পৃথিবীর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে হাজারো রহস্য। যার বেশির ভাগই ইতিমধ্যে সমাধান হয়েছে, বাকিগুলো সম্পর্কে মানুষ এখনও নিশ্চিত নয়। তেমনই এক রহস্যের নাম- নাজকা লাইন । নাজকা লাইন হচ্ছে পৃথিবীর বুকে এমনই এক আবিস্কার যা দেখলে মানব সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে আপনার ধারণা পাল্টে যাবে। ধারণা করা হয় হাজার হাজার বছর আগে কোনো উন্নত সভ্যতা ছিল, যা পরে কোন এক ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অথবা প্রাচীনকালে কোনো বুদ্ধিমান এলিয়েনের দল পৃথিবীতে এসেছিল যারা এই নিদর্শনগুলো রেখে গেছে। আজ আমরা সেই নাযকা লাইন সমর্কে জানার চেষ্টা করবো।

নাজকা লাইন পেরুর নাজকা মরুভূমিতে অবস্থিত। যা লিমা শহর থেকে ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণে নাজকা এবং পাল্পা শহরের মাঝে অবস্থিত। মরুভূমিটির প্রায় ৪৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকার বিভিন্নস্থানে আঁকা হয়েছে অসংখ্য নকশা। জীবজন্তু, ফুল, গাছ, এলিয়েন সহ আরও অসংখ্য জ্যামিতিক নকশা। এসব নকশার কোনো কোনোটি আবার ২০০ মিটার পর্যন্ত বড়।

নাজকা লাইন প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৩০ সালে। তখন এই এলাকা দিয়ে প্রথম বিমান চলাচল শুরু হয়। বিমানের যাত্রীরা এই বিশাল নকশা ও ছবি দেখে অবাক হয়ে যায়। তার পত্রিকা অফিসে খবরটা জানালে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তখন থেকেই নাজকা লাইন পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
যদিও নাজকা লাইন কাদের তৈরি এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। তবে বেশিরভাগ গবেষকরা ধারণা করেন, সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা আনুমানিক খ্রি.পূর্ব ৪০০-৬৫০ মাঝে এই নকশাগুলো একেছিল।

আগেই বলেছি, আনুমানিক খ্রি.পূর্ব ৪০০-৬৫০ দিকে নাজকা লাইনগুলো আঁকা হয়েছে। কিন্তু তখনকার মানুষদের কাছে না ছিল কোনো উন্নত প্রযুক্তি বা উন্নত যন্ত্রপাতি। তাহলে ছবিগুলো পাথুরে মরুতে আকা হল কীভাবে? বিজ্ঞানীদের গবেষণায় জানা গেছে যে, নাজকাতে নকশা ও ছবি আঁকা হয়েছে আয়রন অক্সাইডসমৃদ্ধ লালচে-বাদামি নূড়ি পাথর সরিয়ে ভেতরের অপেক্ষাকৃত সাদা মাটিকে উন্মোচন করে। নক্বশাগুলোর বেশিরভাগ লাইনই ৪-৬ ইঞ্চি গভীর যা শক্ত কাঠের টুকরো এবং পাথর দ্বারা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- তাদের আঁকা ছবিগুলো নকশামত হচ্ছে কিনা তা তারা কীভাবে দেখেছিল? অবশ্যই ছবিগুলো আঁকার সময় তা নকশামাফিক আঁকা হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য কাউকে না কাউকে অনেক উপরে উঠতেই হয়েছিল। কিন্তু সেটাইবা কি করে সম্ভব? তখন তো উড়োজাহাজ আবিস্কার হয়নি। আর আশেপাশে তো কোন পাহাড়ও নেই।

নাজকা লাইনের বেশিরভাগ ছবিই এতোটাই বিশাল যে তা দেখতে হলে কমপক্ষে ১০০ ফুট উপরে উঠতে হবে। প্রাচীন ওই সভ্যতার পক্ষে তো এটা ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব। ধারণা করা হয় নাজকার প্রাচীন বাসিন্দারা বেলুন আবিষ্কার করেছিল। তা দিয়ে তারা আকাশে উড়তে পারত। যদিও এ যুক্তি অনেকেই মানতে চায় না। কারণ তারা যদি বেলুন আবিষ্কার করেই থাকতো তাহলে সে প্রযুক্তি হঠাৎ হারিয়ে গেল কীভাবে? তাছাড়া বেলুন ব্যবহারের কোনো প্রমাণও তাদের সভ্যতার ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায় না। আবার অনেক গবেষক ধারণা করেন যে, প্রথমে ছোট নকশা আকা হত তারপর এর অনুকরণে বড় করে মুল নকশাটা আকা হত। কিন্তু এখানেও পর্যবেক্ষণের সমস্যা রয়ে যায় তাই এই ধারনাও তেমন গ্রহণযোগ্য নয়।

নাজকা লাইন আঁকা হয়েছে মরুময় অঞ্চলের শক্ত পাথুরে জমির উপর। এই এলাকায় সার বছর বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। তাই এমন একটি স্থানে এ ধরনের জটিল সব নকশা আর ছবি আঁকার মানে কি হতে পারে তার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পায়নি গবেষকরা। তবে কিছু গবেষক একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা মনে করেন, প্রাচীন নাজকার বাসিন্দারা তাদের ধর্মীয় রীতিনীতির অংশ হিসেবে এই নকশাগুলো তৈরি করেছিল। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এই নকশাগুলো ছিল মূলত অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ক্যালেন্ডার, যা ব্যবহার করে নাজকার অধিবাসীরা দিন তারিখ গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা রাখার চেষ্টা করতো। তবে সবচেয়ে বেশি গবেষক একমত হয়েছেন যে- বৃষ্টিপাতের জন্য প্রার্থনা ও জল প্রবাহের লাইনের জন্য এগুলো তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে দুটো প্রশ্নের উত্তর অজানাই রয়ে যায়। ১. জল প্রবাহের জন্য সরল লাইন করাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত ছিল, এমন পশু পাখির নকশা আঁকার কি দরকার ছিল? ২. এলাকাটির জলবায়ু অতীতে যে খুব বেশি পরিবর্তিত ছিল, তেমন কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না। তাহলে এই লাইনগুলো দিয়ে জল কীভাবে আসতো?

নাজকা নকশা: এলিয়েন

বিজ্ঞানী ও প্রত্নতাত্ত্বিরা নাজকা লাইনের রহস্য সম্পর্কে গ্রহনযোগ্য কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেনি বলে কিছু আজব তত্ত্ব চালু হয়েছে। সুইস গবেষক এরিখ ভন দানিকেনের মতে, নাজকা লাইন এলিয়েনদের সাহায্যে তৈরি করা হয়েছিল। এলিয়েনদের সহায়তায় নাজকার প্রাচীন বাসিন্দারাই এগুলো তৈরি করেছিল। এবং তিনি মনে করেন নাজকা মূলত ছিল এলিয়েনদের বিমানবন্দর। যেখানে এলিয়েনদের স্পেশসিপ ওঠানামা করত। আর এখানে আঁকা সব নকশা মূলত স্পেশসিপ ওঠানামারই সঙ্কেত। দানিকেনের এই তত্ত্ব বেশ আকর্ষণীয় এবং চমকপ্রদ হলেও পর্যাপ্ত কোনো প্রমাণ না দিতে পারায় তার এই তত্ত্বের সত্যতা নিরূপণের কোন সুযোগ নেই!

তাই তো, সেই ১৯৩০ সালে আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে আজও এই নাজকা লাইনের রহস্যের কোন সমাধান হয়নি। ভবিষ্যতে কি এর কোন সমাধান পাওয়া যাবে? আমরা অপেক্ষায় থাকবো!

ছবি: ইন্টারনেট
লেখকঃ  পার্থ ভৌমিক