ইরানের খুরসানের অন্যতম প্রধান শহর হচ্ছে নিশাপুর। ইরানে এক সময় আরো অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য শহর ছিলো; যেমন, বালখ, মেরভ এবং হেরাত। বর্তমানে এই হেরাত আর বালখ আফগানিস্তানে অবস্থিত।
সিল্ক রোডের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই নিশাপুর, যেটি এশিয়া মাইনর ও মেসোপটেমিয়াকে ভারত এবং চীনের সাথে যুক্ত করে। এ কারণেই ৩য় শতাব্দীতে ইয়াকুত তার বিখ্যাত ভৌগালিক ডিকশনারিতে নিশাপুরকে ‘প্রাচ্যের প্রবেশদ্বার’ বলে উল্লেখ করেন।
উর্বর ভূমির কারণে নিশাপুর বসবাসের জন্য অত্যন্ত উপযোগী ছিলো, তাই প্রাচীনকাল থেকেই এটি একটি জনবহুল শহরে পরিণত হয়েছিলো। সাসানীয় রাজা প্রথম শাপুর অথবা দ্বিতীয় শাপুর এই শহরটির পত্তন করেন বলে তাদের নাম অনুসারেই এর নাম ‘নিশাপুর’ রাখা হয়েছিলো।
ইসলামের তৃতীয় খলিফা ওসমানের হাতেই মূলত এই সাসানীয় শহরটির পত্তন ঘটে। বস্তুতপক্ষে উমায়েদ খলিফার বিরুদ্ধাচরণ এই খুরাসান থেকেই শুরু হয়। আবু মুসলিম নামে একজন পার্সিয়ান ব্যক্তি নিশাপুরে প্রবেশ করেন এবং তা জয় করে নেন। সেই সাথে উমায়েদ খলিফাদের শেষ ঘন্টা বেজে যায়।
এই ঘটনার মধ্য দিয়েই সিরিয়া থেকে ইরাকে মুসলিম ক্ষমতা স্থানান্তরিত হয়। আরব ইতিহাসে এই ঘটনাটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ও গুরুতর বিষয়। কারণ এভাবেই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে ইরাক। আর সিরিয়া পেছনে পড়ে যায়। আরবের ইতিহাসে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।
নিশাপুর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হওয়াতে প্রায় ১৮ বার এই শহরটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং ১৮ বারই এটিকে পুনঃর্গঠন করা হয়। এতো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাগদাদ এবং কায়রোর সঙ্গে একটি সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে সমানভাবে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে নিশাপুর।
নিশাপুর সিরামিক, মৃৎশিল্প, মেটাল ওয়ার্ক, গালিচা বুনন, কাঠের কাজ ও কাঁচের কাজের জন্য অত্যন্ত বিখ্যাত ছিলো। খনি থেকে যে ‘ফিরোজা’ উত্তোলন করা হতো, তা ছিলো অত্যন্ত উন্নতমানের। শহরটিতে একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ছিলো বলে সহজেই এটি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছিলো।
নিশাপুর শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো। এই শহর জন্ম দিয়েছে বহু বিখ্যাত দার্শনিক, গণিতবিদ ও কবিকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ওমর খৈয়াম এবং ফরিদ-উদ-দীন আত্তার।
ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিখ্যাত গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং লেখক। তিনি এই শহরেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার ‘রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম’ গ্রন্থটি বিশ্বের সবার মন জয় করেছিলো।
আর ফরিদ-উদ-দীন আত্তার ছিলেন একজন সূফি মরমী কবি ও দার্শনিক। পার্সিয়াতে তার ব্যাপক প্রভাব সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। তার বিখ্যাত কাজ ‘কনফারেন্স অফ দ্য বার্ডস’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।
আউয়াধের রাজা সম্পর্কে তো আমরা সবাই-ই কম-বেশি জানি, যিনি ভারতবর্ষকে আলু-বিরিয়ানি উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা এটা জানি না যে, তিনি নিশাপুর থেকেই ১৮১৯ সালে ভারতবর্ষে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন।
মুঘল সম্রাট হুমায়ুন শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে ইরানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তার স্ত্রীর সাথে সাফাবিদ রাজবংশের আত্মীয়তা ছিলো এবং হুমায়ূন যাতে ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যকে পুনঃরুদ্ধার করতে পারেন, সে ক্ষেত্রে সাফাবিদরা যথেষ্ট পরিমাণে সাহায্য করেছিলেন। স্থানীয় আউয়াধি এবং পার্সিয়ান ভাষার সংমিশ্রণেই পরবর্তীতে উর্দু ভাষার জন্ম হয়েছিলো।
দাবার উৎপত্তিস্থল নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। কবি ফেরদৌসি বলেছেন, দাবা ভারতবর্ষে থেকে এসেছে। কিন্তু একটি মজার ঘটনা হলো, দাবার উৎপত্তিস্থল হিসেবে ভারতবর্ষকে দাবি করা হলেও প্রাচীনতম একটি দাবার বোর্ড নিশাপুরেই খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো এবং তা এখন নিশাপুরের মেট্রোপলিটন জাদুঘরে রয়েছে।
নিশাপুর ১২২১ সালে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলো এবং এই বির্পযয় ডেকে এনেছিলেন চেঙ্গিস খান। নিশাপুরে চেঙ্গিস খানের প্রিয় জামাতাকে হত্যা করা হয়। এর ফলে চেঙ্গিস খানের ছেলে টলুই রাগ ও হিংসার বশবর্তী হয়ে শহরটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেন। এই ঘটনার পর নিশাপুর আর কোনো দিন তার পূর্বের গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারে নি। অনেকে বলেন, বিখ্যাত কবি ফরিদ-উদ-দীন আত্তারও চেঙ্গিস খানের সেই হত্যাযজ্ঞের একজন ভুক্তভোগী ছিলেন।
রেফারেন্স:
Nishapur, One of the greatest Medieval cities on the Silk Road