নবনীতা যখন প্রেসিডেন্সিতে পড়েন সে সময় অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তিনি প্রেমে পড়েন। তার মা রাধারানি দেবী মেয়েকে বলেছিলেন, প্রেম করো ঠিক আছে, তবে পর্দা টাঙ্গানো রেঁস্তোরা, সন্ধ্যার পর লেকের ধারে আর সিনেমা, এই তিনটি জায়গায় যাবেনা। রাধারানি দেবী মেয়েকে আঁচলে বেঁধে মানুষ করেননি, আবার প্রেমে স্বাধীনতা দিয়েও সেটা যাপনের সীমারেখা টেনে দিয়েছিলেন।
সেই প্রেম শেষপর্যন্ত বিয়েতে গড়ায় (১৯৫৯) সতেরো বছর পরে ১৯৭৬ সালে বিবাহবিচ্ছেদও ঘটে।তারপরেও দুজনের প্রতি দুজনের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আজীবন অটুট ছিলো। ১৯৯৮-এ অমর্ত্য সেন যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন, নবনীতার আনন্দোচ্ছ্বাসে অভাব ছিল না। অমর্ত্য সেনকে নিয়ে তিনি প্রবন্ধও লিখেছেন।
আবার সে-সময়ের উপর তিনি একটি স্মরণীয় ছোটগল্পও লেখেন ‘জরা হটকে, জরা বাঁচকে, ইয়ে হ্যায় নোবেল মেরি জান’।
অন্য দিকে, সেই সময়ে তাঁর সমসাময়িক বলিষ্ঠ নারীকণ্ঠ কবিতা সিংহের মৃত্যুতেও শোকপ্রকাশে এগিয়ে গিয়েছেন। তার স্বচ্ছন্দ তার বিচরণ ছিলো সবখানে , তিনি ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা মনের মানুষ।
নবনীতার মা রাধারানি দেবি (১৯০৩-১৯৮৯) ছিলেন বাল্যবিধবা। তখনকার রক্ষণশীল পুরুষশাসিত সমাজের এক প্রগতিশীল নারীকণ্ঠ। কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনের আয়োজন করা বিতর্কসভায় ‘ডিভোর্স উচিত কিনা’ বিষয়ে অনুরূপা দেবীর বিপক্ষ বক্তব্যকে যুক্তি দিয়ে জোরাল বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন মাত্র তেরো বছর বয়সে। তিনি সাহিত্যচর্চা করতেন, এবং ‘রবিবাসর’-এর সাহিত্যের আড্ডায় তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি ‘অপরাজিতা’ ছদ্মনামে কাব্যচর্চা করে সাড়া জাগিয়েছিলেন। ‘পুরবাসিনী’ (১৯৩৫) কাব্যে তা আরও তীব্র কৌতূহলের বিষয় হয়ে ওঠে। প্রমথ চোধুরী বলেন কাব্যটি কোনও পুরুষ কবির পক্ষে লেখা সম্ভব নয়।
সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ দেবের ‘কাব্য-দিপালী’ পত্রিকাটি সম্পাদনায় সাহায্য করতে গিয়ে তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হয় এবং পরবর্তীতে বিয়ে হয় । এই বিয়েতে তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টাপাধ্যায়ে, ও প্রমথ চৌধূরীর অনুমতি নিয়েছিলেন।
তাদের দুজনের মধ্যে বয়সের ব্যাবধান ছিলো পনেরো বছরের, সে সময় প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেই তাদের বিয়েটা হয়। তিনি কন্যাসম্প্রদানেও নজির রাখলেন, নিজেই নিজেকে সম্প্রদান করলেন। ১৯৩১ সালের ৩১মে সেই বিয়ের পরের দিন সংবাদপত্রে লেখা হয় ‘রাধারানি-নরেন্দ্র দেব বিবাহ: কন্যার আত্মসম্প্রদান’।
এই বিয়েতে তার প্রথম স্বামীর মায়েরও অনুমতি ছিলো।
রাধারানির প্রথম সন্তানের অকাল মৃত্যুর পর নরেন্দ্র দেব কলকাতার হিন্দুস্থান পার্কে ‘ভালোবাসা’ নামে একটি বাড়ি তৈরি করেন।
সেই ‘ভালোবাসায়’ (১৯৩৮) তাঁদের ‘খুকু’, শরৎচন্দ্রের ‘অনুরাধা’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘নবনীতা’র বেড়ে ওঠা। তিনি যে তাঁর মায়েরই মেয়ে, সেটা তিনি প্রতিপদেই প্রমান করে ছেড়েছেন।তাঁর নারীবাদী চেতনা কখনও উগ্রভাবে প্রকাশ পায়নি।সে শিক্ষা তিনি তার মায়ের কাছেই পেয়েছিলেন।
কন্ঠস্বর উঁচু না করেও যে বৈপ্লবিক চেতনার বিস্তার করা যায়, সেটা লেখিকা নবনীতা দেবসেন দেখিয়ে দিয়েছেন। নারীবাদী লেখিকা হিসাবে কখনই তিনি সরব হয়ে ওঠেননি। অথচ, তিনি সেটা পারতেন কারন তার পরিবারিক শিক্ষার মধ্যেই সে রসদ মজুত ছিল।
তার মধ্যে পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের বৈষম্যপীড়িত জীবনবোধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চেতনায় নারীবাদের পরিচয় নানা ভাবেই প্রকাশ পায় । বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন।
ব্যক্তিত্বের বহুমুখী বিস্তারে নবনীতা মা রাধারানিকেও ছাপিয়ে যান। সময়ের সাথে সাথে তিনি পুরস্কার-সম্মাননায় ‘পদ্মশ্রী’, ‘সাহিত্য একাদেমি’, ‘বিদ্যসাগর পুরস্কারে ভূষিত হন।
লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় (পিএইচডি) ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও গবেষণার ব্যাপ্তি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুদীর্ঘকাল (১৯৭৫-২০০২) অধ্যাপনা করেন, পাশাপাশি আমেরিকার কলোরাডো কলেজে মেটাগ প্রফেসর, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাধাকৃষ্ণণ স্মারক লেকচারার ছিলেন।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও তিনি আত্মতৃপ্তি পাননি, তার স্বভাবমতোই তিনি নিজেকে উচ্চশিক্ষার সোপানে শামিল করেছিলেন— হিন্দি, ওড়িয়া, অসমীয়া, সংস্কৃত, জার্মান, হিব্রু এবং ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় তিনি ছিলেন পারদর্শী।
তিনি ট্রাকে চড়ে অরুণাচল সীমান্তে ভারত-চিনের ম্যাকমোহন লাইন ছুঁয়ে এসেছিলেন, তার ভ্রমণকাহিনি ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমোহনে’।আবার হায়দ্রাবাদের সেমিনারে গিয়ে একাই চলে গিয়েছেন কুম্ভমেলায়।তার লেখনীর ছোঁয়ায় ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’ ভ্রমণসাহিত্যে প্রতীয়মান হয়।এ ভাবে দুরারোগ্য ব্যধিকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়েছেন পৃথিবীর দুর্গম পথে, বাংলা সাহিত্যে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতায় অসংখ্য ফসল ফলিয়েছেন অবলীলায়।
তিনি একাধারে ছিলেন উপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, কবি এবং শিক্ষাবিদ।
দীর্ঘদিন ধরে তিনি ক্যানসারে ভুগছিলেন, কিন্তু তার লেখনী থেমে ছিলনা।তাদের দুই কন্যা——
জ্যেষ্ঠা অন্তরা সাংবাদিক ও সম্পাদক এবং কনিষ্ঠা নন্দনা অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী। ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর ৮১ বছর বয়সে কলকাতায় তাঁর নিজের বাড়িতে ( ভালোবাসা) তিনি মারা যান।