাঁদের মতে ছবিতে রবীন্দ্রনাথের যে-গানগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোর সুর যথাযথ হয়নি। এতে ছবির মুক্তি আটকে যাওয়ার উপক্রম হয়। পরিচালকসহ সবার তখন মাথায় হাত! কিন্তু নজরুল বিচলিত হলেন না। সহকারী মানু গাঙ্গুলিকে সঙ্গে নিয়ে একটি ছোট প্রজেক্টর ও ছবির রিলসহ তক্ষুণি তিনি শান্তিনিকেতনে রওনা হলেন খোদ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলতে। নিজের গানের সুরের শুদ্ধতার প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের কঠোর মনোভাবের কথা আমাদের অজানা নয়। নজরুল কিন্তু সেদিন ঠিকই রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। গ্রামোফোন কোম্পানিতে নজরুলের সহকারী সুরকার নিতাই ঘটকের স্মৃতিচারণ থেকে আমরা একথা জানতে পারি।
চেতন দিনগুলোর যে শেষ আট-ন বছর নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানি, মঞ্চ, বেতার ও চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত রচনায় নিজেকে পুরোপুরি ব্যস্ত রাখেন, সে-সময় তিনি কবিতা বলতে গেলে লেখেনই নি। আমরা আগেই সে কথা জেনেছি। ফলে বিদ্রোহী কবির বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় এ সময় আমাদেরকে তাঁর গানেই খুঁজতে হবে। দেশ-সমাজ কিংবা চলমান রাজনীতি সম্পর্কে এ পর্বেও নজরুলের সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর ব্যঙ্গ ও কৌতুকধর্মী গানের সংকলন চন্দ্রবিন্দুতে (১৯৩১)। যেমন, কয়েকটি গানের শিরোনাম : ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’, ‘রাউন্ড-টেবিল কনফারেন্স’, ‘সাইমন কমিশন রিপোর্ট’, ‘প্যাক্ট’, ‘প্রাথমিক শিক্ষা বিল’ প্রভৃতি। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সরকার বইটি নিষিদ্ধ ও এর সব কপি বাজেয়াপ্ত করে। সে নিষেধাজ্ঞা উঠেছিল ১৪ বছর পর, নজরুল যখন সম্পূর্ণ অসুস্থ।
ব্যক্তিগত জীবনেও নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী। তাঁর বিয়ে, পুত্রদের নামকরণ, পারিবারিক আচারপ্রথা সবকিছুর মধ্যেই একটা দ্রোহ বা সমাজ-সংস্কারকে অগ্রাহ্য করার ব্যাপার লক্ষ করা যায়। এখানে কেবল তাঁর বিয়ের বিষয়টাই ধরি। নার্গিসকে নজরুল বিয়ে করেননি পাত্রী তাঁর অপছন্দ ছিল বলে নয়। আলী আকবর খানের দেওয়া বিয়ের শর্ত তাঁর কাছে অসম্মানজনক মনে হয়েছিল। প্রমীলার সঙ্গে প্রণয়কে নজরুল পরিণয় সম্পর্কে স্থায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই দায়িত্বটা তিনি নিয়েছিলেন সমাজ-সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই। এ ব্যাপারে কিছুমাত্র দ্বিধা বা দোদুল্যমানতার তিনি পরিচয় দিয়েছিলেন, কোনো সূত্রে এমন জানা যায় না। প্রমীলাকে বিয়ে করতে গিয়ে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই অনেকের বিরূপতার পাত্র হতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর হিন্দু বন্ধুদের কেউই সে বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন না। ‘মাতৃসমা’ বিরজাসুন্দরীসহ কুমিল্লার সেনগুপ্ত পরিবারের স্নেহ-প্রশ্রয় থেকে বলা যায় চিরতরে বঞ্চিত হয়েছিলেন তিনি। শুধু যে ইসলাম-দর্শন ও মোহাম্মদী-র মতো কোনো কোনো মুসলমান-সম্পাদিত পত্রিকাই নজরুলের রচনার সমালোচনা করতে গিয়ে বারবার তাঁর বিয়ে ও পুত্রদের নামকরণের প্রসঙ্গটি টেনে এনেছে, তাই নয়।
প্রমীলাকে বিয়ে করার পর সেকালের সবচেয়ে নামী বাংলা সাময়িকপত্র প্রবাসীতে (ব্রাহ্মনেতা ও রবীন্দ্র-সুহৃদ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন যার সম্পাদক) নজরুলের লেখা ছাপা বন্ধ হয়ে যায়। কেবল তাই নয়, যে-প্রবাসী এক সময় সাগ্রহে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পুনর্মুদ্রণ করেছিল, সে পত্রিকাতেই এরপর তাঁর সর্বহারা (১৯২৬) কাব্যগন্থের সমালোচনা করতে গিয়ে লেখা হয় : “নজরুল ইসলাম সাহেব সংক্রান্ত সব ব্যাপারই একটা দুর্বোধ্য হেঁয়ালি। তাঁহার কাব্য হেঁয়ালি, তাঁহার কবিবৃত্তি হেঁয়ালি, তাঁহাকে যে তাঁহার ভক্তবৃন্দ ‘নবযুগরবি’ বলিয়া থাকে তাহাও একটা হেঁয়ালি। সব চেয়ে বড় হেঁয়ালি এইটা, কি দেখিয়া বাংলাদেশের সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিক সম্প্রদায় বিনা বাক্যব্যয়ে এই অসম্বদ্ধ প্রলাপভাষীকে কবি বলিয়া মানিয়া লইয়াছে।” (‘পুস্তক পরিচয়’, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪) ঠাকুর পরিবারের বিদুষী কন্যা, ভারতী পত্রিকার সম্পাদক ও কংগ্রেসনেত্রী সরলাদেবী চৌধুরানী সেদিন পত্রিকায় লিখে এই বিয়ের সমালোচনা করেছিলেন। মোটকথা এই বিয়ের ব্যাপারটি নিয়ে নজরুল সেদিন কতটা সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, কীরকম ঝুঁকি নিয়েছিলেন, আজকের দিনে সেটা অনুমান করাও কঠিন। নজরুলের অসুস্থতার, এমনকি মৃত্যুর পরও বিয়ে নিয়ে এই নিন্দা-সমালোচনা তাঁকে একেবারে ছেড়ে যায়নি। সুফী জুলফিকার হায়দারের মতো কেউ কেউ নজরুলের অসুস্থতার সঙ্গেও তাঁর এই বিয়ের ব্যাপারটিকে জড়িত করেছেন।
নজরুল ইসলাম মূলত কবি। রাজনীতিক বা সমাজকর্মী নন। এমনকি প্রাবন্ধিক বা সাংবাদিক পরিচয়টিও তাঁর বেলায় গৌণ। যদিও তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ জাতীয় রচনার সংখ্যা একেবারে কম নয়। আর তার সব না হলেও, বড় অংশটাই চিন্তা ও মননশীলতার পরিচয় বহন করে। এমনকি সংগীতের ক্ষেত্রে তাঁর কিছু কাজ বা অবদানের পেছনে নজরুলের গবেষক মনের উপস্থিতিও টের পাওয়া যায়। কিন্তু যুক্তি বা মনন নয়, সৃজনধর্মিতাই ছিল নজরুল প্রতিভার প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর একজন কবি বা শিল্পীকে বিচার ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সৃজন-প্রতিভার রহস্যময়তার দিকটিকেও আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত। যার অভাবে আমরা হয়তো তাঁর প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে ব্যর্থ হবো। একজন মাইকেল, নজরুল, পুশকিন বা মায়াকোভস্কির মতো কবি, ভ্যান গঁ, পিকাসো বা রামকিংকরের মতো চিত্রশিল্পী কিংবা ঋত্বিক ঘটকের মতো চলচ্চিত্রকার কেন জীবন যাপনে যথেষ্ট গোছালো বা সুশৃঙ্খল ছিলেন না, সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ‘গৃহিণীপনা’র পরিচয় দিতে পারেননি, তা নিয়ে কালোত্তরে আমরা আক্ষেপ ব্যক্ত করতে পারি। জল্পনা-কল্পনা, তর্ক-বিতর্ক করতে পারি। এমনকি বিষয়টি নিয়ে গবেষণা-সমালোচনামূলক প্রবন্ধ বা গ্রন্থ রচনা করতে পারি। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে কোনো মীমাংসা বা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করবে না।
মাইকেল বা নজরুলের জীবনাচরণ, যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা, সর্বোপরি মানস-প্রবণতার মধ্যেই তাঁদের সাফল্য ও ব্যর্থতা দুয়েরই বীজ নিহিত ছিল। প্রায় সমসাময়িক হয়েও বঙ্কিম বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক আর মাইকেল মদুসূদন রবীন্দ্রপূর্ব আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ মহাকবি। উল্টোটাও হতে পারত কি না, কী হলে বা কোন পরিস্থিতিতে সেটাও সম্ভব হতে পারত, চাই কি তাও এক কৌতূহলোদ্দীপক বুদ্ধি বা বিদ্যাচর্চার বিষয় হতে পারে। মধুসূদন প্রথম জীবনে ইউরোপের প্রেমে না পড়লে, হোমার-ভার্জিল-দান্তে ও মিল্টন তাঁকে ওভাবে আচ্ছন্ন না করলে, তাঁর কাব্যচর্চা কোনদিকে গতি পেত আমরা জানি না। ব্যক্তিগত বা সাংসারিক জীবনে তিনি যদি কিছুটা শৃঙ্খলা, দূরদর্শিতা, বাস্তববুদ্ধি বা পরিমিতিবোধের পরিচয় দিতে পারতেন, খুব সম্ভব জীবনটা তাঁর সুসহ হতো, পারিবারিক বিপর্যয় ও আপন জীবনের করুণ পরিণতিটা তিনি এড়াতে পারতেন। কিন্তু ‘আশার ছলনে ভুলে’ অর্থাৎ ইউরোপ যাবার আকাক্সক্ষা থেকে খিস্টধর্মে দীক্ষিত না হলে, তিনি হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়িত এবং সমাজ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হতেন না, এটা যেমন সত্য; তেমনি তাঁর হাত থেকে বিশেষ করে মেঘনাদবধ কাব্যটি পাওয়া যেত কি না, সেটাও লাখ নয় — বলা যায় কোটি টাকা দামের একটা প্রশ্ন। একইভাবে নজরুল যদি সমালোচকদের ভাষায় আরেকটু হিসেবি বা সুশৃংখল জীবন যাপন করতেন, তাঁর সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে তা আর কী ইতিবাচক ফল বয়ে আনত? তিনি কি রবীন্দ্রনাথ হতেন? পৃথিবীর আর কোথাও প্রতিভা বিচারের এ পদ্ধতি চালু আছে কি না জানি না। কিন্তু আমরা যে এ ব্যাপারে খুবই পারঙ্গম, নজরুল বিচারের বেলায় বারবার তার প্রমাণ দিয়েছি।
নজরুলের অধ্যাত্মসাধনার দিকে ঝুঁকবার পেছনে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা ট্রাজেডি, যেমন খুব প্রিয় ও প্রতিভাবান পুত্র বুলবুলের অকাল মৃত্যু, স্ত্রী প্রমীলার আরোগ্যাতীত অসুস্থতা, এসবের একটা বড় ভূমিকা ছিল সন্দেহ নেই। তাঁর ঘনিষ্ঠ ও পরিচিত নানাজনের বক্তব্য-বিবৃৃতি থেকেও এর সমর্থন মেলে। আর যে-কোনো মানুষের বেলায়ই এমনটা ঘটতে পারে। তবে নজরুলের এই অধ্যাত্মচর্চার সঙ্গে তাঁর পরবর্তী অসুস্থতার সম্পর্ক খোঁজার মধ্যে দুরভিসন্ধি যদি নাও থাকে, একটা সরলীকরণের প্রবণতা যে কাজ করে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আবার যাঁরা মনে করেন হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সাধনরীতির সম্মিলন ঘটাবার প্রয়াস — একরকম জগাখিচুড়িই তাঁর মানসিক ভারসাম্যহীনতা বা বৈকল্যের জন্য দায়ী, তাঁরাও বিষয়টিকে ঠিকভাবে বুঝতে সমর্থ হয়েছেন বলে মনে হয় না। উল্লেখ্য, উপমহাদেশীয় ধর্ম বা অধ্যাত্মসাধনার মধ্যে এমন সমন্বয়বাদী প্রবণতা বরাবরই ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মোগল শাহজাদা দারাশিকো (১৬১৫-১৬৫৯) ছিলেন এ ধারার একজন যোগসিদ্ধ পুরুষ। যদিও গোঁড়া ও রক্ষণবাদীরা কখনোই এ ধারাটিকে স্বীকৃতি দেয়নি। আর আজ তো তা এক বড় রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
বিপ্লবী অরবিন্দ যখন আলীপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জেল খাটছেন, তখন কারাগারেই নাকি দেবী তাঁকে দর্শন দেন। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর স্বদেশের মুক্তি সাধনার পথ পরিত্যাগ করে তিনি একান্তভাবে যোগসাধনায় নিবিষ্ট হলেন। পণ্ডিচেরিতে আশ্রম খুলে বাকি জীবন অধ্যাত্মচিন্তা ও ধ্যানে কাটিয়ে দিলেন। অরবিন্দের অনুজ ও স্বদেশী-বিপ্লববাদের আরেক মন্ত্রগুরু বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, যাঁর নির্দেশে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকি বোমা হামলা চালিয়েছিলেন, তিনিও বিপ্লবের পথ পরিত্যাগ করে যোগী হন। নজরুল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নি-বীণা এই সাবেক বিপ্লবীকেই উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে বারীন্দ্রকুমারকে ‘ভাঙা-বাঙলার রাঙা-যুগের আদি পুরোহিত, সাগ্নিক বীর’ বলে অভিহিত করে নজরুল লেখেন, ‘অগ্নি-ঋষি! অগ্নি-বীণা তোমায় শুধু সাজে’। বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ছাড়াও কবি নিশিকান্ত, নজরুল-সুহৃদ ও গায়ক-গীতিকার দিলীপকুমার রায়, সংগীতজ্ঞ ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রস্নেহধন্য সংগীতশিল্পী সাহানা দেবী প্রমুখ অনেকেই আগেপরে পণ্ডিচেরিতে গিয়ে কিংবা অন্যভাবে যোগী জীবনে দীক্ষা নিয়েছিলেন। এই তালিকাটা আরও বড় করা যায়। আশ্রমবাসী না হয়েও নজরুল একই পথের পথিক হন। পূর্বোক্তদের বেলায় এটা যদি দোষের না হয়, নজরুলের বেলায়ই বা হবে কেন? সে কি কেবল তিনি মুসলমান ছিলেন বলে? নজরুল জীবনের এই আধ্যাত্মিক পর্বটি নিয়ে গভীর অনুসন্ধান বা গবেষণার অভাবে বিষয়টি নিয়ে একরকম ধোয়াশা রয়ে গেছে। যার সুযোগে অনেকের মনগড়া এমনকি উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সহজে কল্কে পেয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আবার অতিরঞ্জনমুক্ত বা নিরাসক্ত জীবনী ‘পুনর্গঠনে’র নামেও ‘মনে হয়’, ‘সম্ভবত’, ‘খুব সম্ভব’, ‘হতে পারে’, ‘অসম্ভব নয়’, ‘আমার মনে হয়’ বলে নিজস্ব কিছু অনুমান দাঁড় করানো হচ্ছে। অর্থাৎ তথ্যভ্রান্তি দূর করতে গিয়ে নতুন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে।
নজরুলের জন্ম হয়েছিল এক ‘গ্রামীণ, দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত’ পরিবারে। সাংস্কৃতিক মানেও পরিবারটি ছিল পশ্চাদপদ ও ধর্মাশ্রিত। এই পারিবারিক পটভূমিই “তাঁর চরিত্রে ভক্তিবাদ এবং রহস্যময়তার বৈশিষ্ট্য এঁকে দিয়েছিল। আর ১৯২০-এর দশকের একটা সময় ছাড়া এই দুই বৈশিষ্ট্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ তিনি কোনোদিন কাটিয়ে উঠতে পারেননি।” সম্প্রতি আমাদের একজন স্বনামখ্যাত পণ্ডিত ও গবেষক তাঁর লিখিত নজরুল-জীবনীর বলা যায় প্রধান প্রতিপাদ্য করে তুলেছেন এ কথাটাকে। নজরুল তাঁর বাল্যবয়সে মক্তবে পড়ালেখা করেছেন, পীরের মাজারে খাদেমের কাজ করেছেন। এগুলোকে লেখক নজরুলের ভক্তিবাদের উৎস হিসেবে নির্দেশ করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো জন্মেছিলেন কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। জোড়াসাঁকোর সেই ঠাকুর পরিবার ছিল সেকালে শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার দিক থেকে খুবই অগ্রসর। তো রবীন্দ্রনাথের ভক্তিবাদ বা পরমেশ্বর চেতনা কোত্থেকে এলো? রবীন্দ্রনাথের লেখা ব্রহ্মসংগীতগুলো কি ভক্তিবাদী রচনা নয়? রবীন্দ্রনাথ তো নিজে নিয়মিত ব্রহ্মমন্দিরে উপস্থিত থেকে উপাসনা পরিচালনা বা তাতে পৌরাহিত্য করতেন। ব্রহ্মসংগীতগুলোও তিনি লিখেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মন্দিরের প্রার্থনাসভায় গাওয়ার জন্য। নিজেই গাইতেন সে সব গান। আমরা কি ধরে নেব (প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে) ‘স্বল্পশিক্ষা’ই রবীন্দ্রনাথের বেলায়ও তাঁর চেতনাকে ‘অপুষ্ট’ করে রেখেছিল? অন্যদিকে বিদ্যাসাগর তো জন্মেছিলেন গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় পাচকের কাজ করে সংসার প্রতিপালন করতেন। শিক্ষা-সংস্কৃতির দিক থেকেও বিদ্যাসাগরের পরিবার মোটেও আলোকিত ছিল না। কলকাতায় গিয়েও বিদ্যাসাগর তখনকার আধুনিক শিক্ষার সূতিকাগার বলে পরিচিত হিন্দু কলেজে নয়, পড়েছিলেন সংস্কৃত কলেজে। অথচ সে সময়ের পটভূমিতে বিদ্যাসাগর ছিলেন বাঙলার সবচেয়ে আধুনিক, যুক্তিবাদী ও প্রায় বস্তুবাদী মানুষ। আমাদের উল্লিখিত নজরুল-জীবনীকারের যুক্তি-শৃঙ্খলা থেকে আমরা তবে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছবো?
মানুষের নশ্বর অস্তিত্ব জরা-ব্যাধির (তা সে শারীরিক-মানসিক যাই হোক) আওতাধীন। যে-কোনো সময় তা যে-কাউকে আক্রান্ত ও ধরাশায়ী করতে পারে। প্রতিভাবানরাও এর ব্যতিক্রম নন। কিন্তু চেতনা অবিনশ্বর। মানুষের সৃজনকর্মের মধ্য দিয়ে তা ভবিষ্যতের দিকে প্রবাহিত হয়। নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় ধরা আছে তাঁর কবিতা, গান ও অন্যান্য রচনায়। আজও তা আমাদের জাগ্রত ও উদ্দীপ্ত করে। অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রেরণা দেয়। আগামীদিনের মানুষকেও দেবে। তাঁর সম্পর্কে ‘চিরবিদ্রোহী’ কথাটা আমি এই অর্থেই ব্যবহার করেছি।
লেখকঃ Morshed Shafiul Hasan