ঊনিশ শতকে বাংলার সমাজজীবনের চিত্র যেসব সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল দীনবন্ধু মিত্রের লেখা নাটক ‘নীলদর্পণ’ । নীল চাষিদের ওপর নীলকর সাহেবদের শোষণ, অত্যাচারের বিরুদ্ধে দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন । এটি বাংলার প্রথম বাংলা ভাষায় নাটক যা ইংরেজি ভাষায় অনূবাদ হয় এবং এই ইংরেজি অনুবাদ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বইটি পাদ্রী রেভারেন্ড জেমস লঙের নামে প্রকাশিত হয়। স্বার্থবিরোধী হওয়ায় লঙ সাহেবের নামে নীলকররা মামলা করে । মামলায় তার এক মাস কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয় ।
বড় মুখ করে পরিচয় দেয়ার মতো কিছু ছিলোনা দীনবন্ধুর,তিনি ছিলেন নিতান্ত দরিদ্র ঘরের সন্তান।
কলকাতার বিদ্বজ্জনমন্ডলীতে বা অভিজাত সমাজে মেশার কোন সুযোগও পাননি।
নদীয়ার এক গ্রামের পাঠশালায় পড়তেন, একটু বড় হলে বাবা তাকে জমিদারের সেরেস্তায় খাতা দেখার কাজে লাগিয়ে দেন। কিশোর দীনবন্ধুর সে কাজে মন বসেনি, বাবার আদেশ অমান্য করে গোপনে কলকাতায় পালিয়ে আসেন। এক বৃহত্তর জগৎ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো।
সহায় সম্বল ছাড়া এক কিশোরের জন্য কলকাতায় থাকা সহজ নয়। শিমুলিয়াতে এক পিতৃব্যের বাড়ি খুঁজে বের করলেন, আপাতত আশ্রয় মিললো, তার বিনিময়ে তার উপর রান্নার ভার চাপিয়ে দেয়া হলো। সারাক্ষন তিনি মনখারাপ করে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন, আর স্কুল কলেজগুলির সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
পাদ্রী লঙ সাহেবের একটা অবৈতনিক স্কুল ছিলো। দীনবন্ধু একদিন সেখানে ঢুকে পড়লেন।লঙ সাহেব তার পরীক্ষা নিয়ে বললেন, কিছুদিন দেখবো যদি লেখাপড়ায় ভালো করতে পারো তবেই তোমাকে সুযোগ দিবো, নাহলে নয়।
এখানে তিনি প্রতিটি পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়েছেন এবং সেই টাকায় বই- খাতা কেনা হতো। দীনবন্ধুর নাম আসল নাম ছিলো গন্ধর্বনারায়ন, সবাই গন্ধা বলে ডাকতো যেটা তিনি মোটেও পছন্দ করতেন না। স্কুলে পড়ার সময় তিনি নামটা বদলে নেন।
লঙ সাহেবের স্কুল ছেড়ে কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল, তারপর হিন্দু স্কুল। ভালো রেজাল্ট করলে লঙ সাহেবই তাকে বই- খাতা কিনে দেন। কিন্তু সহপাঠীদের তুলনায় তার বয়স একটু বেশি হওয়ায় হিন্দু স্কুলে তার পড়া হয়না। যে বয়সে অন্য ছেলেরা চাকরিতে যায়, সেই বয়সে তিনি স্কুলের ছাত্র। তাই শেষ পরীক্ষা দেওয়ার আগেই তিনি ডাক বিভাগে চাকরি নেন।
কিছুদিন পাটনায় পোষ্টমাষ্টারী করার পর উড়িষ্যায় বদলি হলেন, সেখান থেকে আবার নদীয়ায়। এরমধ্যে বিয়েটাও সেরে ফেলেছেন।
একদিন তিনি বাংলার সাহিত্যাকাশে উল্কার মতো আসা মাইকেল মধুসূদনের সাথে দেখা করতে এলেন। তিনি মধুসূদনের রচনাবলীর প্রসাংসার পরে বললেন, একটি উদ্দেশ্য নিয়ে আমি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি, যদি শুনেন তবে বলি।
মধুসুদন বললেন, আপনার নিবেদনটা কি?
দীনবন্ধু বললেন, আপনি মদ্যপানের কুপ্রথা, গ্রাম্য জমিদারদের ব্যভিচার নিয়ে স্যাটায়ার লিখে সমাজের অনেক উপকার করেছেন, এবার রায়তদের নিয়ে লিখুন।
আপনি যদি গ্রামের রায়তদের নিয়ে নিয়ে লেখেন তবে সবাই জানবে।
আপনার প্রহসন দুটি ‘ বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ আর ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ আমি পড়েছি, এক কথায় অনবদ্য।আমি নদীয়া যশোরে ঘুরে দেখেছি, সেখানে নীল চাষীদের উপর কি অন্যায়ভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে। আপনার প্রহসন দুটি পড়ার পর আমার মনে হচ্ছে, এইসব হতভাগ্য চাষীদের নিয়ে যদি আপনি একটা নাটক রচনা করেন, তবে দেশের সব মানুষ জানবে। আপনার দুর্দান্ত লেখনীতে এইসব চিত্র ফুটিয়ে তুলুন। আপনি ছাড়া আর কেউ পারবেনা।
মধুসূদন বললেন, তিনি পোয়েট্রি ছাড়া আর কিছু লিখবেন না।
তখন দীনবন্ধু বললেন, পোয়ট্রি তো আপনি লিখবেন কিন্তু এখন নাটকের প্রয়োজন।প্রহসন দুটি লিখে আপনি যে রকম কষাঘাত করেছেন, এখন নীলচাষীদের দুঃখ নিয়ে এমন কিছু লিখুন, যা পড়ে তাদের দুঃখে সবাই কাঁদবে।
আপনি হয়তো জানেন— নীলচাষের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য সরকার থেকে এক কমিশন বসানো হয়েছে। সীটনকার সাহেব তার সভাপতি, শোনা যায় সীটনকার সাহেব চাষীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। লেফটেনান্ট গভর্নর গ্রান্ট সাহেব গোঁড়ার দিকে চাষীদের দিকে ছিলেন কিন্তু আবার বেঁকে বসেছেন।কেউ যদি চাষীদের সাহায্য করতে যায় তবে তাদের ফাটকে পোরার জন্য ১১ আইন চালু করেছে। আমাদের উচিত ইন্ডিগো কমিশনের কাছে প্রকৃত তথ্যগুলি তুলে ধরা, যদি ঐ আইন পাল্টানো যায়!
মধুসূদন বললেন, এগুলি তো ভালো কথা, তবে আমার সাথে কি সম্পর্ক ?
আপনি নীলচাষীদের নিয়ে একটা নাটক রচনা করুন, আপনি ছাড়া আর কেউ পারবেনা।
আমার এখন গদ্য রচনায় মন নেই, শুধু কাব্য লিখবো। রামায়নের মেঘনাদকে নিয়ে একটা কাব্য শুরু করছি।রাম আর তার দলবল যেমন অসভ্যের মতো অন্যায় যুদ্ধে মেঘনাদকে মেরেছে, আমি আমার কাব্যে তার শোধ তুলবো!
আপনি আর নাটক লিখবেননা?
রাজনারায়ন বসু দীনবন্ধুকে বললেন, আপনি তো ভারি অদ্ভুত লোক মশায়, মধু লিখবেনা শুনে আপনার মুখ শুকিয়ে গেলো? আপনি নিজেই লিখুন না! আপনার তো নীলচাষীদের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে
দীনবন্ধু বললেন, হায়, আমি লিখবো! আমার কি সে ক্ষমতা আছে, কয়েক লাইন পদ্য ছাড়া আমার হাত দিয়ে আর কিছুই বেরোয়নি।
মধুসূদন উঠে দীনবন্ধুর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, নীলচাষীদের অবস্থা দেখে আপনার মনে হয়েছে এই বিষয়টি নাটক লেখার যোগ্য —- এই মনে হওয়াটাই ইন্সপিরেশান। বড় বড় লেখকরা ইন্সপিরেশান দিয়েই চলে, আর দ্বিধা না করে কাগজ কলম নিয়ে বসে যান।
মধুসূদনের স্পর্শে রোমাঞ্চিত হলেন দীনবন্ধু, মধুসূদনের শেষ কথাগুলি মাথায় ঘুরতে লাগলো।
দীনবন্ধু তিন সপ্তাহের মধ্যে নাটক লেখা শেষ করলেন।নাম আগেই ঠিক করেছিলেন ‘নীলদর্পন’। সৃষ্টির একটা আনন্দ আছে, কিন্তু বুকের ভিতর দুম দুম শব্দ হচ্ছে। এই নাটক প্রকাশিত হলে রাজরোষে পড়ার সম্ভাবনা আছে। চাকরিও চলে যেতে পারে, কিন্তু এখন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই।
দীনবন্ধু ঢাকায় এলেন বইটি ছাপানোর জন্য, রাম ভৌমিক নামের এক ব্যক্তি নীলদর্পন ছাপিয়ে দিলেন। সেখানে নাট্যকারের কোন নাম রইলোনা। কশ্চিৎ পথিকস্য এই নামে একটা ভূমিকা জুড়ে দিলেন দীনবন্ধু। তারপর নাটকের কয়েক কপি নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন।
দীনবন্ধুর প্রথমেই মনে হলো নাটকটি লঙ সাহেবকে পড়ানো দরকার, কারন লঙ সাহেব তাকে সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন।
পাদ্রী লঙ সাহেব পেশায় সরকারী অনুবাদক। দেশীয় ভাষার রচনার সারমর্ম তিনি ইংরেজীতে অনুবাদ করে সরকারের গোচরে আনেন। আসলে দেশি ভাষায় রাজদ্রোহমূলক কোনকিছু লেখা হচ্ছে কিনা সেটা জানাই সরকারের উদ্দেশ্য।
লঙ সাহেব এ দেশের মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছেন।নিজ উদ্দ্যেগে চাষীদের দুরবস্থা সম্পর্কে তদন্ত করেছেন।
দীনবন্ধুর লেখা পড়তে পড়তে তিনি উত্তেজিত, ক্রুদ্ধ ও কাতর হয়ে বললেন, এগুলি কি সত্যি? গ্রামে চাষীদের সাথে এমন অত্যাচার হয়? তুমি নিজের চোখে দেখেছো?
দীনবন্ধু বললেন, কিছু নিজের চোখে দেখা, কিছু বিশ্বস্ত মানুষের মুখে শোনা।
লঙ বললেন, তুমি অবিলম্বে এই বইটি ইংরেজীতে অনুবাদ করাও, এমন চলতি গ্রাম্যভাষা আমি ইংরেজী করতে পারবোনা। সেই বই আমি ছাপাবার ব্যাবস্থা করবো। তারপর সেই বই আমি ইন্ডিগো কমিশনে পেশ করবো।
নীলদর্পনের ইংরেজী অনুবাদের জন্য সবদিক দিয়ে যোগ্য মধুসূদন। তিনি শর্মিষ্ঠা আর পদ্মাবতীর ইংরেজী অনুবাদে নাটক লিখেছেন, কাজেই তার অভিজ্ঞতা আছে।
দীনবন্ধু গিয়ে ধরলেন তাকে, সবার অনুরোধ তিনি ঠেলতে পারলেন না। বললেন, অনুবাদ করে দেবেন বটে তবে তার নাম যেন কিছুতেই না আসে, কারন তিনি সরকারী আদালতে চাকরি করেন।
লঙ সাহেবের পরামর্শে দীনবন্ধু কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় নিরীহভাবে চাকরি করতে লাগলেন।মধুসূদনকে ঝামাপুকুরে এক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি বললেন, এক রাতেই তিনি অনুবাদ শেষ করে দিবেন। তবে, তার বারো বোতল বিয়ার লাগবে আর গঙ্গানারায়নকে সেই চলতি গ্রাম্যভাষায় লেখা প্রতিটি লাইনের সঠিক অর্থ বুঝিয়ে দিতে হবে।
সন্ধ্যাবেলায় কাজ শুরু হলো। মধুসূদনের একহাতে বিয়ারের বোতল আর অন্য হাতে লেখনী। গঙ্গানারায়ন পড়ে পড়ে বুঝিয়ে দেন আর তিনি গড়গড়িয়ে লিখে যান।
মধ্যরাত্রি পেরোবার পর মধুসূদনের নেশাও চুড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছেচে… চোখ ঢুলে আসে, হাত থেকে কলম খসে পড়ে। গঙ্গানারায়ন বলে- এখন থাক, বাকিটা কাল হবে।
মধুসূদন আবার কলম তুলে নিয়ে একঢোক বিয়ার খেয়ে বলেন, ‘নো-ও-ও। আই মাষ্ট ফিনিস দিস ড্যাম থিং টু নাইট’। তিনি লিখতে লিখতে ক্রমাগত পোষ্টমাষ্টারবাবুটির ( দীনবন্ধু) লেখার প্রশাংসা করতে থাকেন…ড্যাম গুড, ভেরি রিয়েলিষ্টিক।
পঞ্চম অংকে এসে মধুসূদন বললেন, একিরে বাপু, সব্বাইকে মেরে ফেলছে যে! এ যে বাবা হ্যালমেটকেও ছাড়িয়ে গেলো।
পোষ্টমাষ্টারবাবুটি প্রথম নাটক লিখেই শেক্সপিয়র! হা- হা- হা-হা !
নাটকের শেষ বাক্যটি লেখার পর মধুসূদন নেশার ঘোরে জ্ঞান হারিয়ে সেই টেবিলের উপরই শুয়ে পড়লেন।
অনুবাদ শেষ হলো।
তথ্য—সেই সময়
লেখক—- সুনিল গঙ্গাপাধ্যায়