আমরা সবাই ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম শুনেছি সেই ছোটবেলা থেকেই। আমাদের এই হিরোকে নিয়ে কিছু না লিখলেই নয়। তাঁর জন্ম হয় ১৮২০ সালে পশ্চিম বাংলার এক অসচ্ছল ব্রাহ্মণ পরিবারে। তিনি একাধারে ছিলেন একজন দার্শনিক, শিক্ষক, লেখক, প্রকাশক, বহুবিষয়ে বিদ্যাজ্ঞ (polymath) এবং সমাজ সংস্কারক। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। ২০০৪ সালে বিবিসি’র এক জরিপে ঈশ্বর চন্দ্র হন নবম “সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ট বাঙ্গালী”। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে তিনি রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে কার্যত একাই লড়াই করে গিয়েছিলেন। তিনি সে সময় রক্ষণশীল সমাজের সাথে যে বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তার তীব্রতা ছিলো প্রচন্ড।


অত্যন্ত ছোট থাকতেই তাঁর পরিবার তাকে পাঠিয়ে দেয় কলকাতার ভগবৎ চরণ পরিবারের সাথে থাকার জন্য। ঈশ্বর চন্দ্রের পরবর্তী জীবনে ভগবৎ পরিবারের অনেক প্রভাব রয়েছে, বিশেষ করে রায়মনি চরণের সমাজ সংস্কারের চিন্তা-ভাবনায় প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত হন তিনি। রায়মনি ছিলেন ভগবৎ চন্দ্রের সবচেয়ে ছোট মেয়ে, এবং তাঁর কাছ থেকে ঈশ্বর চন্দ্র পান মাতৃসুলভ ভালোবাসা। এই রায়মনি’র প্রত্যক্ষ প্রভাবে ঈশ্বর চন্দ্র নারীদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই শুরু করেন। পরবর্তী বছরগুলোতে বাঙ্গালী সমাজে পুরুষদের সাথে নারীর সমান মর্যাদার সংগ্রামে তিনি ছিলেন এক সাহসী যোদ্ধা এবং অগ্রপথিক।

ঈশ্বর চন্দ্রের সবচেয়ে বড় অবদান হলো বিধবা বিবাহের প্রচলন এবং মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। এ দু’টো করতে গিয়ে তিনি কট্ররপন্থী হিন্দুদের রোষানলে পড়েন। ঐ সময় ভারতে হিন্দু বিধবাদের আবারো বিয়ে করা ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। শুধু তাই নয়, বিধবাদের স্থান সমাজে, এমন কি নিজ পরিবারে ছিল অত্যন্ত অবহেলিত। অনেক বিধবাকে বাধ্য করা হতো মাথার সব চুল ফেলে দিতে এবং সাদা শাড়ী পড়তে, যাতে পুরুষদের কাছে বিধবরা আকর্ষণীয় না হয়ে উঠতে পারে। বিধবাদের সাথে সমাজের এমন আচরণ ঈশ্বর চন্দ্র মনে করতেন অবিচার এবং অগ্রহনযোগ্য। তিনি কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। রায়মনিও মনে প্রাণে বিধবাদের প্রতি সমাজের এমন আচরণের চির অবসান চাচ্ছিলেন।

বিদ্যাসাগরকে আশীর্বাদ করছেন বিধবারা। নয়া গ্রামের বাহাদুর চিত্রকরের আঁকা পটচিত্র। ছবি সৌজন্য চালচিত্র অ্যাকাডেমি

তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিধবা বিবাহের পক্ষে আইন করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তিনি কট্ররপন্থী হিন্দুদেরকে প্রমান করতে বলেন, হিন্দু ধর্মের কোন শাস্ত্রে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি হিন্দু পন্ডিতদেরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন শাস্ত্র মতে প্রমান করতে যে, বিধবা বিবাহ হিন্দু ধর্মে নিষিদ্ধ। ঈশ্বর চন্দ্রকে এ যুদ্ধে জয়ী হতে তাঁকে হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্রের উপর গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছিল। তিনি নিজেই প্রমান করে দেন, হিন্দু বৈদিক শাস্ত্রে বিধবাদের আবারও বিয়ের করার কোনো বাধা নেই।

ঈশ্বর চন্দ্র ইংরেজদের বাধ্য করেছিলে হিন্দু বিধবাদের আবারো বিয়ে করার আইন পাশ করতে। লর্ড ডালহৌসির ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে এবং ঈশ্বর চন্দ্রের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ২৬শে জুলাই ১৮৫৬ সালে ‘বিধবা পুনর্বিবাহ আইন’ পাশ করা হয়। তিনি এখানেই থেমে থাকেন নি। এ আইন যাতে কার্যকর হয়, তার জন্য তিনি বিধবাদের খুঁজে বের করেন এবং তাদের পরিবারকে বোঝাতে থাকেন যে, এ আইন হিন্দু বৈদিক শাস্ত্রের বিপক্ষে নয়। অনেক বিধবাকে তিনি নিজেই বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এমনকি তাঁর নিজের একমাত্র ছেলেকেও ১৮৭০ সালে এক কিশোরী বিধবার সাথে বিয়ে দেন। এখনো অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য যে, তিনি কিভাবে তখনকার শক্তিশালী রক্ষনশীল সমাজের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ একা লড়াই করে জয়ী হয়েছিলেন।

ছাত্র জীবন থেকেই ঈশ্বর চন্দ্র ছিলেন খুবই মেধাবী। বই পড়তে তিনি এতই ভালোবাসতেন যে রাতের বেলায় রাস্তার লাইট পোস্টের আলোতে তাঁকে একাকী বই পড়তে দেখা যেত। রাতে বাড়িতে বাতি জ্বালিয়ে পড়ার মতো আর্থিক অবস্থা তাঁর ছিলো না। তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন ১৮৪১ সালে। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা এবং বিস্তৃতি এত ব্যাপক ছিল যে, সংস্কৃত কলেজ তাঁকে “বিদ্যাসাগর” (Ocean of Knowledge) উপাধি দিয়ে ভূষিত করে। ঈশ্বর চন্দ্রের শিক্ষার বিষয় ছিল সংস্কৃত, আইনশাস্ত্র, দর্শন, বেদ শাস্ত্র এবং জ্যোতিষবিদ্যা। পরবর্তীতে তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজ এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে শিক্ষকতা করেন। এই শিক্ষকতা জীবনে তিনি তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক সংস্কার করেন। সে সময় সংস্কৃত কলেজে নিম্নবর্ণের কোন হিন্দুকে সংস্কৃত পড়তে দেওয়া হতো না। কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে তিনি নিম্নবর্ণের ছাত্রদেরকে ভর্তি করা শুরু করলেন।

১৮৫৬ সালে কলকাতায় তিনি “বাড়িশা উচ্চ বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয়টি তিনি পরিচালনা করেন সম্পূর্ণ ভাবে তার নিজের আধুনিক চিন্তা ভাবনা দিয়ে। ঐ সময় বিশিষ্ট ইংরেজ শিক্ষাবিদ এবং গনিতবিদ জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন ভারতে মেয়েদের জন্য একটি বিদ্যালয় খোলার উদ্যোগ নেন। ঈশ্বর চন্দ্র বেথুনের সাথে মিলে ভারতের প্রথম মহিলা বিদ্যালয়টি খুলেন ১৮৪৯ সালে।

ঈশ্বর চন্দ্রের আরেকটি অবদান হলো বাংলা বর্ণমালা পুনর্বিন্যাস করা। তাঁকে বলা হয় আধুনিক বাংলা ভাষার উদ্ভাবক। তিনি বারোটি স্বর এবং চল্লিশটি ব্যঞ্জন বর্ণের সমন্বয়ে বাংলা টাইপোগ্রাফিকে অনেক সহজ করেন। সংস্কৃত বর্ণ ৠ, ঔ এবং আরো কয়েকটি বর্ণ তিনি কেটে বাদ দিয়ে তিনটি নতুন সমসাময়িক উচ্চারণপূর্ণ বর্ণ, ড়, ঢ়, য় বাংলা বর্ণমালায় যুক্ত করেন। তিনি অনেকগুলো বই লিখেন, তার মধ্যে “বর্ণ পরিচয়”( ১৮৫৪) বাংলা সাহিত্যে একটি অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।
বিদ্যাসাগর তাঁর সাধারণ জীবনযাপন, নির্ভীকতা, আত্মত্যাগের চেতনা, শিক্ষার প্রতি নিষ্ঠাবানতা এবং নিপীড়িত মানুষের পক্ষে লড়াই করে এক কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। ঈশ্বর চন্দ্রের আজকের বিদ্যাসাগর হবার পেছনে তাঁর মা’র অবদান অসীম। বিদ্যাসাগরের মনন গঠন, জীবন-চিন্তা, সামাজিক দায়িত্ববোধ –এসব তিনি শিখেন তাঁর মা’র কাছ থেকেই। ঈশ্বর চন্দ্র বাঙালীর এক গর্ব। এই কিংবদন্তীকে বাঙালী ভুলে যাবে কি করে?

তথ্য সূত্র:
১) Lal, Mohan, “Ishwarchandra Vidyasagar.” The Encyclopaedia of Indian Literature. Sahitya Academy. 2006.
২) Chatterjee, Aparna, “Ishwar Chandra Vidyasagar: A Profile of the Philanthropic Protagonist.” Boloji. 2007.